ডানাকাটা
পুলককান্তি কর
ডানলপ থেকে দক্ষিণেশ্বরের দিকে যাবার রাস্তাটায় এদিক ওদিক দেখতে দেখতে পেট্রোল পাম্পে গাড়িটা ঢুকিয়ে দিল শৈলেশ। ইতি কে পেট্রোল পাম্পের মুখটাতেই দাঁড়াতে বলেছিল সে পৌনে সাতটায়। এখনও যদিও মিনিট সাতেক বাকি আছে। যাক গে, ও আসতে আসতে তেল ট্যাঙ্কটা ফুল করিয়ে নিল সে। হাওয়া-টাওয়াও চেক করতে হবে। দূরের জার্নি। সবকিছু ভালো মতো দেখে টেখে যাওয়াই ভালো। হঠাৎ কী মনে হতে গাড়ীটার মধ্যে ভালো একটা এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে দিল সে। সুগন্ধ শৈলেশের খুব ভালো লাগে। তিন চার রকমের এয়ার ফ্রেশনার গাড়ীতে রাখে সে। এখন সকালবেলা। ল্যাভেন্ডারটাই যাবে ভালো। হঠাৎ দেখলো একটু দূরে পেট্রোল পাম্পের দিকেই হেঁটে আসছে ইতি। হাতে ছোট একটা লাগেজ ব্যাগ আর একটা ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে। ভেবেছিল ওর বর ওকে দিতে আসবে। যাক গে, আসেনি - বাঁচা গেছে। এই সকাল সকাল ওর বরের সাথে হাই-হ্যালো করার বিন্দুমাত্র প্রবৃত্তি ছিল না তার। কেন কে জানে দুজনের কুণ্ডলীতে ছত্রিশের আঁকড়া। শৈলেশ বোঝে ইতির বর অরূপও ওকে বিশেষ পছন্দ করে না। অবশ্য দেখাই বা খুব বেশী হয় কোথায়? ওই ওদের বন্ধুদের গেট টুগেদারে বা কোনও কমন ফ্রেন্ডস এর বাড়ির কোনও অনুষ্ঠান হলেই যা দেখা সাক্ষাৎ। শৈলেশ একটু এগিয়ে গিয়ে ইতি কে বলল- 'দে লাগেজটা দে।
-- ও ঠিক আছে। বেশি ভারি না।
-- আরে দে না ! সঙ্গে মুটে মজুদর থাকলে দেবী নারীদের ব্যাগ-ব্যাগেজ ওদের হস্তান্তর করাটা নৈতিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এতে কেউ দোষ ধরে না।
-- আমি দেবী নারী নই রে। আমার এসব ভালো লাগেনা।
-- আরে দিয়ে দে। নইলে আমিই বা আমার অভ্যাস বজায় রাখবো কিভাবে? বলেই জোর করে ব্যাগটা কেড়ে নিল সে।
-- মেয়েদের প্রতি খুব শিভালরি না?
-- মেয়েদের দেখাবো নাকি হুমদো পুরুষদের দেখাবো?
-- তুই আর বদলালি না শৈল।
-- এভাবেই জীবনের বড় অংশ কেটে গেল। এখন আর নিজেকে বদলে লাভ কি? যা হোক চা টা খেয়ে এসেছিস, নাকি খেয়ে রওনা দেব।
-- বাড়ি থেকে চা খেয়েই বেরিয়েছি। চল রাস্তায় ধাবা-টাবা দেখে আবার খাওয়া যাবে।
শৈলেশ যখন গাড়ী স্টার্ট দিল, তখন ঠিক সকাল সাতটা। এখান থেকে আসানসোল যেতে সাড়ে তিন ঘন্টা তো মিনিমাম লাগবেই। ইতি বলল, কাঁচগুলো তুলে রেখেছিস কেন? এ.সিটা বন্ধ করে প্রকৃতির হাওয়া খেলে হয় না?
-- কলকাতায় এত ধুলো ধোঁয়া, কাঁচ বন্ধ করে চালানোটাই অভ্যাস হয়ে গেছে রে। চল একটুখানি গেলে হাইরোড আসবে, তখন না হয় কাঁচ খুলে দেব। হ্যাঁরে লং জার্নি, চুড়িদার পরে এলে তো পারতিস।
-- অতসীদের বাড়ি যাবো। একটা বিয়ে বাড়ির ব্যাপার। বৌ মানুষ শাড়ি না পরলে গ্রাম দেশে যদি নিন্দা হয়!
-- প্রথম কথা অতসীর দাদার মেয়ের বিয়ে, তুই অতসীর বন্ধু - তোর শাড়ি পরার কোনও দায় আছে কি? আর দ্বিতীয় কথা, আসানসোল এখন গ্রাম দেশ নয়, কোলকাতার থেকেও বেশী শহর।
-- প্রপার আসানসোল তো ওদের বাড়ি নয় শৈল। ভেতরের দিকে কী একটা গ্রাম আছে – লেখা আছে আমার কাছে, ওখানেই তো বিয়ে।
-- আজকাল চুড়িদার, সালোয়ার জাতীয় পোশাক। গ্রামের দিকেও চলে।
🍂
-- তুই এত আমার শাড়ীর পেছনে পড়লি কেন রে? এতে কি আমায় ভালো লাগছে না?
-- ভালো লাগবে না কেন? মেয়ে মাত্রই শাড়ীতে অপূর্ব লাগে। কেমন একটা দেবী দেবী ফিলিংস হয়। তোকেও দারুন লাগছে। ফর্সা রঙে কালো শাড়ী লাল ব্লাউজ – এটা তো কিলার কম্বিনেশন।
-- তাহলে আর সমস্যা কি?
-- ওটাই তো সমস্যা রে। তোকে এত ভালো লাগছে যে সবাই যদি তোকে ফ্লার্ট করতে শুরু করে দেয়?
-- তাতে তোর জেলাসি হচ্ছে কেন?
-- বাঃ। আমার মত ‘এ’ ক্লাস ফ্লার্টার থাকতে থাকতে অন্য কেউ তোকে ফ্লার্ট করে যাবে – সে কি সহ্য হবে?
-- তুইও কর না। কে তোকে মানা করেছে?
-- সেও তো একটা ভয় ইতি। এতটা পথ একসাথে যাবি, আমিও যদি ফ্লার্ট করতে শুরু করি, নিতে পারবি তো?
-- একটু না হয় ফ্লার্টই করবি, শুনেই দেখি তোর স্টাইলটা কেমন?
-- বাব্বা ইতি। তুই তো একেবারে বদলে গেছিস রে। তুই এত কথা শিখে গেছিস এ ক বছরে – আন্দাজই করতে পারিনি। তুই তো ছিলি আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে নিরীহ, গোবেচারা, ভালো মানুষ টাইপের মেয়ে। তা অরূপ এলো না কেন?
-- ওর কাল ভোরেই নাকি অফিসের কাজে দিল্লি যাওয়া আছে।
-- কিন্তু আমার মত একজন রেপুটেড আলুবাজের সাথে তোর বর সাহস করে তোকে ছাড়লো কী করে – তাই ভাবছি। এটা কি তোর প্রতি ওভার কনফিডেন্স নাকি আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করা?
-- অরূপ জানে তোর খালি মুখেই বাহাদুরি। আদতে ততটা নয়।
-- তুইও কি তাই মনে করিস নাকি?
-- সেই ভরসায় তো এসেছি রে।
-- আমাকে একদম চ্যালেঞ্জ করবি না ইতি। এই শর্মার ক্ষমতা সম্বন্ধে তোর ধারণা নেই। দেখাবো আমার জলওয়া?
-- মানে? তুই কি লম্পট নাকি রেপিস্ট? দেখাবো মানে কি?
-- মানে তোকে পটিয়ে দেখাবো?
-- বলিস কী? এই আজ যাচ্ছি, কাল রাতের মধ্যেই ফিরে আসবো। পুরো দুদিনও নয়; এর মধ্যে তুই আমাকে পটিয়ে ফেলবি? কী ভাবিস মেয়েদের?
-- আরে এটা একটা আর্ট। মেয়েদের খারাপ ভাবাভাবির বিষয় নয়। লোক বুঝে চারা ফেলতে হয়।
-- কী ভাষা! এ কি মাছ ধরা যে চারা ফেলবি?
-- যেমন সাবজেক্ট, তার তেমন টার্মিনোলজি। এই লাইনে এইসব ভাষায় চলে।
-- যেমন?
-- এই ছিপ, মাছ ধরা, টোপ, মাল, চুক চুক, লাল – এইসব আর কি? আরো আছে, তবে স্ল্যাং। তোর কানে আবার ধুপ ধুনো দিতে হবে ওসব শুনলে।
-- আচ্ছা দু একটা শুনি কেমন করে চারা ফেলতে হয়!
-- এই যেমন, প্রশংসা। পৃথিবীতে হেন কোনও মেয়ে নেই যে তার রূপের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে না।
-- এটা সবাই বাসে, পুরুষও বাসে।
-- ছেলেদেরটা অন্যরকম। মেয়েদের ক্ষেত্রে এইটা একদম বেষ্ট লাইন অফ ট্রিটমেন্ট। সিম্পলি প্রশংসা করা বিশেষ করে রূপের – যেমন ‘আজ বোধহয় জ্যোৎস্নাও হার মানবে গো তোমার কাছে’ বা, ‘তোর চোখ তো নয় – যেন নীল দীঘি!’ বা, ‘চোখে এমন করে কেউ কাজল দেয়? আমাকে কি তোমার মারার ইচ্ছা?’ – এই বাক্যগুলো একটু সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে দেওয়া যায়। একদম সদ্য পরিচিতাকে দিলে জুতোর বাড়ি দেবে।
-- যে মনে কর দেখতে সুন্দর নয়, তাকে কিভাবে প্রশংসা করবি? ওকে দেখতে ভালো বললে তো বুঝে যাবে আওয়াজ দিচ্ছিস।
-- ওখানে অবস্থা বুঝে। যেমন, বলা যেতে পারে – তোমার গলাটা কী সুন্দর! বা, কী সুন্দর চুল তোমার! যদি কোনওদিন ভালো ড্রেস পরে আসে, সেদিন বলতে হবে – আজ এই শাড়িতে যা ভালো লাগছে তোমায়!মোদ্দা কথা গুণের কদর করতে হবে।
-- আমার মত মেয়েদের কীভাবে ফ্লার্ট করতে হবে?
-- সেটা বলে দিলে আগামী দুদিন করব কী? সব সিক্রেট জেনে গেলে তো ওইগুলোতে তালা মেরে দিবি। আমি তোর ভেতরে ঢুকবো কী করে?
-- তাও জেনারেল কিছু বল যেটা আমার ওপর প্রয়োগ করবি না।
-- তোর মতো যারা 'ভালো মেয়ে' টাইপের, তাদের সরাসরি ফ্লার্ট করতে নেই। তখন ওরা খারাপ ছেলে ভেবে এড়িয়ে যায়। প্রথমেই কারও উপর যদি এমন ছাপ পড়ে যায় তবে সে সহজে মন জয় করতে পারবে না। এসব ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি নিতে হয়। ধীরে ধীরে ওর পছন্দ বুঝতে হবে – সেইমত বাকী সব প্ল্যানিং।
-- তুই তবে দুদিনের মধ্যে কী করে করবি? কত ধীরে চলবি?
-- ইতি, মনে হচ্ছে তুই সত্যি সত্যি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছিস রে। আমি তো তোরটা নিয়ে এখনও ভাবি নি।
-- ভাবিস না। জীবনে পারবি না।
-- বেশ। পরেরটা শোন। যদি দেখিস যে মেয়েটি সেলিব্রিটি বা একটু ডিগনিফায়েড গোছের, ওদের সামনে ফ্লার্ট করতে গেলে উল্টে কেস খেতে হবে। সবার প্রশংসা আর মন জুড়ানো কথা শুনতে ওরা এত অভ্যস্ত যে তুই ওসব বলতে গেলে তাদের সামনে আম আদমি হয়ে যাবি। এসব ক্ষেত্রে সিম্পলি নিজেকেও একটা কেউকেটার মতো মুখ করে ঘুরতে হবে যাতে মেয়েটি ভাবে, ‘বাবা এ আবার কে? আমার দিকেও ফিরে চায় না।’ অবশ্য অনেকে এর মধ্যে আছে যারা অতিস্তাবকতা পছন্দ করে।
-- এখনকার জিন্স টপ পড়া ইংলিশ মিডিয়াম মেয়েরা? শুনেছি এরা তো সব লঘুচিত্ত। ওইসব সাগর, চাঁদ, জ্যোৎস্নার সামঞ্জস্য কি এরা বুঝবে?
-- দেখ ইতি, আমার তো পঁয়তাল্লিশ হয়ে গেল। এত কচি তো পটাইনি কোনওদিন। তবে আমার মনে হয় ঠাকুমা থেকে নাতনী, যে কোনও যুগে, যে কোনও সময়ে মেয়েরা রূপ নিয়ে প্রশংসাতে খুশিই হবে।
-- বেশ। এবার তো দিল্লি রোডে উঠে গেছি। জানালা টানালা গুলো খুলে দে। একটু বাইরের হাওয়া খাই।
-- খুলতে পারি। কিন্তু দেবী, আপনি যে আজ চুলের অন্ধকারে পিঠ ঢাকিয়া চূর্ণ কুন্তলে কপোল সাজাইয়া বসিয়া আছেন, বাহিরের দস্যু বাতাস কিন্তু তাহাদের একা পাইলে ফ্লার্ট করিয়া চলিয়া যাইবে, না না ফ্লার্ট করিতে করিতে চলিতে থাকিবে, আপনি কি তাহা সহ্য করিতে পারিবেন?
-- হাত খোঁপা করে নিচ্ছি। তুই খোল। না পারলে আবার তোর গভীর পিঞ্জরে বন্ধ করে দিস।
-- বেশ। চল, তার আগে একটু চা খেয়ে নিই। সামনের ওই ধাবাটা বেশ অন্যরকম দেখতে।
-- অন্যরকম মানে?
-- মানে একটু যেন নির্জন। রাস্তার থেকে একটু আধো আড়ালে, গাছপালার ফাঁকে যেন আমাদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
-- তুই কি কবি হয়ে গেলি না কি রে? নাকি এটা ফ্লার্টিং এর আর্ট?
-- তোর মত রবীন্দ্রানুরাগী সাহিত্য বোদ্ধা আঁতেল পটাতে হলে একটু আধটু এসবের চর্চাও করতে হয় ইতি। মেয়ে পটানো শব্দটা শুনতে সহজ রে, কিন্তু আদতে এর পেছনে কত মেহনত, কত অনুশীলন – এটা কেউ বোঝে না।
-- কিন্তু এত মেহনত করে লাভ কী?
-- তুই গান গাস কেন ইতি?
-- ভালো লাগে।
-- ওটাও ভালো লাগে। একজনের মন জেতার আনন্দ, একজনের হৃদয় জেতার আনন্দ কি চাট্টিখানি কথা।
এই কথায় হেসে উঠল দুজনেই। শৈলেশ বলল, ‘নাম। চা’র সাথে কি খাবি?’
-- কী পাওয়া যায় এখানে?
-- কচুরি ফচুরি সব ধাবাতেই পাওয়া যায়। কফি সফি খেতে চাইলে ব্রেড বাটার, অমলেটও পাওয়া যেতে পারে।
-- চল, বহুদিন দোকানের কচুরি খাই না। সেই কলেজ পড়ার সময় শ্রীহরি'র হিং এর কচুরি আর ল্যাংচা খেতাম। এখন কি আছে দোকান টা? এর মধ্যে তুই ওদিকে গেছিস নাকি শৈল?
-- না রে। চল দেখি হিং এর কচুরি পাই কিনা।
চা খেয়ে এসে গাড়ীতে স্টার্ট দিল শৈলেশ। ওর সিডি প্লেয়ারটা হালকা করে চালিয়ে আড়চোখে ইতিকে একবার দেখলো সে। ইতি ওরই সমবয়সী, তবে এখনও ততখানি গিন্নিবানী দেখায় না ওকে। আজকে যদিও দেখা যাচ্ছে না, তবু ও দেখেছে ডান দিকে কানের উপরে কয়েকটা চুলে হালকা পাক ধরেছে ইতির। পৃথুলা যদিও নয়, তবু যৌবনের দিনের মতো প্রজাপতি গড়নও এখন নেই। ইতির সাথে চোখাচুখি হতে ঈষৎ অপ্রস্তুত হল সে। বলল, ‘হজমোলা খাবি?’
-- এখন কিনে আনলি নাকি?
-- না। আমার গাড়িতেই রাখা থাকে।
-- কেন রে হজমের গোলমাল হচ্ছে না কি আজকাল?
-- সে হচ্ছে, তবে সেজন্য নয়। ভালো লাগে বলে রাখি।
-- শৈল এটা তো ভালো কথা নয়। ডাক্তার দেখা। ইদানিং দেখছি তোর একটা নোয়াপাতি ভুঁড়িও হচ্ছে। এই রকম চেহারা হলে মেয়ে পটাবি কী করে?
-- বয়স বেড়েছে ঢের পৃথিবীর নরনারীদের!
-- কী ব্যাপার রে শৈল? তুই তো আমাকে ক্রমশ তাজ্জব করে দিচ্ছিস। একদিকে বিক্রম সিং এর গলায় রবীন্দ্রনাথ বাজছেন, অন্যদিকে জীবনানন্দের লাইন – এটা কি শৈলেশ মুখার্জী? যে হিন্দি ফিল্মের গান ছাড়া কিছু শোনে না?
-- আরে না রে, আমি সেই শৈলাশই। নেহাত তুই আঁতেল মানুষ সঙ্গে যাবি। 'পানি পানি পানি' শুনতে কি তোর ভালো লাগবে? ওই জন্য কাল গিয়ে দুটো রবীন্দ্র সঙ্গীতের আর একটা সলিল চৌধুরীর বাংলা আধুনিক গানের সি.ডি কিনে এনেছি। কালকে তোর সাথে সি.ডিগুলো দিয়েও দেব। আমার ওসব শুনতে ভালো লাগে না। মরোজড লাগে। একটু ঢিনচ্যাক ঢিনচ্যাক না হলে চলে? জীবনটাই কোথায় যেন থ্যাব্কা মেরে বসে পড়ে।
-- তাহলে এক কাজ কর। এখন বন্ধ করে দে। ড্রাইভারের মুড ভালো না হলে গাড়ির গতিও আটকে যায়?
-- তা যাবে না। ওইটুকু অভ্যেস রেখেছি, নইলে তোর মতো কেউ গাড়ীতে সহযাত্রী হলে মুস্কিল হয়।
-- কিন্তু সত্যি সত্যি এই গান শোনার এখন মুড নেই রে শৈল। গানগুলো সত্যিই বড় বিষাদ মাখা। এসব গান একা শোনার। গল্প করতে করতে নয়। এখন বরং আমরা গল্প করি।
-- কী গল্প করবি বল। এতক্ষন তো শুধু মেয়ে পটানোর গল্পই হল।
-- সে আর খারাপ কী? অনেক নতুন কথা জানতে পারলাম।
-- এ আর তোর জেনে লাভ কি ইতি? তুই তো আর কোনও মেয়ে পটাতে যাবি না।
-- আমি যাব না ঠিক, তবে নিজেকে অন্যের পটানো থেকে তো প্রতিহত করতে পারবো।
-- জানিস তো ইতি, কখনও কখনও সেরকম লোকের হাতে পটেও সুখ হয়। তুই বেশী ভালো মেয়ে তো। তোর চারিদিকের জানালা দরজা বন্ধ। নইলে এই সুখ তুইও পেতে পারতিস।
-- আচ্ছা শৈল, তোর বউ বাচ্চা এল না কেন? আনতে পারতিস তো।
-- ওই তো বাচ্চার পরীক্ষা চলছে। এখন ওদের নড়ার উপায় নেই। আর তাছাড়া টুসী বাড়িতেই ঠিক থাকে।
-- টুসীর সাথে তো লাভ ম্যারেজ। কিভাবে পটিয়েছিলি?
-- এটা আমার সবচেয়ে কম এফোর্টের ফল রে ইতি! ও তো একটু হাবাগোবা টাইপের ছিল। একদমই চালাক চতুর না। আমি তখন ভেবে দেখলাম – আমি যে টাইপের ছেলে, এই মেয়েই আমার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। বেশ দাবিয়ে রাখা যাবে। আমিও আমার মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মেতে থাকতে পারবো। ও হল তোর এই বন্ধু অতসীর কী-তুতো একটা বোন। আমাদের পাড়াতেই থাকতো ওরা। যখন গ্রাজুয়েশনে ছিল, ওর অ্যাপেন্ডিক্স এর অপারেশন হল। আমিও ঠেক ফেক ক'দিন কামাই দিয়ে নার্সিংহোমেই জোরদার ডিউটি দিয়ে দিলাম। মেয়ের আগেই মেয়ের মা বাবা ভাই পটে গেল। বাকিটা জাস্ট সময়ের অপেক্ষা।
-- শৈল, তুই জীবনে কতগুলো মেয়ে পটিয়েছিস?
-- অসংখ্য। তবে অধিকাংশই টাইম পাস।
-- যেগুলো গভীর, সেরকম কতগুলো আছে?
-- খান চারপাঁচ।
-- যেটার কথা সবচেয়ে আগে মনে পড়েছে তার কথা বল না।
-- আমি তখন সি. এ পড়ছি বুঝলি। বোধহয় দুটো লেভেল কমপ্লিট হয়ে গেছে। এরকম সময় আমার খুব পেন অ্যাবডোমেন হয়েছিল। আমি তখন মেডিকেল কলেজের আউটডোরে দেখাতে যাই। ওখানে তো অনেক পেশেন্ট। জুনিয়ার ডাক্তারেরা সব ভাগাভাগি করে দেখে। আমাকে যে দেখছিল, ওর নাম হচ্ছে অঙ্গনা। কী সুন্দর যে ওকে দেখতে ছিল ইতি, কী বলবো। লম্বা, ফর্সা, টিকালো নাক, গাঢ় কালো চুল। জিন্স আর টপ পরে মনে হচ্ছিল, পুরো ইন্ডিয়ান বিউটি ইন ওয়েস্টার্ন স্টাইল। দেখেই আমার অর্ধেক পেট ব্যথা কমে গেল। মনে মনে ভাবলাম এ মেয়ের হৃদয় যদি জয় করতে পারতাম। কেন কে জানে বরাবরই মহিলা ডাক্তারকে আমার খুব ভালো লাগে সেই ছোট বেলা থেকে। তো অঙ্গনা আমাকে শুইয়ে নানান কায়দায় পেট ফেট টেপাটেপি করতে লাগল। আমি তো ওর স্পর্শেই রোমাঞ্চিত। যা যা জিজ্ঞাসা করল মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলে গেলাম। ব্যথা কয়েকদিনের মধ্যেই কমে গেল তবে আমার নানান ধরনের রোগের উপদ্রব যেন হঠাৎ করে চাগাড় দিল। প্রায় প্রতি সপ্তাহে ঐ নির্দিষ্ট দিনে আমি যথারীতি অঙ্গনার সামনে হাজির হতে শুরু করলাম।
-- প্রত্যেকবার ওর হাতেই পড়তিস কী করে? ওখানে তো অনেক ডাক্তার বসে।
-- ও ম্যানেজ করে নিতাম। অন্য কারো হাতে গেলে আমি বলতাম আমি ওই ডাক্তারবাবুকে দেখিয়েছি। সবাই একটা রোগী কম দেখতে হবে এই আনন্দে খুশি খুশি ছেড়ে দিত।
-- যা হোক, বল তারপরে কী হলো।
-- প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে এলে এমনিই একটা মুখচেনা হয়ে যায়। হালকা করে হলেও একটু অন্তরঙ্গতা বেড়ে ওঠে। আর জানিস তো, ওই বয়সে আমি খুব খারাপও ছিলাম না দেখতে।
-- সে তুই এখনও খারাপ নোস। বরং অন্য অনেকের চেয়ে অনেক ইয়াং।
-- থ্যাংকস। অঙ্গনার সাথেও কথায় কথায় জেনে গেলাম ওর ভালো লাগা, বাড়ী ঘর, অ্যাম্বিশন। ও আমার সম্বন্ধেও টুকটাক জেনে নিল – কী পড়ি, কোথায় থাকি। এত ঘন ঘন রোগে ভুগি বলে অনেক পরামর্শও দিল। বিনা খরচে হাসপাতালে যাতে নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে যায় তার তদ্বিরও করে দিল। আমি ওকে ফলো করতে করতে আবিষ্কারও করে নিলাম ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। মনটা একটু খারাপ হল, তবে হাল ছাড়লাম না। তখন অ্যাকাডেমিতে খুব ভালো একটা নাটক এসেছিল বাংলাদেশের। একদিন সুযোগ বুঝে বললাম, 'ডাক্তার মিত্র, একটা ভালো নাটক এসেছে বাংলাদেশের, আপনি যাবেন'।
-- বাংলাদেশের নাটক তো অসাধারণ হয়।
-- সেজন্যই তো বললাম। আমার কাছে দুটো টিকিট আছে। আপনি যাবেন?
-- যেতে তো ইচ্ছা করছে, কিন্তু কবে?
-- রবিবার।
-- সেদিন যেতেই পারি। কিন্তু...
-- ও আপনি ভাববেন না দুটো টিকিটই আমি আপনাকে দিয়ে দেব।
-- তাহলে আপনি?
-- ও আমি তো প্রচুর দেখি। একটা না দেখলে কী হবে? আপনি দেখে আসুন আপনার কোনও বন্ধুবান্ধব নিয়ে।
অঙ্গনা হঠাৎ কিছু একটা ভাবলো। বলল, ‘না শৈলেশবাবু চলুন আপনার সাথেই যাবো। নাটক বোদ্ধাদের সাথেই দেখতে হয়।’
-- তুই আবার নাটকের বোদ্ধা কবে হলি রে শৈল? ইতি শ্লেষ দিল।
-- আরে ওসব না বললে কি ও আমার সাথে নাটক দেখতে যেত? এর জন্য দুদিন আমাকে কয়েকটা নাটক নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে জানিস?
-- নে নে বল, তারপর কী হলো?
-- সেই শুরু। তারপর একসঙ্গে অনেক নাটক সিনেমা দেখেছি। অ্যাকাডেমি গগনেন্দ্র আর্ট এক্সজিবিশন দেখেছি। নন্দনে আড্ডা মেরেছি। আপনি কখন তুমি হয়ে গেছে। একটা সময় জানিস ইতি, এই চক্করে অঙ্গনা ওর বয়ফ্রেন্ডের থেকেও অনেকটা সরে এসেছিল। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন তো আমাকেই সময় দিত।
-- বিয়ে করলি না কেন ওকে?
-- আমি তো ওকে পটাতে চেয়েছিলাম ইতি, বিয়ে তো করতে চাইনি।
-- মানে?
-- মানে খুব সহজ। দ্যাখ ইতি, ও একটা ডাক্তার মেয়ে। আমার মত সাধারণ ছেলে কি ওর স্বামী হবার যোগ্য? ওর সামনে ভালো ক্যারিয়ার আছে। একটা ডাক্তার ফাক্তার বিয়ে করলেই ওর জন্য ভালো। তাই সরে এলাম।
-- ওর সাথে তোর যোগাযোগ আছে?
-- না রে। ওকে আমি ইচ্ছে করেই হারিয়ে ফেলেছি।
-- যাদের ছেড়ে তুই টুসীকে বিয়ে করলি সে নিশ্চয়ই সবার সেরা? তোকে নিশ্চয়ই সে খুব ভালো রেখেছে?
-- হুঁ। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল শৈলেশের অন্তস্থল থেকে। সে বলল, ‘শক্তিগড় এসেছে। চল ল্যাংচা খাই।’
-- চল।
ল্যাংচা খেয়ে শৈলেশ বলল, 'বাড়ি নিয়ে যাবি না কি'?
-- না। অরূপ তো নেই। ফালতু নিয়ে গিয়ে কী হবে? তুই নিলে নে।
-- না রে। আজ নিলে রাখবো কোথায়। কাল বরং ফেরার পথে নিয়ে নেবো। চল আপাতত।
গাড়িতে উঠে ইতি বলল, ‘তুই তোর বউকে নিয়ে কোথাও বেরোতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিস না, না রে শৈল? কোনও গেট টুগেদারে বা সেরেমনিতে প্রায়শ তুই একাই আসিস। তোর বউ কি আমাদের এই বন্ধুদের গ্যাদারিং পছন্দ করে না? না কি তোর আলুবাজিতে সমস্যা হবে বলে তুই আনতে চাস না?’
-- তোর কী মনে হয়?
-- আমার তো দ্বিতীয়টাই মনে হয়।
শৈলেশ কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
-- কী হল শৈল? দীর্ঘশ্বাস ফেললি!
-- ও কিছু না, এমনি।
-- কিছু তো একটা বটেই। কিছু একটা বলতে চেয়েও বলছিস না।
-- না রে ইতি, বলার মতো কিছু নয়।
-- শৈল, তুই টুসী কে নিয়ে সুখী তো?
-- হ্যাঁ।
-- শৈল আমি একজন মেয়ে। তোর এই 'হ্যাঁ' টাই মস্ত বড় 'না' এর মত শোনাচ্ছে রে। কি হয়েছে বল।
একটু চুপ থেকে শৈলেশ বলল, ‘তুই জিজ্ঞেস করলি না বউ কে নিয়ে এলাম না কেন, জানিস তো ও বাড়িতেই ঠিক থাকে। ও বাইরে বেরোনোর উপযুক্তই নয়।’
-- মানে?
-- ওর শুচিবায়ু রোগ আছে। যত দিন যাচ্ছে, তত বাড়ছে। এখন সঙ্গে আবার ঠাকুর ঠাকুর বাই। ঠাকুর দেখলেই হল। দান প্রণামি তো আছেই, সঙ্গে হাত ধোয়া আর স্নান।
-- চিকিৎসা করাস নি?
-- কিছু বাদ রাখিনি। এ রোগ সারার নয়। আমি বা মেয়ে বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলে যে ভাবে সন্তর্পনে থাকতে হয় আর টুসীর নির্দেশ মত নিজেদের শুদ্ধ করতে হয় কী বলব! তুই জানিস, আমাদের তিনজনের তিনটে আলাদা বিছানা?
-- তাহলে তোদের দাম্পত্য?
-- এক ছাদের তলায় শুধু টিকে আছে। কোনওদিন কোনও পক্ষের বিশেষ চাহিদা হলে তার পূর্বকালীন যে সব বিশুদ্ধিকরনের প্রক্রিয়া চলে, তাতে আর ইচ্ছে বেঁচে থাকে না। তারপর আবার টুসী বাথরুমে ঢুকলে দেড় ঘন্টা। শীত, গ্রীষ্ম, যাই হোক।
দুজন একটুক্ষণ চুপ করে রইল। ইতি দেখল রাস্তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শৈলেশ গাড়ি চালাচ্ছে। কোথায় যেন সেই দৃষ্টির মধ্যে অফুরান শূন্যতা। সামনের কাচ দিয়ে ইতি দেখল বাঁ দিকে খুব সুন্দর টিলা মত একটা জায়গা। ওখানে মস্ত একটা অশ্বত্থ গাছ দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত তার গড়ন। ইতি বললো, ‘শৈল চল না ওই জায়গাটা একটু নেমে দেখি।’
শৈলেশ রাস্তার একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ধীরে ধীরে টিলার উপরে উঠলো। নভেম্বর মাস। বেশ সুন্দর একটা শীতল বাতাস বইছে উত্তরের দিক থেকে। ওই হাওয়ায় ইতির চুলগুলো অদ্ভুত ভাবে উড়ছে। অশ্বত্থের মূল কাণ্ডটা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে ঊর্ধ্ববাহু হয়েছে। চুলগুলো যেন প্রজাপতির মত পাখা মেলে ছুঁতে চাইছে সেই ডালপালা। শৈলেশ বলল, 'তোর মোবাইলটা দে, তোর ছবি তুলে দিই'। কয়েকটা পোজে ছবি তুলে শৈলেশ একটা সিগারেট ধরালো। ইতি বলল, ‘আয় এখানে দাঁড়া, একটা সেলফি তুলি।’
-- না রে। আমি ছবি তুলি না।
-- কেন?
-- আমি নিজের ছবি দেখা পছন্দ করি না।
-- আমার সাথে তোল। আমাকে নিয়ে দেখবি।
-- আমাদের দুজনের ছবি কি এক ফ্রেমে থাকার? অকারণ জটিলতা বাড়িয়ে লাভ কি? চল সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
-- আরও কতটা?
-- আসানসোল পৌঁছাতে আরও প্রায় এক ঘন্টা লাগবে।
-- ওরা যখন আসানসোল হয়ে অতসীদের গ্রামে পৌঁছালো, তখন প্রায় একটা বাজে। গ্রামটা বেশ। তবে দক্ষিণবঙ্গের মতো এতটা শ্যামলিমায় ভরা নয়। বেশ রুক্ষ। দূরে দূরে পাহাড়ের ছোট ছোট টিলা দেখা যায়। লাল মাটি আর পলাশের বন। অতসীদের বাড়ীর লাগোয়া অনেকখানি জায়গা। বাড়ির সামনেই প্যান্ডেল বেঁধে বিয়ের আয়োজন। ওদের বাড়ী যেতে রাস্তায় মস্ত একটা পুকুর পড়ে। চারপাশে তার এত গাছ যে একটুকরো মরুদ্যান বলে ভুল হয়। অতসী ওদের খুব আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গেল। গ্রামের বাড়ী, প্রচুর আত্মীয়-স্বজন। শৈলেশের আলাদা কিছু জুটলো না, ইতিকে একটা বড় ঘরে আরও কয়েকজন মহিলার মধ্যে যদিও বা বসিয়ে আসা গেল কিন্তু জামা কাপড় চেঞ্জ করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে শৈলেশ বড় বিব্রত হয়ে গেল। সে মোবাইলে ইতিকে ফোন করে একটু সময় বুঝে ওই বড় পুকুরের ধারে আসতে অনুরোধ করল। ইতি বলল, 'শৈল কীভাবে যাবো? অতসী কী ভাববে?'
-- বল না, একটু চারপাশটা ঘুরে আসি।
-- যদি ও একা না ছাড়ে, সঙ্গে যেতে চায়?
-- ওরা বিয়ে বাড়ি নিয়ে ব্যস্ত। চাইবে না। আর চাইলেও কাটিয়ে দিস।
-- কি বলবি এখানেই বল না। আবার পুকুর পাড়ে কেন?
-- এখানে বলা যাবে না ইতি। আমি অনেক আড়াল করে ফোনে তোর সাথে কথা বলছি। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি মিনিট দশেকের মধ্যে আয়।
-- আচ্ছা।
একটু পরে ইতি যখন পুকুর পাড়টায় এলো, দেখলো শৈলেশ এক মনে সিগারেট খাচ্ছে।
-- কী রে, কত সিগারেট খাস দিনে?
-- এই তো একা একা সময় কাটছিল না। তাই ধরালাম।
-- তুই যখনই একা হোস, তখনই সিগারেট খাস নাকি?
-- না, তা নয়। তবে এখন খেতে ইচ্ছে হল।
-- তোর কী এমন জরুরী কথা মনে পড়ল যা এতক্ষণ রাস্তায় এলাম বলা গেল না?
-- তখন বলার উপযুক্ত সময় ছিল না। এখন এমন একটা পরিবেশ, এমন ঘুঘু ডাক নিস্তব্ধ দুপুর, তরুছায়া- সব মিলে মনে হল 'এমন স্থলে তারে বলা যায়!'
-- তুই এত কাব্য করিস না শৈল। তোর ভাবমূর্তির সাথে এসব যায় না। এইসব কাব্য করে আমাকে ইমপ্রেস করার কথা ভাবছিস নাকি রে? হাসল ইতি।
-- তোর দেখছি সেই সকাল থেকে এটা মাথা থেকে বেরোচ্ছেই না। আমি আপাতত একটা সিরিয়াস কারণে তোকে ডেকেছি।
-- সেটাই তো জানতে চাইছি।
-- শোন ইতি, আমার এইরকম গ্রামে বিয়ে বাড়ী অ্যাটেন্ড করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। এখানে বাথরুমের সমস্যা, রাতে শোয়ার সমস্যা, স্নানের সমস্যা – আরও হরেক রকমের ব্যাপার আছে যা সবার পক্ষে অ্যাডজাস্ট করা মুশকিল। এতদুর থেকে জার্নি করে এসেছিস, তোর একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার, রেস্ট নেওয়া দরকার, কিন্তু এই বিয়েবাড়ীতে এদের পক্ষে তোকে সেই কমফোর্ট দেওয়া সম্ভব নয়। এসব ভেবেচিন্তে আমি আসানসোলের একটা হোটেলে দুটো রুম বুক করে রেখেছি গত পরশু দিন। তোর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে যেতে পারি।
-- তা কী করে সম্ভব? অতসীই বা কী ভাববে?
-- কী ভাববে! হোটেলে যাব বলার দরকার নেই। আমি বলবো আমার এক অফিস কলিগের বাড়ি এখানে। ওর বাড়িতে যাব ।
-- বিয়ে বাড়ী এসে এভাবে চলে যাওয়া কেমন দেখায়?
-- দেখ, আমরা এখন এখান থেকে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করেই বেরাব। সঙ্গে তো গাড়ী আছে, চিন্তা কী?
-- আবার কি সন্ধ্যায় আসবি?
-- হ্যাঁ। একটু স্নান টান করে রেস্ট নিবি। সেজেগুজে বিকেলে আবার চলে আসবো। রাত্রে খাওয়া দাওয়া করে আবার চলে যাবো।
-- অতসীর খারাপ লাগবে।
-- দ্যাখ ইতি, ও খুশিই হবে। ওর নিজেরই খারাপ লাগছে এখানে আমাদের ঠিকমত অ্যাকোমোডেট করতে পারছে না বলে। ওর নেহাত বাপের বাড়ী, এখানে তো সত্যি ওর কিছু করার নেই। শহরের দিকে হলে না হয় লজ টজ ভাড়া নেওয়া যায়। এই গ্রামে ওরা কী করবে? আমার মনে হয় আমাদের এই প্রস্তাবে ওরা খুশিই হবে।
-- শৈল, তাহলে এক কাজ কর, তুই আগে থেকে অতসীকে ব্যাপারটা গেয়ে রাখ। এই দুপুরে আর যাব না। একেবারে রাত্রে খেয়ে দেয়ে চলে যাব।
-- তুই সাজবি কি করে এখানে এত লোকের ভিড়ে?
-- এদের মেয়েরা যেভাবে সাজবে, সেই ভাবেই করে নেবো, একটা দিন আর কি!
-- অসুবিধে হবে তোর।
-- আমার তো তাও একটা ঘর জুটেছে। তোর তো প্যান্ডেলের চেয়ার। অসুবিধাটা বরং তোর হবে।
-- আমাদের পুরুষ মানুষের আবার কী অসুবিধা? আমি সবখানেই মানিয়ে নিতে পারি। টয়লেট টাই শুধু আমার একটু ফ্যাসিনেশন, তাও এক আধ দিন আমি যে কোনও ভাবে চালিয়ে নিতে পারি।
-- তুই আমাকে রিজিড ভাবিস না। আমিও মানিয়ে নিতে পারি। নে চল, গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করি, নইলে আবার খোঁজাখুঁজি শুরু হবে।
সন্ধের সময় চা টা খেয়ে শৈলেশ কোথায় গিয়ে ড্রেসটা চেঞ্জ করবে এসব ভাবছে, এমন সময় দেখল ওর কাঁধে একটা নরম স্পর্শ। ফিরে দেখল – ইতি। কী অপূর্ব লাগছে আজ ওকে, বলার নয়। সুন্দর কালো রঙের একটা জারদৌসি শাড়ীর সাথে গোল্ডেন ব্লাউজ – দারুন সাজ। চুলগুলো সুন্দর করে একটা খোঁপায় বাঁধা পড়েছে, চোখে হালকা কাজল। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইতি বলল, কীরে প্রথম দেখছিস নাকি?
-- তাই তো মনে হচ্ছে।
-- শোন না শৈল, কোন হারটা পরবো ডিসাইড করতে পারছি না। তারপর ভাবলাম তোর তো মেয়েদের হ্যান্ডেল করার অনেক এক্সপিরিয়েন্স তাই তোকেই জিজ্ঞাসা করতে এলাম।
-- তোর প্রাইমারি চয়েস কী কী?
-- এই মুক্তোর ছড়াটা পড়বো না কি জড়োয়া সেট?
-- আইডিয়ালি তোর জরদৌসীটা এত ব্রাইট আর তোকে এত সুন্দর মানিয়েছে যে হালকা মুক্তোর ছড়াটা মানাবে ভালো। তবে এটা আসানসোল এবং গ্রামদেশ। এখানে জড়োয়া বা এই জাতীয় ভারী কিছু না পরলে অতসীর মান থাকবে না।
-- জড়োয়াটা যাবে তো?
-- ভালোই যাবে, তবে এই টিকলিটা পরিস না। আর কাজলটা আরও গাঢ় করে দে।
-- আরে আয়নার সমস্যা। একটাই বড় আয়না, তার সামনে অন্তত পাঁচ-ছ’জন। যা হয়েছে এই অনেক।
-- আমার গাড়ীটা তো সামনেই আছে। চল না ওর মধ্যে বসে কাজলটা পরে নিবি।
-- লোকে দেখলে হাসবে।
-- কেউ দেখতে পাবে না, চল গাড়িটা উল্টো দিকে মুখ করে ঘুরিয়ে দিচ্ছি।
-- তুই কোথায় চেঞ্জ করবি?
-- তাই তো ভাবছি রে। বাথরুমটা রাজ্যের লোক ব্যবহার করছে। এমন ভেজা ভেজা যে ওখানে ওই শেরওয়ানির চুড়িদার পরা যাবে না।
-- তাহলে উপায়?
