মার্কেজের খোঁজে
(পঞ্চদশ পর্ব)
মলয় সরকার
এই বোগোটা ১৫৩৮ সাল থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত প্রায় তিনশ’ বছর বিদেশী স্প্যানিশ শাসনে ছিল, যতক্ষণ না সাইমন বলিভার (Simon Bolivar) বিদেশী শাসকের হাত থেকে বোয়াকার যুদ্ধে নিজের দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেন।এই বলিভারের নামেই কার্তাহেনা বা বোগোটার বিখ্যাত দুই প্লাজা রয়েছে বলিভার প্লাজা বা Plaja de Bolivar। আর বলিভিয়া দেশটির নামও এই বলিভারের নামেই। তখন অবশ্য বোগোটাকে রাজধানী করা হয়েছিল পানামা, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়া নিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত ছিল, তার।আজ এটি শুধুই কলম্বিয়ার রাজধানী।
মিউজিয়ামে জেনুদের তৈরী গহনাপত্র
সেই সময়ে সারা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে যত সোনা রূপো স্পেনীয়রা পেত, সব জমা করত কার্তাহেনাতে। সেখান থেকে তারা তা’ পাঠাত সারা ইউরোপে। ফলে সেই সময় কার্তাহেনা ছিল সোনাদানার আড়ত। আর তাই বার বার আক্রমণ হয়েছে কার্তাহেনার উপর। সেজন্যই প্রয়োজন পড়েছিল দুর্গ বানানোর। আর এর রাজধানী বা সুরক্ষিত জায়গা হিসাবে তারা বেছেছিল আন্দিজ পর্বতমালার কোলে এই বোগোটাকে।
বোগোটার কয়েকটি বিশেষত্ব আছে, যা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার আর একটি কারণ।বোগোটাতেই রয়েছে এমন এক মিউজিয়াম , যেখানে রয়েছে সারা পৃথিবীর মধ্যে সোনাদানার সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়।এ ছাড়া এখানে এত বেশি পার্ক বা গাছপালা রয়েছে যে একে Greenest City of world ও বলা হয়। তা ছাড়া এখানে এত বেশি থিয়েটার আছে,একে “Theater capital world” ও বলে।
কিন্তু এখানে যখন ১৪ বছর বয়সে প্রথম স্কলারশিপ নিয়ে মার্কেজ আসেন, মোটেই তাঁর জায়গাটাকে ভাল লাগে নি। অবশ্য পরবর্তী জীবনে বহুদিন এখানে কাটিয়েছেন। এখানেই তাঁর সাংবাদিক জীবনের শুরু।
আমরা ফিরে আসি সেই সোনার মিউজিয়ামে। এখানে এসে সোনাদানা দেখে সত্যি চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সেই সঙ্গে ফিরে যেতে হয় সেই সুপ্রাচীন কালে, তাদের কারিগরী শিল্পভাবনা মনকে আচ্ছন্ন করে তোলে।এখানে অনেক জিনিসের মধ্যে আগে বলি, প্রধান দুটি জিনিসের কথা, যার জন্য এটির জগত জোড়া খ্যাতি।একটি হল,poporo quimbaya । এটি হল আমাদের বর্তমান যুগে, যাঁরা পান খান, তাঁরা অল্প চূণ রাখার জন্য একটি ছোট কৌটো রাখেন, তারই পুরাতন সংস্করণ। আমাদের পানের বদলে ওনারা খেতেন কোকো পাতা।সেটি চূণ দিয়ে খাওয়ার জন্য কৌটো রাখা হত।সেরকমই এটি।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি কোকো যদিও অনেক দেশেই নিষিদ্ধ নেশার বস্তু , এখানে বা পেরুতেও এই কোকো পাতা খাওয়ার খুব চল আছে। আমি বহু দোকানে বা হোটেলে এটি খাওয়ার শেষে মৌরী খাওয়ার মত ,এমনিই রাখা থাকে দেখেছি। তার কারণ এর গুণ হল, মুখশুদ্ধি ছাড়াও, ভৌগোলিক উচ্চতার কারণে যে শ্বাসকষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তা এটি রোধ করে; এবং এটি শরীরে বাড়তি শক্তি দেয়। এখানে এত উচ্চতায় ঘোরাফেরার জন্য আমাদের ,অনেকেই এই পাতা খেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমরা তা আর মানি নি।আমাদের দেশে যেমন মানুষ পান খেয়ে থাকেন বা সুপারী চিবোন আসামের মানুষেরা , এখানে বহু মানুষই এরকম কাঁচা কোকো পাতা চিবিয়ে থাকেন। তবে আমি মুখে দিয়ে দেখেছি, খুব স্বাদু কিছু নয়, একটু খসখসে, প্রায় স্বাদহীন পাতা। অবশ্য একবার খাওয়া আর অভ্যাসে খাওয়ার মধ্যে তফাত তো থাকেই।
মিউজিয়ামে জেনুদের তৈরী মাটির মূর্তি
এ ছাড়া মিউজিয়ামে ছিল Muisca raft । এটি আবার এতই বিখ্যাত যে, এটি কলম্বিয়ার আইকন হয়ে গেছে, এর উপর ডাকটিকিটও প্রকশিত হয়েছে।এটাকে বলা হয় এখানকার মুইসকা বা চিবচা আদিবাসীরা যারা আদি কালে বাস করত আন্দিজ পর্বতের আশেপাশে , তাদের সম্পদ।
সৌভাগ্যক্রমে এখানে দেখা হল একটি মেয়ে জুলিয়ার সঙ্গে। সে আসলে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে। এখানে মাঝে মাঝেই আসায়, এখানকার ব্যাপারে ও বেশ ওয়াকিবহাল। মনে হল গাইডের কাজও করে।
সেই আমাকে বলল, ঐ মুইসকা র্যাফটটা দেখেছেন? ওটা যে সেই গল্প কথার ,এল ডোরাডোর কথা মনে করিয়ে দেয়, এটা ভাবি নি।এই এল ডোরাডোর গল্প, সময় পেলে বলার ইচ্ছা রইল।
এটা আমাকে অনেক গভীর ভাবনায় ফেলে দিল।জুলিয়া বলছিল, এখানকার মানুষদের ইতিহাস এতই প্রাচীন আমরা ভাবতেই পারব না। শুধু তাই নয়, এরা শিল্পকর্মে এতই উন্নত ছিল, আজকের শিল্পকর্ম যা করা হয়, তার থেকে যে তারা খুব কম ছিল প্রাচীনত্বের হিসাবে, তা মোটেই মনে হয় না।
আমিও দেখলাম, তাদের মেয়েদের বা ছেলেদের যে সমস্ত মালা, হার, নাকের গহনা ইত্যাদি দেখছিলাম, সেগুলোর প্রতিকৃতি তো আজকের যুগেও একই রকম ব্যবহার হয়।
🍂
মুইসকা আদিবাসীদের তৈরী যে র্যাফট বা ভেলাটি, তার সম্বন্ধে জুলিয়া যা বলল, তা হল এই রকম । এটি আন্দিজ পর্বতমালার উত্তরদিকে যে মুইসকারা বাস করত, তাদের সৃষ্টি। এটি পাওয়া গেছে পাস্কা অঞ্চলের একটি গুহায়। লেক গুয়াতাভিটাতে, যেটি তাদের কাছে পবিত্র লেক বলে বিশ্বাস ছিল, সেখানে মাঝে মাঝেই সোনা উৎসর্গের উৎসব হত।।