জ্বলদর্চি

কুমারেশ ঘোষ (অধ্যাপক, সাংবাদিক, মেদিনীপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭৩
কুমারেশ ঘোষ (অধ্যাপক, সাংবাদিক, মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

"স্যার আপনি?"
"কে বলতো তুমি?" 
"লাল সেলাম স্যার। আপনাকে হামি চিনি এবং জানি। আপনি এখানে কেন আসেন, তাও জানি। আপনি বাংলোয় চলে যান। কেউ আটকাবে না। বাংলোর দরজা খোলা রাখবেন। রাতে আমি আসবো।" 
'বাংলো' মানে কাঁকড়াঝোড় সরকারি বাংলো। সেখানেই আস্তানা গেড়েছিলেন অধ্যাপক কুমারেশ ঘোষ। সঙ্গে একশো জন বিভাগীয় ছাত্র ছাত্রী। যথারীতি রাতে হাজির জংলা শাড়ি পরা শ্যামলা রঙের মেয়েটি। সঙ্গে অস্ত্রধারী কয়েকজন সাগরেদ। বাংলোয় ঢুকেই স্যারের পা ছুঁয়ে প্রনাম। 
"স্যার, আমি আপনার ছাত্রী। আপনি আমার পড়ানোর স্যার। মাস্টারমশাই। আমাকে আপনি অর্থনীতি পড়িয়েছেন মেদিনীপুর কলেজে।"
"আরে, কোন ব্যাচ তুমি? সঙ্গের সাথীরা কারা? তোমার নাম কি?" 
"ছাত্রীজীবনে আমার নাম ছিল বিচিত্রা মাহাতো। এখন আমি মাওবাদী দলের একজন কর্মী।" 
"তুমি তো অর্থনীতির তত্ত্বে ডুবে থাকতে তখন। মাওবাদী দর্শনের সঙ্গে কি সাযুজ্য পেলে আজ? কল্যানমূলক অর্থনীতি এঁরা আনতে পারবে তো? তোমার স্বপ্নের ভারত এঁদের দর্শনতত্ত্বের মাধ্যমে আনা সম্ভব?" 
"স্যার, আপনি আমার শিক্ষাগুরু। আপনি এই জঙ্গলমহলে এসেছেন। আর আমার কর্মজীবনের গুরু কিষানজি এখানেই রয়েছেন এখন। তাঁর সাথে আলাপ করিয়ে দিতে চাই আপনাকে। আসলে আমি আমার প্রথম গুরুকে আমার নতুন গুরুর সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে চাইছি।"

সেই ছাত্রী বিচিত্রা মাহাতোই পরবর্তীতে সমাজ পরিবর্তনের নেশায় বুঁদ হয়ে ওঠা বিপ্লবী মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতো। কিষানজির ডানহাত। জঙ্গলের ডাকাতরানি। যে একসময় কালি কলম নিয়ে অর্থনীতির আকচাআকচি বুঝতে চেষ্টা করত, সে এখন দুহাতেই গুলি ছুঁড়তে পারে। মানুষ মারতে পারে। অবশ্য সেই ডাকাবুকো ছাত্রীর সৌজন্যেই দেখা হয়েছিল কিষানজির সাথে। গামছার আড়ালে মুখ ঢেকে রাখা মাওবাদী সুপ্রিমো কিষানজির সাথে মুখোমুখি বসে চোখে চোখ রেখে কথা বলার অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন অধ্যাপক কুমারেশ ঘোষ। একসময়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পাওয়া দক্ষিণ ভারতের এক মেধাবী ছাত্র আজ হয়ে উঠেছেন মাওবাদী তত্বে বিশ্বাসী একজন পলিটব্যুরো মেম্বার। মানুষ খুনের রাজনীতি নিয়ে যাঁর নিত্য ওঠাবসা। 
সস্ত্রীক কুমারেশ ঘোষের সাথে লেখক

"মানুষের কাছে পৌঁছতে পারলেন?" 
"যাঁরা Swords ব্যবহার করে, তাঁরা ভদ্রতাও জানে মাস্টারজি। সরকার, জমিদার আর জোতদাররা রাইফেল, মর্টার, কালাশনিকভ্ দিয়ে গরিবদের শাসন করবে। আর আমাদের লোককে মারবে, আমরা Swords ব্যবহার করলেই দোষ? ভারতবর্ষে গান্ধীর দিন আর চলছে না মাস্টারজি।"

এরপর আর কথা হয়নি কিষানজির সাথে। অতিথি কুমারেশ ঘোষের সঙ্গ ছেড়ে তিনি মিলিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বিপ্লবের পথে। তাঁর চিরকালীন সন্ত্রাসের পথে। সাংবাদিক সুলভ সাক্ষাৎকার শেষে এরপর কাঁকড়াঝোর সরকারি বাংলোতে ফিরেই সকল ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে মেদিনীপুর ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন কিছু সময়ের মধ্যেই। আসলে স্নেহের ছাত্রী সুচিত্রা মাহাতোর অনুনয়, অনুরোধ কিংবা প্রচ্ছন্ন নির্দেশ মানতে হয়েছিল সেদিন। ঐ রাতেই সেই বনবাংলো মাইন বিস্ফোরণ করে উড়িয়ে দিয়েছিল সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর কিষানজির বনপার্টির লোকেরা। 

কে এই কুমারেশ ঘোষ? মেদিনীপুর কলেজের ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ছিলেন একসময়। ১৯৬২ সালে অধ্যাপনার সাথে যুক্ত হন। সেসময় পরেশনাথ ঘোষ তাঁকে নিয়োগপত্র দেন কলেজে। বেতন পেতেন মাত্র দেড়শ টাকা। ছাত্রজীবনে তাঁর স্যার ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তিনি পই পই করে ছাত্রদের বলতেন, "শ্রেণীকক্ষে শুধু ক্লাস করবে না। শুধু ক্লাসের মধ্যে আটকে থেকোনা। ছেলে মেয়েদের ক্লাসরুমের গণ্ডি ছেড়ে গ্রামে নিয়ে যেও। জঙ্গলমহলে যেও। গ্রাম চেনাবে, মানুষ চেনাবে, প্রকৃতি চেনাবে, আর সেখানকার জীবনের স্বাদ বোঝাবে।" গুরুর কথা অমান্য করেননি তিনি। প্রতিবছর ১০০ জন ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে ফিল্ড সার্ভে করতে যেতেন জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামে। সেসময় কুইনাইন ট্যাবলেট থেকে শুরু করে যাবতীয় সামগ্রী নিয়ে সদলবলে জঙ্গলমহলের গ্রামে কাটাতেন বেশ কয়েকটা দিন। আপনজন হয়ে উঠতেন জঙ্গলমহলের গরিবগুর্বো মানুষজনের কাছে। এরকমই এক ফিল্ড সার্ভে করতে গিয়েই হঠাৎ দেখা পেয়েছিলেন তাঁর মেদিনীপুর কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতোর। 

অধ্যাপনার পাশাপাশি আনন্দবাজার পত্রিকা সহ এর সহযোগী সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ, ভূমিলক্ষ্মী, প্রবাসী আনন্দবাজার ইত্যাদিতে নিয়মিত লিখে গিয়েছেন সাংবাদিক হিসেবে। কাজ করেছেন ইউ এন আই'তেও। সন্তোষ রাণার সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন নিজস্ব বুদ্ধিতে এবং সোর্সের সহায়তায়। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় পুরো পাতাজুড়ে তা প্রকাশিত হয় সেসময়। 

