জ্বলদর্চি

মঞ্চের আলো /অয়ন মুখোপাধ্যায়

মঞ্চের আলো

অয়ন মুখোপাধ্যায়

শীতের কুয়াশায় ঢাকা কলকাতার সকাল। বাইরে ট্রামের ঘণ্টা, চায়ের কেতলির হিসহিস। ভেতরে থিয়েটার হল নিস্তব্ধ। সারি সারি চেয়ার যেন অদৃশ্য দর্শকদল, বাতাসে ভাসছে পুরনো সংলাপের ধুলো।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে শম্ভু মিত্র ফিসফিস করে বললেন—
—“রক্তে ভিজে গেছে ধরণী, তবু থামেনি মানুষের জয়যাত্রা।”
প্রতিধ্বনি ফিরল দেয়াল থেকে। থিয়েটার যেন শ্বাস নিচ্ছে।

তখন ঢুকল নীতিতোষ। কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল—
—“শম্ভুদা, সিনেমা করলে নাম, টাকা, খ্যাতি—সবই পেতেন। এত কষ্ট করে নাটক কেন?”

শম্ভু মিত্র মৃদু হাসলেন।
—“সিনেমা মানুষকে বিনোদন দেয়, নাটক মানুষকে প্রশ্ন করে। আর প্রশ্ন করাই শিল্পীর সবচেয়ে বড় কাজ।”

এই বাক্য তরুণের বুকের ভিতর অগ্নিশিখা হয়ে উঠল।

🍂

রিহার্সাল শুরু হলো।
কণিকা, এক তরুণী অভিনেত্রী, বলল—
—“মঞ্চে নারী কেন সবসময় চোখের জল? সে-ও কি প্রশ্ন তুলতে পারবে না?”
শম্ভু উত্তর দিলেন—“নাটক মানুষকে মানুষ করে, নারী-পুরুষ আলাদা করে না।”

অরুণ, আলো-কর্মী, পুরনো সুইচে ঘাম ঝরাচ্ছে।
বাবু মশাই, কেয়ারটেকার, হাসলেন—“আলো নিভে গেলেও নাটক নিভে না।”

ঠিক তখনই বিদ্যুৎ গেল। অন্ধকার। গুঞ্জন।
শম্ভু বললেন—
—“আলো না থাকলেই কি মানুষ থেমে যায়? আমাদের কণ্ঠই হোক আলো।”

মোমবাতি জ্বলে উঠল। সংলাপ বেরোল বুকের ভিতর থেকে। অন্ধকারে প্রতিটি কণ্ঠ যেন আলোর মশাল।


প্রদর্শনের দিন।
হল ভর্তি দর্শক।
রক্তকরবী শুরু হলো।
শেষ দৃশ্যে মুক্তির স্বপ্ন উচ্চারণ করলেন শম্ভু মিত্র। হল নিস্তব্ধ, তারপর বজ্রপাতের মতো হাততালি।

এক বৃদ্ধা ভিড় ঠেলে তাঁর হাত ধরলেন—
—“বাবা, আজ যেন আমার নিজের কষ্টও তোমার সংলাপে শুনলাম।”

শিল্পীর চোখ নত হলো। সার্থকতার মুহূর্ত—যখন দর্শক তার ব্যথা খুঁজে পায় শিল্পে।


রাত গভীর। আকাশে তারা।
শম্ভু মিত্র থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে আস্তে বললেন—
—“নাটক আমার কাছে শুধু শিল্প নয়, এ আমার দেশ, এ আমার মানুষের মুক্তির স্বপ্ন।”

নীতিতোষ, কণিকা, অরুণ শুনল। মনে হলো কথাগুলো বুকের ভেতর শেকড় গাড়ছে।

মঞ্চ তখন ফাঁকা। তবু কুয়াশার ভেতরে অদৃশ্য দর্শকদল দাঁড়িয়ে আছে।
তারা ইতিহাসের মানুষ, আগামী দিনের মানুষ।

আর তারা একসঙ্গে বলছে—

“যতদিন প্রশ্ন থাকবে, ততদিন নাটক বেঁচে থাকবে।”

Post a Comment

13 Comments

  1. অসম্ভব ভালো লাগলো লেখাটা

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ

      Delete
    2. ধন্যবাদ

      Delete
  2. প্রতিটা সংলাপ মনে দাগ কেটে গেলো, সবকিছু যেন চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পেলাম।

    ReplyDelete
  3. এটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য কারণ নীতিতোষ মুখোপাধ্যায় শম্ভু মিত্র কে অনুকরণ করতেন এবং বলাগরে এই প্রযোজনাও তিনি করেছেন ওখান থেকে তিনি যোগাযোগ রাখতে

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ

      Delete
    2. ধন্যবাদ

      Delete
    3. একদম ঠিক বলেছেন

      Delete
  4. ভালো লাগল

    ReplyDelete
  5. ধন্যবাদ

    ReplyDelete