-- ওই ওদিকে একটা গোয়াল ঘর আছে দেখছি। ওখানেই তোয়ালে নিয়ে গিয়ে চেঞ্জ করে নেব।
-- যাঃ। ওসব আদাড়ে-বাদাড়ে যাস না। সাপে খোপে কাটবে।
-- এখন শীতকাল। ওই ভয়টা নেই।
-- ঠিক আছে চল গাড়ির কাছে, তোর জামা কাপড়ও নিয়ে নে। আমি সরজমিনে জায়গাটা দেখে নিই, তারপর তুই চেঞ্জ করে নিস।
-- ইতি সারা দুপুর তোর খুব কষ্ট হয়েছে না রে? শাড়ি পরে এতগুলো অপরিচিত লোকের মাঝে।
-- ও আর কী করা যাবে। তবে খুব অ্যাসিড হয়েছিল জানিস। বাথরুমে গিয়ে বমি করে এলাম।
-- আমাকে ডাকিস নি কেন?
-- তুই কি ডাক্তার নাকি?
-- ডাক্তার না হই, টুকটাক ওষুধ জানি। সঙ্গে ক্যারিও করি। কোনো প্রয়োজন হলে বলিস, সবরকম ওষুধ আছে আমার কাছে।
-- তুই ডাক্তারি আবার শিখলি কবে?
-- আমার এক ডার্লিং আছে, ডাক্তার।
-- কে অঙ্গনা?
-- না। এটা আরেকটা। আমার এক বন্ধুর বউ।
-- বন্ধুর বউকেও ছাড়ছিস না তুই?
-- ধরছিটাই বা কেমন? আমার এইসব বাক্যে ওরা খুশিই হয় ইতি। পীড়িত হয় না। শোন না তোর মোবাইলটার পাসওয়ার্ড খুলে দে তো। ছবিগুলো এডিট করে দিই।
রাত ন'টা সওয়া ন’টা নাগাদ ওরা খেয়েটেয়ে রওনা হল হোটেলের দিকে। যেতে যেতে শৈলেশ বলল, 'কাল জয়চন্ডী পাহাড় যাবি? এখান থেকে এক ঘন্টার রাস্তা।'
-- নাম শুনেছি তো। যাইনি কোনওদিন?
-- জানিস তো ওখানে 'হীরক রাজার দেশ' এর শুটিং হয়েছিল। দারুন পাহাড়টা।
-- তুই কবে গেলি?
-- ওখানে একটা অডিট করতে গিয়েছিলাম। কী দারুন যে জায়গাটা, কল্পনা করতে পারবি না।
-- কখন যাবি?
-- এই ধর সকাল আটটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যাবো। সাড়ে বারোটা একটা নাগাদ ডাইরেক্ট অতসীদের বাড়ী চলে যাবো। ওখান থেকে খেয়েদেয়ে আবার কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব।
-- বরযাত্রীরা কখন যাবে?
-- সকালেই ম্যাক্সিমাম চলে যাবে। বর, মেয়ে আর দু একজন সন্ধের সময় যাবে। এদের নাকি সেরকমই রেওয়াজ। সুতরাং সকালে আমরা জলখাবার খেতে না গেলে অতসী কিছু মনে করবে না।
-- তুই কি জয়চন্ডী যাবার ব্যাপারে অতসীকে কিছু বলে এসেছিস?
-- হিন্টস দিয়েছি। তুই কনফার্ম করলে সকালে ওকে বলে দেব।
-- চল এসেছি যখন একটু বেড়িয়েও যাই।
মিনিট কুড়ির মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেল ওরা। খুব হাইফাই না হলেও খারাপ নয়। ইতিকে ওর ঘর দেখিয়ে শৈলেশ নিজের ঘরে গেল। বলে গেল ফ্রেশ হয়ে ওকে যেন ইতি একবার কল করে। মিনিট কুড়ি বাদে ইতি বলল, ‘ফোন করতে বলেছিলি।’
-- হ্যাঁ। আমি একটু তোর ঘরে আসছি। দু মিনিট ওয়েট কর। একটু বাদে ইতি দেখল শৈলেশ দুটো চাদর, একটা মসকুইটো রিপেল্যান্ট, ওডোমস, একটা ব্রাশ, ছোট টুথপেস্ট আর হ্যান্ডওয়াশ নিয়ে ওর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে।
-- ইতি বলল, 'এসব কী'
-- আগে ঘরে তো ঢুকতে দে।
ঘরে ঢুকে ইতির খাটের উপর একটা বিছানার চাদর পেতে আর একটা চাদর ব্ল্যাঙ্কেটের তলায় সেট করে দিল।
-- চাদর দিচ্ছিস কেন শৈল? এদের চাদর তো পরিষ্কার।
-- আরে হোটেলের চাদর কি ভরসার যোগ্য। দ্যাখ গিয়ে কাল এতে কেউ শুয়ে গেছে কি না!
-- যাঃ।
-- যা নয় রে। ছোটখাটো হোটেলগুলো এরকমই করে। তাছাড়া যদি কাচাও দেয় ধোবিরা কোন জলে ধোয় তার ঠিক আছে?
-- তোর এত পিটপিটানি হল কবে?
-- শুচিবায়ু স্ত্রীর সাথে ঘর করি। একটু আধটু গুণ কি আমার আসবে না? আর ব্ল্যাঙ্কেট - এটাতো হান্ডেট পার্সেন্ট সিওর যে তিন মাসের আগে ব্ল্যাঙ্কেট ধোওয়া হয় না।
-- এটাও কি তোর কোন ডার্লিং বলেছে?
-- সব কি ডার্লিং বলবে?
-- তুই দুটোই আমাকে দিয়ে দিলি, তুই নিবি কী?
-- আমার আছে।
-- আছে মানে? তুই কি চারটে চাদর এনেছিলিস নাকি?
-- হ্যাঁ। তোর জন্য দুটো এনেছি।
-- ঘরের চাদর বাইরে এনেছিস, তোর বউ কাচতে গিয়ে তো তোকেই ধুইয়ে দেবে।
-- সে গুড়ে বালি। আমার জামা কাপড়, তোয়ালে চাদর টুসী ছোঁয় না। ওসব আমিই কাচি। সুতরাং ও খবর রাখে না এসবের।
-- মানে?
-- মানে মেশিনে ঢোকাই, মেলে দিই। শুকোলে রাত্রে গিয়ে তুলে রাখি।
-- আর এগুলো? ব্রাশ পেস্ট তো পার্সোনাল লায়াবিলিটি, আমি এনেছি।
-- আমি নিয়ে এলাম বাই চান্স ভুলে যাস যদি।
-- মসকুইটো রিপেলেন্ট অনলি কেন? এরা দিয়েছে তো!
-- এদেরটায় কোনও ভরসা নেই। শুনেছি অর্ধেক ওষুধ অর্ধেক জল মিশিয়ে রাখে।
-- তোর আবার বাড়াবাড়ি। এমন কেউ করে?
-- তোর রিক্স নেবার দরকার কী? বিদেশ বিভূঁয়ে এসে মশার কামড় খেয়ে বাড়ী যাবি? এইটা আমি লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছি, শোওয়ার আগে পায়ের পাতায়, হাতে একটু ওডোমস লাগিয়ে নে।
-- তুই এতটা আমার জন্য ভেবেছিস, এর জন্য থ্যাঙ্কস।
-- শোন না, তুই কি বাথরুমে যাবার চটি জুতো এনেছিস?
-- না। এই চামড়ার জুতো দিয়ে চালিয়ে নেব।
-- এক কাজ কর, আমি এজন্য দুটো চটি এনেছি। লেডিস চপ্পল নয়। আর আমার মাপের। আশা করি বাথরুমের কাজ ওতে চলে যাবে। তুই দরজাটা আপাতত লাগিয়ে দে, আমি নিয়ে আসছি।
-- আরে ছাড় না। লাগবে না।
-- কষ্ট করে এনেছি যখন ব্যবহারে লাগুক। বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল শৈলেশ। একটু বাদে একটা চটি জুতো নিয়ে এসে উপস্থিত হল সে। বলল, ‘কাল সকাল সাড়ে ছ’টার মধ্যে উঠে স্নান টান করে নিস। সকালেই আমরা চেক আউট করে নেবো। নইলে আর সময় হবে না। তোর কি ভোরে ঘুম ভাঙ্গে, না কি আমি তুলে দেবো?’
-- তার দরকার হবে না। অ্যালার্ম দিয়ে রাখবো।
-- বেশ, সাড়ে সাতটার মধ্যে তৈরী হয়ে আমাকে কল করিস। রুমে চা ব্রেকফাস্ট করে নেবো তবে। আর শোন, তুই কি সালোয়ার আনিসই নি?
-- না, কেন বল?
-- জয়চন্ডীতে শাড়ী পড়ে উঠতে অসুবিধা হবে।
-- আসলে আমি ভাবলাম ওদের বাড়িতে পরার যখন কোনও চান্সই নেই মিছিমিছি বইবো কেন।
-- বেশ করেছিস। চল গুড নাইট।
-- গুড নাইট।
শৈলেশ চলে যেতে খাটটায় আয়েশ করে গা এলিয়ে দিল ইতি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটু ফেসবুক, একটু হোয়াটসঅ্যাপ করতে করতেই হঠাৎ মনে পড়ল ওর ছবিগুলো সন্ধ্যায় শৈলেশ এডিট করতে নিয়েছিল। কী করল দেখি। গ্যালারি খুলেই নিজেই অবাক হয়ে গেল সে। নিজেকে এত সুন্দরী কখনও মনে হয়নি তার। কী অসম্ভব ভালো ফটোগ্রাফিক সেন্স ওর। গাছের সাথে অ্যাঙ্গেল করে করে কী সব সুন্দর পোজ দিতে বলেছিল ওকে। সত্যি সত্যি নিজেকে এই বয়সও প্রজাপতি বলে মনে হল তার। নিজের হাতে তিনবার অল্প অল্প থুতু ছিটিয়ে দিল সে। 'চশমে বদ্দু!' রাতের বিয়ে বাড়ীর কিছু ছবিও তুলে দিয়েছে শৈলেশ। ওগুলো এডিট করা নয়, তবুও সুন্দর। হঠাৎ টুসীর কথা মনে পড়তে মনটা খারাপ হয়ে গেল ইতির। এত প্রাণোচ্ছল শৈলেশ, অথচ বাড়ীতে বেচারার সুখ নেই। এজন্য কি ও মেয়ে পটিয়ে সুখ পায়? অবশ্য তাই বা কেন? এ সমস্যা তো হালফিলের। শৈলেশের এমন ভাবমূর্তি তো তার ওই ইলেভেন টুয়েলভ ক্লাস থেকে। ওই সব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো সে।
(২)
সকালে তৈরী হয়ে ওরা যখন জয়চন্ডীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল তখন সকাল ঠিক আটটা। টাইমের ব্যাপারে ইতি দেখল শৈলেশ একদম পারফেক্ট। আসানসোল থেকে জয়চন্ডীর রাস্তাটা ভারি চমৎকার। শৈলেশ বলল, 'আর যদি দুই তিন মাস পরে আসতিস তবে এই রাস্তা দেখে পাগল হয়ে যেতিস ইতি। চারিদিকে শুধু লাল আর লাল। আর এই দুদিকে দ্যাখ কী সুন্দর সুন্দর সব পাহাড়। আর তেমনি রাস্তা। উঁচু নীচু এমন ঢেউ খেলানো, যেন ছবিতে আঁকা। জয়চন্ডীতে পৌঁছতে ন’টা বেজে গেল। শৈলেশ বলল, ‘চল, আগে কালী মন্দিরের পাহাড়টায় উঠি। এরপরে রোদ বেড়ে যাবে। তখন বরং পেছনের পাহাড়টায় যাবো।’
কালী মন্দিরের পাহাড়টা তাও ওঠা যায়। খুব স্টিফ নয়। তবে একদম উপরের চূড়াটা বেশ স্টিফ। অত দূর পর্যন্ত উঠে ইতি বলল, ‘শৈল আর পারবো না। তুই বাকিটা ওঠ।’
-- তা কি হয় রে। এভারেস্ট নাই হোক জয়চন্ডীটাতো একসাথে জয় করি। তুই এক কাজ কর জুতোটা খুলে আমার হাতে দে।
-- যাঃ।
-- যা নয় রে। এই জুতো পরে উঠতে পারবি না। পা মচকে যাবে। তারপর প্রায় টেনে ঠেলে কোনওরকমের চুড়োতে পৌঁছালো ওরা দুজন। খানিকক্ষণ বসে শৈলেশ বলল, ‘চল এবার ফিরি।’
-- ইচ্ছে করছে না শৈল। মনে হচ্ছে এর উপরটাই বসে থাকি। কখনও এরকম পাহাড় চূড়োয় উঠিনি। আর একটুখানি বসি?
-- ওদিকে আরও দুটো পাহাড় আছে, দেখবি না?
-- যাবো। একটুখানি বসে নিই।
হঠাৎ শৈলেশ দেখলো ইতি একটুখানি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। কোথাও যেন অস্বস্তি হচ্ছে তার। জিজ্ঞেস করল, 'কি হয়েছে তোর? পেটে ব্যথা হচ্ছে?’
-- না।
-- তবে এমন গুটিসুটি মেরে বসে আছিস কেন?
একটুক্ষণ চুপ থেকে ইতি বলল, ‘শৈল আমাকে কাছাকাছি কোনও মেডিক্যাল শপে নিয়ে যাবি?’
-- তোর কী হয়েছে বল না। টুকটাক সব ওষুধ আমার গাড়ীতে আছে।
-- আমাকে দোকানেই যেতে হবে।
-- সে তো দূর আছে। হয় রঘুনাথপুর যেতে হবে, নয় আদ্রা। আদ্রাটা বোধহয় দূর হবে।
-- তা হোক, চল তাড়াতাড়ি।
-- তোর কি ন্যাপকিন দরকার?
-- হ্যাঁ।
-- তুই এখানেই বোস। আমি নিয়ে আসছি।
-- আমাকে এই টঙে একা ফেলে যাবি? না না আমিও যাবো।
-- দ্যাখ ইতি, যদি আবার তোকে কসরৎ করে নামতে হয়, তোর আরও কন্ট্রাকশন হবে। এইসব অঞ্চলের লোকজন ভালো। তুই নিশ্চিন্তে থাক। আমি নিয়ে উপরে আসছি।
-- শুধু আনলে তো হবে না, আমাকে তো পরতেও হবে। নিয়ে চল আমায়।
এবার প্রায় পাঁজাকোলা করেই ঐ চুড়ো থেকে পরের ধাপে ইতি কে নামিয়ে দিল শৈলেশ। তারপর হাত ধরে ধরে খুব সন্তর্পনে নীচে নেমে এলো ওরা। শৈলেশ বুঝতে পারছে ইতি খুব কায়দা করে ওর থেকে পিছিয়ে পিছিয়ে হাঁটছে। শৈলেশ হঠাৎ করে ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল ‘চিন্তা করিস না, দাগ লাগেনি।’
ইতি লজ্জা পেয়ে হাসলো একটু। শৈলেশ বলল, 'তুই এত হেজিটেট করছিস কেন ইতি? প্রথম কথা এটা বায়োলজিক্যাল একটা ব্যাপার, দ্বিতীয় কথা আমি নিজে বিবাহিত। ফলে এইসব বিষয় বা প্যাড কেনা ইত্যাদি আমার সিলেবাসে কমন। তুই এই নিয়ে বিব্রত হোস না। বরং কলকাতায় ফিরে একটা ইউ. এস. জি করিয়ে নিস।
-- ইউ.এস.জি কেন?
-- দ্যাখ এই বয়সে পিরিয়ড ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। তোর নিশ্চইয়ই এই সময়ে হওয়াটা একেবারেই আনএক্সপেক্টেড। তাহলে তুই কোনো প্রিকোশন নিয়ে রাখতিস। হঠাৎ করে এই যে একটা 'এক্ষুনি হয়ে যাবে' ফিলিংসটা তোর হচ্ছে, এটা অনেক সময় ভেতরে সিস্ট ফিস্ট থাকলে হয়। সেজন্য কোনো ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করিয়ে নিস।
-- এই দ্যাখ না, এই মোড়ে একটা মুদি দোকান আছে। শৈল, দেখবি? এসব দোকানেও থাকতে পারে।
-- তোর কি কোনও ব্রান্ড ফ্যানসিনেশন আছে?
-- তুই যা পাবি তাই আন।
ভাগ্যক্রমে পাওয়াও গেল। ইতি বলল, ‘এদিকে তো পাবলিক টয়লেট নেই, কী হবে?’
-- চলনা ওই পাহাড়ের আড়ালে। একটা কোন খাঁজ দেখে চেঞ্জ করে নিস। এদিকে লোকজন নেই।
--না বাবা। ও আমার দ্বারা হবে না। পাহাড়ের খাঁজ খোঁজে কী জীবজন্তু লুকিয়ে আছে কে জানে?
-- এখানে কিছু নেই। তুই চল না। আমি তো তোর সাথে আছি। আগে আমি চেক করে আসবো, তারপর তুই যাস।
-- কোনও ঘেরা জায়গা ছাড়া আমার পক্ষে চেঞ্জ করা সম্ভব নয় শৈল। আমি পারিনা।
-- শোন না তুই আমার গাড়ীর মধ্যে ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবি?
-- চারিদিকে কাচ, সব দেখা যাবে তো?
--না রে, এই পাহাড়টার পেছনে একটা পাহাড় আছে, গুহা মতো। চল ওখানে যাই। ওই দিকটাই বেশ নির্জন।
-- গুহায় ঢুকবো নাকি?
-- না রে বাবা। গাড়িটা ওই দিকে নিয়ে যাই চল। এবার ওই পাহাড়ের দিকে পেছন করে গাড়ীটা লাগাই। সাইডের কাচ গুলোয় সানস্ক্রিন লাগানো আছে। এক্সট্রা স্ক্রীনও আছে। লাগিয়ে দেবো কেউ দেখতে পাবে না। সামনের কাচে আমার গাড়ী মোছা কতগুলো কাপড় আছে, ওই গুলো দিয়ে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুই চল কোনও অসুবিধা হবে না।
চারিদিকে কাচ ফাচ ঢেকে শৈলেশ বলল, ‘তুই ভেতরে ঢুকে পরে নে। আমি একটু ওই দিকটায় যাচ্ছি। পেছনের সিটটায় চলে যা।
-- কিন্তু কেউ যদি দরজা খুলে দেয়?
-- কেউ খুলবে না। তুই ভেতর থেকে লক করে দে।
-- তুই দূরে যাস না শৈল। এখানেই দাঁড়া।
-- আরে বাবা, তুই কর না, ভয় কি? দরকার পড়লে ফোন করবি।
-- তোর দূরে যাবার দরকার কী শুনি? সিগারেট ফুঁকতে যাবি?
-- হ্যাঁ।
-- কোনও সিগারেট ফিগারেট খাওয়ার দরকার নেই। তুই এখানেই দাঁড়া। তুই চলে গেলে আমি ভয় পাবো।
সামান্য কথা। তবু কথাগুলো ছুঁয়ে গেল শৈলেশের বুকের একদম ভেতরটা। বলল, ‘ঠিক আছে আমি এখানেই আছি। তুই নিশ্চিন্তে কর।’
ইতি দেখল শৈলেশ গাড়ীর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। ও একটা স্লিমফিট টাউজার আর উপরে একটা পাঞ্জাবী পরে আছে। ও বেশ লম্বা। এতটা কখনও ওকে খেয়াল করেনি ইতি। এখনও মাথায় ভর্তি কালো চুল। কলপ করে নাকি? না বোধ হয়। কলপ করলে কখনও না কখনও বোঝা যায়। দু চার মিনিটের মধ্যেই পোষাক টোষাক ঠিক করে লক খুলতে যাবে হঠাৎ করে ওর নজরে পড়ল পেছনের ডিকিতে রাখা কয়েকটা বইয়ের দিকে। রবি ঠাকুরের রক্তকরবী, গার্সিয়া মার্কোসের গল্প, শঙ্করের অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ, জয় গোস্বামীর 'বিষাদ'। শৈলেশ মানে আমাদের শৈল এসব বই পড়ে? এসব পড়ে বোঝার মত ধৈর্য্য এবং স্থিরতা আছে তার? কোথাও যেন ওর মিলছে না কিছু। বইগুলো হাতে নিয়ে দেখলো পড়ার চিহ্ন রয়েছে ওদের গায়ে। ধীরে ধীরে লকটা খুলে বাইরে এলো সে। বাইরে বেরিয়ে দেখলো, শৈল এখনও উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ও খুব মৃদু গলায় ডাকলো ‘শৈল!’
শৈলেশ পেছন ফিরে দেখে বলল, ‘হয়ে গেছে?’
-- হ্যাঁ।
-- এই পাহাড়টায় একটু বসবি, নাকি?
-- চল, বসি।
-- ইতি, ওই যে সামনের পাহাড়টা দেখছিস ওখানেই রবি ঘোষ আর তপেন গাঙ্গুলি হাতে হাতে তালি বাজিয়েছিলেন। আর ওই গুহাটায় সৌমিত্র লুকিয়েছিলেন।
-- শৈল, এই সময়ে মনটা একটু চা, চা করছে। এখানে তো কাছাকাছি কিছু পাওয়া যাবে না?
-- কেন যাবে না? রানীর ইচ্ছে হচ্ছে আর তার হুকুম তামিল হবে না, তা কি হয়? তুই বস আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
-- কোথাও যেতে হবে না। তোর ইচ্ছেটা কী বলতো শৈল? যখন তখন বনে বাদাড়ে আমাকে ফেলে তুই পালাতে চাইছিস কেন? তুই কি চাইছিস আমাকে শেয়ালে ভাল্লুকে খাক?
-- 'তোমাকে স্পর্শীতে না রে দেবের শকতি' – বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে আউড়ে শৈলেশ বলল, ‘রক্ষী উপস্থিত থাকতে তোমাকে স্বয়ং দেবতা ও স্পর্শ করতে পারবে না, হে রানী।’
-- রানীকে রক্ষী যদি তুই তোকারি করে, তবে তার কি গর্দান থাকবে?
-- গর্দান তো কবে দিয়ে দিয়েছি রানী! মড়ার আবার খাঁড়ার ভয় কি?
-- তুই চা কোত্থেকে আনবি শুনি?
-- এই তো গাড়ীতে আছে।
-- মানে?
-- দেখ না, অপেক্ষা কর একটু।
একটু বাদে শৈলেশ একটা ফ্লাক্স, দুটো কাগজের কাপ, ছোট ছোট ডেয়ারি মিল্কের পাউচ, চিনির পাউচ আর ডিপ টি নিয়ে হাজির হল।
-- তুই গরম জল কোত্থেকে পেলি? ইতির গলায় বিষ্ময়।
-- আমি ছোট ওয়াটার হিটার সবসময় ট্যুরে ক্যারি করি। হোটেল থেকে গরম করে ফ্লাক্সে ভরে এনেছি।
-- তুই যেখানে যাস এতসব নিয়ে যাস?
-- সঙ্গে গাড়ী থাকলে তো নিই ই। বাকিটা অবস্থা বুঝে।
-- তুই এতটা গোছালো, ভাবতেই পারি না রে শৈল। তুই বরাবরই একটা কেয়ারলেস টাইপের ইমেজ ক্যারি করতিস। এই জন্যই লোকে বলে মানুষের সাথে এক দু রাত কাটালেই বোঝা যায় আদপে মানুষটা কেমন।
-- এতটাও আবার গোছানো নই রে ইতি। জীবনে পথ চলতে গিয়ে যেটুকু শিখি ততটুকু পরের পথ চলায় পুঁজি করে নিই।
-- এখানকার পরিবেশটা কী সুন্দর না রে শৈল? মনে হচ্ছে না দৈনন্দিন জীবন থেকে কোথায় যেন হারিয়ে গেছি?
-- একটা গান কর না ইতি।
-- কী গাইবো বল।
-- ইচ্ছে তো হয় একটা আমার মাপের ‘লারে লাপ্পা’ শুনি। তবে তোর তো আবার রুচির ব্যাপার আছে। তোর পছন্দের একটা রবীন্দ্র সংগীত কর।
ইতি ইচ্ছে করেই রক্তকরবীর একটা গান গাইল। 'যুগে যুগে বুঝি আমায় চেয়েছিল সে/ সেই বুঝি মোর পথের ধারে রয়েছে বসে...
-- বাঃ। ভারী সুন্দর।
-- বল তো শৈল, কোন নাটকের গান এটা?
-- কেন বাবা আমার পরীক্ষা নিস? ফেল করাবি বলে? আমি তো এ পথের পথিক নই। তুই আমায় জিজ্ঞাসা কর ‘চল ছাঁইয়া ছাঁইয়া’ কোন ফিল্মের গান, লিরিক কার, কে গেয়েছে – সব বলে দেব।
-- তোর গাড়ির পেছনে রক্তকরবী বইটা দেখলাম, ওটা পড়েছিস?
-- দূর। ওসব কি আমি বুঝি? ও তো তোকে দেখাবো বলে রেখেছি। তোর আবার এসব পছন্দ কিনা।
ইতি মনে মনে বলল 'যেন তুই জানতিস আমি তোর গাড়ীর পেছনে গিয়ে বসব।’ অদ্ভুত মানুষ তো শৈল। এ জীবনে যত মানুষ সে দেখেছে, সবাই নিজেকে তাদের স্বাভাবিক অবস্থার থেকে উন্নততর হিসাবে পেশ করেছে, শুধু শৈলই ব্যতিক্রম। ও কখনও নিজেকে প্রকাশিত করেই নি বরং নিজেকে তুলনায় হীন প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে এতদিন। কী লাভ এতে? কেমন ধরনের খেলা এ? কোথাও যেন শৈলর প্রতি একটা শ্রদ্ধা এসে বসেছে ওর মনে।
শৈলেশ বলল, ‘চল উঠি এবার। সওয়া এগারোটা বাজে। অতসীর বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে বারোটা হয়ে যাবে।’
৩
অতসীর বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে যখন ওরা কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরোনোর জন্য তৈরি হল তখন বিকেল চারটে। মেয়ে জামাই একটু পরে বেরোবে। শৈলেশ বলল, ‘ইতি ওদের আগে না বেরোতে পারলে আমাদের কিন্তু বেরোতে ছ’টা বেজে যাবে। তাড়াতাড়ি ফর্মালিটিগুলো সেরে নে।’
-- চল, তোর গিফট টিফটগুলো দিয়ে দিয়েছিস?
-- ও আমি কাল এসেই অতসীর হাতে দিয়ে দিয়েছি। জামাই এর টা এখন দিয়ে দেব। তুই আগে দিয়ে নে।
সবকিছু আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই মিটিয়ে নিল শৈলেশ। ইতি যেন কেমন চুপচাপ হয়ে আছে আজ। সকালের ব্যাপারটা নিয়ে কি ও এমব্যারাসভ। ছোটবেলার বন্ধু। এতটা সিরিয়াসলি এসব বায়োলজিক্যাল ব্যাপারগুলো না নেওয়াই ভালো। তাছাড়া বিষয়টা একটা অঘটনই। কিছুটা হালকা করার জন্য শৈলেশ বলল, আজকাল এসব জায়গাও কলকাতার ওপর দিয়ে যায় বুঝলি?
-- কেন?
-- এই দেখলি না বাড়ীতে এত লোকজন, অথচ বর কনের গুরু লঘু বিচার নেই। যখন তখন হাত ধরছে, জড়িয়ে ধরছে, আমি তো একবার চুমু খেতেও দেখেছি।
-- আজকালকার ধারাই এই। ভেতরের জিনিস এখন সব বাইরে দেখানোটাই রীতি। আমি বাবা পুরোনো ভাবধারার লোক। এসব দুচক্ষে দেখতে পারি না।
-- কিছু যদি মনে না করিস, একটা কথা বলব?
-- বল না।
-- তোর যদি এত অপছন্দ, তবে ওই গাড়োলটা, স্যরি অরূপ সবার সামনে তোকে জড়িয়ে টড়িয়ে চুমু খায় কেন? তোকে তো বাধা দিতে দেখি না।
-- কী করব? সিনক্রিয়েট করব?
-- কেন ভালো করে বুঝিয়ে বলবি, তোর অপছন্দের কথা জানাবি। তোর ছোটবেলার যা ভাবমূর্তি, তোকে এই অবস্থায় দেখলে আমারই খারাপ লাগে। রাগে গা রি রি করে।
--ও কোন লাভ নেই।
-- কেন? অরূপের ভালোবাসা কি খুবই লাউড?
-- বুঝিস না, ফোঁপরা জিনিসেরই দেখনদারী বেশি।
-- মানে?
-- মানে পুরোটাই শো অফ। লোকজনের সামনে দেখানো আমরা কতটা সুখী দাম্পতি।
-- বলিস কী রে ইতি।
-- ওর তো বাইরে একটা মিস্ট্রেস আছে।
-- থাক ইতি, এসব শুনতে চাই না। তুই এমন লোকের সাথে থাকিস আমি ভাবতেই পারবো না রে।
-- প্লিজ শৈল, তুই দয়া করে শোন। পৃথিবীতে কাউকে তো বলতে চাই এই কথা। কতদিন বুকে চেপে রাখব এই পাথর? কতদিন সবাইকে দেখাবো, দেখ কত সুখী আমি? শোন, জানি তোর কষ্ট হবে। তবুও শোন।
-- আচ্ছা বল। কে সে?
-- ওর অফিসেরই এক কলিগ। ডিভোর্সি। মাঝে মাঝে গিয়ে ওর ফ্ল্যাটে থাকে। ওর সাথে সিনেমা যায়, ঘুরতে যায়। দ্যাখ গিয়ে গতকাল দিল্লি যাবার নাম করে ওখানে আছে কিনা।
-- তুই কিছু বলিস না?
-- আগে আগে বলতাম। এই নিয়ে এত অশান্তি হত যে মারামারি গালাগালি কিছু বাকী রাখত না। জানিস তো এসব আমার রুচিতে বাধে। ওইসব নোংরা নোংরা কথা শুনলে আমার তো মনে হতো মাটির মধ্যে মিশে যাই। ধীরে ধীরে সব বলাবলি বন্ধ করে দিয়েছি। ও ওর মতো থাকে, আমি আমার মত।
-- তুই জানলি কী করে।
-- টুকটাক এটা ওটা দেখে সন্দেহ তো ছিলই। একদিন ওই মেয়েটার বর এসে বাড়িতে হুজ্জতি করে গেল। সেই দিনই বিষয়টা প্রকাশ্যে এল।
-- তুই তো চাকরি করিস। তুই ওকে ছেড়ে বেরিয়ে এলি না কেন?
-- আমি বড় ক্লান্ত হয়ে গেছি রে শৈল। এত লড়াই করতে করতে আর নতুন করে লড়ার উদ্যম আমার ফুরিয়েছে। দেখিস না, খাঁচায় থাকতে থাকতে পাখি দোর খুলে দিলেও আর উড়ে যায় না! রাস্তার মেয়েরা ওই নোংরা কাজে থাকতে থাকতে আর সুযোগ পেলেও পালায় না – আমার অবস্থা সেরকমই। ওই বাড়িতে, ওই পরিবেশে নিজেকে এমন ভাবেই মানিয়ে নিয়েছি যে আর স্বর্গেও যেতেও মনে দ্বিধা লাগে। ভাবি ওখানে আবার মানিয়ে নিতে পারবো তো?
-- তোদের কথাবার্তা হয়, নাকি মুখ দেখাদেখি বন্ধ?
-- না না। দাম্পত্যের ষোলআনা দাবি আছে।
-- তুই রাজি হোস কেন?
-- ওই যে বললাম, বাধা দিতেও আর ইচ্ছে করে না। মনে হয় যাক বাবা এটুকু হলেই যদি বাক্য চালাচালি বন্ধ হয়, তাই সই।
-- এসবের জন্য বাইরের দুয়ার তো খোলাই। ঘরে হুটোপুটির দরকার কী?
-- এখন তো দুনিয়া হাতের মুঠিতে শৈল। সমস্ত ব্যক্তিগত গোপন পরিসর এখন শুধুমাত্র একটা আঙুল ছোঁয়ার অপেক্ষায়। যখন অরূপ বাড়িতে থাকে ওইসব নিয়েই থাকে। যখন ভার্চুয়ালি ব্যাপারটা মেটে না তখন জ্যান্ত কারোর দরকার হয়।
চুপ করে রইলো শৈলেশ। এখন আর কিছু ভালো লাগছে না তার। একটা ধাবা দেখে গাড়ি দাঁড় করালো সে। ইতি কে বলল ‘নামবি, নাকি এখানে চা নিয়ে আসবো।’
-- চল নামি।একটু পা-টাও ছাড়বে।
-- তোর কি পেটে ব্যথা হচ্ছি ইতি? চাইলে আমার কাছে ওষুধ আছে।
-- হচ্ছে অল্প অল্প, তবে সইতে পারবো। চট করে ওষুধ খাই না আমি।
-- বেশ, নেমে আয়।
দরজাটা খুলে আস্তে করে ইতির হাত ধরে নামিয়ে দিল শৈলেশ। বলল, ‘এখানে টয়লেট আছে, যাবি?’
-- যাব, চা টা খেয়ে নিই।
চা খেয়ে আবার গাড়ী স্টার্ট দিলো শৈলেশ। অনেকক্ষণ দুজনের কারোরই মুখেই কোনও কথা নেই। শৈলেশ বলল ‘গান শুনতে পারিস। বিক্রম সিং শুনতে ইচ্ছে না হলে অন্য কিছু লাগাতে পারি।’
অন্যমনস্কভাবে ড্যাশবোর্ডের ডালাটা খুলে সিডিগুলো বের করল ইতি। অধিকাংশই রবীন্দ্রসঙ্গীত, নইলে পুরোনো দিনের গান - হিন্দি বাংলা মিলে। দু একটা গজল এবং ঠুংরীরও দেখা মিলল। তথাকথিত ‘লারে লাপ্পা’ তো একটাও নেই। ইতি কায়দা করে জিজ্ঞাসা করল ‘তুই অফিসে কি নিজে গাড়ি চালিয়ে যাস?’
-- না, ড্রাইভার আছে। কলকাতায় গাড়ী চালাতে ভালো লাগে না। এ কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
-- এমনি।
ইতি খুব মৃদুস্বরে দেবব্রত বিশ্বাসের একটা সি. ডি লাগিয়ে দিল। আড়চোখে দেখলো শৈলেশ এক মনে গাড়ী চালাচ্ছে। ওর নিজেরও খুব একটা গানে মন দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটু চোখ বন্ধ করে কৈশোরের দিনগুলো মনে করতে লাগলো সে। তখন ওরা ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। একদিন ওর বন্ধু গার্গী ওকে আড়ালে ডেকে বলল, ‘জানিস তো, তোর নতুন এক প্রেমিক জুটেছে?’
-- কে রে?
-- একটা ফচকে ছোঁড়া।
-- হেঁয়ালি করিস না, নামটা বল।
-- আমাদের ফচকে শৈল রে।
-- বলিস কি?
-- হ্যাঁ রে। ওর একটা খাতা কাল আমি নিয়ে গিয়েছিলাম বাড়ী। ভেতরে দেখি এই চিঠিটা। মনে হয় তোকে দেবে বলে এনেছিল। ভুলে গেছে।
-- কই দেখি দেখি।
চিঠির সব কথা মনে নেই। শুধু মনে আছে খুব ভাষা দিয়ে লেখা একটা প্রেমপত্র। বাঙালি ছেলে মাত্রই বেশ ভাষা দিয়ে প্রেমপত্র লেখে। সুতরাং এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু শুরুটা ছিল সাংঘাতিক। 'সুচরিতাষু, চিঠি শুরু করার আনুষ্ঠানিক শব্দ দিয়ে সম্বোধন করতে গিয়ে ভয়ে শিহরিত হচ্ছি – এটা শেষের শুরু নয় তো!' তারপর কিছু কথা লিখেছিল প্রশস্তিমূলক। শেষে লিখেছিল 'প্রত্যুত্তর স্বপ্ন মনে হয়, তবু মন সেই স্বপ্নটাই দেখতে চায়।’ ইতি বলেছিল, ‘কিছু বলিস না গার্গী। চিঠি যেমন ছিল খাতায় তেমনি রেখে দে। এই নিয়ে কিছু বলতে গেলে ওর চক্ষু লজ্জা ভেঙে যাবে।’ তারপর আজ প্রায় তিরিশ বছর পার হয়ে গেল। শৈলেশ না তো তাকে কোনও চিঠি দিয়েছে, না তো তাকে কখনও প্রপোজ করেছে। এ কথা কোনওদিন জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আজও জিজ্ঞাসা করতে ও সঙ্কোচ বোধ করছে। তবু এমন দিন ওর জীবনে আর আসবে না। জিজ্ঞাসা করতে হলে, আজই সবচেয়ে উপযুক্ত দিন। বলল, ‘শৈল, কালকে তো তোর জীবনের অনেক মেয়ে পটানোর গল্প বললি, পটাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিস এমন কোনও গল্প তো বললি না।’
-- তেমনটা তো কখনো হয়নি ইতি। আমি পটাতে চেয়েছি অথচ পারিনি, এমনটা মনে পড়ে না।
-- কারোর জন্য চিঠি লিখে তাকে নাই দিতে পারিস, কিন্তু বিষয়টা কি পটাতে চাওয়া নয়?
-- মানে?
-- মানে বুঝিস না? নাকি বুঝতে চাইছিস না?
একটুক্ষণ চুপ করে রইল শৈলেশ। তারপর বলল, ‘কিন্তু তুই জানলি কী করে? পৃথিবীর কাউকে তো আমি এ কথা বলেছি বলে মনে পড়ে না।’
-- সে কথা পরে হবে। তুই চিঠি লিখেও দিস নি কেন?
-- দিলে কি তুই রাজি হয়ে যেতিস?
-- না।
-- সেই জন্যই দিইনি।
-- তাহলে লিখেছিলিস কেন?
-- লিখতে ইচ্ছে হত। যখন তোকে মনে পড়তো তখনই কিছু না কিছু লিখতাম।
-- ও ওটা একমাত্র চিঠি নয়?
-- তুই কোন চিঠিটার কথা বলছিস, তাই তো জানি না।
-- তোর ইংলিশ এর খাতায় একটা চিঠি ছিল। সেই খাতা ভুল করে তুই গার্গীকে দিয়েছিলি। তা এরকম কত চিঠি লিখেছিলি?
-- গুনিনি।অগুনতি।
-- তুই তো এই বিদ্যায় ওস্তাদ ছিলি। বলে দেখতে পারতিস, অন্তত পটাবার চেষ্টা তো করতে পারতিস?
-- কী হত তাহলে?
-- কিছুই না। তবে এটা আমার কৌতূহল, কী এমন ছিল যা তোর মতো ওস্তাদ ছেলেকে সরাসরি বলা থেকে নিরস্ত করেছিল?
-- আসলে তোর ভাবমূর্তিটা আমার কাছে দেবীর মত ছিল। আপাপবিদ্ধা কোমল করুণ এক কুঁড়ি। এই ধরনের প্রেমপত্র বা প্রেম প্রস্তাব তোকে দেওয়া যায় - এটা ভাবলেই আমার মনে হতো এতে তোকে পাপ স্পর্শ করবে। সেই পাপ আমি তোকে দেবো, এটা ভাবতেই পারতাম না। তুই বলবি, তবে লিখতাম কেন? আসলে মনে এত ভাব আসতো, না লিখে পারতাম না। আমি তখন সিগারেট বিড়ি ফুঁকতে শুরু করছি; মাঝে মাঝে দু চার পেগ ঝেড়ে দিই সুযোগ পেলে – এমন ছেলের হাতে তোর মত কোমল কুসুম দেখতেও লোকেদের কাছে চক্ষু পীড়াকর হতো।
-- ওই চিঠি গুলোর কী গতি হয়েছে?
-- ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।
-- কবে?
-- যেদিন তুই কারুর হলি।
-- বিশ্বাস করি না।
-- কী বিশ্বাস করি না?
-- ওই চিঠি ছিঁড়ে ফেলা।
-- এতে না বিশ্বাস করার কি আছে?
-- আমি এখন তোর কোনও কথা বিশ্বাস করি না শৈল। তুই বলিস এক, দেখাস এক – আদতে তুই অন্য লোক।
-- দূর বোকা, বুঝিস না সবই ছল, মেয়ে পটানোর কৌশল এসব।
চুপ করে রইল ইতি। গাড়ী দক্ষিণেশ্বরে এসে গেছে। শৈলেশ বলল, ‘তোর বাড়ি দিয়ে আসি।’
-- না রে। যেখান থেকে তুলেছিলি, সেখানেই নামিয়ে দে। নইলে বাড়তিটুকুর হিসাব মিলবে না। রাস্তাটা বড় দ্রুত শেষ হয়ে গেল রে শৈল। তোকে ধন্যবাদ, অনেকদিন বাদে একদিন আমাকে বাঁচতে দিলি তুই।
-- ধন্যবাদ তো তোরই প্রাপ্য ইতি। তুই একদিন অন্তত তোর রাস্তায় আমাকে পা ফেলতে দিয়েছিস।
-- তুই পা দিয়েছিস বলেই তো আমার চলাটা সহজ হয়েছে। এই স্মৃতিতে হয়তো আরো কটা দিন বেঁচে নেবো।
-- ডানলপ এসে গেল ইতি। তুই এখান থেকে কিসে যাবি?
-- রিক্সা করে নেব।
ইতি নেমে আস্তে আস্তে হাঁটা দিল রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে। আজ একটা তাঁতের শাড়ি পড়েছে সে। পেছন থেকে ওর হাঁটা একমনে দেখতে লাগলো শৈলেশ। একটু কি খুঁড়িয়ে হাঁটছে ও। হাঁটার দরকার কী? উড়ে গেলেই তো পারে! হঠাৎ ওর কোমরের দিকে চোখ গেল তার। ডানা দুটো কই? কখন যেন ডানা দুটো হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে কেউ ...
0 Comments