জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(দ্বাদশ পর্ব) /মলয় সরকার

কার্তাহেনায় কফির দোকান
মার্কেজের খোঁজে
(দ্বাদশ পর্ব)
মলয় সরকার


বোগোটা আমাদের কাছে নতুন শহর।এখানে কিভাবে বাড়ি চিনতে হয়, (তার নম্বর , নেম প্লেট, রাস্তা ইত্যাদি) কিছুই জানি না। সঙ্গে আছে শুধু বাড়ির নম্বর, একটি কোড নম্বর ও তার পরের নির্দেশিকা। কিভাবে কোড নম্বর কোথায় দেব, কিসের কোড তাও সঠিক জানি না। বিপদ গুণছি মনে মনে।

 ড্রাইভার আমার ভাবসাব ,খুব দেখে শুনে বলল, হ্যাঁ এই রাস্তা, এই বাড়ি এটা নিশ্চিত।আপনি খুলুন দরজা।আমি দাঁড়িয়ে আছি।
 অনেক চেষ্টা করেও পারলাম না। তখন ওই রাতেও ঘাম বেরোচ্ছে- কাকে ডাকব, কোথায় যাব, এই রাত্রে মালপত্র নিয়ে। ড্রাইভার কিন্তু ছেড়ে যায় নি, বলল, বিশ্বাস করে আমাকে কোড নম্বরটা দিন। বিদেশে সেটা উচিত হবে কি না মনের কোণে সেটাও উঁকি দিল। বিশ্বাস করে তো অনেক জায়গায় ঠকেছি।তবু মনে পড়ল ‘বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ , তর্কে বহুদূর’।তাই বাধ্য হয়ে ‘জয় মা’ বলে দিয়েই দিলাম।
 দেখলাম, ও এখানকার এই সমস্ত ব্যাপারগুলোতে অভিজ্ঞ। ও সঙ্গে সঙ্গে লক খুলে দিয়ে বলল, নিন ভিতরে যান। মালপত্র সব তুলে দিলে ঘরের ভিতর। দরজা টেনে দিতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল।চলে গেল ড্রাইভার।রেখে গেল আমার আজীবনের মনের কোণে এক চিরস্থায়ী সোনার রেখা।
কাঠের সিঁড়ির ফাঁকে জর্জ, আমাদের বোগোটার অভ্যর্থনাকারী

আবার অন্তরটা ভরে উঠল কৃতজ্ঞতায়। এই অজানা অচেনা ড্রাইভার এত রাত্রে যেভাবে সাহায্য করল, সে কি ভুলে যাওয়ার! মানুষ হয়ত চলে যায়, হারিয়ে যায় হাজার মানুষের ভিড়ে।কিন্তু এই সমস্ত স্মৃতি; তার তো ক্ষয় নেই।তারা বেঁচে থাকে , চির অবিনশ্বর হয়ে । আর তাই দিয়েই এই পৃথিবীটা আজও সুন্দর হয়। ফুল আজও ফোটে, বাঁশি আজও গান করে ।শত আবিলতার ঘুর্ণি থেকে এরাই পৃথিবীকে সুন্দর করে এক একটি ফুলদানির ফুলের মত সাজিয়ে সুন্দর করে রাখে।পথ চলার পথে এই তো আমার সঞ্চয় । তাই যত্ন করে এগুলোই কুড়িয়ে রাখি মনের মণিকোঠায়।আর এই সমস্ত ছোট ছোট ঘটনাগুলিই মনের কোণে মুক্তো হয়ে জ্বলজ্বল করে।

