পুলককান্তি কর
-- কিরে পিকলু, এই ফলকাটা ছুরিটা নিয়ে কোথায় চললি?
-- তুই জানিস না সোম, মালটা ছুরি নিয়ে কোথায় যায়? হি হি করে হাসতে হাসতে বলল অনীক।
-- না। এই ট্রেনে ছুরি নিয়ে কোথায় চলল? বিস্মিত গলায় বলল সোম।- এই টি.টি দেখলে ফাইন করবে।
-- ফাইন করবে কেন? এটা কি প্লেন না কি বে? তুই ট্রেনে ফল কাটিস না? হিস হিস করে হেসে উঠল পিকলু।
-- না, তা নয়; তবে কোথায় কার গায়ে লেগে যাবে, তোর চাকু নিয়ে ঘোরার দরকার কি? ফোড়ন কাটলো পরিমল।
-- ছুরি নিয়ে যাচ্ছিস টা কোথায়? সোম আবার বলল।
-- বাথরুমে।
-- বাথরুমে? সমস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করলো সোম আর পরিমল। বাথরুমে নিয়ে করবি কি? হাতের শিরা কাটবি? কী কেস বলতো বাওয়া।
-- সত্যি, তোরা না...! শ্লেষের ঢঙে অনীক বলল ‘দেখিস না ট্রেনের বাথরুমে অমুকের নাম প্লাস তমুকের নাম, নানান খিস্তি খাস্তা লেখা থাকে, বাবু যাচ্ছেন সেই মহান উদ্দেশ্যে।’
-- কী রে পিকলু, বাথরুমে তোর নাম খোদাই করতে যাবি? সোমের বিস্ময় আর ফুরোয় না। কী লাভ এতে?
-- কেন রামকৃষ্ণ ঠাকুর বলেছেন না, ‘ওরে জন্মেছিস যখন, সংসারের দাগ রেখে যা।’ পিকলু মজা করল।
-- তা বাথরুমে দাগ রাখলে কোন মজাটা হবে?
-- দূর বোকা, আমি কখনও নিজের নাম খোদাই করি না। আমি ওই বাপ্পার আগের মালটা ছিল না, তার ফোন নম্বরটা লিখে আসব বাথরুমে।
-- কী হবে তাতে?
-- দূর দূর! তোরা কিসসু জানিস না! বাথরুমের উপর দেখিস না লেখা থাকে 'কল মি' বা 'বোর লাগছে? এই নম্বরে ফোন করুন' - তার নীচে একটা নম্বর দেওয়া থাকে! সেই রকম রিঙ্কুর নাম্বারটা ওখানে লিখে দু চারটে সেক্সি সেক্সি কথা লিখে দেব।
-- তাতে কী হবে? সোম ক্রমশ আশ্চর্য হয়ে পড়ছে।
-- কী হবে মানে? লোকজন ওকে ইন্টু মিন্টু ফোন করবে।
-- তাতে তোর কী?
-- তুই জানিস না শালা, ওই রিঙ্কু মালটা আমাদের বাপ্পার সাথে কী করেছে?
-- কী করেছে?
-- এই দু'বছর বাপ্পার সাথে ঘুরঘুর করে এখন অন্য এক ক্যালানের সাথে ঢলাঢলি করছে।
-- তাতে তোর কী? ওটা ওর আর বাপ্পার ব্যাপার।
-- শোন আমি তোদের মতো শহুরে বন্ধুত্ব করি না। বাপ্পার কষ্টটা দেখেছিস? যে বাপ্পার সাথে চিট করে, আমিও তাকে মজা দেখাবো।
-- তুই যে এসব করতে যাচ্ছিস, বাপ্পা জানে? পরিমল বলল।
🍂
-- বাপ্পা জানে না। সে পরে জানিয়ে দেব'খন।
-- বাপ্পা যদি 'না' করে?
