জ্বলদর্চি

কাঞ্চন /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭৬
কাঞ্চন

ভাস্করব্রত পতি

'ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল, 
ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল। 
চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায়,
বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায়' ---
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ফাল্গুন' কবিতায় উল্লেখ করেছেন কাঞ্চন ফুলের কথা। বাংলার গ্রামের আনাচে কানাচে আজও এই বৃক্ষটির দেখা মেলে। কাঞ্চন ফুলের গাছ ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া থেকে এসেছে বলে অভিমত অনেকের। 

কাঞ্চনকে সংস্কৃতে যুগ্মপত্রক, হিন্দিতে কচনার, সোনা, তামিলে সেগাছ, মারাঠিতে কাঞ্চন, মালয়লামে চোবনসুন্দরী, ওড়িয়াতে বোরোঠা বলে। এছাড়াও কাঞ্চনকে কোবিদার বা কর্বদারও বলে। বৈদিক সুক্তিতে (অথর্ববেদ, বৈদ্যককল্প ১৯৫। ৩।৪১) আছে --
'অমুত্র ভূয়াদধ যদ্যমস্য মৃত্যু মস্মাদ কোবিদারো দেবানাম্।
দ্যুমত্তমা তে তনুত্বং সুপ্রতীকস্য সুনোঃ'।
কান্তপুষ্প, করক, কান্তার, কুদার, বিদল, কাঞ্চনক গণ্ডারি, কুন্দাল, তামপুষ্প, শোণপুষ্পক, কাঞ্চনার, চমরিক, কণকারক, যমলচ্ছদ, কাঞ্চনাল নামেও ডাকা হয়। সুশ্রুতের লেখায় পাই 'কবুদার' নাম। ইংরেজিতে Mountain Ebony, Dwarf White Bauhinia, Yellow Bauhinia, Yellow Orchid Tree, St Thomas Tree, Yellow Bell, White Orchid Tree, Snowy Orchid Tree, Kachnar বলে। 
শুকনো কাঞ্চন ফল

এটি Fabaceae পরিবারের অন্তর্গত। সুইস ফরাসী উদ্ভিদবিদ ভাতৃদ্বয় গ্যাসপার্ড বাউহিন এবং যোহান বাউহিনের নামে এই গাছের জেনাসের (গণ) নামকরণ হয়েছে। এই গণের ১৯৩ টি প্রজাতির খোঁজ মিলেছে। কাঞ্চনের কয়েকটি প্রজাতির বিজ্ঞানসম্মত নাম হল --
Bauhinia recemosa
Bauhinia variegata 
Bauhinia purpurea 
Bauhinia blakeana 
Bauhinia acuminata
Bauhinia tomentosa
সবুজ বর্ণের কাঁচা কাঞ্চন ফল গাছে ঝুলছে

কাঞ্চনগাছ জন্মায় পাহাড় এবং সমতল দু যায়গাতেই। পশ্চিমবঙ্গের বুকে সাধারণত তিন প্রকারের কাঞ্চনের দেখা মেলে। যথা - 
১) শ্বেত কাঞ্চন :
সাদা বড় বড় ফুল বারমাসই ফোটে। এই সাদা কাঞ্চন ভারতের প্রায় সর্বত্র জন্মায়। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Bauhinia recemosa এবং Bauhinia acuminata। 
২) রক্তকাঞ্চন :
রক্তকাঞ্চনের বিজ্ঞানসম্মত নাম Bauhinia variegata। এটির ফুল হয় ফাল্গুন চৈত্রে, তারপরে ফল হয়। যা পাকে বর্ষাকালে। সংস্কৃতে বলে কাঞ্চনার, কোবিদার। 
৩) দেবকাঞ্চন :
এই ফুল ফোটে শীতকালে। এর রং কোনওটা ফিকে, বেগুনি অথবা লাল আভাযুক্ত হয় (পাটলবর্ণ। একেই আমরা দেবকাঞ্চন ব'লে থাকি। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Bauhinia purpuria। 
'কর্বদার' এর অর্থ পীতপুষ্প কাঞ্চন। এর আর একটি নাম গিরিজ। আর 'কোবিদার' হল Bauhinia tomentosa। এটি শীতকালীন ফুল। 
কুঁড়ি সহ কাঞ্চন ফুল

তবে সবচেয়ে  জনপ্রিয় এবং পরিচিত প্রজাতির কাঞ্চন হল শ্বেতকাঞ্চন। এটি প্রায় ৩ মিটার উচ্চতার হয়। পত্রমোচী গাছ। পাতাগুলো দ্বিধাবিভক্ত এবং ১০ - ১৫ সেমি দীর্ঘ ও ৭ - ১২ সেমি প্রস্থ। পাতাগুলো বেশ মসৃণ, নিচের শিরায় সামান্য রোম লক্ষ্য করা যায়। বৈশাখের শেষ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত ফুল ফোটে। পাতার কক্ষের একটি থোকায় একসাথে অনেকগুলি করে ফোটে। সাদা রঙের ফুলগুলি সম্পূর্ণ গন্ধহীন। পাঁচটি মুক্ত পাঁপড়ি থাকে। বীজ থাকে শুঁটির মধ্যে। সেগুলি শিমের মতো চ্যাপ্টা, বিদারী এবং পেকে গেলে ধূসর বর্ণের হয়। অনেক শুঁটি হয়। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি বীজ দেখা যায়। 
দ্বিধাবিভক্ত কাঞ্চন পাতা

কাঞ্চনের বেশ কিছু প্রজাতির জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছেন প্যালিওবোটানিষ্টরা। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য --
Bauhinia cheniae 
Bauhinia cretacea 
Bauhinia fotana 
Bauhinia gigantea 
Bauhinia gracilis 
Bauhinia larsenii 
Bauhinia ningmingensis  
Bauhinia potosiana 
Bauhinia tibetensis 
Bauhinia thonningii 
Bauhinia ungulatoides 
Bauhinia wenshanensis 
Bauhinia wyomingiana 
ধূসর রঙের শুকনো কাঞ্চন ফল গাছে ঝুলছে

হংকংয়ের পতাকায় থাকে কাঞ্চন ফুলের ছবি। এছাড়াও হংকং এয়ারলাইন্স (পূর্বের সি আর এয়ারওয়েজ) এই বাহুইনিয়ার ছবি ব্যবহার করে থাকে। কাঞ্চনের প্রধান কাজ হ'লো রক্তবহ স্রোতের বিশুদ্ধিকরণ। এছাড়াও দাহ রোগ, মূত্র কৃচ্ছ, রক্ত পিত্ত, রক্ত আমাশা, স্মৃতিশক্তি বিনাশ, অর্শ, খাবারে অরুচি, বাত রক্ত বা কুষ্ঠ, বসন্ত রোগ, পিরিয়ডসের গণ্ডগোল, মাথা ধরা ইত্যাদি রোগের উপশমকারী এই কাঞ্চন গাছের বিভিন্ন অংশ।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments