বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭৫
শসা
ভাস্করব্রত পতি
'ফিলজফার বিজ্ঞলোক, প্লাউম্যান চাষা।
পমকিন লাউ কুমড়ো, কুকুম্বার শশা'।।
ইংরেজ রাজত্বে সদ্য ইংরেজি শেখা ভারতীয়দের ইংরেজীর বহর বোঝাতে এই ছড়াটি খুব জনপ্রিয় ছিল। অতি সাধারণ সব্জি কিংবা ফল হিসেবে শসাকে নিয়ে ভালোবাসার সঙ্গে তার সম্পর্ক মিলিয়ে এক অদ্ভুত গ্রাম্য ছড়া ছড়িয়ে আছে গ্রামাঞ্চলে --
'লোক দেখানো ভালোবাসা, ভাদ্র মাসের কচি শশা। দেখলে পরে হয় লোভ, খেলে পরে পিত্তের কোপ'।।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতানুসারে মূল শব্দ 'শস্য' থেকে এসেছে শসা বা শশা বা সসা শব্দটি। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে 'শসা হেন মশাগুলা'। চৈতন্যমঙ্গলে পাই 'সসা নামে খন্দ'। শিবায়নে 'সসা ফুটি' শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলা প্রবাদে শসা নিয়ে পাই 'কেউ খাবে শসা, আবার কেউ তাড়াবে মশা"। একটি বিশেষ ছড়াতে শসার কথা পাই এভাবে --
'চৈত্রে শ্রীফল মিঠা খেয়েছিলেন রাম;
বৈশাখেতে শশা মিঠা শোল মাছে আম।।
জৈষ্ঠেতে পাকা আম, আষাঢ়ে কাঁঠাল।
শ্রাবণেতে খৈ দৈ, ভাদ্রে পাকা তাল।।
আশ্বিনেতে নারিকেল, কার্তিকেতে ওল।
অগ্রহাণে নব অন্ন, চিঙ্গড়ি মাছের ঝোল।।
পৌষ মাসে মূলা মুড়ি খেতে লাগে মিঠা।
ঘন আউটা দুধের সাথে বাসি পোড়া পিঠা।।
মাঘেতে মকর মিঠা তেলে ভাজা সীম।
ভারতে শসা উৎপাদনের ইতিহাস ৩ হাজার বছরের পুরনো। ভারতের কয়েকটি রাজ্য ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, দুই ২৪ পরগণা, দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, হুগলী, হাওড়া ইত্যাদি জেলায় প্রচুর পরিমাণে এটির চাষ হয়। মেদিনীপুরের লোকেরা শসাকে ক্ষীরা বলে। এটি cucurbitaceae পরিবারের অন্তর্গত। বিজ্ঞানসম্মত নাম Cucumis sativa Linn। শসাকে সংস্কৃতে ত্রপুসী, হিন্দিতে ক্ষীরা, বালসক্ষীরা, মারাঠীতে তৌসিকর্কটি, ওড়িয়াতে কল্ট আরি, তামিলে দোজকইয়া, তেলুগুতে দোসাকয় বলে। এছাড়াও শসার পরিচিতি ত্রপুসী, পীতপুষ্পী, কন্টালু, ত্রপুষ্কর্কটী, বহুফলা, কোশফলা, তুন্দিলফলা নামেও।
এটি কাঁকুড় জাতীয় ফল। বর্ষজীবী লতানো গাছ। শক্ত লোমযুক্ত। আকর্ষের সাহায্যে বেয়ে বেয়ে যায় ও স্থায়ীভাবে থাকে। পাঁচ কোণ বিশিষ্ট পাতাগুলির আকার হৃৎপিন্ডের মতো। এই শসাকে কেন্দ্র করে ধাঁধাতে রয়েছে --
'মায়ের নাম লতাবতী
বইনের নাম সোনারতী।
ভাইয়ের নাম ঠেংগা
এই শিলোক ভাংগা'।
শসা মাটিতে কিংবা মাচায় ফলে। তাই ধাঁধার মাধ্যমে বলতে দেখা যায় --
'মামার বাড়ি গেলাম
মাচায় ঝুলিয়া রলাম'।
ভাদ্রমাসে ক্ষেতের মাচায় যে শশা হয়, তা 'ভাদুরে শশা' নামে পরিচিত এবং চৈত্র মাসে মাটিতে যে শসা হয় তাকে 'ক্ষিতি শশা' বলে। শসা ফলগুলো ফিকে সবুজ বর্ণ' বা শাদা রঙের হয়। ফলে অনেক বীজ থাকে। লম্বা, মসৃণ। দেখতে খুব সুন্দর। রংপুর এলাকায় শোনা যায় শসার রূপ সম্পর্কে --
'বাপ ডিন ঘিন, মাও পাতারি।
মুড়ি দিয়ে শসা কুচি মাখিয়ে খেতে খুবই সুস্বাদু। স্যালাড তৈরির অন্যতম উপকরণ হল শসা। তবে পাকা শসা মোটেও খেতে ভালো নয়। আর তা নিয়ে মেদিনীপুরের মানুষের মুখে শোনা যায় এই আজব ধাঁধা --
'পাকলে নর খেতে চায়না,
কাঁচা খেতে চায়।
এ কেমন ফল,
ভেবে ভেবে বলতো আমায়'।।
তেমনি কাঁচা শসা খাওয়ার কথা সিলেট এলাকার ধাঁধাতেও পাই --
'আকোল কইলে তুকায় পায়।
কি ফল কাঁচা খায়'।।
যশোরের লোকেরাও ধাঁধাতে সেরকমই বিষয় তুলে ধরেছে --
'এই ছা লাটা বুটা কাটা।
হেজলি বুটা ঝরে আটা'।।
ভেষজটি পরিচিত ত্রপুষী নামে। ত্রপুষ থেকে ত্রপুষী -
ত্রপ্ + উস্ -- ত্রপুস
অর্থাৎ তাপ পেলে যা গ'লে যায়। এই একটি ফল যেটির ব্যবহারে দেহের মুত্রঘটিত রোগ দূর করে। মূত্রথলিতে পাথর হলে তা গলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে শসা। যা আসলে অশ্মরী অর্থাৎ পাথুরী রোগ। খাদ্য হিসেবে ছাড়াও শসা খুব উপকারী অরুচি, কামোত্তেজনা, গলঃক্ষতে, রসবহ ও মেদোবহ স্রোতে, ভ্রম রোগ, পিত্তাধিক্য, মূত্রকৃচ্ছতায়, মুত্রাঘাতে ও অশ্মরী ইত্যাদি নিরসনে।
বাঁকুড়ার এক অন্যতম লৌকিক উৎসব হল 'শেয়াল শকুনি'। এই উৎসবের লোকাচারে যেসব ফল উপকরণ হিসেবে লাগে তার মধ্যে শসা অন্যতম। যখন পুকুর বা নদীর ঘাটে গিয়ে মাটির তৈরি শেয়াল শকুনিকে রেখে পূজো করে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, তখন যে ছড়াটি শোনা যায়, তা হল --
'শিয়াল গেল খালকে
শসা ডুবা কালকে,
এ শিয়াল যাস্ না
ছেলেগুলাক কাঁদাস না।'
এই ভাসানের কাজে পুরুষদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় না। জলে ভাসানোর সময় ছড়া কেটে বলে --
'জিৎবাহন শিয়াল শুকনি
বছর বছর ফিরো
চিড়া দই গুড় দেবো
পেট পুরে খেও।'
এরপর ব্রতীনীরা ডুব দেওয়ার সময় শসায় আড়াই কামড় দেয়।
'শসা ডুবা আড়াই কামড়
ব্রতীরা সব হাকড় মাকড়,
ব্রতীনীরা ডুব দেয়
উপর থেকে জীবিতবান
মহান বর দেয়।'
এছাড়াও এই সময় ছড়া কেটে বলা হয় ---
'শিয়াল শুকনি পরম মিতা
শসা কামড় গোটা গোটা,
শিয়াল শুকনি রুষ্ট হলে
ব্রত হয় না উপাস দিলে।
আচার বিচার করলে পর
জীবিতবান দিবেক বর।
পুত্র পৌত্রে ভরে ঘর
আর থামে যমের ডর।'
সেইসাথে নদীর পাড়ে বসে মটর কলাই, মুড়ি, শসা খেয়ে ব্রত ভঙ্গ করে সবাই।
'ন’পুয়া কলাই ভিজা
ন'টি শসা গোটা।
এসবগুলা পালতে হবে
শসার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির নাম হল বারাসতি, কৃষ্ণনগর সিলেকশন, মাইশোর গ্রিন লং, জাপানিজ লং গ্রিন, সুপার গ্রিন, নরেশ এফ-১, ফুজিন এফ-১, সন্দেশ এফ-১, মহেশ এফ-১, থালিয়া এফ-১, প্রিন্স এফ-১, সুরেশ এফ-১, বীরেশ এফ-১, প্রিন্সেস এফ-১, হিমাঙ্গি, খিরা পুণা, মাতিপুনো, বরদান, পুসা সংযোগ, পয়েনসেট, বালাম খিরা, বাতংগাস হোয়াইট, হোয়াইট ওয়ান্ডার, চায়না, স্ট্রেইট এইট, চেতন ইত্যাদি। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৭.৩ মিলিয়ন টন শসা উৎপাদন করে চিন (২০২২)। বিশ্বজুড়ে মোট উৎপাদনের ৮২ শতাংশ।
🍂
0 Comments