জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /কমলিকা ভট্টাচার্য

গুচ্ছ কবিতা
কমলিকা ভট্টাচার্য

একাদশীর উপবাস

কৃষ্ণপক্ষের একাদশী, চাঁদ যেন মুখ ঢেকে কাঁদে,
নীরব আকাশে ক্ষীণ জ্যোৎস্না, হৃদয়েও ব্যথা মায়ার ফাঁদে।

ফলাহারেই দিন কেটেছে, কেউ বলেনি — করো উপবাস,
তবু করেছিল সে, শুধু ভালবাসার আশ।

পেটের ক্ষুধা নয়, মনে ছিল তৃষ্ণা —
তার চোখে একটুকরো প্রশ্রয়, একফোঁটা দৃষ্টি-স্পর্শই ছিল ভীষণ স্পষ্ট।

সে বুঝল না একাদশীর শুদ্ধতা,
বুঝল না হৃদয়-কথার নিবেদন — শুধু চুপচাপ চলে গেল।

ধর্ম বলে — উপবাসে মেলে মুক্তির দোর,
মেয়েটি চেয়েছিল শুধু মনের দরজা খুলে একটুখানি আদর।

যার জন্য রাখল উপবাস, সে তো ফিরেও চায়নি মুখ,
তার জন্য রেখে গেলো নিঃসঙ্গ এক বিষণ্ণ নিঃশ্বাসের বুক।

কৃষ্ণপক্ষের রাত আজ চুপচাপ জাগে —
এক প্রেম আজ না পেয়ে পূর্ণিমা সাজে শুধুই ফিকে ফাগে।

🍂
ad


নিশির অর্কপ্রভা

হাতছোঁয়া দূরত্বে ছিলে না,
তবুও পাতা উল্টোতেই জেগে উঠল আলোহীন আগুন।
শব্দেরা ভিজে গেল
ঝর্ণার রেশে, উল্টো বয়ে গেল সময়।

একচিমটে গোধূলি ছিল তোমার কণ্ঠে,
তাতে মিশে গেল সন্ধ্যার সুর
আঙুল মগ্ন হলো তানপুরায়।
আমি নুয়ে পড়লাম শব্দবৃষ্টির নিচে।

জলসা থেমে গেলে
একটা ভেজা ডানা ঝেড়ে ভাব উড়ে গেল
আমার মাথার ওপরে ভার করে আড়ি ,
আঙ্গুলের মাথায় একটু ক্ষতচিহ্ন।

তোমাকে ভাবলেই ভাবনায় স্মৃতির গলন,
সেই গলনের স্রোতে আমি সাঁতরে উঠি ব্যঞ্জনার কূলে।
সবটুকু তো ছিল না
কিছুটা ছিল থেমে যাওয়া বেতার তরঙ্গে
বাকিটা ছিল হাওয়ার খামে
সেখানেই লেখা ছিল
একটা যাত্রার ঠিকানা,
যা শেষ হয় না, কেবল পালটে যায়।


আলোর নিচে ছায়া

সময় পালিয়ে যায় আলোর বেগে,
তবু কিছু মুহূর্ত
চুরি করে রেখো —
আলোর চাদরে মুড়ে দাও,
যাতে হারিয়ে গেলেও
স্মৃতির ছায়া ঠিক খুঁজে পায় পথ।

চোখের সামনে থেকেও
হারিয়ে যায় অনেকে —
তখন নিঃশ্বাস ছুঁতে চায় মুখ,
কিন্তু সেই মুখ ঘুমিয়ে পড়ে
অপ্রাপ্তির নিঃশব্দ ভোরে।

মোমবাতির আলোয়
দেখতে পাও একচিলতে মুখ —
যেখানে একদিন হাসি ছিল,
আজ শুধু নিঃশব্দে
জিজ্ঞেস করে — “তুই কাঁদছিস কেন?”

এই সংসার,
জন্মের প্রথম কান্নাতেই শিখিয়ে দেয়
সবচেয়ে কঠিন পাঠ —
নিজে ভেঙে পড়েই তুই
অন্যকে ভরসা দিতে শিখবি।

হয়তো সেটাই জীবন,
একটা দীর্ঘ প্রার্থনা —
যেখানে কেউই পুরোটা পায় না,
তবু কেউ না কেউ চায়
অন্য কারও চোখের জল মুছিয়ে দিতে।


সব থাক মনে মনে

সব থাক মনে মনে —
প্রেম, রাগ, হিংসা, ব্যথা,
আশা, অভিমান, কথা —
এই সামাজিক প্রথা।

কিন্তু আসলে
মনে মনে জমছে অসুখ,
খুন হচ্ছে বাইরের সুখ।

চোখের কোণে হিম হয়ে থাকা
অশ্রু আজ ফুলকি আগুন।

ভাঙা স্বপ্নের করাত চালিয়ে
কাটা পড়ে বিশ্বাসের ডাল,
ভেতরের হিংসে সাপ হয়ে উঠে
কাটে বাইরের উৎসবের খেয়াল।

আমরা জমাই —
রাগের গুদামে অবহেলার পাথর,
দুঃখের কারখানায়
প্রতিদিন তৈরি হয় ঝড়।

প্রেম রাখি তালাবন্ধ বাক্সে,
আদর রাখি মুখোশের নিচে,
আর বাইরে জন্মায় গালাগাল,
লজ্জা পড়ে থাকে রাস্তার পিচে।

হিংসে রাখি শীতল বাতাসে,
অভিমান চাপা দরজার ফাঁকে,
এইভাবে মনের গভীর বিষ
ছড়ায় ধ্বংস পৃথিবীর বাঁকে।

ভবিষ্যতের প্লাস্টিক খোঁপায়
বেঁধে রাখি অসমাপ্ত গান,
আলমারিতে প্রেমের চিঠি নয় —
আজকাল ঠাঁই পায় পরিত্যক্ত
আলব্যাম।

রাগের রসায়নে গলে যায়
চোখে লুকোনো নদীর স্রোত,
হিংসের কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলি
সম্ভাবনার রঙিন কাগজের নৌকো।

আমরা ভাবি —
যা থাকে ভিতরে, তাই বুঝি গোপন!
কিন্তু একদিন সেই ভেতরের স্নায়ুর আগুন
ছড়ায় বাইরে অরণ্যদাহ।

একজন ঠোঁট চেপে রাখা কবি
হয়ে ওঠে রক্ত স্রোতে নীরব সৈনিক,
একজন মৃদুস্বভাব সাধারণের
অন্তঃস্থ শূন্যতায় জন্মায় জল্লাদের ছায়া।

মনে রাখো —
অভ্যন্তরের অসুখের সংক্রমণেই
বাইরের শহরে বাজে অশনির কোলাহল।

তবু সবাই খোঁজে সুখের বৃষ্টি,
ভিজতে চায় আনন্দের ঢেউ,
কেউ দেখে না, কবে যে ভেতর
চুপিচুপি হচ্ছি আমরা শত্রু।

Post a Comment

0 Comments