আমি নির্দেশিকায় দেখলাম লেখা আছে, এর পর সামনেই আর একটা গেট, সেটা চাবী দিয়ে বন্ধ থাকার কথা, চাবী কোথায় থাকবে তা-ও বলা আছে।
কিন্তু আমি দেখি অনেক হাতড়েও, চাবী নেই। ব্যস্‌! সর্বনাশের মাথায় পা! এখন অবস্থা এমন, সামনের দরজা বন্ধ, পিছনের দরজাও বন্ধ, এইটুকু জায়গায় একটা চেয়ার পর্যন্ত নেই। একটা বেশ পুরানো ( ক’শো বছরের কে জানে)ঘরের গলির মধ্যে আমরা দুটি প্রাণী এত রাত্রে আনাদাম্নের কারাগারের মত বন্দী হয়েদাঁড়িয়ে।একেবারে ত্রিশঙ্কু অবস্থা। ভাবছিলাম, এভাবেই দাঁড়িয়ে এখানেই রাত কাটাতে হবে নাকি জলশূন্য খাবার শূন্য অবস্থায়!

বাধ্য হয়ে ওর মালিককে (তাঁর নাম মানু) ফোন করলাম ( সৌভাগ্যক্রমে ফোন বা তার ধারক কেউই বিশ্বাসঘাতকতা করে নি)। তিনি বললেন, যাচ্ছি। মিনিটি দশেক বাদে তাঁর বাইকের আওয়াজ পেলাম। তিনি এসে বাইরে থেকে ঘর খুলে ঢুকে সব দেখে মাথা চুলকে বললেন, আমি তো চাবীটা এখানে রাখতে বলেছিলাম, রাখে নি দেখছি। ঠিক আছে একটু দাঁড়ান, আসছি।
রাত তখন অনেক।শরীর ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। শরীর এলিয়ে পড়ছে।উপায় নেই। দাঁড়িয়েই রইলাম।মনে মনে অনুভব করতে চেষ্টা করছিলাম, যে সমস্ত রাজবন্দীদের উপর অত্যাচার চালানো হয় দেশকে ভালবাসার জন্য, সেগুলো সহ্য করে দেশকে তারপরেও ভালবাসা কত কঠিন। এই ভাবে মৃত্যু বরণ করা কত কঠিন।

আবার দশ মিনিট বাদে তিনি চাবী এনে আমাদের ঘরের ঢোকার ব্যবস্থা করলেন।অনেক দুঃখ প্রকাশ ইত্যাদিও হল। কিন্তু তখন সে সব শোনার বা হৃদয়ঙ্গম করার মত সময় বা মনের অবস্থা কিছুই অবশিষ্ট নেই।
আমাদের কাছে বলা হয়েছিল, বাড়িটার বাইরের ভিউ একেবারে স্বর্গের মত, সামনেই উত্তুঙ্গ পাহাড়ের চূড়া, বাইরে যাবার দরকার নেই, ঘরে বসেই সব দেখা যাবে।ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কি।

 তাঁকে বিদায় দিয়ে বুলবুলকে বললাম , অনেক রাত হয়েছে শুই, পরে সব দেখব।আজ খুব ক্লান্ত।

