জ্বলদর্চি

স্বর্ণকুমারী দেবী / ঈশিতা ভাদুড়ী


স্বর্ণকুমারী দেবী
/ ঈশিতা ভাদুড়ী


দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫ –১৯৩২) প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক না হলেও রচনার উৎকর্ষ ও পরিমাণের দিক থেকে তাঁকেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা ঔপন্যাসিকের মর্যাদা দেওয়া হয় অবিতর্কিতভাবে। বাংলা সাহিত্যে মহিলা-ঔপন্যাসিকের সাহিত্য সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর নিজস্ব ভাষা-চিন্তা ও সমাজ ভাবনার বিশিষ্ট পরিচয়টি মহিলা ঔপন্যাসিকের সৃষ্টির মধ্যেই যথার্থভাবে প্রকাশিত হতে পারে। স্বর্ণকুমারীর রচনায় নারীচেতনার এই বিশিষ্ট রূপটি স্পষ্ট হয়ে না উঠলেও তাঁর ঔপন্যাসিক প্রতিভাকে অস্বীকার করা যাবে না। সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বর্ণকুমারী দেবী বা কামিনী রায়ের মতো মহিলা সাহিত্যিকদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাঁরা ছিলেন শিক্ষিত বাঙালি নারীসমাজের প্রথম যুগের প্রতিনিধি। সেই হিসাবে তাঁদের দায়িত্বগুলি সাহিত্যরচনার মাধ্যমে পালন করে গিয়েছিলেন তাঁরা। 

স্বর্ণকুমারী দেবী উনিশ শতকে লিখতে শুরু করলেও বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে তাঁর উল্লেখযোগ্য তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল, ‘বিচিত্রা’, ‘স্বপ্নবাণী’, ‘মিলনরাত্রি’। দুই ভাগে লেখা তাঁর ‘স্নেহলতা’ উপন্যাসে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষোর্ধের বাঙালি সমাজ ও জীবনযাপনের ছবি চিত্রিত হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে সমাজ-চেতনা বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। সমাজের নির্মম উদাসীনতায় বিধবা স্নেহলতার সমস্যাগুলি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর নিবিড় চেতনা ও তীক্ষ্ণ লেখনীর মধ্যে দিয়ে। 

সেই সময় ‘ভারতী’ নামে একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ছিল, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ এবং দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছর আয়ু ছিল তার। এই পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে একটি গোষ্ঠী তৈরী হয়, সেই গোষ্ঠীর ভূমিকা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যথেষ্ট মূল্যবান। ভারতী গোষ্ঠী তদানীন্তন সাহিত্য-জগতে আধুনিকভাবাপন্ন এবং যুগোপযোগী ছিল। পত্রিকাটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত হয়েছিল, প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর এগারো বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এই পত্রিকার স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। এই পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হত। এর ভাষাও ছিল সহজ সরল। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যারা বারো বছর ও রবীন্দ্রনাথ এক বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর আট বছর স্বর্ণকুমারী দেবী আবার এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তারপর নয় বছরের ব্যবধানে আবার স্বর্ণকুমারী দেবী এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। এরপর দুই বছর সম্পাদনার পর তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। এই ভাবে ভারতী পত্রিকা প্রায় অর্ধশতাব্দী কালব্যাপী প্রকাশিত হয়।

শুধু সাহিত্যকর্ম নয়, বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবী যুক্ত ছিলেন। অনাথ ও বিধবাদের সাহায্যার্থে ১৮৯৬ সালে ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে তিনি “সখীসমিতি” স্থাপন করেন। সখীসমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অসহায় অনাথ কুমারী ও বিধবাদের শিক্ষাদান করে এবং সেই শিক্ষিতাদের শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত করে সহায়তা করা। সংগঠন পরিচালনা কেবলমাত্র সদস্যদের চাঁদায় সম্ভব নয় অনুভব করে স্বর্ণকুমারী দেবী বেথুন কলেজে একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন করেন। সেই মেলায় ঢাকা ও শান্তিপুরের শাড়ি, কৃষ্ণনগর ও বীরভূমের হস্তশিল্প এবং বহির্বঙ্গের কাশ্মীর, মোরাদাবাদ, বারাণসী, আগ্রা, জয়পুর ও বোম্বাইয়ের হস্তশিল্প প্রদর্শিত হয়েছিল। স্বর্ণকুমারী দেবীর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের দেশজ পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা। সেই যুগে এই মেলা কলকাতার সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

স্বর্ণকুমারী দেবী তিন শতাধিক গানের রচয়িতা। ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের মধ্যে গান রচনার সংখ্যার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরই স্বর্ণকুমারীর স্থান। 

স্বর্ণকুমারী প্রতিভাবান লেখিকা হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজা রূপে জন্ম গ্রহণ তাঁর সাহিত্য-কর্মের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধক হিসাবে বিবেচিত হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার আলোয় স্বর্ণকুমারীর কাজের মূল্যায়ন অনেক সময় গৌণ হয়ে যায়। স্বর্ণকুমারী দেবীর রচনাবলির ভূমিকায় বাণী রায় লিখেছিলেন, ‘স্বর্ণকুমারী দেবীর চরম দুর্ভাগ্য তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজা রূপে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।... এবম্বিধ উক্তি আমাকে বাতুল অথবা নির্বোধ অথবা উদ্ধত ভাষী প্রতিপন্ন করতে পারে।... আমি বলতে চাই যে আসমুদ্র হিমাচল ব্যাপ্ত, সারা পৃথিবীস্পর্শী প্রতিভাধর অনুজ রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির অন্তরালে এই অসাধারণ লেখিকা সম্পূর্ণ আবৃত হয়ে আছেন, তাঁর যা প্রাপ্য তিনি তা পাননি।... সাহিত্য সৃষ্টির উৎকর্ষে শুধু নয়, সাহিত্য সৃষ্টির বৈচিত্রে তিনি অদ্যাপি অতুলনীয়া’।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments