জ্বলদর্চি

শ্রীকবি শঙ্কর দাস (মধ্যযুগের কবি, চন্দ্রকোনা) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৬২
শ্রীকবি শঙ্কর দাস (মধ্যযুগের কবি, চন্দ্রকোনা) 

ভাস্করব্রত পতি

কোনও এক সময়ে জয় সিংহ নামে এক শিবভক্ত রাজা ছিলেন দিলীপনগরে। তিনি নিয়মিত শিবলিঙ্গের পূজা করতেন। 
'দিলীপনগরে রাজা নামে জয় সিংহ 
শিব ভক্ত মহারাজ পূজে শিব লিঙ্গ'।
সেই রাজা জয় সিংহের সাত রাণী নিয়ে বিশাল সংসার। কিন্তু তাঁদের কারোরই কোনও সন্তানাদি ছিল না। তাই রাজা এবং রাণীদের খুব দুঃখ। 
'সাত রাণী আছে তার পুত্র কন্যা নাই 
বিধাতা বিমুখ তারে করেছে গোঁসাই'।
কবি তাঁর কাব্যে উল্লেখ করেছেন রাজার সাত রাণীর নাম। 
'অমলা, কুন্তলা, কলা আর বিধুমুখি 
চন্দ্রাবতী, বিদ্যাধরী আর সুধামুখি'।
এই রাণীদের কারও কোল আলো করে সন্তানাদি না থাকায় রাজা ছিলেন চিন্তিত। বিধাতার করুনা বর্ষণ থেকে বঞ্চিত রাজা জয় সিংহ ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনে বেজায় কষ্ট রেখে কালাতিপাত করছিলেন। 

এমতাবস্থায় ষষ্ঠীদেবী এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশে রাজ দরবারে এলেন ভিক্ষাচ্ছলে পূজা চাওয়ার জন্য। রাজার কাছে পূজা পেলে তবেই মর্ত্যে তাঁর পূজা হবে। সেসময় অপুত্রক রাজা জয় সিংহ ছদ্মবেশী দেবীকে ভিক্ষা দিতে গেলে তিনি রাজাকে জানান, 'হে রাজন, আমি তোমার ভিক্ষা নিতে পারি না। তুমি হলে সন্তানহীন পিতা। তোমার মতো আঁটকুড়োর হাত থেকে ভিক্ষা নেওয়া সমীচীন নয়'। এতে প্রচণ্ড অপমানিত হলেন রাজা। কিন্তু বুঝতে পারেননি দেবীর অভিলাষ। তৎক্ষণাৎ তিনি ঐ ব্রাহ্মণীকে অপমান করে রাজসভা থেকে বের করে দিলেন। 

ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণী এবার চললেন, মান সরোবর তীরে, যেখানে রাজার সাত রাণী স্নান করছিলেন। ব্রাহ্মণী তাঁদের মধ্যে কেবল সুন্দরী ছোটরাণী বিমলাকে নিজের দাসী করে নিয়ে সাত পুত্রসন্তানের মা হওয়ার আশীর্বাদ দিলেন। 
'ফুল বাগানে ফুলের শোভা বনের শোভা হরিণী; 
মায়ের কোলে ছেলের শোভা, ছেলের শোভা জননী'।
ব্রাহ্মণীর বরে নির্দিষ্ট সময়ে ছোট রাণী গর্ভবতী হলেন। কিন্তু তা জানতে পেরে বাকি রাণীদের খুব হিংসা। 
'গর্ভব্যথা পায় রাণী বিমলা সুন্দরী 
কপট বিচার করে আর ছয় নারী'। 
ছয় রাণী প্রমাদ গুনলেন। ছোট রাণীর ছেলে হলে তো সেইই রাজার ভালোবাসা বেশি করে পাবে! এটা ভেবেই তাঁদের মন কূটকাচালিতে ভরে উঠলো। 
'বিমলার পুত্র হলে মোরা কিসের অধিকারী, 
রাজমাতা হবে সে সর্বস্য তাহারই'।

এরপরেই ছয়রাণী একসাথে ছোট রাণীর বিরুদ্ধে শুরু করলো কুযুক্তি। যুক্তি আঁটতে লাগলো কিভাবে ফাঁদে ফেলা যায়। যথাসময়ে বিমলার পুত্র হল। সকলের সিদ্ধান্ত, তাঁদের জলে ফেলে দেওয়া হবে একে একে। ছয় রাণীই সেই ভয়ঙ্কর কাজটি নির্দিধায় করে যায়। ছোট রাণীর পরপর ৭ টি সন্তানকেই তাঁরা জলে ফেলে দেয়। আর রাজাকে মিথ্যে তথ্য দিয়ে তাঁরা জানায় যে --
'প্রথমেতে মুড়া ঝাঁটা, তার পর ছাতি 
তারপর লাতাকানি, পরে ধূপবাতি 
অতঃপর খোলা গুড়া আর ছেঁড়া কানি 
চেনাকাঠি প্রসবিতে হল জানাজানি। 
অলক্ষুণে রাণী এই শুন রাজাজী 
না জানি বিবাদ রাজা আর বা আছে কি?'

এসব কথা অবলীলায় বিশ্বাস করে নেয় রাজা। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রাজা জয় সিংহ তখন তাঁর আদরের ছোট রাণী বিমলাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। কিন্তুন্তু এতে বাধা দিলেন রাজার পাত্র মিত্র ও সিপাই সান্ত্রীরা। বরং তাঁরা প্রস্তাব দিলেন, রাণীকে রাজার ঘোড়াশালে আশ্রয় দিতে। রাজা সেটাই করলেন। ঘোড়াশালে রাণী অছ্যুৎ হয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। সন্তানহীনা মায়ের বুক জুড়ে সন্তান হারানোর যন্ত্রনা। 
'আকুলেতে বিমলা যে করিছে রোদন 
বর দিয়া যষ্ঠীমাতা বধিল জীবন। 
এইরূপে অনাহারে নিদ্রাগত হল 
নিশিযোগে ষষ্ঠীমাতা তাহারে কহিল। 
কেন কাঁদ, মনে ক্লেশ না করিহ আর 
বর দিয়া আমি বন্দি হয়েছি তোমার। 
তোর পুত্র লাগি আমি ছাড়িনু কৈলাশ 
তোরে বর দিয়া আমি জ্বলে কৈনু বাস। 
দেবী বলে, সাত পুত্র প্রসব হইল 
কুট করি ছয় রাণী জলে ফেলে দিল। 
বাঁচায়ে রেখেছি তারে জলের ভিতরে 
আটিয়ার সঙ্গে থাকি তারে কেন মারে?'

দুঃখিনী ছোট রাণী বিমলা ষষ্ঠীদেবীর কৃপায় সাতটি সন্তানেরই দর্শন পেলেন। আনন্দে ভরে উঠলো মন প্রাণ। মায়ের স্নেহে বুকের দুধ খাওয়াতে লাগলেন রাণী। 
'স্তন দিয়া পুত্র মুখ, আনন্দিত মন 
পার্বতী পাইল যেন কোলে গজানন।'

বিমলার সব দুঃখের অবসান ঘটল। এবার চাইলেন রাজার সাথে মিলন ঘটাতে। তিনি তখন দেবীর কাছে সরাসরি প্রার্থনা জানালেন। দেবীর মন বিগলিত হল বিমলার করুন প্রার্থনায়। 
'এতেক শুনিয়া দেবীর দয়া উপজিল 
আপনার আভরণ সকলই পরাল। 
চিরুনিতে আঁচড়িয়া কুন্তল কেশ বন্দ 
রচিত করিল চুষ্য চন্দনের গন্ধ। 
পিতাম্বর লভি মাতা পরাণ আপনি 
আষাড়িয়া মেঘ যেন চমকে দামিনী।'

অবশেষে একদিন রাজার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল রাণীর। তখন রাজা জয় সিংহ বিমলাকে দেখে খুব রেগে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন এই নারী কোথা থেকে এমন বস্ত্র অলংকার পেল। খুব অবাকই হলেন। 
'কোথা সে পাইল হেন বস্ত্র অলংকার 
সুগন্ধে সৌরভ তার ভ্রমর ঝংকার।
বেশ্যা যেমন লম্পটে সৌরভ দেখায় 
সেই রূপ দেখি আজ ভুলাবে আমায়।
মাজলে পিতল চিকন, পুরুষ চিকন রায় 
পর পুরুষে নারী চিকন, ছেলে চিকন মায়।'

ক্রোধান্বিত রাজা রাজা জয় সিংহ কিছু না বুঝে নিজের রাণীকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। কে তাঁকে এরকম গয়নাগাটি দিয়েছে -- জিজ্ঞাসা করলেন। তখন রাণী বিমলা রাজাকে শান্তস্বরে বললেন, যে আমাকে এইসব দিয়েছে, তাঁর কাছে চলুন। আপনার সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব মুছে যাবেই। রাজাকে নিয়ে রাণী জলাধারের সামনে পৌঁছে দেখালেন তাঁদের সাতজন শিশুপুত্র এবং এক বৃদ্ধাকে। রাণী সব জানালেন রাজাকে এবং ষষ্ঠীমাতার কৃপাতেই যে এসব হয়েছে, তাও জানালেন। 

রাণীর মুখে সব ঘটনা শুনে রাজার ভুল ভাঙলো। বুঝলেন সব ঘটনার নেপথ্যে তাঁর ছয় রাণীর কারসাজি। তখন তিনি ঐ রাণীদের হত্যা করতে চাইলেন। সেসময় স্বয়ং ষষ্ঠীদেবী এসে তা রুখে দিলেন। রাজাকে তাঁদের ক্ষমা করে দিতে বললেন। এরপর দেবী বিমলার শিশু পুত্রদের ছয় রাণীর হাতে তুলে দিলেন। সবশেষে দেবী তাঁর আত্মপরিচয়ে জানালেন --
'ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর বসি একস্থানে 
এ মর্তে পাঠালো মোরে জাহির কারণে 
রাজা বলে সত্য বটে দেবী ভগবতি 
কে তোমায় চিনিতে পারে হেন কার শক্তি।'

ষষ্ঠীদেবীর কথায় জয় সিংহের যাবতীয় ভুল ভাঙে। নিজের তাগিদেই মহাসমারোহে দেবীপূজা করলেন। এই কাহিনি নিয়েই মধ্যযুগের মেদিনীপুরের অখ্যাত কবি শঙ্কর দাস লিখেছেন তাঁর ষষ্ঠীমঙ্গল কাব্য বা ষষ্ঠীর পাঁচালি। হলদিয়া, নন্দীগ্রাম, খেজুরী এলাকায় একসময় তা বেশ জনপ্রিয় ছিল। সেই পাঁচালিতে গাওয়া হত ওড়িশার করন সম্প্রদায়ের একটি প্রাচীন সংস্কার তথা বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত উপরোক্ত বিশেষ কাহিনি। বিভিন্ন পরিবারের সন্তান জন্মগ্রহণ উপলক্ষে ষষ্ঠীর পূজার সময় গীত হত এই পাঁচালিগান বা ষষ্ঠীমঙ্গল পালাগান। এর ভনিতাতে উল্লিখিত ছিল --
'জাজপুরে জাত শ্রীগুরু প্রসাদ 
সূর্য্য বংশে রঘুবীর 
রূপে মনোহর বচন গম্ভীর 
কর্ণের সমান দানে, 
সীতারাম তাত একবংশে জাত
শ্রীকবি শংকরে ভনে'।
  -- (ষষ্ঠীমঙ্গল পালা বা ষষ্ঠীমঙ্গল) 