তখনই শুনলাম, বাড়িটা চার শ’ বছরের পুরানো। এই সব বাড়ি বা শহর, যা স্প্যানিশরা বানিয়েছিল বা ওই সময়ে তৈরী হয়েছিল, সেগুলোর কোন পরিবর্তন হয় নি। বর্তমান মালিকেরাও তাকে কিছুই পরিবর্তন করে নি। সেটা কার্তাহেনাতেও যেমন দেখলাম, এখানেও তেমনই।
এরপর প্রতি পদে পদেই ধাক্কা খেতে থাকলাম এবং মানুর বলা ‘সুন্দর বাড়ি’র সুন্দরের আসল অর্থ (?) হৃদয়ঙ্গম করতে থাকলাম।
 প্রথমেই ধাক্কা হল, সরু ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সমস্ত মালপত্র দোতলায় তুলতে হবে, কারণ দোতলাতেই থাকার জায়গা, বা খাট বিছানা। বাথরুম নীচে, অর্থাৎ প্রতিবারেই বাথরুম যেতে গেলে আমাদের নীচে নামতে হবে ঐ ঘোরানো সরু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। এদিকে রাতে ঘুম চোখে আমাদের দু’ একবার বাথরুম যেতে হয়ই।তখন নামতে গেলে পড়ে যেতেও পারি। গীজার চলে না।স্নানের জায়গা এতটুকু, পাশ ফেরা যায় না।
তাও মেনে নিতাম, কিন্তু গ্যাস জ্বলতে চায় না, গরম জল চা ইত্যাদিও করতে পারব না। কাপড়জামা মেলার জায়গা নেই,।একটি চেয়ার বা খাটের পাশে কোন রকমে রাখতে পেরেছি সুটকেশগুলো।
 সুটকেশ খোলার জায়গা নেই ঘরে। বললাম, নাঃ এভাবে এখানে থাকতে পারব না।পয়সা দিয়ে এত কষ্ট করতে পারব না। ছেলেকে জানালাম, ও বলল, ওকে নাকি বলেছে, বাড়িটা স্বর্গের মত। আমি বললাম, ঠিকই বলেছে, এখান থেকে ওঠা নামাও সমস্যা, আর এখানে থাকাও সমস্যা। সেই হিসাবে আমাদের মত পৃথিবীর মানুষের বাসযোগ্য নয় এটি।স্বর্গই বটে!
🍂
ad

ও আশ্বাস দিল এখানে রাতটা থাকো, সকালেই অন্য ব্যবস্থা করছি।

সকাল হতেই একটি সাদা ধবধবে বিড়াল কোথা থেকে এসে একেবারে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমাদের কাছে চলে এল। এসে গোটা ঘর ঘুরে জিনিসপত্র শুঁকে আরাম করে চেয়ারের উপর উঠে চোখ বুজে হাই তুলতে লাগল। বুলবুল বলল, ও আমাদের খবর নিতে এসেছে। নতুন এসেছি তো, সুবিধা -অসুবিধা কি হচ্ছে তার খবর নিচ্ছে।
আমি বললাম, তা নয়, আমাদের সঙ্গে সন্দেহজনক কিছু আছে কিনা ,তারই সন্ধানে এসেছে।

একটু পরেই মালিক মানু এসে হাজির। সে বলল, ও সত্যিই খুব ভাল বিড়াল। ওর নাম জর্জ। আমারও মনে হল, খুব ভাল ওর স্বভাব।তাই এক রাত্রেই ও আমাদের আপন করে নিতে পেরেছে।হয়ত থেকেই যেতাম, মানুর ব্যবহারও খুব ভাল । কিন্তুএই বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়। তাই ওর টানের চেয়েও আমাদের  বাড়ি ছাড়ার টানটা অনেক বেশি হল।
 
সত্যিই সকালেই আমাদের নতুন ঘরের ব্যবস্থা হল। ছাড়ার আগে মানুকে বললাম, বাড়ির এই অবস্থা, এত সমস্ত কমপ্লেন নিয়ে আপনি বাড়ি কেন ভাড়া দিয়েছেন? তিনি দোষীর মত বললেন, না, বাড়িটা বহুদিনের পুরানো তো, সবই ঠিক করতে হবে, তাছাড়া এটা যে, আপনাদের বয়সীদের বাসযোগ্য নয়, তা সত্যিই হাড়ে হাড়ে বুঝছি ও স্বীকার করছি।
সে তো ভুল স্বীকার করল, কিন্তু আমাদের যা পাপ ছিল তার প্রায়শ্চিত্ত হয়েই গেল।
বোগোটার রাস্তায় ট্রান্সমিলেনিয়াম বাসের স্টেশনের প্রবেশপথ

জিত সকালেই খাবার জল, ডিম, ব্রেড ও আপেল পাঠাল। যাই হোক, খেয়ে দেয়ে সে বাড়ি ছাড়া গেল।

