জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন/ পর্ব -৫০/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -৫০
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া

     || গগনে গরজে মেঘ...||

       ছোড়দা ফোন করে জানালো বাপি  হসপিটালে ভর্তি।আর জি কর থেকে ক্রিটিক্যাল কেয়ারের কোর্স করে সবেই সে বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে জয়েন করেছে। 
      কী হয়েছে বাপির? এই তো দেখে এলাম 
মর্নিং ওয়াক করছে। বাজারে যাচ্ছে।একটু রোগা লাগছিল অবশ্য।
         বমি হচ্ছিল। আরো নানা উপসর্গ। আসলে... আসলে কী? বলবি তো। উত্তর দিস না কেন?কোলোরেক্টাল  ক্যান্সার।বোন মেটাস্টিসিস হয়ে গেছে। এতটাই ছড়িয়ে গেছে যে কিচ্ছু করার নেই।বলছে বাড়ি নিয়ে গিয়ে কেয়ার দিতে। ছোড়দা শব্দ করে কেঁদে উঠলো আর নোকিয়ার  ছোট এইটুক সেলফোনের এপারে চুপ করে গেল  সে যেন বোবা ঠসা কারো সঙ্গে কথা কইছে ছোড়দা। মাকে এসব বলা যাবে না,তুই কবে...কে জানে আর কি সব কথা।
             শালিখকে নিয়ে রাতের গাড়ি ধরলো সে।বসিরহাটের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না।এই অবস্থায় জার্ণি করা নেক্সট টু ইম্পসিবল;দানি বলল, এখানেই থাক।
‌‌      কদিনেই এত রোগা হয়ে গেছে  তাদের হাসিখুশি বাবা ভালো করে উঠে বসতেও পারছে না।মুখ ভর্তি না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি শাদা হয়ে আছে।কবে এত বয়স বেড়ে গেল তাদের বাবার? উঠিয়ে বসাতে গেলে এত হালকা লাগে মনে হয় ছোট এক ছেলের মতো কোলে নিতে পারবে সে।
   দাঁড়ি কাটোনি কেন?রেজার দিয়ে দাঁড়ি কেটে দেয় 
সে।শালিখকে যেভাবে গল্প বলে বলে খাওয়ায় সেভাবেই বাবাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু দুচার গাল খাওয়ার পরেই বাপি আর না বলতে থাকে।
         ছোটবেলায় বাবা তাকে যেসব রুশ গল্প পড়ে শোনাতো  এখন রোজ সে বাবাকে সে সব গল্প বলে। সেই মাশা আর ভাল্লুকের গল্প,কুড়ুলের জাউয়ের গল্প, দুধের নদী সুজির পারের গল্প। দুধের নদী, সুজির পার আমায় একটু লুকিয়ে রাখো না।আগে আমার দুধ দিয়ে একটু সুজি খাও। ইসস্ বাড়িতে রান্না পরিজই বলে আমি খাই না। নদীও মুখ ফিরিয়ে বইতে লাগলো।ওই এসে পড়েছে বাবা ইয়াগা ডাইনি বুড়ির হাঁসরা। ভাইবোনকে  ধরে ফেলে আর কি।চট করে দুধ দিয়ে একটু সুজি খেয়ে নদীকে ধন্যবাদ জানালো মেয়ে আর দুধের নদীও সুজি দিয়ে ঢেকে দিল তাদের।  হাঁসরা কী আর করে,ফিরে গেল খুঁজে না পেয়ে। আবার  দৌড় দৌড় দৌড় বাড়ির কাছে এসে পড়েছে তারা,এমন সময়।কী হলো এমন সময়? মিটমিট হাসে সে। মনে পড়ে বাবাও গল্পের ক্লাইমেক্সে তখন হলো কীইইই... বলে লম্বা এক বিরতি দিয়ে চুপ করে যেত।
   কী হলো তখন বলে জামা টানতো  বাবার,হাত ঝাঁকাতো আর বাবা বলছি বলছি তারপঅঅঅর ....
