জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প— ২৪৬/ক্যাঙারু কেন লাফিয়েই চলে/অস্ট্রেলিয়া /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোক গল্প— ২৪৬

ক্যাঙারু কেন লাফিয়েই চলে

অস্ট্রেলিয়া

চিন্ময় দাশ


মা-ক্যাঙারু আর তার একটা বাচ্চাকে নিয়ে সংসার। বাচ্চাটার নাম—কিপ। কিপ যেমন আমুদে, তেমনি মিশুকেও। আশপাশের সকলের সাথেই তার আলাপ। সকলের সাথেই পরিচয়।

একবার বাচ্চাটার মাথায় ঢুকল— বনের মধ্যে আর সবাইকে তো দেখি, স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করে। তাহলে, কেবল আমরা ক্যাঙারুরা কেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলি? 

অনেক ভেবেও, যুৎসই কোন কারণ দেখতে পেল না। চুলকে চুলকে মাথার লোম উঠে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু কোনও কারণই খুঁজে পাচ্ছে না। 

অগত্যা মাকে গিয়ে ধরে পড়ল—আচ্ছা, মা। এই বনে তো দেখি, সকলে কেমন বেশ স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে বেড়ায়। শুধু আমরা ক্যাঙারুরাই কেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলি? আর তো কেউ এভাবে লাফায় না! আর, এদিকে আমরা হাঁটতে পারি না, দৌড়তে পারি না। 

মা-ক্যাঙারু তো পড়ল আকাশ থেকে। প্রথমে খেই ধরতে পারল না কথাটার। বলল—কী বলছিস তুই? কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। 

কিপ বলল—বলব আবার কী? সবাই কেমন সুন্দর হেঁটে চলে বেড়ায়। সাপের কথাই ধরো না। কী সুন্দর পেটে ভর দিয়ে পিছলে পিছলে যায়। চলেও নিজের খেয়াল খুশি মতো। ইচ্ছে হোল তো দৌড়ল। মন চাইল তো চলল ধীরে সুস্থে গড়িয়ে গড়িয়ে। আমরাই কেন শুধু লাফিয়ে চলি?

ক্যাঙারুদের লেজ বেশ লম্বা। কথা বলছে আর লাল মাটিতে সেই লেজখানা আছড়াচ্ছে বাচ্চাটা। 

এমন বেমক্কা প্রশ্ন মা-ক্যাঙারু জীবনে শোনেনি কখনও। তাও আবার নিজের ছেলের মুখে। কিছুক্ষণ বাচ্চাটার দিকে চেয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। পরে বলল—আমরা লাফিয়ে চলি, কারণ আমরা ক্যাঙারু। ক্যাঙারু কখনও হাঁটে না, ছোটে না। পেটে ভর দিয়ে পিছলেও যায় না। 

জবাবটা মনঃপুত হোল না। এক লাফে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল কিপ—মা, আমি একটু ঘুরে আসছি। বন্ধুদের সাথে একটু দেখা করি গিয়ে। 

ছেলে বেরিয়ে গেল। মা-ক্যাঙারুও ব্যস্ত হয়ে পড়ল সংসারের কাজে। 

কিপ গিয়ে হাজির হয়েছে একটা জলাশয়ের পাশে। সেই কোন অতীত কালে একটা নদী বয়ে যেত এদিক দিয়ে। বহুকাল হোল এক সময় সে নদী ভিন্ন পথে সরে গিয়েছে। এখানে ওখানে বড় বড় জলাশয় রেখে গিয়েছে নদীটা। তেমনই একটা জলাশয়ের কাছে এসে হাজির হয়েছে বাচ্চা ক্যাঙারুটা।

🍂
ad

সেখানে তার এক বন্ধু কিমি নামের কোয়ালার সাথে দেখা। (কোয়ালা হোল অস্ট্রেলিয়ার একজাতের ভালুক।) কিপের মাথায় তো প্রশ্নটা ঘুরছিল। কিপ ভাবল, কিমিকে জিজ্ঞেস করে দেখা যাক। সে কিছু জানে কি না। কিপ বলল—আচ্ছা কিম্মি, তোমরা কি লাফাও?

কিম্মি তখন বসে বসে আরাম করে ইউক্যালিপটাস পাতা চিবাচ্ছিল। সে জবাব দিল—না হে, আমরা লাফাই না। এমনকি, দৌড়াইও না আমরা। আমাকেই দ্যাখো না, গাছে চড়ি আর পাতা খাই চিবিয়ে চিবিয়ে। কিন্তু হঠাৎ আমরা লাফাই কি না, জিজ্ঞেস করছ কেন? 

