জ্বলদর্চি

কুলেখাঁড়া /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৮৪
কুলেখাঁড়া

ভাস্করব্রত পতি

'কুলেখাঁড়া শাক' নামেই সর্বাধিক পরিচিত। তবে একে 'কুপো শাক'ও বলে। এই কুলেখাঁড়া পরিচিত 'কোকিলাক্ষ' নামেও। কোথাও কোথাও একে গোকুলকাঁটাও বলে। এর অবশ্য অনেক নাম। এটি সংস্কৃতে ইক্ষুরক, হিন্দিতে কৈলয়া, তালমাখানা, ইংরেজিতে Marsh Barbel, মারাঠীতে বিখরা, গুজরাটিতে এখরো, কন্নড়ে কুলুগোলিকে, কোঙ্কনিতে খাড়াকুলে বলে। কুলেখাঁড়ার অন্যান্য যেসব নাম রয়েছে, তা হল -- বজ্রাস্থি, বজ্রকণ্টক, শৃগালী, শৃঙ্খলী, শৃগালঘণ্টী, পিকেক্ষণা, পিচ্ছিলা, ইক্ষুগন্ধা, কান্ডেক্ষু, ইক্ষুর, ক্ষুর এবং শূরক। সাদা কুলেখাঁড়া পরিচিত ত্রিক্ষুর, ক্ষুরক, শুক্লপুষ্প, বীরতর ও কুলাহক নামে। লাল কুলেখাঁড়াকে ছত্তক এবং অতিচ্ছত্র নামে ডাকা হয়। 
ঝুড়িতে রাখা কুলেখাঁড়া শাক

কুলেখাড়ার রসে ইক্ষু বা আখের রসের গন্ধ পাওয়া যায়। চরক সংহিতায় একে শুক্রশোধনের উপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তাই অথর্ববেদে এটির নাম 'ক্ষুরক'। অর্থাৎ সে চে'ছে বার ক'রে দেয়। আবার 'দ্রংষ্ট্রা'ও বলা হয়। কেননা, এর পর্বে পর্বে খুব কাঁটা হয়। ফলে কোনও গবাদি পশু এদের সমূলে মুড়িয়ে খেতে পারে না এবং চোরেও তাকে ডিঙ্গোতে পারে না।

এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Hygrophila auriculata। এটি Acanthaceae পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়াও কুলেখাঁড়ার আরও যেক'টি প্রজাতির দেখা মেলে, সেগুলি হল --
Astercantha longifolia
Barleria auriculata 
Barleria longifolia 
Hygrophila schulli  
Hygrophila spinosa 
Ruelia longifolia 

এই গাছটি জলাভুমিতে অযত্নেই প্রচুর জন্মায়। গ্রামাঞ্চলে ভালোই দেখা যায়। ইদানিং চাষীরা চাষ করছে তাঁদের জমিতে। কুলেখাঁড়ার মূল বহুশাখা সমম্বিত। কাণ্ড চতুষ্কোণ আকারের। শাখাগুলি গ্রন্থিযুক্ত, রোমযুক্ত ও চ্যাপ্টা। পাতাগুলি সরু এবং লম্বা। গাছের শাখার গ্রন্থি থেকে জোড়ায় জোড়ায় পাতা জন্মায়। কুলেখাঁড়াকে দেখতে অনেকটা হিঞ্চে (Enhydra fluctuans) শাকের শাকের মত। তবে এদের পাতা একটু লম্বাটে। পাতার গায়ে কাঁটা থাকে। তবে প্রথমে কাঁটা জন্মায় না। এদের ফুল মিলিত দল এবং নীলবর্ণের।
শিলনোড়ায় বাটা কাঁচা কুলেখাঁড়ার রস

ভারত ছাড়াও এই গাছটি নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, চিন, আফ্রিকার কিছু অংশ এবং মায়ানমারেও পাওয়া যায়। অত্যন্ত উপকারী ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। এর সব অংশই উপকারী। এর 'পঞ্চাঙ্গ' তথা মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল থেকে ঔষধ তৈরি হয়। এর মধ্যে থাকে ফাইটোস্টেরল, অ্যালকালয়েডস, ডায়াস্টেজ, মিউসিলেজ, লাইপেজ, অক্সালিক অ্যাসিড, প্রোটিয়েজ, সুগন্ধি তেল ইত্যাদি। 

যাঁদের শরীরে হিমোগ্লোবিন কম থাকে, তাঁদের এই কুলেখাঁড়ার রস খাওয়ানো হলে ভালো ফল মেলে। কুলেখাঁড়ার তরকারিও বেশ উপাদেয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে এটি অত্যন্ত উপকারী সুস্বাদু শাক হিসেবে হেঁসেলে ব্যবহৃত হয়। বাতরক্ত, পাথুরী রোগ, অনিদ্রা, পিত্ত শ্লেষ্মা বিকৃতিজনিত রোগ, পায়ের চেটো ফুলে যাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী সম্ভোগ, শীতলী রোগের উপশমকারী ভেষজ গাছ হিসেবে এই কুলেখাঁড়ার জুড়ি মেলা ভার। বাজারে কুলেখাঁড়ার বিকল্প হিসেবে এলোপ্যাথিক ঔষধ পাওয়া গেলেও কাঁচা কুলেখাঁড়া বেটে নিঃসৃত রস বা সেদ্ধ করে বের করা রস অনেক বেশি কার্যকরী।

লেখক পরিচিতি 

🍂

Post a Comment

0 Comments