মনে করা হয়, এই র্যাফটটি হল, এল ডোরাডো বা সোনার দেশের যে রাজা জিপা (Zipa)সারা গায়ে সোনার গুঁড়ো মেখে চলতেন বাহকের কাঁধে সেই লেক গুয়াতাভিটাতে দেবতাকে সোনা উৎসর্গ করতে, সেই রাজা জিপার র্যাফটের প্রতিকৃতি। এটি সম্ভবতঃ ১২৯৫ থেকে ১৪১০ সালের মধ্যে মোম ছাঁচ পদ্ধতিতে সোনা রূপো ও তামার মিশ্রণে তৈরী হয়েছিল।তবে মুইসকারা যেহেতু কৃষিজীবি ছিল, ওদের কাছে সোনা বেশি ছিল না। এ জন্য ওরা নির্ভর করত অন্য জায়গার মানুষদের কাছে।তা সত্বেও ওরা কিন্তু ঘরের দরজা ও জানালায় সোনা রূপোর ব্যবহার করত।এটি আবিষ্কার হয়েছিল ১৯৬৯ সালে।
আমার মনে প্রশ্ন জাগল আবার, তাহলে কি এল ডোরাডো* সত্যিই কোথাও ছিল,যার সন্ধানে শুধু স্প্যানিশরা নয়, বহু মানুষ ছুটে বেড়িয়েছে পাগলের মত।
এই সেই সোনার তৈরি র্যাফট (জিপার র্যফটের প্রতিকৃতি) (বিশেষ যত্নে রাখা)
জুলিয়া বেশ চঞ্চল ফুরফুরে স্বচ্ছন্দ একটি মেয়ে। ও-ই আমাকে দেখাল, সোনার নানা গহনার সঙ্গে সোনার বক্ষবন্ধনী রয়েছে বেশ অনেকগুলি।মুখোস, নাকের, কানের, গলার গহনা, মাথার মুকুট, নানা ভঙ্গিমার মানুষের মূর্তি,এ ছাড়াও রয়েছে দেবতার কিংবা অন্য কিছুর মূর্তি। সোনার পাতের তৈরী শাঁখও দেখলাম একটা।২১০০ খ্রীঃপূঃর নাকের গহনা দেখলাম।ব্যাঙ ও অন্যান্য জন্তু জানোয়ারের প্রতিকৃতি, অস্ত্রশস্ত্র, সোনা গলানোর ও জিনিসপত্র বানানোর সরঞ্জাম রয়েছে প্রদর্শনীতে।সেগুলিও যথাযথভাবেই সাজানো রয়েছে। তবে বেশির ভাগই সোনার পাতের তৈরী। এ ছাড়া মাটির মূর্তিও রয়েছে এখানে নানা ভঙ্গিমায়।
জুলিয়া জিজ্ঞাসা করছিল, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? বললাম ভারতবর্ষ। শুনে বলল, আপনাদের দেশের ইতিহাসও তো অনেক প্রাচীন। বললাম, হ্যাঁ।আমাদের সভ্যতাও বহু প্রাচীন। আমাদের দেশে যখন মানুষ বহু এগিয়ে গেছে, সারা পৃথিবীর বহু মানুষ তখনও অজ্ঞানতার অন্ধকারে। আমাদের দেশের দুটি মহাকাব্যের নামও দেখলাম জানে মেয়েটি। নিজেকে নিয়ে গর্ব হল, সেই দেশের মানুষ হিসাবে।
জুলিয়া জিজ্ঞাসা করছিল, আপনাদের দেশে এরকম মিউজিয়াম আছে, যেখানে গেলে আমরা অনেক কিছু জানতে পারব? বললাম, মিউজিয়াম তো অনেক আছে, তা, তুমি আসবে নাকি আমাদের দেশে? ও বলল, ইচ্ছা রয়েছে। আমি তো প্রত্নতত্ব আর ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করি আর তাতেই আগ্রহী, তাই আপনাদের দেশে এবং সেই সঙ্গে চীন পাকিস্তানেও যাওয়ার ইচ্ছা আছে।সেখানেও অনেক কিছু আছে। আমি বললাম, হ্যাঁ চীনে আমিও গিয়েছি। সত্যিই ওখানে দেখার অনেক কিছু আছে।তবে তুমি এলে কিন্তু আমাকে জানিও, আমি তোমাকে কিছু সাহায্য করতেও পারি। মনে পড়ে গেল, চীনের একটি মেয়েও প্লেনে আসার সময় আমার সঙ্গে সারা রাস্তা অনেক গল্প করতে করতে এসেছিল। তার নাম সানি হুয়াং। এ-ও ঠিক তারই মত। তার কথা লিখেছি অন্য লেখায়।
ক্রমশঃ-
0 Comments