-- 'না' করবে কেন? বাপ্পা জানে না মেয়েটার স্বভাব চরিত্র ভালো নয়? গায়ে গতরে করছে - না হয় ফোনেও একটু লোকজনকে আনন্দ দেবে, কী হয়েছে! পিকলু খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল।
-- তুই যা বল পিকলু, এটা তুই ঠিক করছিস না।সোম বেশ জোর দিয়ে বলল কথাটা।
-- দ্যাখ সোম, তোকে শালা কে বিচার করতে বলেছে - এটা ঠিক না ভুল? এত নীতির লেকচার দিতে আসিস না পিকলু! যা বাবা ট্যাম্পাটা মেরে আয়। অনীক খুব উৎসাহের চোটে সিট থেকে উঠে পিকলুর হাত ধরে টানল।
সোম বেশ নিরাশ হল অনীকের কথায়। ওরা সাতজন সেই কে.জি ক্লাশ থেকে বন্ধু। সবাই যে বড় মাপের কেউকেটা হয়েছে তা নয়। এই সব বেসরকারী কোম্পানিতে কেউ সেলসে, কেউ মোবাইলের রিপারিং, কেউবা ক্ল্যারিক্যাল কাজ। এর মধ্যে বাপ্পার সবথেকে ভালো চাকুরি। একটা বড় মাল্টিন্যাশনাল ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ। পিকলু একটা মোবাইল কোম্পানির সেলস ম্যানেজার। অনীকের নিজের একটা মোবাইল রিপেয়ারিংয়ের দোকান আছে। সোম এখনও লড়ছে তেমন কিছু করেনা; পরিমল একটা স্মল ফিনান্স কোম্পানিতে এজেন্ট। ওরা দু-তিন মাসে একবার রবিবার সবাই মিলে কাছাকাছি কোনও স্পটে পিকনিকে বেরিয়ে পড়ে। এবার যাচ্ছে বর্ধমান এ। এবার বাপ্পা নেই; আজ কী সব জরুরী ডক্টরস মিট আছে তার। ওরা সবাই খুব কাছের বন্ধু। এদের মধ্যে পিকলুর একটু মুখ খারাপ করা অভ্যাস আছে সে জানে। কথায় কথায় খিস্তি খাস্তা দেয়, তবে এমন সব কাজ ও করে বলে কখনো শোনেনি সে। ও নিজেও আগে অবাক হয়ে ট্রেনে বসে এরকম লেখা দেখে ভাবতো - কী লাভ এতে? একবার উদয়পুর ফোর্টে বেড়াতে গিয়ে সেখানেও দেয়ালে অমুক প্লাশ অমুক দেখে অবাক হয়েছিল সে। নামের সাথে নাম লিখে পাবলিকলি খোদাই করলে কী খুব আনন্দ পাওয়া যায়? ওদের মধ্যে বাপ্পাই প্রেমিক পুরুষ। ছোটবেলা থেকে দু-তিন ঘাটে জল খাওয়া। যেদিন রিঙ্কুর সাথে বাপ্পার আলাপ, সেদিন সোমও সাথে ছিল। ও আর বাপ্পা, বাপ্পারই এক কাজে নৈহাটি থেকে ফিরছিল ট্রেনে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা ছটা হবে। ও সময়ের লোকালের ব্যাপক ভিড়। ওরা নৈহাটি থেকে উঠেছিল বলে, জায়গা পেয়েছিল। একটি মেয়ে ভিড় ঠেলে ঠেলে যখন ওদের সিটের সামনের করিডোরটায় এল তখন শ্যামনগর। প্রচুর পুরুষ মানুষের ভিড়ে তখন মেয়েটির হাঁকুপাঁকু অবস্থা। সোম ভদ্রতার খাতিরে ওকে ওর জায়গাটা ছেড়ে দিতে হাঁ হাঁ করে উঠলেন সামনের ভদ্রলোক - কী মশাই কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, আপনি সীটটা ওঁকে ছাড়লেন কেন?
-- আমি তো নেমে যাচ্ছি না। ভদ্রমহিলার অসুবিধা হচ্ছে দেখে ওঁকে বসতে দিলাম। সোম ফোঁস করে উঠলো।
-- আজকাল মেয়ে হলেই সুবিধা। ফোড়ন কাটল একজন। এই ট্রেনে যেমন হয় আর কী! নানান লোকের নানান মন্তব্যের মাঝখানে কুঁকড়ে থাকা মেয়েটিকে ভালো করে দেখল সোম। বেশ মিষ্টি দোহারা চেহারা। বেশ চকচকে গা। একেই কি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলে? কে জানে। নিজেকে বেশ 'কিছু করেছি' 'কিছু করেছি' এমন এক পুরুষ মানুষ মনে হতে লাগল। এই ফাঁকে বাপ্পা বেশ নিজেকে ছোট করে নিয়ে জানালার পাশে মেয়েটিকে চালান করে দিল। সেই শুরু। তারপর বাপ্পা কখন রিঙ্কুর সাথে ডেটিং শুরু করেছে সোম জানতেও পারেনি। যখন জানলো তখন প্রায় ছমাস পেরিয়ে গেছে। সেই রিঙ্কুকে নিয়ে পিকলু এমন কিছু খারাপ জিনিস করতে যাচ্ছে ভাবতেও গাটা কেমন করে উঠল। মুখে বলল ‘আচ্ছা অনীক এই যে বাথরুমে এসব লেখা থাকে, কেউ কল করে?’
-- কেন করবে না? বাজারে রসিক লোকের কি অভাব আছে?
-- তুই করিস?
-- হ্যাঁ। মাঝে মাঝে করি।
-- কী হয় তাতে?
-- মজা হয়।
-- কী রকম।
-- কখনও কখনও কোনও ব্যাটাছেলে হারামজাদা নিজেদের ফোন নম্বর লিখে নিচে 'বিজলী' 'পদ্মা' এমন সব নাম লিখে দেয়। তারা ফোন করলেই হ্যা হ্যা করে হেসে এমন খিল্লি দেয় যে কী বলব - ওস্তাদ, হেব্বী মজা।
-- কখনও মেয়েরা ফোন ধরে?
-- আরে কী ভাবছিস তুই? মেয়েরা কি সব সতী সাধ্বী? কেউ কেউ আছে বেশ রগড়ে, কেউ কেউ একদম রসমালাই। মোটামুটি কান মন ভরে যায় রে! একবার ট্রাই করবি? সে কথার উত্তর না দিয়েই সোম বলল ‘আর রিঙ্কুর মতো কেসে?’