ঘাটালের ক্ষেপুত গ্রামে ১৯৪০ এর ৪ ঠা মার্চ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মা রেণুকা ঘোষ সাধারণ গৃহবধূ। বাবা বিজয়কৃষ্ণ ঘোষ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। মেদিনীপুরের তিন কুখ্যাত জেলাশাসক হত্যার ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল বাবার। এজন্য তাঁকে দশ বছর জেল খাটতে হয়। এমনকি তাঁর ঠাকুমা লক্ষ্মীমনি দাসীর ওপরও অকথ্য অত্যাচার চলে সেসময়। আজ জীবন সায়াহ্ণে পৌঁছেও অধ্যাপক কুমারেশ ঘোষ নানারকম সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। 'মেদিনীপুর ছাত্র সমাজে'র সাথে আত্মিক সম্পর্ক। তাঁর এক অতি প্রিয় ভালোবাসার সংগঠন। এসব কাজে তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মতো আনন্দ পান। মনের মধ্যে কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হোক, এই ভাবনা পোষণ করেন মানসিকভাবে। একজন ছাত্রী 'বিচিত্রা মাহাতো' মাওবাদী দলের 'সুচিত্রা মাহাতো' রূপে পরিবর্তিত হলেও আখেরে তাঁর দেওয়া শিক্ষা বৃথা যায়নি বাকি ছাত্র ছাত্রীদের জীবনে। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। সুচিত্রাদের ভাবনার 'সামাজিক পরিবর্তন' তিনি চাননি। মানুষের জীবন না কেড়ে সকল 'দিন আনা দিন খাওয়া' মানুষের দিন কাটুক ভাত জোগাড়ের চিন্তা না করে -- এরকম অর্থনৈতিক পরিবর্তনই চেয়েছেন অর্থনীতির অধ্যাপক কুমারেশ ঘোষ। 

বাড়িতে আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিলনা। সেসময় মাত্র তিরিশ টাকা মাইনেতে কি সংসার চলে? তবুও তাঁর বাবা তিন ছেলে ও তিন মেয়েকে মানুষ করেছেন শত বাধা উপেক্ষা করে। কুমারেশ ঘোষ তাঁদের বড় ছেলে। মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক এবং আনন্দবাজার পত্রিকার নামকরা সাংবাদিক হয়েছিলেন নিজের যোগ্যতায়। মেজছেলে প্রনবেশ ঘোষ হয়েছিলেন দূরদর্শনের ডিরেক্টর। আর ছোট ছেলে পুলকেশ ঘোষ ছিলেন বর্তমান পত্রিকার নামকরা সাংবাদিক। তিন ছেলেই যুক্ত হয়েছিলেন সাংবাদিকতার সাথে। 

একসময় মেদিনীপুরের বুকে আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন প্রাক্তন বিধায়ক তথা কংগ্রেস নেতা জ্ঞান সিং সোহনপাল। তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হতে সেই কাজে স্থলাভিষিক্ত হন কুমারেশ ঘোষ। ১৯৬৫ সালে সেসময় নানা পরীক্ষা দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্বটি পালনে যুক্ত হন। ১৯৯৯ পর্যন্ত টানা লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। দীর্ঘ এই সময়ে তিনি তাঁর কাজের নিরিখে নিজের জাত চিনিয়েছেন। সুদূর মেদিনীপুরের বুকে থেকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক কাগজের চাহিদামতো নানা গুরুত্বপূর্ণ খবরের নির্যাস তুলে ধরেছেন বারবার। আলোড়ন তুলেছিলেন রাজ্যজুড়ে। তখন না ছিল ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা, না ছিল উন্নত টেকনোলজি। স্রেফ নিজের ক্যারিশমা আর ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে যেসব নিউজ 'বিট' করেছিলেন, তা আজকের যুগে সাংবাদিকদের কাছে স্বপ্নের মতো। তিনি আখেরে গর্বিত করেছেন মেদিনীপুরকে। উজ্জ্বল করেছেন সাংবাদিকতা নামক মহান পেশাটিকে। 

১৯৭৮ এর বন্যায় কলাইকুন্ডা বিমানবন্দরে গিয়ে সেনাবাহিনীর বিমানে উঠে দেখেছিলেন এরাজ্যের বন্যার চিত্র। চারিদিকে জল। কোথাও যেন স্থলের দেখা নেই। তাঁর কথায়, 'ঘাটালে কোনও প্রাণের অস্তিত্ব পেলাম না'। সেই অভিজ্ঞতা এবং 'আঁখো দেখা হাল' নিয়ে কলমের আঁচড়ে আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় লিখলেন মর্মস্পর্শী 'ফ্লাড কভারেজ'। "আকাশে উড়ে দেখি নীচে সমুদ্র। কোনও কালে বিশাল জায়গাটা যে স্থলভাগ ছিল -- মনেই হয়না। কূল নাই, সীমা নাই, অকূল দরিয়ার পানি।"  তাঁর লেখা বন্যার খবর নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতার ব্যানার হেডলাইন ছিল -- 'আকাশ থেকে দেখি নিচে সমুদ্র'। এই একটি খবর সেদিন আলোড়িত করেছিল চারিদিকে। তখন জেলাশাসক ছিলেন সত্যেন ঘোষ। তাঁর এই রিপোর্টিংয়ের ভিত্তিতে নড়েচড়ে বসল প্রশাসন। মেদিনীপুরের সেই ভয়াবহ বন্যার সত্যিকারের রূপ জেনেছিল গোটা বাংলা।

সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজনে এই বিশেষ ঘটনার প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, "পেয়েছিলাম এক প্রধানমন্ত্রী পুত্রকে। ১৯৭৮ সালে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় শেষ প্রবল বন্যায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে তিনি নেমেছিলেন সামরিক বিভাগের এক এয়ারপোর্ট কলাইকুণ্ডায়। তাঁর সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার সফরসঙ্গী হয়ে আমি ঘুরেছিলাম বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলগুলি। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক জেনে আমার কাছ থেকে উনি এই অঞ্চলের বিগত এবং বর্তমান বন্যার রূপ, ভূমিরূপ এ অঞ্চলের ভূমিক্ষয়ের প্রকৃতি জেনে নিজের ছোট নোট বইয়ে 'নোটস' নিতে শুরু করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে 'গুরুজী' বলে ডাকতেও শুরু করলেন। বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হল ধীরে ধীরে বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে। তা রয়েও গেল তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।" সেদিনের ঐ প্রধানমন্ত্রী পুত্র ছিলেন রাজীব গান্ধী। যিনিও পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। রাজীব গান্ধীর সঙ্গে পরিচয় প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, "রাজীবের সঙ্গে যখন পরিচয় হল তখন সে দেশের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্লেন পাইলট।"

সুচিত্রার মতোই তাঁর আরেক ছাত্রী ছিল চুনি কোটাল। আত্মহত্যা করেছিল সে। তাঁকে নিয়ে 'দেশ' পত্রিকায় কভার স্টোরি বানিয়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন সারা দেশে। এই লেখার জন্য তিনি ১৯৯২ সালে পেয়েছিলেন প্রেস্টিজিয়াস 'স্টেটসম্যান অ্যাওয়ার্ড'। সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি চুনি কোটালের জীবনের খবর লিখে। লড়াইয়ের খবর লিখে। চুনি কোটালের প্রতি সামাজিক অন্যায়ের খবর লিখে। এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য সে সময়কার স্টেটসম্যানের জে ডি ইরানী আমেরিকা থেকে উড়িয়ে এনেছিলেন অমর্ত্য সেনকে। তিনি ছাড়াও এই পুরস্কার সেবার পেয়েছিলেন অদিতি চাড্ডা কাপুর এবং অটুই সি দেউলগাঁওকর। কুমারেশ ঘোষের মানপত্রে লেখা ছিল চুনি কোটালের কথা -- "If being born a woman in a backward Indian village is a curse, being born a woman in a Lodha family is hell. At least, the life of Chuni Kotal, the first Lodha woman graduate who committed suicide, testifies to this. Chuni was born into a poor Lodha family, the youngest of seven brothers and sisters. When she was born, her father, Shambhunath Kotal, used to earn 13 paise a day as a soil-digger. When the hapless child just saw the light of day there was no rice in the house."

মেদিনীপুর শহর থেকে ১০ মাইল দূরের এক গ্রাম গোহালডিহাতে বসবাস করত এই হতদরিদ্র লোধা পরিবারের মেয়ে চুনি কোটাল। কিন্তু অদম্য উৎসাহ, স্পৃহা এবং জেদকে সঙ্গী করে ঐ লোধা ছাত্রীটি হাজির হয়েছিল অধ্যাপক কুমারেশ ঘোষের মেদিনীপুর কলেজের অর্থনীতির ক্লাসরুমে। চরম দারিদ্র্য বাধা হয়ে দাঁড়ালেও চুনি কোটালের পড়াশোনাকে থমকে দিতে পারেনি। সেসময় স্যারের কাছে তাঁর একটাই আর্তি ছিল "স্যার, আমি সারা দেশের মধ্যে প্রথম মহিলা লোধা গ্র্যাজুয়েট হতে চাই।" চুনি কোটালের স্মৃতি হাতড়ে কুমারেশ ঘোষ লিখেছেন, "তার একটা ভাঙা সাইকেল ছিল। আমি ঐ ভাঙা সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারে বসে তাঁর সঙ্গে তাঁর একেবারে ভেঙে পড়া বাড়ি গিয়ে তাঁর বাবাকে বোঝাই, বলি - ওখান থেকে ভাঙা সাইকেলে প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার পথ ঠেঙিযে তাঁর পক্ষে গ্র্যাজুয়েট হওয়া কঠিন। উনি যদি আমার স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে রেখে চুনিকে পড়াতে চান, আমাদের কোনও অসুবিধা হবে না। চুনির বাবা রাজী হন। চুনি গ্র্যাজুয়েটও হয়, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে ভর্তিও হয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ফাইন্যালের ঠিক আগে সে আত্মহত্যা করে।"