শ্রীকবি শঙ্কর দাস ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অতি স্বল্প পরিচিত এক নাম। খুব কম লোকই জানে মেদিনীপুরের এই সুযোগ্য সন্তানটিকে। যদিও কবির পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল ওড়িশার জাজপুর জেলায়। অর্থাৎ কবির পরিবার ছিলেন এখানকার আদি বাসিন্দা। তাঁরা ছিলেন জাতে করণ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। কবির লেখা ষষ্ঠীমঙ্গল পালাতে নিজের পরিচয় এভাবেই দিয়েছেন তিনি। মোট ১৩ টি পরিচ্ছেদে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে এই পালায়।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনার রাজাবাজারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর মাতা ছিলেন যশোমতী দাস। কবি তাঁর আত্মপরিচয় দিয়েছেন এভাবে --
'আদ্যাশক্তি চন্দ্রকোনা,
সবে করে ধন্য ধন্যা
নাম যার শ্রীরাম সুদাস;
রাজার বাজারে স্থিতি,
যশোমতী পূণ্য খ্যাতি
বিশালাক্ষী পদে যার আশ।
তাহার অগ্রজ শ্যাম,
সীতারাম দাস নাম
তার ছোট ভাই গোবর্ধন
তাহার অনুজ ভাই,
ষষ্ঠীর আদেশ পাই
শ্রীকবি শংকরে বিরচন'।

আলোচিত করণ সম্প্রদায়ের লোকজন বিশ্বাস করতো যে নবজাতক নবজাতিকার ছয়দিন বয়সে তাঁদের ভাগ্য ফেরানোর জন্য স্বয়ং বিধাতা কলম ধরতে আসেন তাঁদের বাড়িতে। তাই বাচ্চার জন্মের ষষ্ঠ দিনটিকে খুব মান্যতা দেওয়া হয়। শ্রদ্ধায় উদযাপন করা হয়। গর্ভবতী নারীদের বিশ্বাস, যদি ষষ্ঠীদেবী প্রসন্ন হন, তবে আসন্ন জাতকদের কল্যান হবেই। এই ষষ্ঠীদেবী আবার অপুত্রক নারীদের পূজিতা দেবী। দেবী প্রসন্না হলে পুত্রের মা হতে পারেন বাবা মা। এই দিনকে বলে 'ষেটেরা'। এদিন বাড়িতে প্রদীপ জ্বালানো হয়। পুজো করা হয়। এই আচারকে বলা হয় 'সারি আচার'। প্রত্যন্ত গ্রামের এই লৌকিক আচার থেকে ঐ দিন বাড়িতে অভিনিত হয় যষ্ঠিমঙ্গল কাব্য বা ষষ্ঠীর পাঁচালি। এজন্য পালাকাররা লিখেছেন এইসব অনুষ্ঠানের জন্য মঙ্গলকাব্য। 

কবি শঙ্কর দাসের কাব্যটি সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রচিত। আসলে কবিকংকন মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যটি রচিত হয়েছিল ১৭৫৩ সালে। স্বভাবতই তার পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কবিদের রচনাই ষষ্ঠীমঙ্গল পাঁচালি। তাই এহেন অনুমান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই কাব্যটি ছাপার অক্ষরে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। গবেষক চিত্তরঞ্জন মাইতি গ্রামে অভিনীত এই কাব্যের গায়কদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছেন। যা এক মূল্যবান সম্পদ আজ। সংগ্রাহকের কথায়, 'অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে কাব্যটির রচনার কাল অনুমান করা অসংগত হবেনা। কবির কাব্যটি মুদ্রাযন্ত্রের কৃপালাভ করেনি। কয়েকটি ষষ্টীবাসর থেকে কাব্য বা পাঁচালিটি আমি সংগ্রহ করেছি'। কবির লেখা এই একটিমাত্র কাব্যেরই সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। মেদিনীপুরের এই কবির সেই কাব্য একটি প্রাচীন লোককাহিনির ওপর নির্ভর করে রচিত। কাব্যের সেই কাহিনির দিকে উঁকি দিলে বেরিয়ে আসবে তৎকালীন সমাজের এক চিত্র।

তথ্যসূত্র : এষণা, ত্রয়োদশ সংকলন ২০০২, অবিভক্ত মেদিনীপুরের আদি কবি ও তাঁর কাব্য প্রসঙ্গ -- চিত্তরঞ্জন মাইতি

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments