অজিত দেবনাথ
আকাশে তখন সোনালি রোদ নেমেছে। দখিনা হাওয়া শতেক স্মৃতি নিয়ে নির্বাক স্টেশনের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পাতাঝরা নির্জন পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটছিলাম আমি, তিথি আর রূপক। যেন তিনজন, অথচ যেন একটিই সত্তা—ভিন্ন রূপে, ভিন্ন অনুভবে। স্বপ্ন নির্মিত গুহাচিত্রের পূর্ণ, অপূর্ণ দিগম্বর। ঝরাপাতার শব্দ-সন্তাপ। নিশ্চুপ পৃথিবীর দেয়ালে কত রং ও বিস্ময়। কারুকার্যে বিকশিত এক আশ্চর্য অন্তমিল! ছায়ার বাঁকে বাঁকে অদৃশ্য কথা ওড়ে। অরণ্যের সান্ধ্য বৈঠকখানায় জ্যোৎস্নার সটান ঢেউ নেমে আসে।
তিথি আমার প্রেমিকা, শান্ত অথচ গভীর। চোখে যেন অদ্ভুত এক বিস্ময়। আর রূপক—আমার বন্ধু, আমার কল্পনার ছায়া, যার অস্তিত্ব বাস্তব কি না তা নিয়ে তিথিও মাঝে মাঝে সংশয়ে পড়ে যেত।
পাহাড়ের এই নির্জন জায়গায় আমরা এসেছিলাম দীর্ঘ অপেক্ষার পর। এক অদৃশ্য সংকেতে। শহরের ব্যস্ততা, সম্পর্কের জট, জীবনের অস্থিরতা থেকে পালিয়ে কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে। চারিদিকে সবুজের বিচিত্র সমারোহ। আকাশ-পাহাড় পাশাপাশি নিঃশব্দে হাঁটছে। কি মধুময় প্রকৃতি! কিন্তু সে নিঃশ্বাসের মাঝে যে কী গভীরতা অপেক্ষা করছিল, তা তখন বুঝিনি।
তিথি চুপচাপ সামনে হাঁটছিল। দূর থেকে ভেসে আসছে ঝরনার মৃদু শব্দ। ওর উপস্থিতি নিঃসীম উপত্যকায় একমুঠো সুগন্ধি ছড়িয়ে দেয়। আমি পাশে, আর রূপক পেছনে—মাঝে মধ্যে পাথরের উপর বসে উদ্ভট সব ভাবনার কথা বলছিল।
🍂
হঠাৎ একটা পাহাড়ি ঢালে এসে তিথি দাঁড়িয়ে গেল। নিচে সবুজ উপত্যকা, দূরে নদী সাপের মতো বয়ে চলেছে। আকাশজোড়া নীরবতা। অজানা পাখিদের খিলখিল হাসি। আর জলনূপুরের শব্দ বিস্তীর্ণ প্রকৃতির বুকে আরক্ত পলাশের আঁচল বিছিয়ে দেয়।
তিথি বলল, “জানো, এই নির্জনতায় আমি নিজেকে খুঁজে পাই। এ কথা সত্যি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো , কিন্তু তুমি কি আমার চোখের ভেতরে স্বপ্নের বিপুল বিস্তার খুঁজে পাও?”
আমি থেমে গেলাম। কিছু বলার ছিল, কিন্তু শব্দগুলো এল না। তখন রূপক এগিয়ে এল।
সে বলল, “তিথি, প্রেম মানে কেবল কাছে থাকা নয়। প্রেম মানে বোঝা, আবার না বোঝার মধ্যেও পাশে থাকা। প্রতিটি অপেক্ষা একেকটি শঙ্কিত দীপশিখা। রূপ শুধু চোখে নয়, রূপ আছে মনের কুসুমার্ত ঝোপে, মনে আছে স্বপ্ন নির্মিত অলিগলি, আর সেই চিলেকোঠাতেই নিশিপক্ষী কামিনী ফুলের মতো ওড়ে।প্রেম যে অপূর্ণ বসন্ত আর নিজস্ব রঙের মানচিত্র।”
তিথি তাকাল রূপকের দিকে, তারপর আমার দিকে। বলল, “তোমরা দুজনেই তো আমার। একজন বাস্তব, অন্যজন রূপক। কিন্তু আমি তো চাই, তোমার মধ্যেই যেন রূপককে খুঁজে পাই। তুমি কি পারবে?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম, “চেষ্টা করব। আমি যদি তোমার স্বপ্নের রূপককে ছুঁতে না পারি, তবে সে রূপক আমার মধ্যেই জন্মাবে।”
তিথি তখন হাসল—একটা দুঃখমিশ্রিত হাসি। কিছু অনুচ্চারিত মধ্যবিত্ত স্মৃতি। বলল, “তবে এই পাহাড়ে ফিরে এসো একদিন, যখন আমায় হারাবে। এই নির্জনতা তোমায় মনে করিয়ে দেবে, ভালোবাসা শুধু উপস্থিতির নয়, অনুপস্থিতিরও অর্থ আছে। যেন একমুঠো সুগন্ধি ফুলের আনত চোখ”
সন্ধ্যা নামছিল। পাখিরাও ঘরে ফিরে যায়। রূপক তখন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। আমি জানতাম, সে আমার কল্পনা, আমার অপরিণত অনুভব, যার মধ্যে তিথি উজ্জ্বল হীরকখণ্ডের মতো আলিঙ্গনে বন্দি হয়।
ফিরে যাওয়ার সময় তিথি আমার হাত ধরেছিল। বলেছিল, “আমার রূপক যেন তুমি নিজেই হয়ে ওঠো, যদি একদিন আমি না থাকি।”
আজ তিথি নেই। অনেক বছর কেটে গেছে। কিন্তু আমি প্রতি বছর সেই নির্জন পাহাড়ে যাই। বসে থাকি সেই ঢালে, যেখানে সে বলেছিল তার মনের কথা। জীবন অনেকটা মেঘ ভাঙা বৃষ্টির মতো। কখন যে ঝপ ঝপ খসে পড়ে, আছাড়ি পিছাড়ি খায় নদীর শক্ত পাড়ও বুঝতে পারে না। শুধু অনিশ্চিত সুতোর সরু দাগগুলো অসহায়ের মতো হাঁ মুখে তাকিয়ে থাকে।
রূপক এখন আমার মধ্যেই বেঁচে থাকে। আমি বুঝেছি, প্রেম মানে শুধু হাসি নয়, রূপের উন্মোচনও নয়—প্রেম মানে সেই গভীর নির্জনতা, যেখানে নিজের ছায়ার সঙ্গেও কথা বলা যায়।
আর তিথি?
0 Comments