জ্বলদর্চি

অসাম্প্রতিক | বাপন দেব লাড়ু


অসাম্প্রতিক 

বাপন দেব লাড়ু 

জানালা খুলে রাখা আছে। গ্রীষ্মের শেষ বিকেলের রোদ জানালার কাচে প্রতিফলিত হয়ে ঘরে একটা হলদে নিস্তব্ধতা ফেলেছে। বাতাস নেই বললেই চলে, তবু পর্দাগুলো একটু একটু দুলে উঠছে---যেন ভেতরের স্থবিরতা ভাঙার জন্য হালকা চেষ্টা।
ঘরটা সাজানো-গোছানো। অথচ তাতে প্রাণ নেই। সবকিছু সঠিক জায়গায়, কিন্তু কোথাও কোনো স্পর্শের উষ্ণতা নেই। টেবিলের ওপর খোলা একটি খাতা, পাশে কলম। পাতাটি সাদা। অনেকদিন ধরে সাদা। ঠিক কতদিন---অরিন্দম হিসেব রাখে না। সময় এখন তার কাছে কিছুই নয়। একেকটা দিন পেরোয়, যেন একটা ধুলোবালির কণা সময়ের ফাঁকে পড়ে থাকে, কেউ খেয়াল রাখে না।
অরিন্দম জানালার ধারে বসে আছে। মুখ শুকনো, চোখে নিষ্পৃহতা। কেবল মুখটা ঝুলে আছে সামনে, চোখ জোড়া তাকিয়ে থাকে বাইরে। তার চাহনিতে কোনো আগ্রহ নেই, কোনো আকুলতা নেই---একটা ফাঁকা বেঁচে থাকা।
আগে এমন ছিল না। এক সময় সে কবি ছিল। না, কেবল শব্দের কারিগর নয়---একজন সত্যিকারের অনুভবকারী। যার কাছে একটি শব্দ জন্ম নেওয়ার আগেই কাঁপত হৃদয়ের শিরা-উপশিরা। প্রতিটি পঙক্তির আগে সে অনুভব করত, প্রতিটি স্তবকের মাঝে সে হারিয়ে যেত।
আর ছিল অনন্যা।
যে প্রথম তার কবিতার পাতায় এসেছিল হাসি হয়ে, তারপর ধীরে ধীরে রক্তমাংসের এক বাস্তব হয়ে তার জীবনে জায়গা নিয়েছিল। অনন্যার হাসির শব্দ, চায়ের কাপ ধরা ভঙ্গি, হালকা কপালের ভাঁজ---এসব কিছু অরিন্দমের কবিতার ভিতর ঢুকে গিয়েছিল। অনন্যা হয়ে উঠেছিল তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
কিন্তু প্রেমিক কবি আর একজন স্ত্রী চাওয়ার মানুষের মধ্যে যেমন পার্থক্য থাকে, তেমনই ছিল তাদের জীবনে।
প্রথমদিকে অনন্যা মুগ্ধ ছিল। কবির প্রেমিক হতে পেরে সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করত। রাত জেগে লেখা কবিতা, হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে ছুটে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ানো অরিন্দম, অদ্ভুত সব কথা বলা---এসব কিছু যেন এক গভীর রোমান্টিকতাকে জাগিয়ে তুলেছিল তার ভেতরে।
কিন্তু দিনে দিনে এই মুগ্ধতা ক্লান্তিতে রূপ নিল।
অরিন্দম সবসময় নিজের জগতেই থাকত। একবার ভাবনায় ডুবে গেলে কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে যেতেও টের পেত না। অনন্যা যখন রান্না করত, বাজার করত, অফিস সামলাত --- অরিন্দম তখন শব্দ খুঁজত, ব্যঞ্জনা সাজাত। তার কাছে একটা সঠিক উপমা পাওয়া মানে ছিল দিনজয়।
অনন্যা বারবার বুঝাতে চেষ্টা করেছিল,
--- “আমি পাশে থাকতে চাই, কিন্তু পাশে বসে থেকেও যেন পাশে নেই আমি।”
অরিন্দম শুধু বলত,
--- “তুমি আছো বলেই আমি লিখতে পারি।”
সে বুঝতে পারত না, শব্দের মধ্যে অনন্যার উপস্থিতি আর বাস্তব জীবনের ছোঁয়ার মধ্যে কী তফাৎ।
একদিন দুপুরে, এক নিঃশব্দ আলোয় ভরা ঘরে দাঁড়িয়ে, অনন্যা বলেছিল---
--- “তুমি কি কখনো আমাকে ছুঁয়েছো? মানে সত্যিকারেরভাবে? শুধু কবিতায় না, বাস্তবে? আমার ক্লান্তির পাশে দাঁড়িয়েছো? আমার অভিমান বোঝার চেষ্টা করেছো?”
অরিন্দম তখন ঠিক একটা কবিতার শেষ লাইন নিয়ে দ্বিধায় ছিল। তার চোখে ছায়া, মনে দোলাচল। সে চুপ ছিল।
অনন্যা আর দাঁড়ায়নি। সে শুধু বলেছিল---
--- “আমি যাচ্ছি, অরিন্দম। কোথাও না, শুধু একটু দূরে। নিজের কাছে। যদি কোনোদিন তোমার প্রয়োজন হয়, আর তুমি মানুষ হতে পারো ডেকো।”
অরিন্দম তাকিয়ে ছিল জানালার ফাঁক দিয়ে। তীক্ষ্ণ আলো এসে পড়ছিল টেবিলে। সেদিনও সে শেষ লাইনটা লিখতে পারেনি।
অনন্যা চলে গিয়েছিল।
প্রথমে সে ভাবেনি চিরতরে যাচ্ছে। ভেবেছিল, দিন দুয়েকের ঝড়। কিন্তু অনন্যা আর ফেরেনি।
অরিন্দম একা হয়ে গেল। কিন্তু কবিতার পাশে থেকে।
প্রথম কিছুদিন খুব লিখেছিল সে। অভিমান, তীব্রতা, ক্ষোভ, ভালোবাসা সব মিশে এক ধরণের যন্ত্রণাময় রচনায় রূপ নিয়েছিল। সে লিখত যেন লিখে অনন্যাকে ছুঁতে চাইছে।
কিন্তু কিছুদিন পর শব্দরাও ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
তারপর হঠাৎ একদিন কলম আর চলল না। সে বসে থাকে খাতার পাশে, কিন্তু কিছু আসে না। শব্দেরা যেন তার ওপর অভিমান করে সরে গেল।
এদিকে অনন্যার জীবন নতুন করে শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু সে বুঝতে পারেনি, নতুনের নিচে পুরোনো ঠিক কেমন করে কাঁদে।
🍂
ad

