সিদ্ধার্থ সাঁতরা
তাঁর জন্মশতবর্ষে আমার এই লেখাটি ভারতের অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ চিত্রনির্মাতার প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ। তাঁর জন্ম ৪ নভেম্বর , ১৯২৫ ও মৃত্যু ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬। ঋত্বিক যখন কলেজের প্রথম বর্ষে তখনই তাঁর যোগাযোগ আই পি টি এ-র সঙ্গে। তখন তাঁর বয়স কত বড় জোর উনিশ/কুড়ি । সেসময় তাঁর অভিনয়ের শুরু । ১৯৪৮ সালে তিনি গণনাট্য সংঘের সম্পাদক হন। গণনাট্য সংঘে থাকাকালীন 'দলিল', 'জ্বালা', 'সাঁকো', 'ভাঙা-বন্দর' ইত্যাদি তাঁর লেখা নাটক সেখানে অভিনীত হয় । তিনিই ছিলেন ঐসব নাটকের পরিচালক এবং প্রয়োজনমতো অভিনয়ও করেছেন সেখানে। এই সময়ের কথা আছে তাঁর "কোমল গান্ধার" ছবিতে । সেই সময়ে যে ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ঋত্বিক ছিলেন তাঁর কর্মী। এই অংশগ্রহণ ঋত্বিককে সমৃদ্ধ করেছিল। গণনাট্য সংঘে থেকে নাটকের অভিজ্ঞতার চেয়েও ঋত্বিক যেটা বেশি অর্জন করেছিলেন তা হলো রাজনৈতিক চেতনা। গণনাট্য সংঘ থেকে সিনেমা জগতে চলে আসার পরও এই চেতনা তাঁকে পথ দেখিয়েছে এবং সমৃদ্ধ করেছে । তাই ঋত্বিক বলেছেন " আমার শিল্পীজীবনের সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় এই দুই অবস্থাতেই বুঝেছি যে সংগ্রামকে শিল্পীজীবনের নিত্যসঙ্গী করে তুলতে হয়।" তিনি আরও বলেছেন "ছবি তৈরির মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ভালো করা। মানুষের ভালো না করতে পারলে কোন শিল্পই শিল্প হয়ে দাঁড়ায় না। ছবি যখন তৈরি করতে যাই তখন নজর রাখতে হয় মানুষের দিকে। তাৎক্ষণিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কোনদিকে যাচ্ছে সেটার দিকে তাকাই। এবং টু দি বেস্ট অফ মাই এবিলিটি আমি সেটাকে বলার চেষ্টা করি । আমার একমাত্র চিন্তার বিষয় হচ্ছে আমার দেশের মানুষ। আমার আর কিস্যু নেই।"
🍂
শুধু শিল্প করার তাগিদে তিনি সিনেমা করতে আসেননি। তাঁর অনেক কিছু বলার ছিল যা লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার তাগিদে তিনি সিনেমা তৈরি করতে এসেছিলেন। যখন তাঁর চারপাশের মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক জগতে একটা বিপন্নতা জেগে উঠেছে তখন তিনি করলেন তাঁর প্রথম ছবি "নাগরিক"(১৯৫২)। ছবির নায়ক রামু একটার পর একটা চাকরির ইন্টারভিউতে যায় কিন্তু বিফল হয়ে ফিরে আসে। ছবির শুরুতে সে সবার চেয়ে আলাদা, সে স্বপ্ন দেখে একটা চাকরি পেলে কত সুখে থাকবে। ছবির শেষে সে চাকরি পায় না সে বাধ্য হয় তাঁর মতো অন্যদের পাশে এসে দাঁড়াতে। রামু, উমা, সীতা, সাগররা পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়ায়। যারা নিম্নমধ্যবিত্ত তারা চিরকালই অর্থনৈতিক দিক থেকে এই জায়গাতেই যেন আটকে পড়ে আছে যেখান থেকে উত্তরণের পথ মানুষ খুঁজে পাচ্ছেনা এই উপলব্ধিতে ছবি শেষ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন-যন্ত্রণার প্রথম বস্তুনিষ্ঠ সিনেমা তৈরির চেষ্টা এই "নাগরিক"।
কুড়ি বছরে মাত্র আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্যর ছবি করতে পেরেছিলেন। সংখ্যায় কম হলেও নানা গুণে গুণান্বিত এই ছবিগুলি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে চিরভাস্বর থাকবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। তাঁর আরও একটি ছবি "মেঘে ঢাকা তারা" ১৯৬০ সালে তৈরি এবং এই ছবি উদ্বাস্তু সমস্যার নানা দিক, তৎকালীন মানুষের জীবন যন্ত্রণার যে আখ্যান তাই নিয়ে তৈরি । শিকড় ছেঁড়া মানুষের অচেনা জমিতে পুনর্বাসনের পর বেঁচে থাকার জন্য যে অর্থনৈতিক লড়াই, নীতি, আদর্শ এবং বিবেকের যে লড়াই তাঁর ছবি । দেশভাগের যে যন্ত্রণা, ক্ষত-বিক্ষত জীবনের যে অসহায়তা, তার ছবি, একমুঠো খাবারের জন্য আত্মসমর্পনের যে কাহিনী তার প্রতি ঘৃণা সব মিলিয়ে এক কঠিন সময়ের দলিল এই ছবি।
দেশভাগ হওয়াটাই আমাদের অর্থনীতিকে ভেঙেছে। দেশভাগের সবচেয়ে সার্থক দলিল "সুবর্ণরেখা"। যে ছবির শুরুতেই শোনা যায় "রাতে কোনো যুবক ঘুমোবেননা।" এই ছবিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক প্রলয়ক্ষেত্রে পরমানন্দে ছোট্ট মেয়ে সীতাকে ছুটে বেড়াতে দেখি। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ায় এক কালীমূর্তি। সীতা চমকে ওঠে। ঐ কালীমূর্তি একজন বহুরূপী যে ওকে ভয় দেখাতে চায়নি। সেই সীতা বড় হয়ে জীবনে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। ছবির শুরুতে যে রাত জাগার কথা সেই রাত জাগা কী ভয়ঙ্কর। সেই রাত্রিতে সীতা পালিয়ে যেতে চায় জীবন থেকে। সে পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে কিন্তু সে পালাতে পারেনা। এই যে সংকট, মানুষের বেঁচে থাকার যে সংকট তাঁর ছবিতে তিনি বারবার এই সংকটকে ধরবার চেষ্টা করেছেন। ঋত্বিক মনে করতেন দেশের সংকটকে কোনো না কোনো দিক থেকে যদি উদ্ঘাটিত করতে না পারেন তাহলে তাঁর শিল্পকর্ম করবার কোনো অধিকারই থাকবে না। যে দারিদ্র আর নীতিহীনতা মানুষের নিত্যসঙ্গী, যেখানে কালোবাজারি আর অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের রাজত্ব, সেখানে বিভীষিকা আর দুঃখ দরিদ্র মানুষের নিত্যসঙ্গী। খণ্ডিত জরাজীর্ণ বাংলার যে বিবর্ণ রূপ মানুষ দিনের পর দিন প্রত্যক্ষ করছে তা ঐ পতিতালয়ে সীতার মতো অবস্থা। ঋত্বিক ব্যথা পেয়েছেন, পীড়িত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন । ঋত্বিকের মনে হয়েছিল "যদি আপনি সচেতন হয়ে ওঠেন, ছবি দেখে বেরিয়ে এসে বাইরের সামাজিক বাধা বা দুর্নীতি বদলানোর কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার প্রতিবাদকে যদি আপনার মধ্যে চারিয়ে দিতে পারি তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।"
একের পর এক ছবিতে তিনি তুলে ধরেছেন দ্বিখণ্ডিত দেশের সমাজ, মানুষ ও তার বিপন্নতা, সময়ের খেই হারানো জীবনের কথা। তাঁর নির্মিত ছবিগুলি হলো নাগরিক (১৯৫২), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৫৯), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) এবং যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪)। এছাড়া দশটি তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্যর ছবিও করেছেন যেমন সিজার্স (১৯৬২), ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান (১৯৬৩), ফিয়ার (১৯৬৪-৬৫), পুরুলিয়ার ছৌ (১৯৭০), আমার লেনিন (১৯৭০), দি কোয়েশ্চন (১৯৭০), দুর্বার গতি পদ্মা (১৯৭১) ইত্যাদি। তিনি বইও লিখেছেন নাম "সিনেমা এন্ড আই", "চলচ্চিত্র, মানুষ এবং আরো কিছু" ইত্যাদি । অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন চলচ্চিত্র গবেষকরা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (ঋত্বিকতন্ত্র ), সুরমা ঘটক (ঋত্বিক )। একটা সিনেমাও তৈরি হয়েছে তাঁকে নিয়ে নাম "দ্য নেম অফ এ রিভার"(অনুপ সিং /২০০১)।
সম্প্রতি (২০২৫) তাঁকে নিয়ে কলকাতায় একটি নাটক প্রযোজিত হয়েছে নাম "মেঘে ঢাকা ঘটক"। পরিচালক সুজন নীল মুখোপাধ্যায়। নাটকটি দর্শক মহলে উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে। জন্ম শতবর্ষে এই নাটক আবার নতুন করে একটা প্রেক্ষিত রচনা করলো যেখানে অসামান্য এই নাটকে সুজন নীল মুখোপাধ্যায় , ঋত্বিক হয়ে উঠতে যে দহন আর মন্থন পার করেছেন বা করছেন , প্রকরণের বন্ধন মুক্ত করে , সেটা অনুভব করা গেছে প্রতি মূহুর্তে। পরপর শো-এ হল ভর্তি মানুষ কাঁদছে একসাথে, কিসের জন্য? ঋত্বিকের জন্য না সুরমার জন্য না নিজেদের জন্য, একসময়ে সেই বোধ গুলিয়ে যায়। অসংখ্য হা-হাভাতে জীবন মনে করাও তুমি, তোমরা, তোমরা সবাই। আমাদের জীর্ণ সং -কে একটানে ছিঁড়ে ফেলেছো তোমরা, আমাদের সুখের সাধের সং-সারে আগুন লাগছে, আমাদের তীব্র রাগ হচ্ছে, কান্না আসছে, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে " আমিও বাঁচতে চেয়েছিলাম...."
1 Comments
খুব সুন্দর লেখা, সুন্দর উপস্থাপনা, অনেক আমার অজানা তথ্য
ReplyDeleteসম্পাদনা চমৎকার
সাফল্য কামনা করি