গোয়ালিনীর স্বপ্ন
সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক-বিজয় দাস, গ্ৰাম- যুগীশোল, থানা-নয়াগ্ৰাম, জেলা-ঝাড়গ্ৰাম
ছোটো মেয়ে পাখি তার ঠাকুমার সঙ্গে ছোটো একটি গ্ৰামে বাস করত। পাখি ছিল গোয়ালিনী। আর ওদের কাছে দুটো গরু ছিল।
পাখি প্রতিদিন গরুর দুধ দুইতো। আর মাথায় করে সেই দুধের কলসি নিয়ে গ্ৰামে গ্ৰামে বিক্রি করতে যেত। সারাদিন দুধ বিক্রি করে সন্ধ্যেবেলা সে বাড়ি ফিরে আসত।
পাখি তার গরুদের খুব যত্ন করত। তাদের ঠিকমতো খেতে দিত আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখত।
ঠাকুমা ছাড়া পাখির আর কেউ ছিল না। কিন্তু পাখি ভালো মেয়ে হলেও তার একটা খারাপ অভ্যাস ছিল। সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখত। সে স্বপ্ন দেখত যে সে খুব বড়লোক হয়ে গেছে। আর এই দিবাস্বপ্ন তাকে সবসময় বিপদে ফেলত।
তেমনই একদিন পাখি বসে বসে স্বপ্ন দেখছিল, যে সে বড়লোক হয়ে গেছে। তখন তার ঠাকুমা বলে-“পাখি মা, তুমি কী করছ? গরুগুলো তো গোয়াল থেকে বেরিয়ে গেল। ওরা হারিয়ে যাবে। তুমি ওদের উপর একটু নজর রাখ্।”
পাখির তখন স্বপ্ন ভেঙে যায়। সে বলে-“ভুল হয়ে গেছে ঠাকুমা, আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।”
তার ঠাকুমা বলে-“আমি জানি, তুমি কী স্বপ্ন দেখছিলে। কিন্তু মা, বড়লোক হওয়ার জন্য তোমাকে আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে।”
এছাড়া পাখিকে ঠাকুমা এও বলেন যে,“ এই দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ না করলে তোমাকে একদিন না একদিন এর অনেক বড়ো মূল্য চোকাতে হবে।”
তখন পাখি বলে-“আমার ভুল হয়ে গেছে ঠাকুমা। আমি আর স্বপ্ন দেখব না।” কিন্তু পাখির এই দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ হল না।
একদিন পাখি দুধ বিক্রি করতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার ঠাকুমা তাকে বলে-“পাখি মা, আজ আর তোমাকে গ্ৰামে গ্ৰামে দুধ বিক্রি করতে যেতে হবে না।” তখন পাখি বলে-“কেন ঠাকুমা, আজ কী?”
তার ঠাকুমা বলল-“আজ তেমন কিছু না। আসলে কাল আমাদের পাশের গ্ৰামের জমিদার বাবুর ছেলের বিয়ে। আর বিয়েতে বিভিন্ন রকমের মিষ্টির প্রয়োজন। তাই জমিদার বাড়ির রাঁধুনি আমাদের থেকে এক কলসি টাটকা দুধ নেবে বলেছে। আর সেই দুধ দিয়ে মিষ্টি তৈরি করবে।”
পাখি এই কথা শুনে খুব খুশি হয়। এছাড়া তার ঠাকুমা এও বলেন যে-“দুধ ভালো হলে জমিদার বাবু বলেছেন, বাজারের থেকেও দুধের দ্বিগুণ দাম দেবেন এবং তাঁর ছেলের বিয়েতে নেমন্তন্নও করবেন।”
পাখি বলে-“কী বলছ ঠাকুমা? দ্বিগুণ দাম দেবেন। তাহলে তো আমরা বড়লোক হয়ে যাব। জমিদার বাড়ির বিয়েতে কত লোক আসবে। সবাই আমাদের গরুর দুধের তৈরি মিষ্টি খেয়ে খুশি হলে জমিদার বাবু আমাদের অনেক অনেক টাকা দিবেন। সবাই আমাদের চিনবে।”
তার ঠাকুমা বলে-“ও হো পাখি, তুমি আবার দিবাস্বপ্ন দেখছ।”
এমনকি ঠাকুমা পাখিকে এও বলেন-“এখনও দুধ জমিদার বাড়ি পৌঁছাল না, রাঁধুনি মিষ্টি বানালোই না, আর তুমি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখছ।”
আমি বারবার তোমাকে বলছি-“মাটির কেল্লা বানিও না, স্বপ্ন দেখ না।”
পাখি তখন বলে-“ঠিক আছে ঠাকুমা। আমি স্বপ্ন দেখব না।”
এরপর পাখি এক কলসি টাটকা দুধ নিয়ে পাশের গ্ৰামের জমিদারের বাড়ির দিকে রওনা হয়।
তার ঠাকুমা তাকে বারেবারে বলে-“এই এক কলসি দুধ তুমি খুব সাবধানে নিয়ে যেও। আমাদের কাছে কিন্তু আর দুধ নেই। এছাড়া দুধ যাতে ঠিকমতো জমিদার বাড়ি পৌঁছায়। তার না হলে জমিদার বাবু খুব রাগ করবেন। আর একটা কথা তুমি মনে রেখো…….।”
