জ্বলদর্চি

জানালার পাশে / অজিত দেবনাথ

জানালার পাশে
        
অজিত দেবনাথ


অনিমেষ বাবু এখন আর স্কুলে যান না। যাবেনই বা কীভাবে? পঁইত্রিশ বছরের শিক্ষকতার অধ্যায় শেষ করে আজ তিনি বসে আছেন এক নিস্তব্ধ অবসরের ছায়ায়। দীর্ঘ বছর ধরে প্রতিটি সকালে যিনি স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি শুনে জীবন শুরু করতেন, যাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হতো ‘গুড মর্নিং’ কিংবা 'আসন গ্রহণ করো'—আজ তাঁর চারপাশে শুধুই নীরবতা। অথচ সেই ‘অবসর’ শব্দটি তাঁর জীবনে কোনো আরামের ছবি আঁকে না; বরং তা যেন এক টানা দীর্ঘশ্বাস, যেন এক অতৃপ্ত প্রতীক্ষা, একটি মৃদু কিন্তু গভীর শূন্যতা।
Chalk-এর ধুলো, যা একদিন তাঁর আঙুলে লেগে ছড়িয়েছিল আলো, উজ্জ্বল করেছিল কত শত কিশোর মন—আজ তা উড়ে মিশে গেছে কুয়াশার মতো বিস্মৃতির ধুলোরাশি-ভরা বাতাসে। সে ধুলো আর কাশি আনে না, আনে না বিদ্যাচর্চার উত্তাপ; বরং মনে করিয়ে দেয়, যে আলো তিনি একদিন জ্বেলেছিলেন, তা আজ নিভে এসেছে নিঃশব্দে।
তবু, অভ্যাস কি এত সহজে যায়? যায় না। এক অমোচনীয় টান, এক নীরব আকর্ষণ, প্রতিদিন সকালে, দুপুরে কিংবা সাঁঝে—তাঁকে টেনে নিয়ে যায় সেই জানালার ধারে। সেই জানালা, যার বাইরে একসময় ছিল এক জীবন—আলোকিত, কোলাহলময়, প্রাণচঞ্চল। এখন সেই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি আর কিছু দেখেন না; তিনি ‘অনুভব’ করেন। জানালার ফ্রেম যেন তাঁর জীবনের অতীত ও বর্তমানের সীমানা—যার এক পাশে স্মৃতি, অন্য পাশে নিস্তব্ধতা।
জানালার ওপারে এককালে ছিল এক বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমি—আলুথালু ঘাসে মোড়া, কদাচিৎ বুনো ফুলের ঝিলিক, আর সেই ঘাসের মাঝে শালিকেরা আপন তালে হেঁটে বেড়াত। ঝোপে লুকিয়ে থাকত গুবরে পোকা, মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসত রোদে গা সেঁকতে। দূরে দু-একটা গাছ ছিল, ছায়ায় জড়ানো, যেন নির্জন বিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক স্তম্ভ। প্রকৃতি যেন এখানে নিজের খাতা খুলে বসেছিল—প্রতিটি পাতায় ছিল ছেলেবেলার অনুপম ছবি, অক্ষরহীন অথচ জীবনের গভীর ভাষায় লেখা।
অনিমেষ বাবুর চোখে সেই মাঠটি ছিল এক স্নেহময় পাঠশালা—সিলেবাসহীন, নিয়মছাড়া, কিন্তু প্রাণের ছন্দে পূর্ণ। এখানে কোনো ঘণ্টা বাজত না, কিন্তু প্রতিটি হাওয়ায় বাজত শৈশবের নূপুর। শিশুরা খেলত—দড়ি লাফ, মার্বেল, ঘুড়ি ও ফুটবলে। কেউ খালি পায়ে ছুটে চলত সূর্যাস্তের দিকে, কেউ ঝগড়ার ফাঁকে হেসে উঠত হঠাৎ। তাদের হাসিতে, দৌড়ে, ধুলোর ভেতর থেকেও যেন একটি স্বপ্ন জেগে উঠত—একটি শৃঙ্খল মুক্ত জীবনের কথা মনে করিয়ে দিত।
এই শিশুরাই হয়ে উঠেছিল অনিমেষ বাবুর নতুন ছাত্র। কাগজে তাদের নাম লেখা না থাকলেও তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল—রুবেল, টুকাই, মোনা, পিয়াল… যেন কোন গল্পের চরিত্র তারা। কেউ কেউ খেলতে খেলতে জানালার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ত, আর তিনি স্নেহভরে জবাব দিতেন মৃদু হাসিতে। বসে বসে তিনি যেন শুনতেন এক অদৃশ্য পাঠশালার প্রতিধ্বনি—যেখানে জীবনের নিঃশব্দ রাগিণী ধীরে ধীরে বেজে উঠত তাঁর অন্তরে।
একদিন হঠাৎ, সেই শান্ত মাঠের বুক চিরে ঢুকে পড়ে নির্মাণ যন্ত্রের গর্জন। যেন এক নির্দয় আঘাত প্রকৃতির কোমল শরীরে। ভারী ট্রাক এসে দাঁড়ায়, শব্দহীন দুপুরকে বিদীর্ণ করে ধপধপিয়ে পড়ে ইঁটের স্তূপ, আর কংক্রিটের প্রথম স্তম্ভ দাঁড়িয়ে যায় শিশির ভেজা ঘাসের কোমল বুকে। চাকা ঘোরে, ধুলো উড়ে এসে বসে অনিমেষ বাবুর জানালার চৌকাঠে—বিষণ্ণ এক সংলাপের প্রতীক হয়ে। সেই পরিচিত দৃশ্যপট এক অচেনা ভৌতিক আড়ালে ঢেকে যায়।
“বসুন্ধরা রেসিডেন্সি”—এই নামে চিহ্নিত হয় সেই নতুন প্রকল্প। পাঁচতলা বিশিষ্ট ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স, কারপেটেড রাস্তা, ভিডিও ডোর ফোন, সিসিটিভি, জিমনেশিয়াম—সব আছে, শুধু নেই এক চিলতে খোলা মাঠ, এক টুকরো আকাশ, আর হাওয়ায় ওড়া কাগজের ঘুড়ি। দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়, আর ধীরে-ধীরে হারিয়ে যায় খেলার মাঠ, খোলা রোদ, শালিকের ছায়া। জানালার ওপাশে গজিয়ে ওঠে কংক্রিটের উঁচু দেয়াল, যা আড়াল করে দেয় সূর্যরশ্মি, হাওয়ার অনাবৃত প্রবাহ, এমনকি শিশুর সুরেলা কণ্ঠস্বরও।
🍂
ad

রুবেল, টুকাই, মোনা—তাদের নাম এখন আর কেউ নেয় না। তাদের হাসির রেশ মিশে যায় গাড়ির হর্নে, লিফটের শব্দে, আর ইন্টারকমের যান্ত্রিক বিপবিপে। সেই নির্জন দুপুরগুলো, যখন অনিমেষ বাবু জানালায় বসে হাওয়ার সঙ্গে কথোপকথনে মগ্ন হতেন, এখন সেগুলোও যেন কঠোর শাসনে শায়িত হয়ে গেছে । মাঠের ওপরে উঠেছে চেহারাবিহীন, শীর্ণ ছায়া—একঘেয়ে, নিরাবেগ, ইট-সিমেন্টের অনির্বচনীয় স্থবিরতা।
এক সন্ধ্যায়, নিঃশব্দে ডায়েরি খুলে অনিমেষ বাবু লিখে রাখেন তাঁর হৃদয়ের উদ্যত দুঃখ—
“মানুষ যখন নিজের শৈশব হারায়, তখন সে কষ্ট পায়। কিন্তু যখন সে অন্যের শৈশব হারাতে দেখে, তখন সে সত্যিই একা হয়ে যায়। তখন আর কিছুই ফেরে না—না খেলার মাঠ, না জানালার রোদ, না সেই হাওয়ায় ভেসে আসা অচেনা গানের কলি।”
এক বিকেলে  হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায় পুরো পাড়ায়। ঘরবাড়ি ম্লান হয়ে যায় চাদরে মোড়ানো অন্ধকারে, যেন সময় থেমে গেছে এক মুহূর্তের জন্য। সেই অন্ধকারেই যেন খুলে যায় অনিমেষ বাবুর মনের এক গভীর কল্পনার জানালা। হঠাৎ করেই, ভোরের আলো এসে মিশে যায় গোধূলির আকাশের তটে। ঠিক তখন, জানালার বাইরে, ফ্ল্যাটের এক কোণে ধীরে-ধীরে খুলে যায় একটি ছোট জানালা। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে এক মেয়ে—ছোট্ট হাতের মুঠিতে থাকা পুতুল যেন জীবনের নরম স্পর্শ। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত বিস্ময়, যার ভেতর লুকিয়ে ছিল সেইসব অজানা স্বপ্নের ঝলক, যা দীর্ঘদিন ধরে হারিয়ে গিয়েছিল। মেয়েটির দৃষ্টিতে ছিল এক নবীনতার মৃদু উত্তাপ, যেন যুগান্তরের দূত সে, পুরাতন ও নতুনের মাঝে এক সেতুবন্ধন।
অনিমেষ বাবুর চোখ মুহূর্তে আটকে গেল তার চোখে, যেন হারিয়ে যাওয়া সময় ফিরে পেতে চায় সে ছোট্ট মায়াবী দৃষ্টির মাঝে। মনে হলো, পুরোনো দিনের সেই হাসি, সেই খেলা, সেই অজানার খোঁজ মিশে এসেছে আবার নতুন রূপে। হঠাৎ করেই জীবনের হারানো এক অধ্যায় ফিরে এসে ভিড় করছে তাঁর হৃদয়ে।
পরদিন সকালে, সেই অনুভূতি নিয়ে অনিমেষ বাবু  একটি ছোটো বাক্স রাখলেন জানালার পাশে—বাক্সের মধ্যে ছিল একটি পুরনো বই, “ঠাকুরমার ঝুলি”। বিকেলে, মেয়েটি আসলো সাবলীল পায়ে, হাতে তুলে নিল বইটি। তার চোখে ঝলমল করছে একরাশ আলো—একই আলো, যা একসময় অনিমেষ বাবুর শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করত জানালার ফাঁক দিয়ে, জ্ঞানের উন্মেষে।
এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায়, মেয়েটি যেন অনিমেষ বাবুর একান্ত বন্ধু হয়ে উঠল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে কখনও পুতুল নাচায়, কখনও রঙিন কাগজে আঁকা ছবি দেখায়, আবার কখনও শুধু নীরবে হাত নাড়ে—এক ধরণের অদৃশ্য ভাষায় যা কেবল হৃদয়ই বুঝতে পারে।
অনিমেষ বাবু জানালার বাইরে যা ঘটছে তা কেবল চোখে দেখে বসে থাকেন না—তার চেয়ে বেশি গভীরভাবে তিনি সেটিকে হৃদয়ে অনুভব করেন। জানালার ওপারের কংক্রিটের দেয়াল কিংবা ফ্ল্যাটবাড়ির নিস্তেজ ধারগুলো তাঁর কাছে আর শুধুমাত্র দৃশ্য নয়; বরং এক বিশাল অনুভূতির দিগন্ত, যেখানে স্মৃতি, শৈশব, সময় এবং জীবন একসাথে হাঁটছে।
প্রতিটি সন্ধ্যায় মেয়েটির ছোট্ট আঙুলের ইশারা, তার চোখের কৌতূহল, পুতুলের নড়াচড়া, আর আঁকা রঙিন ছবিগুলো তাঁর জন্য এক অদৃশ্য বার্তা নিয়ে আসে— যা বোধগম্য হয় হৃদয়ের গভীরে, চোখের বাইরে। জানালার ওপার যেন একটি জীবন্ত কবিতা, যেখানে নীরবতাই কথোপকথন, এবং অনুভূতি হয়ে ওঠে শব্দ।
অনিমেষ বাবু সেই অনুভবের গভীরে হারিয়ে যান। স্মৃতির পাতা উলটে ফিরে আসেন এক অদেখা জগতে—যেখানে শৈশব কখনো মরে না, কেবল সে ঘর বদলায়। দেয়াল পেরিয়ে সে ছুটে আসে নতুন জানালায় দাঁড়াতে, পুরোনো কাউকে ডাকে, হারানো দিনের গল্প বলতে। ডায়েরির এক পৃষ্ঠায় তিনি আবার লিখে রাখেন— “শৈশব কখনো মরে না। সে শুধু স্থান বদলায়, দেয়াল পেরিয়ে যায়, আর নতুন জানালায় এসে দাঁড়ায়—একদিন পুরোনো কাউকে ডাক দেওয়ার জন্য।”
এই কথাগুলো শুধু বাক্য নয়, বরং তাঁর জীবনের এক নিঃশব্দ সত্য, যা প্রতিদিন তাঁর হৃদয়ে গুণগুণ করে। জানালার ওপারে, মেয়েটির চোখে, সেই শৈশব আবার জেগে ওঠে—নতুন রঙে, নতুন স্পন্দনে, কিন্তু আগের মতোই গভীর এবং প্রাণবন্ত।

Post a Comment

0 Comments