--না, না তেমন কিছু না। আসলে আমি জানতে চাইছি, আমার বন্ধুদের মধ্যে কে কে লাফিয়ে চলে। ঠিক আছে, বন্ধু। একবার কুমির বন্ধুর কাছে যাই। এখন চলি। পরে দেখা হবে আবার।

কুমির ভয়াণক বিপজ্জনক জীব। সাধারণত কুমিরের কাছে কেউ যায় না। কিপের সে সব আসে না। সে সোজা জলের কিনারায় পৌঁছ দেখল, তার কুমির বন্ধু জলে সাঁতার কাটছে। কিপ চেঁচিয়ে বলল—বলো তো, বন্ধু। সাঁতার তো কাটো। লাফাও কি? 

কিপ কুমিরের বন্ধু। বন্ধুর গলা শুনে, জলের কিনারায় চলে এলো কুমির। বলল—অবশ্যই না। জলে থাকি যখন, আমি সাঁতরাই। কখনও ডাঙায় উঠলে, আমি হাঁটিও। কিন্তু না আমি দৌড়াই, না লাফাই। 

--কেন? লাফাও না কেন? কিপ প্রশ্ন করল।

--লাফানোর দরকারটা কি আমার? আমি কুমির। জলের জীব। জলেই থাকি। সাঁতরাই আর মাছ খাই। লাফাবার আমার দরকারটা কি, বন্ধু? 

কিপ আর কথা বাড়াল না। বলল—চলি বন্ধু। ড্যানির সাথে একবার দেখা করতে হবে। আজ চলি। পরে দেখা হবে আবার। 

বলতে বলতেই চলে গেল কিপ। কুমিরও চলে গেল গভীর জলের দিকে।

অস্ট্রেলিয়ায় ডিঙ্গো নামে এক জাতের কুকুর আছে। আকারে বেশ বড়। দেখতে অনেকটা শেয়ালের মতো। ড্যানি হল তাদেরই একজন। তার সাথেই কিপের বন্ধুত্ব। কিপ যখন ড্যানির কাছে পৌঁছল, সে তখন জল খেয়ে ঘরে ফিরছে।

কিপ হাঁক পেড়ে বলল—ড্যানি, একটা কথা জানবার ছিল তোমার কাছে। 

ড্যানি মাথা নেড়ে বলল—কী কথা, হে? বলো, শুনি।

--তুমি কি লাফাও?

যাচ্ছিল জল খাওয়ার জন্য। আচমকা এমন একটা বেমক্কা প্রশ্ন শুনে থমকে গেল। কিছু মাথায় ঢুকল না ড্যানির।

একটু বাদে ঘেউ ঘেউ করে উঠল—না, লাফাই না। তুমি জানো না, আমি দৌড়ই? হাঁটিও। এমনকি, দরকার পড়লে, এই জলাশয়টায় সাঁতরাতেও পারব অনেক ক্ষণ ধরে। তবে উড়তে পারি না। লাফাতেও পারি না। 

একজনও বলল না তারা লাফাতে পারে, বা তারাও লাফায়। মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে কিপের। তার মনে বেশ আশা জেগেছিল, ড্যানি নিশ্চয় লাফায়। কিন্তু তার কথা শুনে খুব হতাশ হয়ে পড়ল। বলল—কেন বন্ধু, লাফাও না কেন?

ড্যানি বলল—কেন আবার? দরকার পড়ে না বলে। শুধুমুদু লাফাতে যাবই বা কেন?। চলি ভাই, আমার তাড়া আছে। অনেক ক্ষণ হোল বেরিয়েছি। দেরি হলে, মা আবার ভাবনা করবে। 

ড্যানিকে বিদায় জানিয়ে, এগোতে লাগল কিপ। জলের একেবারে কিনারা ধরে চলেছে। কিপের ছায়া পড়েছে জলে। সেদিকে অনেক সময় ধরে তাকিয়ে থাকল। কিপের মনে কিন্তু একটাই ভাবনা, আমার একজন বন্ধুও লাফায় না। কারণটা কী?

এমন সময় একটা পাখির সুরেলা ডাক কানে এলো। এদিক ওদিক চেয়ে দেখল, গাছের ডালে বসে নিজের মনে ডেকে চলেছে একটা কুকাবুরা—ক্ররররকাকাকাকুকুকু…

কুকাবুরা অস্ট্রেলিয়ায় বেশ পরিচিত পাখি। পাখনার রঙ নীল। দেখতে ভারি সুন্দর। লম্বাটে ঠোঁট। মাথা উঁচিয়ে লম্বা করে ডাক পাড়ে। যদি উড়ে যায় পাখিটা! তাড়াতাড়ি গাছের তলায় গিয়ে হাজির কিপ। ঘাড় উঁচিয়ে জানতে চাইল—আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম। 

ডাক বন্ধ করে পাখিটা মাথা নামিয়ে দেখল কিপকে। বলল—পাচ্ছি শুনতে। বলো, কী জানতে চাও। 

কিপ বলল—বেশ তো উড়ে বেড়াও। ডাকটিও বেশ সুন্দর তোমার। তুমি কি লাফাতে পারো?

কুকাবুরা তো হেসেই অস্থির। এদিক ওদিক মাথা দুলিয়ে বলল—অবশ্যই না। আমি উড়তে পারি, আর গান গাইতে পারি। লাফানো ঝাঁপানোর মধ্যে আমি নাই। তাছাড়া, লাফানোর আমার দরকারটাই বা কী?

কিপ কিছু বলতে যাচ্ছিল। পাখিটা বলল—একটা কথা বলি তোমাকে। খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, তোমরা ক্যাঙারুরা ছাড়া, দুনিয়ার আর কেউ এমন বেখাপ্পা ভাবে লাফিয়ে বেড়ায় না।

কথা শেষ করেই উড়ে গেল কাকাবুরা। বলা যায় না, আবার কোনও বেখাপ্পা কিছু প্রশ্ন করে বসবে। আগেভাগে সরে পড়ল তাই। 

কিন্তু পাখির শেষ কথাটা গিয়ে বেশ গেঁথে গেছে কিপের মাথায়। চিড়িক করে উঠল মনে। সত্যিই তো। আমরা ক্যাঙারুরা ছাড়া, দুনিয়ার আর কেউ তো লাফায় না। আসলে, লাফাতে পারেই না আর কেউ। হেঁটে বেড়াও, ছুটে বেড়াও, দৌড়ে বেড়াও, এমনকি উড়েও বেড়াও আকাশে ডানা মেলে। কিন্তু লাফাতে পারো না তোমরা কেউ। লাফানো এতো সোজা কাজ নয়, বুঝলে। নিজে নিজেই সব বন্ধুদের সাথে কথা বলে যাচ্ছে বাচ্চাটা।

এইভাবে বকর বকর করতে করতে সোজা মায়ের কাছে বাড়িতেই ফিরে এসেছে কিপ। এবার মাকেই বলতে লাগল—বুঝলে মা। সব বন্ধুদের সাথে কথা বললাম। তারা কেউই লাফাতে পারে না। কেবল আমরা ক্যাঙারুরাই একমাত্র লাফাতে পারি। আর কেউ না। কেউই না।

মা-ক্যাঙারুর মুখে হাসি। মনে মনে বেশ নিশ্চিন্ত হোল। যাক বাবা, একটা ভূত নেমেছে ছেলের মাথা থেকে। কিপকে বলল—তাহলে দেখলে, দুনিয়ার সব কাজ সবাই পারে না। বিধাতা ঠাকুর যাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন, সেটার জন্য তার মন খারাপ করতে নাই। বরং গর্ব করতে পারো এ জন্য। আচ্ছা সোনা। এখন তুমি একটু লাফিয়ে দেখাও তো দেখি। কেমন লাফাতে পেরেছ। 

মায়ের কথায় ভারি উৎসাহ পেয়ে গেল কিপ। --দেখো তাহলে। বলেই, লম্বা একখানা লাফ। একেবারে বাইরে গিয়ে পড়ল। তারপরও লাফাতেই লাগল। থামল না। 

কিপের দিকে চেয়ে, মা হেসে বল—পাগল ছেলে একটা আমার।

  • (আমরা অনেকেই ক্যাঙারু কিংবা ক্যাঙারুর ছবি দেখেছি। এই জীবটির চারটে পা। কিন্তু পাগুলোর গড়ন ভারি অদ্ভূত। সামনের দুটো যে তাদের হাত না কি পা, বোঝা দুরুহ। এই ছোট্ট ছোট্ট একটুকুনি। চলাফেরা করবার সময় কোন কাজেই লাগে না। আর পেছনের দু’খানা এই এত্তোখানি লম্বা। তার চেয়েও বেশি লম্বা তাদের লেজখানা। পায়ের পাতা দুটোও বেশ বড়। চলাফেরা করবার সময় ছাড়া, পাতা দুটোর ওপর বসে থাকে যখন, লেজের ওপরেই ঠেস দিয়ে রাখে। ক্যাঙারুদের চলাফেরা বলতে, পেছনের দুটো পায়ে লাফানো। লাফিয়ে লাফিয়েই চলে তারা।)


Post a Comment

0 Comments