নারীর প্রান্তিকতার এক ভিন্নতর আখ্যান
বর্ণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
সারাংশ: বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম নারীবাদী লেখক হলেন তারশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর লেখনিতে আমরা মূলত গ্রাম বাংলার প্রান্তিক নারীর জীবন কাহিনীর পরিচয় পাই। একজন পুরুষ লেখক হয়েও সাবলীল ভাবে তিনি তাঁর নারী চরিত্রগুলিকে অঙ্কণ করেছেন। এমন দুই অসাধারণ নারী চরিত্র আমরা দেখতে পাই তারশঙ্করের রচিত দুটি অন্যবদ্য ছোটগল্প ডাইনি ও বেদিনীতে। ডাইনির সুরধনী ও বেদিনীর রাধিকা নারী চরিত্রের এক ভিন্নরূপ আমাদের সামনে তুলে ধরে। এই দুই চরিত্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নগ্ন রূপ যেমন দর্শায়, এক সাথেই তাদের চরিত্রের ভিন্নতা ও দৃঢ়তার সাথে আমাদের পরিচয় করায়। পুরুষের লেখনিতে নারীর এই ভিন্নতর আখ্যান অব্যশই নারীবাদী আলোচনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যা অবশ্যই হয়ে উঠতে পারে নারীবাদী পাঠের এক বিকল্প পথ।
সূচকশব্দঃ নারীবাদ, পুরুষ লেখক, বাংলা সাহিত্য, প্রান্তিক, তারশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়.।
বাংলা সাহিত্যের নারীবাদী আলোচনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূলত নারী লেখকদের লেখনীর প্রসঙ্গ উঠে আসে। কিন্তু এখানে আমরা বেশ কয়েকজন পুরুষ লেখকের নাম উল্লেখ করতে পারি, যাদের রচনায় বার বার নারীর কথা উঠে আসে। এমনই একজন লেখক হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যে নারীবাদী চর্চা যাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। এই আলোচনা প্রসঙ্গ মূলত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত দুটি ছোট গল্প ডাইনি ও বেদিনী সম্পর্কে। তারাশঙ্কর তাঁর লেখনিতে মূলত গ্রাম বাংলার পল্লীজীবনের রূপ বর্ণনা করেছেন। সমাজতাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় তাঁর লেখনী ভীষণভাবে সামাজিক যা সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবন যাপনের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। তিনি তাঁর লেখায় নারীকে এক সামাজিক বর্গ রূপে দেখেছেন। তিনি গ্রাম বাংলার প্রান্তিক নারীর কথা বলেছেন। ডাইনি গল্পে এমনই এক নারী, সুরধনী বা সরা কিভাবে মানুষের চোখে রক্ত পিপাসী ডাইনি হয়ে ওঠে তারই চিত্র বর্ণনা করেছেন। অনাথ বালিকা সরার পরিচয় সমাজের কাছে ঢাকা পড়ে যায় ডাইনি উপাধির আড়ালে। গ্রামের মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের জালে সাধারণ রক্ত মাংসের নারী হয়েও নিজেই নিজেকে সে ডাইনি ভাবতে শুরু করে। ডাইনির মনোজগতের বর্ণনায় তাই ফুটে ওঠে এক সর্বগ্রাসী লোলুপ সাপের জিহ্বা যা সাপের ফণার মত তুলে নেচে ওঠে। বৃদ্ধ ডাইনি ক্রোধে সাপিনীর মত ফুলে ওঠে আবার ক্রুদ্ধ অজগরীর মত ফোঁসফোঁসও করে। তাঁর দৃষ্টির সর্বনাশী তীক্ষ্ণতার পাশাপাশি এক মর্মান্তিক আক্ষেপ, তার চরিত্রের প্রতিরোধ, সমাজের প্রতি তার বিদ্বেষকে তুলে ধরে। সেই দৃষ্টি দিয়ে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে চায় সে। আবার চরম আকুলতায় দেবীর কাছে নিজের বুকের রক্ত অর্পণ করে পুজো দিয়ে সাধারণ নারী হয়ে ওঠার কামনা করে। প্রতিনিয়ত তাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া অমঙ্গল ঘটনা, সমাজের প্রত্যাখ্যান তাকেও ভাবতে শেখায় সে ডাইনি। ভয় ও একাকীত্ব থেকে সঞ্চারিত হয়েছে তার মধ্যে ক্রূরতা, যা হয়ে উঠেছে তার একমাত্র প্রতিবাদের হাতিয়ার। ছাতি ফাটা মাঠের শেষ প্রান্তে কুঁড়ে ঘরে থাকা এক বৃদ্ধ নারীর অন্তরটা হয়ে উঠেছে তৃষ্ণার্ত, তাই মানুষ দেখলেই তার অন্তরাত্মা তার অনিষ্ঠ করতে উদ্যত হয়ে উঠত। আবার তার কঠিন হৃদয়ই স্নেহ মায়া রসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রখর রোদে সন্তান কোলে আসা এক ক্লান্ত অসহায় ক্ষুধার্ত রমণীকে দেখে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সেই রমণীর সন্তানের মঙ্গল কামনায় নিজের দৃষ্টিকে ধিক্কার করে বলে ওঠে,“ছেলেটাকে খেয়ে ফেললাম রে, পালা পালা তুই ছেলে নিয়ে পালা বলছি।” তারপর আবার নিজের পরিচয় নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছে,। কালবৈশাখী ঝড়ের মধ্যে ছাতিফাটা মাঠ পেরতে গিয়ে যেন তারই শোষণে মৃত নিজের স্বামীর জন্যে ডুকরে কেঁদে উঠেছে তার মন। তারপরই হারিয়ে গেছে চিরতরে। তার মৃত্যুও শেষে হল অপঘাতে। অনাথ অভূক্ত সরার সামান্য আম খাওয়ার, গরম মাছ ভাজা খাওয়ার ইচ্ছা বদলে গেছে সর্বনাশী লোলুপতায়, সর্বগ্রাসীতায়, অনিষ্টস্পৃহায়। ঊদ্ধর্তনের অধস্তনের প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা, অলৌকিক বিশ্বাস এবং কুসংস্কার মানুষের জীবনে কত ভয়াবহ রূপে আত্মপ্রকাশ করে ‘ডাইনী’ গল্পের সুরধনির জীবনের শোচনীয় পরিণাম তার এক চরমতম রূপ আমাদের দর্শায়। এইরকম নারী চরিত্র কেবল বাংলা সাহিত্যেই পাওয়া যায় আর তাও এক পুরুষের লেখকের কলমে। যেখানে এক প্রান্তিক নিম্ন বর্গের নারী হয়ে ওঠে এক অমানবিক পৈশাচিক নারী।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ছোট গল্প বেদিনী গল্পের প্রধান চরিত্র এক নারী, রাধিকা। যে তার উদ্যত যৌবনের মদিরার নেশায় পুরুষের বুকে ঝড় তোলে। নেই তার কোন পাপ পুণ্যের বোধ। নারী চরিত্রের এক আদিম বন্য রূপ দর্শায় এই গল্প। অবলীলায় সে পাল্টে ফেলে জীবন সঙ্গীকে। সে কখনো সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে যায় কখনো বা হিংস্র সাপিনীর মত শনশন করে চলে। অতীতের পিছুটান কাটিয়ে শুধুই এগিয়ে যায় আপন যৌবনের মদিরায় চুর হয়ে। কখনো বা অপমানে দীর্ণ হয়ে গর্জে উঠে বিষাক্ত নাগিনীর ন্যায় ফণা তোলে। এই গল্প বড় নগ্ন, নির্মম এক বলিষ্ঠ নারী চরিত্রকে দর্শায়। যেখানে নেই কোন সংস্কার, নেই কোন পিছুটান , নেই কোন অতীতের প্রতি মোহটান, নেই কোন ভবিষ্যতের প্রতি মিথ্যা দুরাশা, আছে শুধু উন্মুক্ত জীবনস্রোতের টানে এগিয়ে চলা জলতরঙ্গের ন্যায় যৌবনের মদিরতা। বেদের মেয়ে রাধিকা যেন মদিরার সুমুদ্রে স্নান করে উঠেছে। মাদকতা যেন তার সর্ব অঙ্গ দিয়ে ঝরে পরে। যার হাতছানি কোন পুরুষ অস্বীকার করতে পারেনি, বার বার পুরুষেরা এই মদিরার সমুদ্রে ডুব দিয়েছে। অল্প বয়সে বেদের ঘরের ছেলে শিবপদের সাথে তার বিয়ে হয়ে ছিল। শান্ত স্নিগ্ধ স্বভাবের সেই পুরুষ মানুষটি ছিল তার ক্রীতদাসের মত। কিন্তু শিবপদের এই শান্ত, সংযত রূপ তাকে তুষ্ট করতে পারেনি তাই গ্রামে বাজিগরের খেলা দেখাতে আসা উগ্র, পিঙ্গল বর্ণের বলিষ্ঠ পুরুষ শম্ভু বাজিগরকে দেখে রাধিকার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। নিজের স্বামী, সংসার, সমাজ সব ত্যাগ করে যৌবনের অমোঘ টানে ঘরছাড়া হয়ে নতুন ঘর বাঁধে। সমাজ পরিজনের কাউকে তোয়াক্কা না করে নারীর আপন শর্তে বেঁচে থাকার এক নিদর্শন হল রাধিকা। তাই স্বামীর সঞ্চিত অর্থ নিয়ে সংসার থেকে পালিয়ে সাজিয়ে তোলে নিজের নতুন সংসার। কয়েক বছর তার কেটে যায় শম্ভু বাজিগরের সাথে বাজি দেখিয়ে। কিন্তু বৃদ্ধ শম্ভুর পুরোনো বাজিগরের খেলার তাঁবুর পাশে নতুন তাঁবু নিয়ে খেলা দেখতে আসা সবল, বলিষ্ঠ যুবক কিষ্টো বেদের নাগপাশে রাধিকা আবার নতুন করে ধরা দেয়। শম্ভুর অপমানের, অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রতিহিংসায় ঘুমন্ত বৃদ্ধ বাজিগরের তাঁবুতে কেরোসিন ছিটিয়ে দেশলাই কাঠি দিয়ে আগুন লাগিয়ে অবলীলায় কিষ্টো র হাত ধরে পাড়ি দেয় নতুন জীবন যৌবনের সন্ধানে। পুরোনোকে ত্যাগ করে অনায়াসে বার বার সে গড়ে তোলে নতুন খেলাঘর, যেখানে ফেলে আসা জীবনের প্রতি থাকেনা কোন আফসোস, কোনো অনুশোচনা। এত দৃপ্ত স্বাধীন নারী বোধহয় বাংলা সাহিত্যে খুব কম্ পাওয়া যায়। রাধিকা যখন যে পুরুষের সাথে থেকেছে তখন তাকে সম্পূর্ণ রূপে ভালবেসেছে ,আবার নতুন কাউকে পেয়ে নাগিনীর মত ফোঁস করে পুরোনোকে অবলীলায় ত্যাগ করে নতুন করে ঘর বেঁধেছে। কোন অনুশোচনা, কোন গ্লানি বোধ না করেই জীবনকে নিজের শর্তে বাঁচতে চেয়েছে। তথাকথিত ভদ্র সমাজের বাইরে থাকা এক প্রান্তিক বেদিনী নারীর জীবনের গাঁথা আদর্শ আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে খারাপ হলেও এবং হয়ত কামজ ভোগ তার জীবনে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় বোধ হলেও, সেই প্রয়োজনকে স্বীকার করার মধ্যে তার নেই কোন ভণিতা। আর সেটা করার জন্যেও লাগে নিজের চরিত্রের দৃঢ়তা। এক অশিক্ষিত,সমাজের নিচুতলার মানুষের মধ্যে যা খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। আর এইখানেই এই গল্পের সার্থকতা। বর্তমান সময়ে নারীর ক্ষমতায়নের যুগে দাড়িয়ে বলা যায় আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পূর্বে লেখা এই গল্প নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন, তার স্বাধীনতা, তার প্রতিবাদের চিত্রই ফুটিয়ে তুলেছে।
তারাশঙ্করের এই দুটি গল্প নারীর এক বিচিত্র রূপের সন্ধান দেয় এবং পাঠকের সঙ্গে সমাজের প্রান্তিকতার পরিচয় করায়। তাঁর গল্পে উঠে এসেছে প্রান্ত সমাজের কথা। তাঁর গল্পে গোষ্ঠী জীবন আর ব্যক্তি জীবন কোথাও যেন মিলে মিশে যায়। তাই ডাইনি গল্পের সুরধনী সমাজের কুসংস্কারের বলি হতে হতে নিজেকে সেই কুসংস্কারের ঘেরাটোপে বন্দী করে ফেলে। নিজের আপন পরিচিতিকে ভুলে বিশ্বাস করতে শুরু করে সমাজের দেওয়া মিথ্যে পরিচয়কে, আর সেই পরিচয় বহন করতে করতে তার প্রতিবাদের ভাষা পরিণত হয় প্রতিহিংসায়। বেদেরা মূলত যাযাবর সম্প্রদায়ের হয়, যাদের নিজেদের কোন স্থায়ী ঠিকানা থাকেনা. সাপেদের সাথে সহবাস করতে করতে এরাও সাপের মত কিছুটা শীতল বিষাক্ত হয়ে ওঠে। বেদিনী গল্পের রাধিকার মধ্যে বেদে প্রজাতির সেই চরিত্রকে আরো জোরালো ভাবে দেখতে পাওয়া যায়। আর তার সাথে নিজের চরিত্রের স্বমহিমা তাকে আরো বলিষ্ঠ করে তুলেছে। মনি মুক্তোর মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তারশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক গল্পেরই নারী চরিত্র বিশেষ অলোচনার দাবি রাখলেও এই দুটি গল্পে নারীর প্রান্তিকতা ও তার প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথক পৃথক ভাবে বর্ণিত হয়েছে। সুরধনী সমাজের চাপে নিজের পরিচয়কে ভুলে গিয়ে নিজেকে বারংবার ডাইনি রূপে প্রতিপন্ন করতে চেয়ে পরিশেষে অপঘাতে মৃত্যু বরণ করে হয়ত প্রমাণ করতে চেয়েছে সে ডাইনি নয়। আর অন্যদিকে রাধিকা সমাজ সংসারকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে আপন শর্তে জীবন যাপন করতে চেয়েছে , আর তার জন্যে কোন কিছুর পরোয়া না করে পুরোনো প্রেমিককে মেরে ফেলতেও দ্বিধা বোধ করেনি। এই দুই নারীর সমাজ আলাদা, জীবন যাপন আলাদা কিন্তু তা সত্তেও নিজেদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভাষা দিয়ে কোথাও যেন এরা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, যা অবশ্যই নারীবাদী চর্চার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দেয়।
গ্রন্থপঞ্জীঃ
ভট্টাচার্য জগদীশ (১৯৭১), তারশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প, বেঙ্গল পাবলিশার্স লিমটেড।
সেন রুশতী (২০০৭), মানুষের কথা ফানুসের বয়ান, এবং মুশায়েরা।
হক মাসুদুল (২০১৩), বাংলা সাহিত্যে নারী, নান্দনিক, বাংলাদেশ।
ভট্টাচার্য সুতপা (২০০০), মেয়েলি পাঠ, পুস্তক বিপনি, কলকাতা।
মুখোপাধ্যায় কামদেব (২০১৪), তারাশঙ্করের ছোটগল্পে সমাজতত্ত্ব।
শেখ রাহুল,(২০২৩), ইতিহাস ও সাহিত্য: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ও উপন্যাসে প্রান্তজন, Trisangam International Refereed Jurnal, volume-3, Issue IV, October 2023.
🍂
0 Comments