তখন পাখি বলে-“আমি জানি, আমি জানি ঠাকুমা। তুমি চিন্তা করো না। আমি মাটির কেল্লা বানাবো না, স্বপ্ন দেখব না।”
এরপর পাখি তার ঠাকুমার থেকে বিদায় নেয়। আর মাথায় করে দুধের কলসি নিয়ে জমিদারদের বাড়ির দিকে রওনা হয়।
পাশের গ্ৰামে যেতে হলে তাদের বনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাই পাখি বনের মধ্যে দিয়ে যেতে থাকে। বনের রাস্তায় যেতে যেতে তাজা ফুল ও ফলের গন্ধে তার মন ভরে যায়। কিন্তু তার খুব কষ্ট হয় খালি পায়ে হাঁটতে। ছোটো ছোটো নুড়ি পাথর তার পায়ে ফুটতে থাকে।
তখন সে বলে-“বনের মধ্যে দিয়ে যেতে আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আমার হাঁটতে ভালো লাগছে না। এই পাথরগুলো পায়ে ফুটতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”
কিন্তু তার সত্ত্বেও তাকে হাঁটতে হয়। কারণ জমিদারের বাড়িতে দুধ না দিলে সে দ্বিগুণ টাকা পাবে না। আর তার বড়লোক হওয়াও হবে না।
পথে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবে-“এই দুধ বিক্রি করে যে টাকা পাব তা দিয়ে আমি শহরে একটা বাড়ি বানাব। তখন আমি বড়লোক হয়ে যাব। আর বড়লোকেরা তো হাঁটে না।”
এছাড়া মাথায় করে দুধ নিয়ে যেতেও পাখির খুব কষ্ট হয়। তাই সে মনে মনে বলে-“জমিদারের দেওয়া টাকা দিয়ে আমি একটা গরুর গাড়ি কিনব। তখন সব পরিশ্রম করবে ওই গরুগুলো। আর আমি আরাম করব।”
এইসব ভাবতে ভাবতে সে তার প্রিয় গান গুনগুন করতে করতে এগিয়ে চলে। পাখি দেখল সে জমিদারদের গ্ৰামের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।
তখন পাখি বলতে থাকে“আর কয়েক মাইল হাঁটলেই আমি বড়লোক হয়ে যাব।”
এছাড়া সে এও ভাবতে লাগল-“আজ আমি যে দ্বিগুণ টাকাটা পাব তা দিয়ে কী করব? আরও কয়েকটি গরু কিনব! না না গরু কিনব না। কারণ ওই গরুর দুধ সেই আমাকেই দুইতে হবে। তাহলে আমি কী করব?”
এইসব ভাবতে ভাবতে তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে ভাবল-“আমি ওই দ্বিগুণ টাকা দিয়ে কয়েকটি মুরগি কিনব। সেই মুরগিগুলো অনেক ডিম দেবে, আর ওই ডিম ফুটে আরও অনেক মুরগি হবে। তখন আমি সেই ডিম আর মুরগিগুলো চড়া দামে বাজারে বিক্রি করব।”
কিন্তু পাখি ভাবে “শুধু মুরগি কিনলে তো হবে না। মুরগিগুলোকে রাখার জন্য একটা ঘরও বানাতে হবে। কিন্তু ঘর বানানোর টাকা পাব কোথায়?”
সেইমুহূর্তে তার মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। সে ভাবে “জমিদারের যদি তাদের গরুর দুধ পছন্দ হয়, তাহলে সে জমিদারকে বলবে আরও কিছু টাকা দিতে এবং সেই টাকা দিয়ে মুরগির জন্য ঘর বানাবে।”
এইসব নানাধরনের কল্পনা তার মাথায় আসে। পাখি ভাবতে থাকে-“আমি ওই মুরগির ডিম ও মুরগি বিক্রি করে যখন বড়লোক হয়ে যাব, তখন অনেক বড়ো বড়ো ঘরের ছেলেরা আমায় বিয়ে করতে চাইবে। কিন্তু আমি তাদের বলব- না-না-না, আমি তোমাদের বিয়ে করব না।”
স্বপ্নে না-না-না বলার সময় বাস্তবেও পাখির মাথাটা খুব জোরে জোরে নড়তে থাকে। যারফলে মাথায় থাকা দুধের কলসিটা সশব্দে মাটিতে পড়ে যায়। আর দুধের মতো তার সব স্বপ্ন মাটিতে মিশে যায়।
পাখি তখন খুব কাঁদতে থাকে। সে বলে-“এটা আমি কী করলাম। সব দুধ ফেলে দিলাম। এবার জমিদার বাড়িতে দুধ দেব কীভাবে? আমাদের বাড়িতেও তো আর দুধ নেই।”
এইসব কথা ভেবে সে আরও কাঁদতে থাকে। সেইসময় কাঁদতে কাঁদতে শুধু তার ঠাকুমার একটি কথাই মনে পড়ে। তার ঠাকুমা তাকে বারবার বলেছিল-“পাখি মা, মাটির কেল্লা বানিও না, স্বপ্ন দেখ না।”
0 Comments