        শালিখ আর বাবার অধীর মুখ দেখে সে শুরু করে; বাবা ইয়াগা ক্ষেপে গিয়ে আবার তো পাঠিয়েছে তার হাঁসদের।শনশন  তারা উড়ে আসছে দেখে ভাই কোলে ছোট্ট মেয়ে দেখে জঙ্গলে এক আপেল গাছ। ডালে ডালে রাঙা আপেল ছেয়ে আছে।তো আপেল গাছ আপেল গাছ আমায় একটু লুকিয়ে রাখো না; আগে আমার বুনো আপেল খাও। ইস্! বাড়ির বাগানের সোনালি আপেলই বলে খাই না আমি! তবে আমি পারবো না। ওদিকে ডাইনি বুড়ির হাঁসরা  ভাইকে কোল থেকে ছোঁ মেরে  নেয় আর কি। তাতাড়ি করে মেয়ে বুনো আপেলে কামড় দিয়ে গাছকে ধন্যবাদ জানায়। অমনি আপেল গাছ নুইয়ে আনে তার ডালপালা ভাইবোনকে ঢেকে দেয়  হাঁসেরাও খুঁজে না পেয়ে ফিরে গেলেই ভাই বোন নিজেদের বাড়ি ফিরে  এক্কেবারে মা বাবার কোলে চড়ে বসে। গল্প শুনে শালিখ আর বাপি দুজনেই হাততালি দিয়ে হাসে।
          দিন রাতের জন্য ঝর্ণাদি আর বিমলাদি নামে দুজন দিদি ঠিক করা হয়েছে। একদম খেতে পারছে না  বাবা।দু চামচ বেশী দিলেই ঝিনুক মা আমায় বাঁচাও এদের হাত থেকে বলে কষ্ট করে হাসে বাবা।
         টকটকে লাল বা  একটা হলদে গোলাপ এনে হাতে দিলেই খুশি।মোড় থেকে যুঁই ফুলের মালা কিনে এনে থালায় জল দিয়ে রাখে। লম্বা শ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ে তাদের বাবা।একটু বসিরহাটের বাড়িতে নিয়ে যাবি মা?যাব। এবার তো ছুটি ফুরোল আমার। পরেরবার আমরা সবাই মিলে বাড়ি যাব।
              বই পড়তে পারছে না বলে ছোড়দা একটা টিভি এনে সেট করল বাবার ঘরে।  মিউজিক সিস্টেম আনলো গান শোনার জন্য। ঝর্ণাদিকে  সবসময় খুব আস্তে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজাতে শেখানো হলো । টবসুদ্ধু কটা গাছ এনে সাজিয়ে রাখে সে বাবার ঘরে।দাদাই ভাল হচ্ছে না কেন মা?কবে ঠিক হবে দাদাই।এই তো  সেরে উঠছে। কিছু দিন পরেই দেখো এক্কেবারে ঠিক হয়ে যাবে।পনেরো দিনের ছুটি শেষ হয়ে এলো তার।
              শালিখকে নিয়ে ফিরলেও মন পড়ে থাকে কলকাতা।দিন  সাত আট বাদে বাদে সে একাই দুদিনের জন্য হলেও বাবার কাছে যায়।
        বালুরঘাটে থাকলে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে সে হেঁটে ফেরা ধরল বাড়িতে। শ্মশান পার্কের পাশ দিয়ে বাঁধের রাস্তা ধরলে আত্রাইয়ের ধার দিয়ে নির্জনে হাঁটা যায়।এই সময়টা তার আর বাবার। নোকিয়া ফোনে  বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে হাঁটে।  
        কান্ড দেখো বাপি।সন্ধে নেমেছে তো ,জেলে নৌকোয় লম্ফো জ্বলছে। জলে তার ছায়া পড়েছে। আবার সন্ধেতারারও ছায়া পড়েছে।বোঝো অবস্তা! নদীর জলে কোনটা সন্ধে তারা আর কোনটা টেমির ছায়া এখন বোঝাই দায়। তুমি আমার চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছো? হ্যাঁ। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, বাবা উত্তর দেয়।
         কোনোদিন বুঝলে কিনা,এমন মস্ত বন ধুতরো ফুটেছে জঙ্গলে; একেবারে সেই মারিয়ার গেলাসের গপ্পোর মতো।জানো তো সে গপ্পো? রাস্তা চলতে চলতে মারিয়ার তো ভারি তেষ্টা পেল একদিন। শরবত ওলা যাচ্ছে ভরা পিপে গড়িয়ে গড়িয়ে। বড্ডো পিপাসা গো।একটু শরবত দেবে? দিতে তো ইচ্ছে যায় ভালো মানুষের মেয়ে,কিন্তু আমার কাছে তো গেলাসই নেই । তোমার কোনো পাত্তর থাকলে বাড়াও।তখন রাস্তার ধারে ফুটে থাকা বন ধুতরোর ফুল ছিঁড়ে সে পেতে ধরলে। শরবতওলাও ফুল ভত্তি করে তার তেষ্টা মেটালো। কেমন গপ্পো?খাসা। ফোনের ওধারে টেনে টেনে বাবা হাসে। 
🍂
ad

          মা নইলে শালিখেরও চলে না। হসপিটাল আর এন জি ও র বাইরে মায়ের এক ছটাক সময় সে কাউকে দিতে রাজি না। তবু রোজ সন্ধেবেলা সে অনেক সময় ধরে নদীর পার ধরে হেঁটে হেঁটে ফেরে।  শালিখও বুঝে নিয়েছে এই সময়টা মা দাদাইয়ের সঙ্গে কাটাতে চায়।
        আজ বিষ্টি হয়েছে জানো। বাগানে জুঁই ফুটেছে গাছ ভরে। আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছি। গন্ধ পাচ্ছো বাপি। হ্যাঁ। চমৎকার সুবাস।কে কাকে ভোলাচ্ছে ঘুলিয়ে যায় বটে ,এক একদিন তাই সরাসরি কথা বলে সে। বাপি, ভয় পাচ্ছো নাকি? না। কষ্ট হচ্ছে।আর শরীরের যন্ত্রনাও খুব। 
     ভয় নেই বাপি। হয়তো নতুন একটা জামা পরার মতো ছোটখাটো ব্যাপার কিংবা এঘর থেকে ওঘরে যাওয়ার মতো এমন কোথাও যাব আমরা ,ধরো কোনো টাইম জোন বা অন্য কোথাও, সেখানে এই ব্যাথা, যন্ত্রনা কিন্তু মোটে নেই। 
         মৃত্যুতেই সব শেষ ঝিনুক মা। উপনিষদ বা মিশরীয়দের ধারণার কোনো প্রমাণ পায়নি বিজ্ঞান। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে বাবা।কে বলেছে শেষ?এই যে তুমি শিখিয়েছো মানুষকে ভালবাসতে, আমি শেখাচ্ছি তোমার দাদাইকে।এই বয়ে যাওয়া কি সত্যি নয়? পৃথিবী হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন ।আবার নতুন গ্ৰহে প্রাণের উণ্মেষ হবে, আবার মানুষ। তাদের চেতনায় আবার ভালবাসা হয়ে ঢুকব আমরা বলে জড়িয়ে ধরে রোগা ছোট্ট হয়ে যাওয়া বাবাকে।তা তো বটেই বলে বোধহয় বাবাই তাকে স্বান্তনা দেয়।
          তুই কি উন্মাদ? পুজোর সময় দানি বলল, এই অবস্থায় বসিরহাটের বাড়ি অবধি বাপিকে নেওয়া অসম্ভব। এতটুকু মুভ করলেই হাড়ের যন্ত্রনায় চিৎকার করছে কোনো জার্ণিই তার পক্ষে সম্ভব নয়।পথেই কিছু ঘটে যেতে পারে। বড় বৌদি মানে টুটুলদিও বলল অসম্ভব।
       দাঁতে ঠোঁট কামড়ে সে বলল আমি সি সি ইউ থেকে এমার্জেন্সি সবরকম মেডিসিন সঙ্গে এনেছি। অ্যাম্বুলেন্স বুক করেছি।বাপির এই ইচ্ছেটুকু মেটাতে এই একটা বার আমি কারো কথা শুনব না। 
      বাপি দেখো দেখো মাতলা নদীর ওপরে কেমন মেঘ করেছে।অ্যাম্বুলেন্সে কোল থেকে মাথাটা সাবধানে তুলে ধরে সে। কী অদ্ভুত হাসে  বাবা। তোমরা ছোট ছিলে যখন,ব্রিজ হয়নি তখন এই নদী পেরিয়ে কলেজে পড়াতে যেতাম।
        বাবার প্রিয় কবিতা শুরু করে সে।গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা/কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা... বলা শেষ হলেই বাবা বলে আবার বলো।
          বাড়ি ঢুকলেও করিম ভাই দৌড়ে এলো না ।মাস দুই আগে শুক্কুরবার বলে তাতাড়ি করে কাজ সেরে বাড়ি গেছিল করিম ভাই।তার ঘরের  দোরেই ছোট একখানা মসজিদ।ফি শুক্কুরবার সেখানেই নামাজ পড়তে যায়। সেদিনও যোহরের নামাজ পরে এসে দাওয়ায় চ্যটাই পেতে  ঘুমিয়ে পড়েছে। আর  নাকি ঘুম ভেঙে ওঠেনি।
      বোধহয় ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক হয়েছিল । মসজিদে আজান দেয় যে পাড়ার মোতিউর  ভাই বলল, দেলডা সাচ্চা ছেল ভাইজানের। কোনো ঋণ খিয়ানত তো ছেলো না।রুহ্ তার জান্নাত পেই গেছ। বাড়ি গেলে তাও মনে হয় কামিনী ঝোঁপের তলা দিয়ে বা হাস্নুহানার ঝাড়ে কঞ্চির ঠেকা দিতে দিতে মুখ বাড়িয়ে বলবে ও ছোড়দি,আ্যদ্দিনে এউছ তালি ?
      বন্ধুগন, আমাদের মাঝখানে কিছুক্ষণের মধ্যেই অতি চমৎকার এক ম্যাজিক ঘটতে চলেছে।বাড়ি এসে  বাবা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে বেশ। বিকেলে দানি ধরে ধরে বাইরে হাঁটিয়েছে কাল তবু সকালবেলা খাবার টেবিলে ছোড়দার ঘোষণায় জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকালো সবাই। বারান্দায় একটু আলপনা দিয়ে মোম প্রদীপ জ্বেলে সাজা তো ঝিনি।কী হবে?মা বাপি কে বসিয়ে ছবি তুলব।
        সাজানো তাদের লাল মেঝের বারান্দায় মায়ের পাশে ধরে ধরে বসালো  তারা বাবাকে। কোত্থেকে  ছোড়দা এনে রাখল  একটা পলাশ গাছের চারা।জন্মদিনে টবসুদ্ধু কে ওকে উপহার দিয়েছে। গাড়িতে করে এনে বাগানে রেখেছে কখন কেউ খেয়াল করেনি।কিছুদিন আগে বাংলাদেশ গিয়েছিল ছোড়দা। যেখানে তাদের ভিটেবাড়ি ছিল অন্য কাদের ঘরবসত সেখানে এখন, তবু  তারা যত্ন করেছিল  নাকি খুব।সেই ভিটে থেকে দু'মুঠ আর মামাবাড়ির ভিটের দু'মুঠ মাটি এনেছে পলিথিনে বেঁধে।  
          কাঁটা তার কিছু ভাগ করতে পারে না ... থেমে থেমে বলল  বাবা।কাঁপা হাতে পলাশের টবটাতে মাটি দিতে দিতে অদ্ভুত এক হাসি ফুটলো  মুখে। মাটি ছুঁয়ে ফুঁপিয়ে উঠল মা।
        তিন ভাইবোন মিলে ছোট পুকুরের ধারে পুঁততে গেল পলাশ গাছটা। আশ্চর্য,ঝিরঝির বিষ্টি নামল তখনই।  মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে জল মিলিয়ে থাকে... চারাটার চারধারে চাপড়ে মাটি সমান করতে করতে ছোড়দা গাইছিল। কোদাল নামিয়ে দানি দেখছিল দাঁড়িয়ে।দৌড়ে সে দাদাদের হাত জড়িয়ে ধরল। ছোড়দা আকাশের দিকে তাকিয়ে  গায় ...কবে কাটিয়ে বাঁধন পালিয়ে যখন যায় সে দূরে/আকাশপুরে গো,/তখন কাজল মেঘের সজল ছায়া শূন্যে আঁকে,/সুদূর শূন্যে আঁকে...মাটি  পায় না, পায় না, মাটি পায় না তাকে।তার হাতের মুঠোয় দানির হাত কেঁপে কেঁপে ওঠে। বৃষ্টি কি ধুয়ে দেবে এই জল?
     তখন কোন দূর দেশ থেকে হু হু হাওয়া ছুটে আসছে ;পলাশ চারাটাকে ঘিরে হাত ধরাধরি করে ভিজছে তিনজন‌।গলা বুজে আসে ছোড়দার।  বৃষ্টির শব্দে প্রায় শোনা যায় না খুব আস্তে থেমে থেমে ভাঙা এক বাতিল হারমোনিয়ামের মতো সে গাইছিল...
তখন কাছের ধন যে দূরের থেকে কাছে আসে/
বুকের পাশে গো,/তখন চোখের জলে নামে সে যে চোখের জলের ডাকে,/ আকুল চোখের জলের ডাকে...মাটি পায় রে মাটি পায় রে তাকে...
         কলকাতা ফিরতে হবে বাপিকে বুঝিয়ে বল ঝিনি; ছুটি তো  ফুরিয়ে এলো । দানির কথায় সে ভোলায় বাবাকে।বাপি ফিসফিসিয়ে তাকে বলে ওরা ফিরে যাক।তুমি আর আমি থাকি? তুমি তো তিনমাস থাকবে বলেছো।থাকব তো। আবার আসব আমরা। বাড়িতে থাকব তখন পাক্কা তিন মাস।
        তিন মাস অবশ্য কলকাতা আর বালুরঘাট সে যাতায়াত করছে কেবল। কবিতা শোনাও। সোনার তরীই শুরু করে সে। আবার শোনাও। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে  গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা বলেই যায় সে। ঘুমিয়ে পড়লে উঠে আসে আস্তে। ফেব্রুয়ারির এক ভোরে কলকাতা পৌঁছে দেখে ঘুমন্ত তাদের বাবাকে ঘিরে বসে আছে ওরা।দেরি করার জন্য কেউ কিছু বলল না অবশ্য। 
      বাপিকে দেখেই সে ট্রলি খুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।কী করছিস ঝিনি এদিকে আয়। টুটুলদির ডাক শুনেও আরো ঝুঁকে পড়ল ট্রলিতে।জামা কাপড় হাটকে সে বার করে আনল নরম কম্বলটা। কী করছিস?ওই ইয়ে বাপির জন্য আনলাম তো তাই। বলে কম্বলটা জড়িয়ে দিল বাবার গায়ে।
         আত্মীয় স্বজন আসতে শুরু করেছে। ছোড়দা  ডেকে বলল বাপি কিন্তু সব নিয়মকানুন বারণ করে গেছে। ঝিনি তুলসি পাতা দিতে বারণ কর ওদের।না কেউ ওসব দেবে না। আমি শুধু নাড়ু আর ঝর্ণা মাসীকে বলেছি নতুন পাজামা পাঞ্জাবী পরিয়ে দিতে।চন্দন দিয়ে সাজিয়ে দিই ছোড়দা? অনেক দূরে যাবে তো। সুন্দর করে সাজিয়ে দিই আজ।
          চন্দন পরাতে গিয়ে দেখে ঘরে সে একাই। বাবার ঠোঁটে চুমু খেল সে। নীলচে বরফের মতো ঠোঁট। বড়দের মধ্যে কে যেন বাইরে বলে উঠল কানে হরিনাম দেওয়া হয়েছে? বুকে একখানা ছোট গীতা? চন্দন টিপ দিতে দিতে সে গীতাপাঠের মতো শুরু করল গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা/কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা/রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হলো সারা/ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা... 
        এ কমাস কলকাতায় মোটেও মন টিকত না বাবার।বাড়ি যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে নিয়ে বেঁচে ছিল তাদের বাবা।অথচ মরার পর কাঁচ গাড়িতে বাবাকে নিয়ে বসিরহাট চলল সবাই। বাবার 'ভোরের আলো' ক্লাবের বন্ধুরা অপেক্ষায় আছে। এখানেও সবাই মালা আর ফুল দিচ্ছে।সবকিছুই দেখছে সে অন্য কোনো লোক যেভাবে দেখে।নাড়ু যেমন একটা রজনীগন্ধার মালা তার হাতে দিয়ে বলল মেসোমশাইকে দাও।
         সেও তড়বড় করে গিয়ে বাবার পায়ে  মালাটা রাখল দেখে নাড়ু মাথা নাড়ল। ভুল হয়েছে নাকি?তালে বোধহয় গলায় পরিয়ে দিতে হতো সে ভাবল।অত মালায় ঢেকে যাচ্ছে বলেই তো পায়ের ওপর রাখল সে ।সেজো,কাঁদছে,সানা, টুটুলদি ,দেবু সবাই কান্নাকাটি করছে অথচ তার তো কান্না পাচ্ছে না। যেন বাবা নয়,অন্য কেউ  মারা গেছে। দূর  থেকে সে কেবল দেখতে এসেছে।
      মা খুব কাঁদছে দেখে সে শুধু  মা'র মাথা কাঁধে নিয়ে বাচ্চাদের মতো চাপড়ে দিচ্ছে। বসিরহাটের বাড়িতেও  সবাই আরো ফুল হাতে এগিয়ে এলো।শঙ্কর কাকা বলল তিন ভাইবোনের কেউ একজন বাবাকে ছুঁয়ে বসো। সে গিয়ে বসল আবার। আবার চুমু খেল কপালে, ঠোঁটে।নাঃ, একইরকম ঠাণ্ডা। শ্মশানে চুল্লির দরজা বন্ধ হবার আগে দৌড়ে গেল আর একবার। হাঁটু গেড়ে বসে খুঁটিয়ে দেখছিল বাবাকে  কিন্তু মহুল তাকে উঠিয়ে আনল বাইরে।
         লাল সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চে বসল দাদাদের পাশে।কে যেন এক ভাঁড় চা দিল আর আশ্চর্য হয়ে সে দেখল চায়ে চুমুক  দিচ্ছে সে।
         দাদারা যাবে না বলে নারান  বাবার অস্থি নিয়ে জলের দিকে যাচ্ছিল। আমি যাব বলে মাটির কলসটা সে নিল। আস্তে নাম।নারান ধরল তাকে।পা ডুবে যাচ্ছে নদীর কাদায়। 
       কুয়াশা মাখা চাঁদের তলায় জলে নেমে অস্থি ভাসিয়ে সে দেখল  ওপারের ইটিণ্ডে ঘাট। বাবা কি ভাসতে ভাসতে ইটিণ্ডের ওধারে সাতক্ষীরে জিলা পেরিয়ে খুলনের মধুমতির জলে চলে যাবে? 
