মার্কেজের খোঁজে
(দশম পর্ব)
মলয় সরকার
কলম্বিয়ার এই অঞ্চলে ২০০খ্রীঃ পূঃ -১৬০০ খ্রীঃ পর্যন্ত যে সমস্ত অধিবাসীরা এখানে Sinu ও San Jorge নদীর ধারে বাস করত, তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রই রয়েছে।তারা মৃতদেহের সঙ্গে তার ব্যবহৃত বহু সোনার জিনিস সমাধিতে দিত।স্পেনীয়রা সেই সমস্ত সোনা বেশিরভাগই লুট করে। স্থানীয় অধিবাসীরা ছিল বেশিরভাগই কৃষক, শিকারী ইত্যাদি ধরণের। কিন্তু তারা সোনার জিনিসপত্র ভালই বানাতে জানত। তারা খাল কাটতে পারত। মিউজিয়ামে যথেষ্ট পরিমাণে মেয়েদের ব্যবহার করা সোনার বক্ষাবরণী, আংটি, নাকের রিং, মানুষের প্রতিকৃতি ইত্যাদি দর্শনীয় হিসাবে স্থান পেয়েছে। এই জেনুদের ভাষা অবলুপ্ত হয়েছে প্রায় ২০০ বছর আগে।
মিউজিয়ামে মাটির তৈরী জিনিসপত্র
এই মিউজিয়ামটি আসলে একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ বলে মনে হল। একটি দ্বিতল বাড়ির মধ্যে এটি রয়েছে, যার বারান্দাটি গ্রিল দেওয়া, বাড়ির মাঝে একটি বড় গাছ রয়েছে উঠানে। এখানে এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু সিরামিক, মাটির পাত্রের টুকরো যা এই অঞ্চলের শিল্পকর্মের নিদর্শন। কিছু মাছ পশু-পাখী গাছপালা ইত্যাদি যা তারা দেখেছিল সবকিছুর প্রতিকৃতিই রয়েছে। এখানে সোনা রূপা ও তামার যে সমস্ত শিল্প কর্ম রয়েছে তার নাম Tumbaga ।তবে সোনা-রূপার কাজ যে যথেষ্ট সুক্ষ্ম এ ব্যাপারে কোনও দ্বিমত নেই।এখানে যে সমস্ত মানুষের কথা ধরে রাখা হয়েছে, তারা প্রধানতঃ চন্দ্র ও সূর্যকেই প্রধান দেবতা মানত।তাদের সমাজে মেয়েদের একটা আলাদা উচ্চ স্থান ছিল।তারা মেয়েদের জ্ঞান, উর্বরা শক্তির প্রতীক মনে করত।মৃত্যুর পর তারা নানা বাদ্য নৃত্য সহযোগে মৃতদেহকে সমাধিস্থ করত। সেই সমাধির উপর একটি গাছ লাগাত।সেই গাছের ডালে সোনার ঘণ্টা ঝোলাত।এদের বৃত্তাকার বা অর্ধবৃত্তাকার গহণাগুলি পুরুষ, স্ত্রী ও শিশুরাও পরত।এরা প্রধানতঃ মোম ঢালাই পদ্ধতিতে, সম্ভবতঃ, এগুলো বানাত। কিছু জিনিসপত্র পিটিয়েও বানাত।এই জেনুরা অধিকাংশই শেষ হয়ে গেছে স্পেনীয়দের অত্যাচারে, অতিরিক্ত করের চাপে ও নানা বিদেশী নতুন রোগের প্রকোপে। এখানে ঢোকার কোন দর্শনী লাগে না। এখান থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের ইতিহাসের অনেক কিছুই উঠে আসে।এই মিউজিয়ামেরই আরও বড় সংস্করণ রয়েছে রাজধানী বোগোটাতে।
ফেরার সময় ঢুকলাম একটা কাফেতে। মনটা একটা গরম পানীয়ের জন্য ছটফট করছিল। ঢুকেই দেখি সামনে রয়েছে কলম্বিয়ান কফি। আমি তো জানি কলম্বিয়ার কফি বিখ্যাত।তাই ভাবলাম এসেছি যখন চেখেই দেখি, কলম্বিয়ার কফি।
জেনুদের তৈরী সোনার বক্ষাবরণী
আজকাল আমি একটু বেশি কফি ভক্ত হয়ে পড়েছি, চায়ের থেকেও। কলম্বিয়ার কফি, তুলনামূলকভাবে একটু নরম ধরণের, খুব কড়া হয় না।ফলে আমার বেশ ভালই লাগে।এখানে বছরে প্রায় সাড়ে এগারো মিলিয়ন ব্যাগ( এক ব্যাগ=৬০ কিগ্রা) কফি হয় যা সারা পৃথিবীর মধ্যে পরিমাণের দিক থেকে তৃতীয়, ব্রেজিল ও ভিয়েতনামের পর।এগুলো ওরা প্রধানতঃ আমেরিকা, জার্মানী ফ্রান্স জাপান ইটালী ইত্যাদি দেশে রপ্তানী করে।ইউনেস্কো এদের এই কফি সংস্কৃতিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আখ্যা দিয়েছে।প্রায় তিনশ’ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে চলেছে এই কফি খাওয়ার প্রবণতা।
মিউজিয়াম
এখানে বাইরে রোদের প্রকোপ ভালই।প্রায় ৩২ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড। আমরা তো একদিন কাপড়ে কেচে বিপদেই পড়েছিলাম।ওদের ওয়াশিং মেসিন রয়েছে, সুন্দর। তাতে তো জমিয়ে রাখা আছে সব বিগত কয়েকদিনের নোংরা সব জামাকাপড়।কাচতে তো হবেই। তারপর খেয়াল হল, আরে এদের তো ড্রাইং মেসিন নেই। জিজ্ঞাসা করলাম, কি করে শুকাব? বারান্দায় মেলে দেব কি? কিছুক্ষণ পরেই তো শুকিয়ে যাবে, যা গরম। ওরা বলে, না সেরকম নিয়ম নেই।বাইরে কোথাও মেলা যাবে না।তাহলে কি করব! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তখন বাধ্য হয়ে, ঘরে সমস্ত জায়গায় আসবাবপত্রের উপরে কাচা জামাকাপড় মেলে দিয়ে ঘরে ফুলস্পীডে ফ্যান চালিয়ে দিলাম।কি আর করি! ভাগ্য ভাল, অন্যান্য জায়গার মত ঘর থেকে বেরোলেই সুইচ অফ হয়ে যায় না। যাই হোক, দিনের শেষে ফিরে এলাম যখন, সব শুকিয়ে গেছে। নিশ্চিন্ত হলাম।
🍂
রাতে র্যাপির পাঠানো মুসুর ডাল,আলু, জল, মাখন ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর মুসুর ডাল ভাতে, আলু ভাতে, গরম গরম ভাত মাখন দিয়ে খাওয়া হল।বুলবুল বলে, বাঃ বাইরে এসে তো ভালই পিকনিক হচ্ছে।
অর্ডার করে হোটেলের খাবার এনে তো খাওয়াই যায়। কিন্তু নিজেদের হাতের এই গরম ভাত তো অমৃত। এর কাছে কিছুই লাগে না। বাইরে বেরিয়ে এখন ঘরের মত রান্নাই ভাল লাগে। ভরপেট খেয়ে রাত্রে একটা নিশ্চিন্ত ঘুম।
পরদিন উঠে টিফিন খেয়ে আমরা গেলাম Convento e Iglesia de San Pedro Claver বা San Pedro Claver চার্চে। এখনে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়।এটি ১৫৮০ সালে তৈরী হওয়া স্প্যানিশ ঢঙ্গে তৈরি একটি চার্চ।ভিতরে একেবারে শান্ত স্তব্ধ সব। সময় যেন এখানে জমাট বেঁধে রয়েছে আর ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে টাইম মেসিনে চাপিয়ে সেই পুরানো দিনে। এখানে শুধু আপাততঃ নিস্তব্ধ গাছপালার মধ্যে দিয়ে শিরশির করে বাতাস বয়ে যাওয়া ছাড়া কোন আওয়াজ নেই।