-- রিঙ্কুর মতো কেস মানে?
-- মানে যেখানে অন্য কেউ কোনও মেয়ের ফোন নম্বর লিখে দেয়, অথচ মেয়েটি জানে না বা ভালো মেয়ে যারা - তাদের বেলা?
-- দ্যাখ তেমনই বেশী হয়। সেক্ষেত্রে মেয়েটির এই ধরনের কলগুলো ব্লক করে দেওয়া উচিৎ।
-- সে বুঝবে কী করে ফোনটা দরকারী না এরকম লোকের?
-- সেও এক মজা হয় মাইরী। ফোনটা তুলে যখন দু চারটে রসের কথা শুনবে তখন কেটে দেবে।
-- কী হ্যারাসিং বল তো! এমন কেউ করে?
-- এত সিরিয়াসলি নিশ্চিস কেন শালা? জন্মেছিস, মজা লোট! এটাও একটা ফান। পিকলু বলল। ‘আর তাছাড়া আমরা কি সবার ভালোর ঠিকা নিয়েছি?’
-- ভালোর ঠিকা না নিস, মন্দটাও তো করিস না!
-- আর ও যে বাপ্পাকে কষ্ট দিল তার বেলা? বুঝুক অন্যর দিল নিয়ে খেললে তার শাস্তি কি!
-- তুই শাস্তি দেবার কে? তুই কি ভগবান?
-- শোন বাওয়া। আমি বুঝি, ভগবান নিজে এসে শাস্তি দেয় না। যুগে যুগে আমাদের মত অবতার তৈরী করে তার মাধ্যমে শাস্তি দেয়।
-- করিস না পিকলু।
-- কেন রে শালা? তোর একটু মালটার সাথে ইন্টু মিন্টু আছে না? বাপ্পা একবার বলছিল বোধ হয়। অনীক ফুট কাটলো। তাহলে তুইও কদিন ঘুরে টুরে মজা লড়তে পারতি।
পিকলু বলল, ‘শোন না অনীক, তুই তোর কোনও একটা ক্লায়েন্টের সিম দিয়ে রিঙ্কুকে কল করে একটু রসের কথা বল না। তোকে তো চেনে না। তুই তো পুরোনো পাপী। তোকে তো আর শিখিয়ে দিতে হবে না। সোম শালাটার কানে একটু মধু বর্ষণ হোক!’
-- ক্লায়েন্টের সিম এখন কোথায় পাব? আমার নিজেরই কত সিম তোলা আছে নানান নামে। লাগাবো এখন?
-- লাগা না! লাগা না! সোমের বাধা চেপে গেল বাকি বন্ধুদের চিৎকারে। আজ রবিবার। উল্টো দিকের ট্রেন। তাই রক্ষা। ওদের দিকটায় ওরা ছাড়া আর অন্য লোক নেই। অনীক ঝটপট ফোন লাগালো রিঙ্কুর নম্বরে।
-- হ্যালো, কে রিঙ্কু ডার্লিং?
-- কে বলছেন? ওপাশ থেকে এক তরুণী কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
-- আমি তোমার এক ফোনের বন্ধু ডার্লিং।
-- আপনার নাম কি?
-- নামে কি হবে ডালিম? বুকে বড় কষ্ট, ভাবলাম তোমার সাথে দু চারটে কথা বলে একটু হৃদয় জুড়াই। চোখ টিপলো অনীক।
-- অসভ্য কোথাকার! ফোন রাখ। বলে ফোনটা কেটে দিল রিঙ্কু।
-- আবার লাগা না রে! ইন্দু বলল মহা উৎসাহ নিয়ে।
-- হ্যালো, কী হলো ডার্লিং? ফোন কাটলে কেন? আমাকে পছন্দ হল না? আমি কিন্তু ফ্রিতে কিছু করি না। দেখা করলে কিছু পাবেও। রসও পাবে, মালও পাবে।
-- দেব তোকে পুলিশে? আর একবার ফোন কর, দেখাচ্ছি মজা তোর। টুক করে ফোন কেটে দিল রিঙ্কু।
-- কীরে সোম? ছ্যাঁকা লাগছে। অনীক চিমটি দিল।
-- তুই আর একবার কর না অনীক। এবার মজা বুঝুক শালী। কেমন একটা অচেনা হাসিতে মুখটা ভরিয়ে ফেলল পিকলু।
খানিকক্ষণ ফোনে ট্রাই করতে করতে অনীক বলল ‘না রে, লাগছে না। এতক্ষণে বোধহয় নম্বরটা ব্ল্যাকলিস্টেড করে ফেলেছে। এবার অন্য নাম্বার থেকে করি?’
-- তুই কতগুলো সিম নিয়ে ঘুরিস? ইন্দু বলল।
-- এটাই লাস্ট। নে তুই কর না! বলে ইন্দু কে ফোনটা দিল অনীক।
-- হ্যালো রিঙ্কু ডার্লিং; তুমি আমার ছেলের ঝিঙ্কু মামনি হবে?
-- কে রে তুই?
-- আহা, তুই তোকারি কর কেন? আমি তো তোমার ফোনের নাগর।
একটুক্ষণ চুপ থেকে রিঙ্কু একটা নরম গলায় বলল ‘আচ্ছা আমার ফোন নম্বর আপনি পেলেন কোথায়?’
-- কেন সোনাই? তুমি তো এখন নগর নটী। যাকে বলে বিখ্যাত লোক। তোমার নাম্বার তো এখন লোকের পকেটে পকেটে?
-- আপনার পকেটে এলো কোথা থেকে শুনি?
-- কেন ট্রেনের বাথরুমে?
-- কোন ট্রেন?
-- পশ্চিমবঙ্গে কি একটা ট্রেন মামনি? শত শত ট্রেন, শত শত বাথরুম। হি হি!
ফোনটা কেটে গেল বুঝলো ইন্দু। সোম মাথা নীচু করে চুপ করে বসে আছে। তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি যেন পৃথিবীটা দ্বিধা হয়; এখুনি যেন এই মানুষগুলোকে আর না দেখতে হয়। ছি ছি! এভাবেও হিউমিলিয়েশন করা যায় কাউকে! সে কী একবার ফোন করবে রিঙ্কুকে? বলে দেবে, এসব ওর বন্ধুদের কাজ? কিন্তু রিঙ্কুর ফোন নম্বর তো ওর কাছে নেই। এদের কাছে চাওয়া যাবে না। হে ঈশ্বর কিছু বুদ্ধি দাও, মেয়েটা এই জ্বালা থেকে রক্ষা পাক। আচ্ছা, বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো একটা কথা মাথায় এল তার। রিঙ্কু তো মোবাইল নম্বর বদলাতে পারে। হে ঈশ্বর ওকে বুদ্ধি দাও, ও যেন নিজের নম্বরটা আজই বদলে নেয়।
২
অনেকদিনই সিটের পেছনে একটা নম্বর লক্ষ্য করে মনীশ। বসিরহাট থেকে ন্যাজাটে যায় সে। ন্যাজাটেই তার অফিস। অধিকাংশ দিনই পেছনের ছজনের সিটের ডান দিকের জানালার ধারেরটা বা তার আগের সিটটাই পায় সে। বাকী সিটগুলো স্ট্যান্ড থেকেই ভর্তি হয়ে আসে। ও একটা স্টপেজ পরে ওঠে বলে শেষের সিটগুলো পায়। ওই সিটের সামনের যে দুজনের সিটটা আছে, তার পেছনে একটা মোবাইল নম্বর খোদাই করা আছে। উপরে লেখা ভুল বানানে ‘জীবন হতাস? মরে যেতে ইচ্ছা করে? নিচের নম্বরে ফোন করুন।’ বড় কৌতুহল হয় তার, মনে মনে ভাবে একবার ফোন করলেই হয়। আজকাল তো পেপার খুললেই এরকম নানান বিজ্ঞাপন। 'বন্ধু হতে চান' 'দুদন্ড মনের কথা বলুন' কিংবা 'অল্পবয়সী মেয়েদের বন্ধু হতে চান ইত্যাদি। তবে সব থেকে যেটা অবাক লাগে যখন দেখে বিজ্ঞাপনে লেখা ‘১০০% সুখ, নইলে মূল্য ফেরৎ'। কথা বলে কি সত্যিই এরা সুখ দিতে পারে? যেখানে মূল্য চুকাতে হয়, সেখানে কি সুখ হয়? কী জানি! ওসব তো তাও বোঝা যায়, কোনও র্যাকেট হতে পারে। তবে এইরকম ভাবে ঘরে বসে কি পার্সোনাল লেভেলে ব্যবসার বিজ্ঞাপন হতে পারে? একবার ফোন করলেই হয়। নানান ‘কিন্তু’ অতিক্রম করে আজ মনীশ ফোন নম্বরটা সেভ করেই নিল। অফিস পৌঁছে লাগানো যাবে। অফিসে এসে প্রয়োজনীয় কয়েকটা কাজ ছেড়ে ফোনটি লাগালো সে। নম্বরটায় ভালো একটা কলার টিউনও লাগানো আছে। বেশ কয়েকবার বেজে বন্ধ হয়ে গেল রিং। কী হল? একটা চাপা উত্তেজনায় আবার রিং করল। না এবারও তুললো না কেউ। এমনি কেউ বোকা বানানোর জন্য লিখেছে? তবে রিং হল কেন? অফিসে থাকতে থাকতে বেশ কয়েকবার রিং করলো মনীশ। অবশেষে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ একটি অল্প বয়সী মেয়ের গলা পেল সে।
-- কে বলছেন?
-- নাম শুনে কী করবে। তুমি নাকি হতাশ জীবনে আসার আলো জ্বালাতে পারো?
-- কী যা তা বকছেন আপনি?
-- তাইতো লিখেছ বিজ্ঞাপনে!
-- আবার অসভ্যতা করছেন? কয়েকদিন আমি সহ্য করছি আপনার অসভ্যতা। এবার আপনাকে সাবধান করছি, আর ফোন করবেন না। বলে টুক করে ফোনটা কেটে দিলো মেয়েটি।
মনীশ বেশ উত্তেজিত বোধ করলো এবার। হারুর দোকান থেকে একটা চা সিগারেট খেয়ে ফের ফোন লাগালো ওই নম্বরে। ওর অন্য একটি ফোন থেকে।
-- হ্যালো, কে বলছেন? সেই মেয়েটির গলা তো মনে হচ্ছে না এটা। তবে কি ওর কোন বন্ধু বলছে? যাইহোক গলার স্বরটা একটু বদলে নিয়ে মনীশ বললো, ‘হতাশ জীবনে আসার আলো কি দেখাবে আমায়?’
-- তা পারি। তবে তার জন্য তো আমায় জানতে হবে কার সাথে কথা বলছি।
-- আমার নাম তারাপদ।তারাপদ রায়।
-- আপনার বয়স।
-- পঁয়তাল্লিশ। বয়সে কী যায় আসে!
-- না তা নয়, তবে আন্দাজ করতে তো পারি আমার ফোনের বন্ধুটি আমার থেকে কত বড়, তার সমস্যা কত বড়।
-- তোমার নাম?
-- আমার নাম - হঠাৎ হেসে উঠল মেয়েটি। বলল, ‘যে নামে খুশী ডাকুন না। এ লাইনের সব নামই নকল।’
এ মেয়ে বেশ খেলুড়ে বোঝাই যাচ্ছে। তবে এরা টাকা পয়সার বিনিময় কেমন করে বোঝা যাচ্ছে না। সব থেকে বড় কথা, আগের মেয়েটি তবে কে ছিল? ও নিজেই প্যাঁচে পড়ে যাচ্ছে না তো? এসব ভাবতে ভাবতে ও পাশের মেয়েটি বলল ‘কী হল? চুপ করে রইলে যে?’
-- না মানে কী বলে ডাকব বুঝতে পারছি না তো।
-- বেশ অনামিকাই বলুন না। নামহীনাদের অনামিকা নাম দেওয়া তো কমন প্র্যাকটিশ।
-- সে জন্যই তো ওই নাম দিতে চাই না।
-- তবে বলুন কী নাম দিতে চান? প্রিয়া? প্রানেশ্বরী - হি হি হি!
-- না, না তোমায় বরং ‘আলো’ বলে ডাকি! আশার আলো তো তুমি!
-- আচ্ছা সেই ভালো। এবার বলুন তো আপনার হতাশাটা কি? মিসেসের সাথে বনে না? পরস্ত্রীর প্রতি প্রেম?
-- না না। তেমন কিছু নয়। এমনি ভালো লাগে না কিছু।
-- ওমা! এ আবার কেমন কথা - বাড়িতে সমস্যা নেই, পরকীয়া নেই, তবে অন্য মেয়ে মানুষের সাথে ফোনে কথা বলার সাধ কেন?
মনীশ এই কথার জবাব এড়িয়ে গেল। মনে মনে গুছিয়ে নিল - কী বলবে সে। হঠাৎ করে বলল ‘জানো আলো, রাতে আমার ঘুম আসে না। খুব একা লাগে। তখন তোমায় ফোন করব?’
-- কেন? বৌদি সাথে শোন না বুঝি?
-- না।
-- ও বুঝেছি। কেন, শোন না কেন?
-- মেয়ে শোয়।
-- সেটা আপনার হতাশার কারণ?
-- না না।
-- তবে?
-- তবে আর কী! এমনি হতাশা।
-- আপনি কি কবি?
-- কেন?
-- কবিদের হতাশা কাটানোর উপায় জানা নেই আমার। ওরা সব সময় হতাশ।
মেয়েটির গলাটা যেন খুব চেনা চেনা একটা স্বর। যেন কত আপন! ওর কথাবার্তাও সত্যি সাধারণ এলেবেলে দের মতো নয়। এরা সত্যিই পেশাদার। এটুকু কথা বলেই খুব ভালো লেগে গেল তার। বলল ‘আলো তোমার সাথে কি আমার দেখা হতে পারে?’
-- একটু রহস্য নিয়ে মেয়েটি বলল, ‘এই একদিনেই?’
-- না, তা নয়। তোমাকে নিয়ে আমার খুব কৌতুহল হচ্ছে। সেটা মেটাতে চাই।
-- কৌতুহল মিটে গেলে তো আমার সমস্যা। তার কী হবে?
-- প্লীজ আলো, তুমি 'না' বলো না।
-- কবে কোথায় দেখা করবেন বলুন।
-- তুমি থাকো কোথায়?
-- এই তো ভেবিয়ায়।
-- এটা কি সত্যি ঠিকানা দিলে, না বানানো? তোমার নামের মতো।
-- যা ভাববেন।
-- রহস্য কোরো না আলো। সেই মত আমি তোমায় জায়গা বলব।
-- আপনি জায়গা বলুন। আমি কাল পৌঁছে যাব। এই নম্বরটা রাখবেন কাছে, তবে চিনতে পারবো।
-- ঠিক আছে। কাল দুপুর একটায় বসিরহাটে ইচ্ছামতীর পাড়টায় এসো।
-- বেশ। বলেই ফোনটা কেটে দিল আলো।
মনীশের ভেতরটা আজ কেমন যেন এলোমেলো হতে লাগল। যেমনটা সে ভেবেছিল তেমনটা তো এটা নয়ই, আবার যেমন ভাবে কেসটা এখন এসে দাঁড়ালো, সেভাবে সে তৈরীও নয়। অন্যমস্কভাবে আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল সে। কাল সকালে অফিস ছুঁয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। সেই মতন সব কলিগদের ফোন করে নিজের কাজ ভাগ করে দিল সে ।
দুপুর বেলা খুব অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল মনীশ। বারবার মোবাইলের আলোটা জ্বেলে দেখছিল কোনও কল এসেছে কিনা। প্রায় দেড়টা বাজে। সঙ্গে অল্প কিছু টাকা-পয়সা আছে। মনে মনে ভয়ও আছে এরা কোনও বড় গ্যাং এর লোক নয় তো! এক করতে অন্য বিপদ না হয়! বুকের ভেতর একটা অস্থিরতাকে যত সে বড় বড় শ্বাস নিয়ে দমাতে চায়, তত যেন নতুন করে ঢিপ ঢিপ করে উঠে বুক। হঠাৎ করে ওই নম্বর থেকে ফোন বেজে উঠতেই পেছনে ফিরে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল সে। একি, একটি বছর পনেরোর একটি মেয়ের সাথে তার মেয়ে তুলি।
-- আপনি তারাপদ রায়? মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল।
মনীশ কিছু বলবে – তার আগেই তুলি চেঁচিয়ে উঠল ‘বাপি, তুমি এখানে?’
-- তুই এখানে কী করছিস?
-- ছিঃ ছিঃ বাপি! তুমি তোমার মেয়ের বয়সী এক মেয়ের সাথে নাম ভাঙিয়ে ফোনে নোংরামি কর? ছিঃ!
-- কিছুটা হতভম্ব ভাব কাটিয়ে রুদ্রমূর্তি ধরল মনীশ। ঠাস করে একটা চড় কষাল তুলির গালে। লজ্জা করে না তোর। তুই পড়াশোনা ছেড়ে রোজগারে বেরিয়েছিস? তাও এইভাবে নোংরামি করে? ফের আরেকটা চড় দিতে উদ্যত হল সে। এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তুলি চিৎকার করে উঠল ‘খবর্দার আমার গায়ে হাত দেবে না। আমাকে ছোঁবে না তুমি। ইতর, নোংরা লোক। আজ কনটিনিউ একমাস তুমি আমার বন্ধুকে জ্বালিয়ে যাচ্ছ।’
-- আমি জ্বালাচ্ছি? আচ্ছা সে কথা পরে হবে। তুই এখানে কেন সে কথা আগে বল। মা জানে? ফোন কর মা -কে।
-- আমি ও তো চাই। মাকে ডাকি। মা এসে দেখুক কেমন নোংরা লোকের সাথে থাকে। বলেই মোবাইল হাতড়াতে লাগল সে।
-- আমি বলি কী তুলি, এখন মাসিমাকে ফোন করিস না। অকারণ অশান্তি হবে। আগে বরং তুই বলনা, এখানে আমরা কেন এসেছি। তুলির বন্ধুটি বলল।
-- দ্যাখ মুনু, এই লোকটাকে আমার কৈফিয়ৎ দেওয়ার কিছু নেই। আর তুই এইরকম ভালোমানুষি ত্যাগ কর। গত একমাস তোকে এ কীভাবে জ্বালিয়েছে ভুলে গেলি?
-- একমাস মানে? আমি তো কাল শুধু ফোন করেছি। মনীশ বলল।
-- তোমার মতো লোকের কথায় কোনও বিশ্বাস আছে? ধমকে উঠল তুলি।
-- এই দ্যাখ, কল লিস্ট।
-- অন্য কোনও ফোন থেকেও তো করতে পারো। তাও দাও দেখি। বলে ছিনিয়ে নিল ফোন। কল লিস্টে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, ফোন আমার কাছেই থাক। পুলিশকে প্রমাণ দেখানো যাবে। নইলে যদি ডিলিট করে দাও।’
-- কী বলছিস তুলি? আর্ত্তনাদ করে উঠলো মুনু। ‘জানিস, থানা পুলিশে কত ঝামেলা। আমার মা-বাবা জানবে, পাড়া জানবে। তাছাড়া শুনেই দ্যাখ না, কাকু কেন ফোন করেছিল?’
-- শুনবি কী? একমাস শুনে শুনে মন ভরে নি? বিদ্রূপ করল তুলি। একদিন তোর ভালোমানুষির জন্য মরবি তুই, বলে দিলাম।
মনীশ দেখল, পরিস্থিতি খুব সুবিধার নয়। তবু খানিকটা জোর করেই মুখে কঠোর ভাব বজায় রেখে তুলিকে বলল ‘পুলিশকে ডাকলে ডাক। তার আগে আমাকে বল তুই আজ এখানে কী করতে এসেছিস?’
-- চোর ধরতে।
-- মানে?
-- মানে কাল আমি ফাঁদ পেতেছিলাম। গত এক মাস ধরে দেখি মুনু সব সময় মনমরা হয়ে থাকে। কেউ ওকে নাকি ফোন করে নোংরা নোংরা কথা বলে।
-- তো কল ব্ল্যাকলিস্টেড করে না কেন?
-- বিভিন্ন ফোন নম্বর থেকে কল আসে। কালও এসেছিল। আমরা তখন ক্লাশে ছিলাম। পরে বিকেলে যখন কল এল, মুনু যথারীতি ফোন কেটে দিল। আমি বুঝলাম ফের ওই কল এসেছে। নিশ্চই আবার করবে। সত্যি সত্যি যখন আবার কল এল, তখন ওর থেকে ফোনটা নিয়ে আমি কথা শুরু করি। আমার টার্গেটই ছিল যাতে তুমি দেখা করতে চাও; এবং তুমি তা চাইলে।
-- আমিও দেখা করার টার্গেট নিয়ে ফোনটা করেছিলাম। মনীশ বলল।
-- সে তো চাইবেই। নইলে নোংরামোর ষোলকলা পূর্ণ হবে কী করে!
-- আরে আমার কথা তো শোন। কেন ফোন করেছিলাম।
-- তোমার কোনও কথাই শুনবো না। গর্জে উঠল তুলি।
-- না না কাকু, আপনি বলুন না। মিনমিন করে বলল মুনু।
-- ঠিক আছে। দ্যাখো এখন পৌনে তিনটে বাজে। চলো বসিহাট বাস স্ট্যান্ডে যাই। ওই সাড়ে তিনটের নাগাদ ন্যাজাটা থেকে 'বাবা তারকনাথ' নামের যে বাসটা আসে, ওই বাসে উঠে কথা বলবো।
-- আমরা কোথাও যাবো না। যা বলার এখানেই বল তুমি।
-- তোর না তুলি সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি! কাকু যখন বলছেন, চলই না। কী আর হবে!
তিন জন একটা ভ্যান রিক্সায় চেপে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাল। ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে মনীশ বলল ‘এখানে দু মিনিট দাঁড়াও তোমরা, আমি একটু আসছি।’ বলেই হাঁটার উদ্যোগ করল সে।
-- কোথায় চললে? পালাবার মতলব নাকি? তুলির গলায় এখনও দাপট।
-- কোথায় পালাব তোদের ফেলে? দাঁড়া এখানে। বড় বেশী টিসটিসানি তোর। বলেই জোরে জোরে পা ফেলল মনীশ।
-- কোথায় গেলেন বলতো কাকু?
-- কী জানি! যাবে কোথায়? চাকরি করে না! চাকরী ছেড়ে তো পালাতে পারবে না। সেখানে গিয়ে ক্যাঁক করে ধরবো না তাহলে!
-- কী যে হচ্ছে তুলি, বুঝছি না রে। কাকুর মতো মানুষ কেন ফোন করল বল তো!
-- আরে বুঝিস না, লোকে বলে বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়। এরও তাই হয়েছে। এনলার্জড প্রষ্টেট।
-- না রে! আমার কেমন যেন মনে হয় কিছু একটা ব্যাপার আছে।
-- কোন ও ব্যাপার নেই। এরা পুরুষ মানুষ। সব এক ধান্দা।
-- না রে তুলি। তোর বাড়ি গেলে কাকু আমার সাথে কত গল্প করে বল তো!
-- আরে এটা যে তোর ফোন নম্বর তা তো আর জানে না। জানলে তোকে ফোন করত না। চেনা লোককে ফোন করে ধরা পড়ুক আর কি!
-- তবে ফোন নম্বর পেলে কী করে? মুনু একথা বলতে বলতেই বাসষ্ট্যান্ডে 'বাবা তারকনাথ' বাসটিকে ঢুকতে দেখা গেল। মনীশের এখনও দেখা নেই। আরও পাঁচ সাত মিনিট পর দেখা গেল মনীশ ওদের দিকে আসছে। বেশ ক্ষিপ্র এবং সপ্রতিভ। তুলি অবাক হয়ে ভাবলো, এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, তাতে কোন ও হেলদোল নেই। লজ্জা নেই। কেমন লোকের মেয়ে ও। ছিঃ ছিঃ।
-- আয়। তোরা দুজন এই পেছনের গেট দিয়ে উঠে আয়। ওরা দুজন উঠতেই মনীশ ইশারা করে দেখালো ডান দিকের শেষ দুজনের সীটের পেছনের দিকটা। বড় বড় করে লেখা 'জীবনে হতাস? মরে যেতে ইচ্ছে করে? নিচের নম্বরে ফোন করুন।’ নীচে যে নম্বরটা লেখা ওটা তো মুনুরই নম্বর!
মনীশ মুনুকে বলল, ‘ঠিক করে দেখে বলতো এই ফোনের নম্বরটি কি তোমার হাতের লেখা?’
-- দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। লেখার ছাঁদটা আমার মতই। তবে এখানে আমি লিখব কেন?
-- আর এই লেখাগুলো?
-- না না, পাগল নাকি আমি!
-- সে আমি বুঝেছি। ভুল বানান আর এমন বিচ্ছিরি লেখা তোমার মত শিক্ষিত মেয়ের হবে না। এটা অন্য কারও লেখা।
তুলি বলল, ‘তবে মুনু, তোর যেখানে সেখানে বসে খুটখাট করা অভ্যেস। টেবিলে বসলে ধারালো কিছু দিয়ে হয় তুমি নিজের নাম খোদাই করিস বা আঁকিবুঁকি কাটিস।’
-- হ্যাঁ তা ঠিক। হাতে পেন থাকলে হিজিবিজি লেখা বা এটা ওটা আঁকা আমার স্বভাব। তবে বাসের সিটে কি আমি লিখব?
-- হয়তো অন্যমনস্ক ছিলি। তুই তো এই বাসে বাড়ি ফিরিস। তখন হয়তো মাথার ক্লিপ ফ্লিপ দিয়ে লিখে থাকবি।
মনীশ বলল ‘আমারও তাই মনে হয়। এবার কোনও দুষ্টু লোক শূন্যস্থান পূরণ করে দিয়েছে। দুটো লেখার তফাৎ দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে কেউ এমন করে কাউকে ফাঁসাচ্ছে।তাই ভাবলাম এবার ফোন করে দেখি।’
-- গুল দিও না বাপি। দিনরাত আমরা এমন কত নম্বর দেখি বাথরুমে লেখা, ট্রেনে লেখা। আমরা এত শত ভাবি? তুমি ভাবলে আর ফোন করে দিলে কেউ ফাঁসাচ্ছে ভেবে?
-- বিশ্বাস করা বা না করা তোমাদের ইচ্ছে। কাল সারাদিন ফোন না ধরে বিকেলে মুনু যখন ফোনটা পেয়ে কেটে দিল তখন আমি নিশ্চিত হয়ে যাই এটা কোনও ভালো মেয়েই হবে। কোনও দুষ্টু লোকের দুষ্টুমির শিকার হতে চলেছে। ভাবলাম একবার যদি দেখা করতে পারি, তবে বুঝিয়ে বলব - এমন হলে কী করা উচিৎ। এজন্যই দ্বিতীয়বার ফোন করেছিলাম। তখন তুই ফোন তুলে এমন ভাবে কথা ঘুরিয়ে দিলি আমি হকচকিয়ে গেলাম। আবার রিষ্কও নিলাম এই ভেবে যে হয়তো তুইও - মানে তোরাও কোনও লক্ষ্য নিয়ে দেখা করতে চাইছিস।
-- গল্প দিচ্ছ আবার? আজকালকার দিনে কেউ উপযাচক হয়ে এমন বাঁশ নেবে পেছনে? তুলির গলায় বিস্ময়।
-- শোন, ফোন কর তোর সোম মামুকে। জিজ্ঞাসা কর তোর মায়ের জীবনে এমন কিছু ঘটেছিল কিনা?
-- মানে? চিৎকার করে উঠল তুলি?
-- আচ্ছা বেশ, তুই তোর মা'কেই ফোন কর। তোরা এখন বড় হয়েছিস, সব কথা জানতে পারিস। ফোন করে দ্যাখ মায়ের ফোন নম্বর দুষ্টু ছেলেপুলেরা ট্রেনের বাথরুমে লাগিয়ে কেমন মজার খোরাক করে তুলেছিল! তোর মায়ের দু-তিন বছর নষ্ট হয়েই গেছে জীবন থেকে – এই ট্রমায়। আমি যবে থেকে তোর মা'কে বিয়ে করেছি, জেনেছি, আমি চেষ্টা করি কিছু করতে। এমন কিছু দেখলে বিষয়টা যতটা সম্ভব কৌতুহল নিয়ে মনে মনে জরিপ করি, ফোন করি। এটা আমার এক প্রকার সমাজসেবা বলতে পারিস।
-- তুমি এখন কোথায় গিয়েছিলে বাপি?
--এই দ্যাখ। বলেই মনীশ ব্যাগ থেকে একটা প্যাস্টেল রঙ আর তুলি বের করল। লেখাগুলোর উপর রঙ চাপাতে চাপাতে বলল ‘পল্টুদার দোকান থেকে রঙ তুলি কিনতে গেছিলাম। ওর দোকানটা বন্ধ ছিল বলে দেরি হল একটু। দ্যাখ কেমন নতুন রঙে মুছে দিলাম সব কালিমা।’
মনীষের গা ঘেঁষে এসে বসল তুলি। ওর চোখে দু ফোঁটা জল। পরম স্নেহে হাতটা দিয়ে চোখটা মোছাতে যেতেই তুলি গালে লেগে গেল দু এক ফোঁটা লাল রঙ। সেই রঙ মিশে গেল কিছুটা অনুতাপ আর অনেক খানি ভালোবাসা।
1 Comments
Puro ta porlam sir...Besh bhalo laglo...❤️
ReplyDelete