জ্বলদর্চি

ধ্যানসিং মুণ্ডার শিকার যাত্রা /পলাশ পোড়েল


ধ্যানসিং মুণ্ডার শিকার যাত্রা

পলাশ পোড়েল

শরতের সকালে সূর্য ঠিক যেন একটু বেশি অলস। ঘুম থেকে উঠে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, দূরে কুয়াশার চাদরে মোড়া মাঠ আর গাছপালা। আজ যে আমাদের বহু প্রতীক্ষিত শিকারে যাওয়ার দিন!
সকালের কুয়াশায় মোড়া মাঠের বুক চিরে একদল মানুষ এগিয়ে চলেছে নিঃশব্দে। আমি, বাবা, ধ্যানসিং আর সুরেন হাঁসদা সামনে।পিছনে পাঁচজন গাট্টাগোট্টা সাঁওতাল যুবক। শেষে গ্রাম মোড়ল রাবণ সর্দার। বাবার হাতে পুরনো এক বন্দুক, যেটা তিনি যত্ন করে রাখেন আলমারির ওপরে। আজ আমি প্রথমবারের মতো শিকারে যাচ্ছি।গ্রামে বুনো শুয়োরের অত্যাচারে চাষীদের ফসল দফারফা। তারা কিছুতেই তাদের হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে পারছে না। সবাই মিলে মিটিং করে শিকার করার আয়োজন করা হয়েছে। বাবা আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিলো না প্রথম। তারপর অনেক করে ম্যানেজ করেছি। আমরা সবাই হাঁটতে হাঁটতে রওনা দিলাম। সকালের নিস্তব্ধতা, ঘাসে জমে থাকা শিশির, আর দূরের কাকের ডাক—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল। আমি একটু ভয়ে, একটু উত্তেজনায় বারবার বাবার দিকে তাকাচ্ছিলাম।এই সুন্দর পরিবেশে গান করতে ইচ্ছা করছে। 
“চুপ করে হাঁটো,” বাবা ফিসফিস করে বললেন, “জঙ্গলের শিকার শব্দে পলায়ন করে।”
আমরা হাঁটছিলাম গ্রামের পাশে ‘বড় জঙ্গল’-এর দিকে। জায়গাটা রহস্যময়। ছোটবেলায় শুনেছি, সেখানে নাকি রাত হলে শেয়ালের ডাকে কুকুর পর্যন্ত পালিয়ে যায়। আজ তবে আমরাই যাচ্ছি সেই গহীনে।জঙ্গলে ঢোকার পর আমাদের পা চলছিল ধীরগতিতে। চারদিকে কেবল পাতার খসখস শব্দ আর পাখির ডাক। 
জঙ্গলে ঢুকে মিনিট পাঁচেক কাটেনি, হঠাৎ একটা খসখস শব্দে আমাদের পা থমকে গেল। ধ্যানসিং গাছের আড়াল থেকে দেখলেন—একটা শুয়োর গাছের গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে চঞ্চল চোখে তাকাচ্ছে। তিনি নিশ্বাস আটকে বন্দুক তুললেন। গুলির শব্দে পাখিরা উড়াল দিল আকাশে, কিন্তু শুয়োরটা হঠাৎ লাফিয়ে বনে গায়েব !
“বাঁচিয়ে দিলি!” সুরেন হতাশ কণ্ঠে বললেন।
ধ্যানসিং মাথা নিচু করে হাসল, “পরের বার হাত কাঁপবে না সর্দার।”
🍂
ad

বুনো শুয়োরের দেখা নেই।শুধু হাঁটছি।আমি তখন একটু মন খারাপ করলাম, কিন্তু বাবা বললেন, “শিকার মানেই ধৈর্য। তাড়াহুড়া করলে কিছুই হবে না।” আমরা আবার এগিয়ে চললাম। সময় তখন সকাল দশটা। সূর্য একটু উঁচুতে উঠেছে, গাছের পাতার ফাঁকে আলো পড়ে জমিনে এক বিচিত্র ছায়া তৈরি করেছে। মনে হলো শুয়োরের দল। কিন্তু না কাছে গিয়ে দেখা গেল কিছু নেই। 
আমরা আবার হাঁটতে থাকি। ঘন গাছ, নিচে ঝোপঝাড়, মাঝে মাঝে ভেজা মাটিতে ছাপ পড়ে থাকা চেনা-অচেনা পায়ের চিহ্ন। সময় তখন দুপুর ছুঁই ছুঁই।
একটা বড় বটগাছের নিচে বসে পড়লাম সবাই।রাবণ সর্দার ব্যাগ থেকে রুটি, আলুর দম আর ডিম বের করলেন। পাখির ডাক, পাতার দোলা আর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখির ছায়ায় এক মুহূর্ত যেন থেমে গেল সময়।ঝিরঝির বাতাসে ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। 
খাওয়ার ঠিক পরই ধ্যানসিং হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।
“শব্দ শুনছো?” তিনি কান পেতে বললেন।
আমরা থমকে গেলাম। দূর থেকে ভারী কিছুর হাঁটার আওয়াজ। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল—একটা বুনো শুয়োর গুঁতো দিতে দিতে এগিয়ে আসছে ঝোপের দিকে।
ধ্যানসিং কাঁধে বন্দুক তুলে বললেন, “এইবার মিস হলে কিন্তু আমি বাড়ি ফিরছি না। মারাং বুরুর কসম !”
কয়েকটি মিনিটের নিরবতা পালন আর তারপর সেই মিরাক্কেল ঘটল। ধ্যানসিং তাক লাগালো....! বাবাও করলো তাক। যদি ধ্যানসিং না পারে তাই অতিরিক্ত সতর্ক সবাই। 
দু দুটি গুলির শব্দে জঙ্গল কেঁপে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে শুয়োরটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে পাতার ওপরে।মোড়ল রাবণ সর্দার সহ সাঁওতালদের দলটি বুনো গাছের লতায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।গেঁথে দিয়েছে সবাই বল্লাম। হাসিমুখ চকচক করছে সবার। 
আমি চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছি। এই প্রথম এমন দৃশ্য দেখছি! বাবা বললেন, “দেখলে? এটা শিকার—একটা ধৈর্যের খেলা।” 
আমার বুক তখনও ধকধক করছিল। জীবনের প্রথম শিকার দেখে মনে হলো, আমরা যেন আদিম কোনো যুগে এসে পৌঁছেছি।আগুনের গরমে টগবগ করে ফুটছে মাংস। চোখে  এক অদ্ভুত ঘোর। এতবড় প্রাণীকে মারা সম্ভব হলো শেষে। 
বাবা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “শিকার মানে শুধু মারা নয়, শিখতে হয় ধৈর্য, লক্ষ্য আর সময় চিনতে।”
সবাই মিলে শুয়োরটা রশি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে রওনা দিলাম গ্রামের দিকে।

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJune 24, 2025

    Sikar avijan, dur deser golpo, holud upakhan khub valo laglo.

    ReplyDelete