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে/দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে... কী বিড়বিড় কচ্ছিস? ভরা পালে চলে যায়/কোনোদিকে নাহি চায়/ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দুধারে...ঝিনি ঝিনি শুনছিস ? এবার আছড়ে ভাঙ কলসটা।
 ...ওগো তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে/বারেক ভিড়াও তরী কুলেতে এসে... পেছন ফিরে তাকাবি না বলো। সাবধানে ওঠ। হাত ধর আমার।   এতকাল নদীকুলে যাহা লয়ে ছিনু ভুলে ... এদিকে আয় 
পায় তো হাবড় কাদা ।এই ট্যাপে  ধুয়ে নে।
         নারান তাকে টেনে টেনে নিয়ে যায়।ছোট বুলাদা তাকে গাড়িতে বসতে বলে। শেষবারের মতো সে ইচ্ছামতীর দিকে তাকায়।এখন জোয়ার না রে? ওপরে ওপরে শান্ত কিন্তু চোরাটান আছে জলে খুব।কী বলছিস?নারান কেন তার কথা শুনতে পাচ্ছে না। সে তো নিজের গলা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।অথচ নারান বলছে ঠোঁট নাড়ছিস তখন থে।কেঁদি কেঁদি গলা মনে হয় বসি গেছ তোর। কাঁদিনি তো বেশ জোরেই বলল  সে।নারান তাও শুনতে পেল না।
কুয়াশা জমেছেও আজ।নদী যেন দেয়ালা করছে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ।ইটিন্ডেঘাট হয়ে সাতক্ষীরের দিক আবছা হয়ে আছে দূর।ওপারের গাঙকুল মধুমতি চরশিবপুরেও কি ঘুমোচ্ছে জল? নাকি ঘুম ভেঙে বম্মা , সাজে জেঠি,ঠাকুমার কোলের কাছে শীতের দোলাই গায়ে আলাভোলা এক শৈশব গ্ৰাম তাদের বাবার  অপেক্ষায় আছে….
          কুয়াশার আর সামান্য চাঁদ কী অলৌকিক মায়া  করেছে আজ।কিছু তারা ছিটিয়ে আছে। রুদ্রাক্ষের মালা ছিঁড়ে কোঁচকানো পুঁতির মতো ছড়িয়ে আছে আকাশের এধার ওধার।
 ভা-ব-ন ,ভা -ব-ন  হেএএএ জেলে নৌকায়  দূর থেকে হেঁকে উঠল কে।ভাবন কারো নাম? হেএএএ আরও দূর কুয়াশায় প্রায় অদৃশ্য ডিঙি থেকে উত্তর এল।  দুই ডাকের মধ্যে  তক্ষুনি হাওয়ার সাঁকো উঁচু হতে দেখল সে। দুই নিঃশ্বাসের মাঝখানে ,জীয়ন্ত আর মরার মাঝখানে বাতাসের  যে সেতু  উঁচু হয় আর ফাঁকা মাটির কলসির মতো আছড়ে ভেঙে যায়।দূরের চাইতেও বেশী বলে পেছনে তাকালেও তাকে দেখা যায় না আর।

Post a Comment

0 Comments