এটি স্পেনীয় সন্যাসী সেন্ট পিটার ক্ল্যাভারের নামে উৎসর্গীকৃত, যিনি এখানেই থাকতেন ও এখানেই দেহরক্ষা করেছিলেন। তাঁকে কৃষ্ণকায় মানুষগুলোর পরিত্রাতা “The apostle of the slaves “ বলে ভাবা হত।কিন্তু তিনি নিজেকে দাসানুদাস বলে ভাবতেন। যে সমস্ত মানুষদের আফ্রিকা থেকে ধরে আনা হত তাদের মঙ্গলের জন্য নিজেকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন। ঘরের দেওয়ালে তাঁর জীবনের নানা কথা, ছবি ইত্যাদি রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতলে উঠলে তাঁর ব্যবহার করা জিনিসপত্র, বিছানা ইত্যাদি সমস্ত দর্শনীয় হিসাবে রাখা রয়েছে দেখা যায়।চার্চের বা বাড়ির ভিতরের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ সত্যিই মনকে শান্ত করে দেয় আর মনে করিয়ে দেয় সেই প্রাচীন যুগের কথা।
এখানে কিছু, স্প্যানিশ যুগের আগেকার চিত্র, হাতের কাজও রয়েছে।এখানেই সেন্ট ক্ল্যাভারের দেহাবশেষ একটি কাঁচের কফিনে রাখা রয়েছে। একটি বড় হল ঘর রয়েছে, যেখানে তাঁর দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ক্লাশ হয়। হল ঘরে দেওয়ালে অনেক চিত্রও রয়েছে।
এটি একটি ত্রিতল বাড়ি যার মাঝের উঠানটি গাছপালায় ঢাকা। তার একদিকে একটি কুয়ো রয়েছে, যা পুরানো দিনে ব্যবহৃত হত।দ্বিতলের চারদিক ঘিরে রয়েছে বেশ চওড়া বারান্দা।এখানে প্রধানতঃ অন্য কিছুর থেকে তাঁর কথা আর জীবনীই চারিদিকে ছড়ানো।বারান্দায় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি চেয়ার পাতা রয়েছে, যেখানে বসে একটু বিশ্রাম করা যায়।
এই সেই সেন্ট বলিভার প্লাজার বেঞ্চ ,যেখানে বসে অনেক সময় কেটেছে মার্কেজের
সত্যিই মনটা শান্ত হয়ে গেল। বেরিয়ে এলাম একটা স্তব্ধ যুগ থেকে।সামনে একটি সুন্দর অথচ বড় প্লাজা। এখানে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে বা বসে রয়েছে সেই, কার্তাহেনার বিশেষ চিহ্ন সূচক প্যালেঙ্কিরো মেয়েরা , দেশের পতাকার রঙের ঊজ্বল ঘাগরা দেওয়া স্কার্ট পরে। মাথায় রয়েছে তাজা বড় বড় ফল।প্রথমে ভেবেছিলাম, ওরা বুঝি ছবি তোলানোর জন্য ‘পোজ’ দেবে বলে ঘুরছে। পরে নিজের ধারণার কাছে নিজেই লজ্জায় অপমানে ছোট হয়ে যাই। ওরা ঘুরছে, পেটের তাগিদে, মানুষের কাছে তাজা ফল বিক্রী করবে বলে। আমি অনুরোধ করাতেও ওরা ছবি তুলতে রাজী হল না, বরং তাদের ছবি তুলতে নিষেধ করল। অগত্যা, ওদের না জানিয়েই চোরের মত ছবি নিতে হল বাধ্য হয়েই । একই অবস্থা হয়েছিল চীন দেশের তাজাইতে।
ক্রমশঃ-
আগামী দিনেও থাকুন সঙ্গে।পথিকের তো পথই ঘর, আর চলাই তার নেশা বা ধর্ম। আপনারাও চলুন সঙ্গে–
0 Comments