একটু পরেই একই রাস্তায়, উল্টোদিকের কয়েকটা বাড়ির পরেই একটি বাড়ি থেকে একজন লোক এল ডাকতে। বাড়িওয়ালা ছেলেটির নাম, ডেভিড। খুব সুন্দর তার ব্যবহার ও আতিথেয়তা।ওর নির্দেশেই লোকটি এসে আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র দোতলা থেকে নামিয়ে নিয়ে আমাদের ডেভিডের বাড়ির নতুন বাসস্থানে তুলল।

দেখলাম, এ বাড়ীটা যথেষ্ট সুন্দর, অনেক জায়গা এবং সুন্দর ব্যবস্থা। বাড়ির মালিক ছেলেটিও ভাল।তবে মনে হল, এ বাড়ীটিও ওই চার-পাঁচশ’ বছরেরই পুরানো। তবে ভেঙ্গে চুরে কিছু নতুনত্বের ছাপ এসেছে। কয়েকতলা বাড়িটিতে অনেক লোক থাকে, বেশ কয়েকটা অফিসও আছে। তবে নিশ্চিন্ত হলাম, এখানে অন্তত; বাড়ির আরামটুকু পাওয়া যাবে। রান্নার জায়গা থেকে শুরু করে সোফায় আরামের জায়গাও আছে। একই রাস্তার উলটো দিকে কাজেই দরজা থেকে বেরিয়েই পাহাড়ের মনোরম দৃশ্যও দেখা যাবে।

একটু স্থিতু হয়ে বিকেলের দিকে ৩.৩০ নাগাদ বেরোলাম ঘর থেকে। বাইরে বেরিয়েই মনটা ভরে গেল। সামনের রাস্তা ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠে গেছে, অর্থাৎ এই রাস্তা বাড়ি সব একটা পাহাড়ের গায়ে,  ঢালের উপর। সামনের রাস্তার দুপাশে বাড়ি।কিছুটা অন্তর অন্তর আড়াআড়ি ভাবে সমান্তরাল রাস্তা চলে গেছে উপর থেকে নীচে পর্যন্ত পরপর।বাড়ির সামনে খুব প্রয়োজন না পড়লে গাড়ি আসবে না, সেটুকু পায়ে হাঁটা। অর্থাৎ গোটা জায়গাটা চৌকো চৌকো ভাবে বিভক্ত। এর সামনে উঁচুদিকে দেখা যাচ্ছে গাছপালায় ঘেরা পাহাড়ের মাথা, তাতে মেঘে ঢাকা হওয়ায় বেশ একটা ‘মিস্টিক’ ভাব রয়েছে। মনে হচ্ছে, সত্যিই কোন স্বর্গরাজ্যে রয়েছি। জায়গাটার রাস্তাগুলো সব পাথরে বাঁধানো। সরু ফুটপাথ, জায়গার অপ্রতুলতা যথেষ্ট, যেমন কার্তাহেনায় দেখেছি। কার্তাহেনা ছিল সমুদ্রের ধারে সমতলে আর বোগোটা হল পাহাড়ি এবং পাহাড় ঘেরা।
বুলবুল দেখলাম, বাইরে রাস্তা থেকে আর ভিতরে যেতেই চায় না।দরজার সামনেই সিমেন্টের বসার সুন্দর জায়গা রয়েছে।  ও তাকিয়ে রয়েছে সামনের পাহাড়ের দিকে , মনে হচ্ছে ও শুধু দেখছে না, ঢুকে যাচ্ছে সেই স্বর্গীয় পরিবেশের মধ্যে।ও হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল, দেখ, এরকম একটা জায়গায় আমাদের একটা বাড়ি হলে কেমন হয়? হেসে বললাম, তুমি বললে আমি আজই কিনতে পারি। ও বেশ কাব্যিক ভাবে আমার দিকে তাকাল।
ক্রমশঃ-
সঙ্গে থাকুন বন্ধুরা। এরপর শুরু হবে আমার বোগোটা শহরের পথচলা।

Post a Comment

0 Comments