অফিস, বন্ধু, শহর বদল---সব কিছুর মাঝেও কোথাও একটা অদৃশ্য শূন্যতা তার ভিতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকত।
রাতে একা বিছানায় শুয়ে থাকলে, তার মনে পড়ত অরিন্দমের চোখের ভাষা---যে ভাষা সে একদিন বুঝতে চায়নি।
একদিন সে পুরোনো একটা ফাইল খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় অরিন্দমের লেখা একটা চিঠি। একটা পঙক্তি ছিল সেখানে---
“ভালোবাসা সবসময় জোরে বলে না। কোনো কোনোটা কেবল চুপচাপ পাশে বসে থাকে।”
সেই লাইনটা যেন সরাসরি এসে বুকে ধাক্কা দেয়।
সে কাঁপা হাতে ফোন তুলে নেয়।
লিখে ফেলে---
"অরিন্দম, আমি বুঝেছি। তুমি তোমার মতো করেই ভালোবেসেছো। আমি পালিয়ে গেছিলাম।
আমি ফিরতে চাই।
তুমি এখনো সেখানে আছো তো?
তুমি যদি আগের মতো না-ও হও, আমি বদলে গেছি।"
মেসেজটা পাঠিয়ে সে অপেক্ষা করে।
কোনো উত্তর আসে না।
তিন দিন পর, এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে, সে আবার দাঁড়ায় সেই পুরোনো ফ্ল্যাটের সামনে। দরজা খোলা। ঘরের ভিতরে ঢুকে তার গা শিরশির করে ওঠে।
সবকিছু একই আছে—কিন্তু একরাশ শূন্যতা চারপাশে জড়ানো।
টেবিলের পাশে বসে আছে অরিন্দম। চোখ জানালার বাইরে।
অনন্যা ধীরে এসে দাঁড়ায়।
--- “আমি এসেছি, অরিন্দম…”
অরিন্দম ধীরে তার দিকে তাকায়। কোনো বিস্ময় নেই চোখে, কোনো অভিযোগ নেই।
শুধু একটা কথা বলে---
--- “তুমি ফিরেছো… কিন্তু আমি আর ফিরে আসতে পারি না।”
অনন্যা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে, এই ফিরে আসা কোনো রোমান্টিক পুনর্মিলন নয়। এটা শুধু এককালের ছুঁয়ে যাওয়া দু’টি ছায়ার ফিরে এসে পাশে বসে থাকা।
সে ধীরে টেবিলের খাতার পাতায় চোখ রাখে।
একটি লাইন লেখা:
“যদি কেউ সব ভুল বুঝে ফিরে আসে, একটুখানি আলোর আশায়,
তখন যদি আমি আর সেই আলো ধরার মতো না থাকি
---তবে?”
অনন্যা চোখ বন্ধ করে। তারপর কলমটা তুলে নিচের লাইনে লিখে দেয়—
“তবে আমি অপেক্ষা করবো…
যতদিন না তুমি ফিরে আসো তোমার মধ্যেই,
নতুন করে, নিঃশব্দে, আবার।”
অরিন্দম কিছু বলে না।
কিন্তু দীর্ঘদিন পর তার চোখের কোণায় একফোঁটা জল জমে ওঠে।
জানালা দিয়ে হালকা হাওয়া ঢোকে।
সেই হাওয়ার সঙ্গে, হয়তো কোনো অদৃশ্য শব্দ---আবার।
[শেষ]

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJuly 19, 2025

    অজস্র ধন্যবাদ জানাই। আমার লেখা স্থান করে নেবার জন্য।

    ReplyDelete