জ্বলদর্চি

দূর দেশের রূপকথা -- ২৪৫ রাজার মেয়ে রানীর মেয়ে (স্কটল্যান্ড—ইউরোপ) /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের রূপকথা -- ২৪৫ 

রাজার মেয়ে রানীর মেয়ে 

(স্কটল্যান্ড—ইউরোপ) 

চিন্ময় দাশ


এক ছিল রাজা, আর তার ছোট রানী। বড় রানী বেঁচে নেই। তবে তার একটি মেয়ে আছে। তাকে সবাই বলে রাজার মেয়ে। আর ছোট রানীরও একটি মেয়ে আছে। তার পরিচয় রানীর মেয়ে।

রাজার মেয়েটি দেখতে সুন্দরী। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে। আর ব্যবহারটিও তেমনি মিষ্টি। রাজ্যের সবাই তাকে ভালোবাসে। 

এদিকে রানীর মেয়ে দেখতে মোটেই ভালো নয়। মেজাজটিও তার সব সময় তিরিক্ষি। সারা রাজ্যে একজনও কেউ তাকে ভালোবাসে না।

এইজন্যই রাজার মেয়েকে একদম পছন্দ করত না ছোট রানী। তার মনে সব সময় একটা চিন্তাই ঘুরে বেড়ায়। কী করে রাজবাড়ি থেকে মেয়েটাকে তাড়ানো যায়। অনেক ভেবে চিন্তে, একটা ফন্দি বার করল। অসুখের ভান করে, শুয়ে রইলো বিছানায়। রাজাকে বলল-- যদি রাজার মেয়ে তেপান্তরের কুয়োর জল এনে দেয় আমাকে, তাহলে আমার রোগ সারতে পারে।

রাজার মেয়ে কেবল দেখতেই সুন্দর নয়, মনটিও তার ভারী সুন্দর। ছোট রানী তাকে একটা জলের পাত্র ধরিয়ে দিতে, সরল মনে সে ছোটমার জন্য জল আনতে চলল। এদিকে তেপান্তরের মাঠের যেন শেষই নেই। একেবারে পৃথিবীর শেষ সীমায় পৌঁছে, তবেই সেই মিষ্টি জলের কুয়া। সেখানে একবার গেলে, কেউ আর ফিরে আসতে পারবে না। আর, ছোট রানি তো সেটাই চায়।

জল আনতে চলেছে রাজার মেয়ে। কত পথ চলতে চলতে, চলতে চলতে একদিন এসে দাঁড়ালো সেই তেপান্তরের মাঠের পাশটিতে। সেখানে একটা ঘোড়া বাঁধা আছে গাছের সাথে। মেয়েকে দেখে, ঘোড়া বলে উঠল—

দাও খুলে দাও বাঁধন আমার, ওগো সোনার মেয়ে।

বাঁধা আছি গেছে চলে সাতটি বছর বেয়ে।। 

রাজার মেয়ে ঘোড়ার দুঃখের কথা শুনল। সাথে সাথে জবাব দিল—

এই এক্ষুনি দিচ্ছি বাছা, দিচ্ছি বাঁধন খুলে। 

সাতটি বছর আটকে আছো, দুঃখ যেও ভুলে।


বাঁধনছাড়া পেয়ে, ঘোড়ার মনে দারুণ আনন্দ। সে রাজার মেয়েকে বলল-- কষ্ট করে পায়ে হেঁটে যাবে কেন? আমার পিঠে চেপে পড়ো। তেপান্তরের মাঠ আমি পার করে দেব তোমাকে। 

রাজার মেয়েকে পিঠে তুলে নিল ঘোড়া। তারপর তেপান্তরের মাঠ পাড়ি দিতে লাগলো। দূর, আরো দূর, কতদূর পথ যে সে পাড়ি দিল, হিসাব নাই। তারপর একদিন এসে পৌঁছালো সেই কুয়োর কাছে।

কিন্তু পৌঁছলে কী হবে? জলের নাগাল পেলে তো! রাজার মেয়ে তাকিয়ে দেখল, জল রয়েছে অনেক নিচে। সেখান থেকে জল তুলবে কেমন করে সে? এমন সময় ধুলো-কাদা মাখা তিনজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পেল মেয়েটি। তারা বলল—

সাফ করে দাও তুমি মোদের, ওগো সোনার মেয়ে।

গা মুছিয়ে দাও তোমার ঐ রঙিন ওড়না দিয়ে।। 

রাজার মেয়ে তাকিয়ে দেখলো তিন সন্যাসীকে। জবাব দিল—

যা বলেছেন করছি সবই, সাধু মহারাজ। 

ঋষির সেবায় ওড়না আমার ধন্য হবে আজ।।

তিন- সন্ন্যাসীকে যত্ন করে সাফসুতরো করে তুলল রাজার মেয়ে। ঝলমলে রঙিন ওড়না ছিল গায়ে। তা দিয়ে গা মুছিয়ে দিল তিনজনের। সন্ন্যাসীরাও খুশি হয়ে কুয়োর মিষ্টি জলে ভরে দিল রাজার মেয়ের পাত্রটি।

মেয়েটি রওণা দেবে। তিন সন্ন্যাসী নিজেরা আলোচনা করতে লাগলো, আহারে, কী সুন্দর মনের মেয়ে! কী বলে আশীর্বাদ করি একে।

প্রথমজন বলল-- আমি আশীর্বাদ করছি, সুন্দরী হবে এই মেয়ে। আগে যা সুন্দরী ছিল, তার দশ গুণ।

দ্বিতীয়জন বলল-- প্রত্যেকবার কথা বলার সময় একটা করে হিরে, একটা মণি আর একটা মুক্তো ঝরে পড়বে এই মেয়ের মুখ থেকে।

তৃতীয় সন্ন্যাসী বলল-- আমি আশীর্বাদ করছি প্রত্যেকবার মাথায় চিরুনি দেবার সময়, মাথা থেকে সোনা-রূপো ঝরে পড়বে।

জল ভরা হয়ে গেছে। আবার ঘোড়ার পিঠে চাপলো মেয়ে। জল নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরেও এলো। এখন সে দেখতে আরো সুন্দরী। আগের চেয়ে দশ দশ গুন বেশি। যখনই কথা বলার জন্য মুখ খুলছে, হীরে মণি মুক্তো ঝরে ঝরে পড়ছে তার মুখ থেকে। আর চুলে চিরুনি বসালেই, ঝরে পড়ছে সোনা আর রুপো।

অবস্থা দেখে, ছোট রানীর তো চোখ ছানাবড়া। কথাই সরে না মুখ দিয়ে। সে ভাবলো, তাহলে আমার মেয়েটাকে কেন পাঠাই না, জল আনতে? তারও তো তাহলে কপাল খুলে যাবে এভাবে। 

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। রানীর মেয়ে রওনা হলো কুয়োর জল আনতে। চলতে চলতে সে একসময় হাজির হলো তেপান্তরের মাঠের কাছে। সেখানে গাছের ডালে বাঁধা ঘোড়া বলে উঠলো—

দাও খুলে দাও বাধন আমার, ওগো রানীর মেয়ে।

 বাঁধা আছি সাতটি বছর গেছে চলে বয়ে।।

কথাগুলো কানে গেছে রানীর মেয়ের। সে ঘোড়ার দিকে চেয়ে দেখল। জবাব দিল—

তোর বাঁধনে হাত ছোঁয়াবো, ভাবিসটা তুই কী ?

জানিস না কি? আমি হলাম ছোট রানের ঝি।। 

ঘোড়ার বাঁধন খুলে দিল না সে। তাতে হলো কী, ঘোড়াও তাকে তেপান্তরের মাঠ পার করিয়ে দিল না। কতদূর হেঁটে হেঁটে, হেঁটে হেঁটে একদিন সে এসে পৌঁছালো কূয়োটার কাছে। কিন্তু জল যে অনেক গভীরে! নাগাল পাবে কী করে? 

সেই তিনজন সন্ন্যাসী বলে উঠলো—

সাফ করে দাও তুমি মোদের, ওগো রানীর মেয়ে। 

গা মুছিয়ে দাও গো তোমার রঙিন ওড়না দিয়ে।।

 রানীর মেয়ে তো হেসে বাঁচে না। বলল—

বলছোটা কী? এই তোমাদের ধুলো-কাদার দেহ। 

এমন রঙিন ওড়না আমার, নষ্ট করে কেহ? 

রানীর মেয়ে তাদের সাহায্য করল না। তারাও তাকে জল তুলে দিল না কুয়া থেকে। নিজেরা বলাবলি করতে লাগলো, কী বিচ্ছিরি এই মেয়েটি! একে কী বলা যায়?

প্রথম সন্ন্যাসী বলল, এই মেয়ে যতটা কুৎসিত, তার থেকে দশগুণ কুৎসিত হবে। 

দ্বিতীয়জন বলল, যখনই কথা বলবে মেয়েটা, ওর মুখ থেকে ইঁদুর ছানা আর কাঁকড়া বিছে বেরিয়ে আসবে।

তৃতীয় জন বলল, মেয়েটা মাথায চিরুনি দিলেই, উঠে আসবে মুঠো মুঠো উকুন আর এক দলা করে মাংস।

কুয়োর মিষ্টি জল তোলা হলো না রানীর মেয়ের। বহু দিন ধরে পথ চলতে চলতে, একদিন সে ঘরে ফিরেও এলো। কিন্তু দেখতে এখন হয়েছে আগের চেয়ে দশগুণ কুৎসিত। কথা বললেই, বেরিয়ে আসছে ইঁদুর ছানা আর কাঁকড়া বিছে। উকুনের ঝাঁক আর দলা দলা মাংস উঠে আসছে মাথায় চিরুনি ছোঁয়ালেই।

এমন মেয়েকে কি আর রাজবাড়িতে রাখা যায়? দূর- ছাই করে তাড়িয়ে দেওয়া হলো রাজধানী থেকে।

ক’দিন না যেতে, একদিন এক রাজার ছেলে এসে হাজিরত রাজবাড়িতে। সাথে তিন জন সন্ন্যাসী আর একটা ঘোড়া। যেমন রূপ রাজকুমারের, তেমনি তার পোশাক পরিচ্ছদ অলংকার। তার ঘোড়াটিরও বা কী বাহার! দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। 

যেন এই ছেলের জন্যই সবাই অপেক্ষা করে ছিল। তিন সন্ন্যসীকে দেখে, প্রণাম করলেন রাজামশাই। খাতির করে ভেতরে নিয়ে গেলেন সবাইকে। 

সন্ন্যাসীরা বললেন—রাজামশাই, ভারি গুণবতী মেয়ে আপনার। ওকে আমাদের হাতে দিন। রাজরানি করে রাখব আমরা।  

একদিন মহা ধুমধাম করে রাজকুমারের সাথে বিয়ে হয়ে গেল রাজার মেয়ের।
🍂
ad

Post a Comment

0 Comments