এই জঙ্গলমহলের বুকেই তিনি পেয়েছিলেন আরেক 'চরিত্র' গোপীনাথ মাহাতোকে। আমৃত্যু তাঁর সঙ্গে সখ্যতা এবং সম্পর্ক বজায় ছিল। এই সেই গোপীনাথ মাহাতো, যাঁকে আমরা দেখতে পাই বিখ্যাত সিনেমা 'চারমূর্তি'তে গরুর গাড়ির চালকের চরিত্রে অভিনয় করতে। তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, "গোপীনাথ মাহাতকে পেয়েছিলাম কাঁকড়াঝোরে। শ্মশ্রুগুম্ফ ভরা আনপড় মুখে সর্বদাই হাসির এক প্রসন্ন সকাল। ...... গোপীনাথকে যখন চিনি, তখন সে টেনিদার লেখা 'চারমূর্তি' সিনেমার গরুর গাড়ি চালায়। আমিই ওর এই মুখটার পরিচয় দিয়েছিলাম পরিচালক উমানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে।"

সাংবাদিকতার প্রয়োজনে বিভিন্ন যায়গায় গিয়ে যে অভিজ্ঞতার ঝুলি তিনি ভরেছেন, সেগুলো নিয়েই লিখে ফেলেছেন বেশ কয়েকটা বই। তাঁর লেখা বইগুলি হল জঙ্গলমহলের হাসিকান্না, জঙ্গলমহল ও উপর মহল, জঙ্গলমহলের আমন্ত্রণ, ভালোবাসায় জঙ্গলমহল এবং মেদিনীপুরের অন্যান্যরা (স্ত্রী নুপুর ঘোষের সাথে যৌথভাবে)। তাঁর যাবতীয় কাজের ক্ষেত্রে অন্যতম অনুপ্রেরণা তাঁর শিক্ষিকা স্ত্রী। 

মর্যাদাপূর্ণ 'স্টেটসম্যান অ্যাওয়ার্ড' ছাড়াও তিনি পেয়েছেন গনপতি বসু স্মারক সম্মান (দাতা : চন্দন বসু), সকলের কথা পুরস্কার (বঙ্কিম ব্রম্ভচারী পুরস্কার) সহ অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার। কিন্তু পুরস্কারের আবহে তাঁকে বিচার করা যায়না। তাঁর দীর্ঘ সাংবাদিকতার কাজ তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। একদিকে অধ্যাপনা, অন্যদিকে সাংবাদিকতা -- বারবার এই দুই পেশার মিশ্রণ ঘটেছে তাঁর কাজের জগতে। নিজের হাতে গড়া ছাত্র ছাত্রীরা পরবর্তীতে হয়ে উঠেছে এক নামকরা 'চরিত্র'। যাঁদের নিয়ে তিনি কলম ধরেছেন খবরের কাগজের পাতায়। একসময় যাঁকে ক্লাসরুমের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রেখে শিক্ষক হিসেবে বুঝিয়েছেন অর্থনীতির জটিল পাঠ, পরবর্তীতে তাঁকেই জনসমক্ষে হাইলাইট করতে হয়েছে সাংবাদিক হিসেবে। একজন 'গুরু' হিসেবে এটাই তাঁর পরম প্রাপ্তি।
🍂

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব ভালো লিখেছ ভাস্কর ! ভগবান তোমাকে আশীর্বাদ করুন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।।

      Delete
  2. Awesome👍

    ReplyDelete