তৃতীয় পর্ব
অয়ন মুখোপাধ্যায়
অদৃশ্য নাট্যকার
শীতের ভোর। প্রেসিডেন্সি কলেজের হোস্টেলের উঠোন কুয়াশায় ঢাকা। চায়ের কাপ নিয়ে কেদারনাথ ও তার বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে। কেদারনাথ হঠাৎ বলল—
কঠিন ঠান্ডায়“শরীর কাঁপছে ঠিকই, কিন্তু মনটা বলছে: ষোড়শী না দেখলে এই জীবনটাই বৃথা।”
হাসির রোল উঠল। অমল কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, “টিকিট না পেলে রংমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ষোড়শীর পোস্টার দেখেই ফিরতে হবে।” বিনয় ঠাট্টা করে বলল, “রঙ্গমহলে ঢোকা তো প্রেসিডেন্সির ক্লাসে ঢোকার মতো নয়, রে বাবা!”
কেদার গম্ভীর মুখে বলল, “আরে বাবা, আমি এগুলো কি আর জানি না? সব জানি, সবই বুঝি; তবু বলছি — আমি দেখবই। তার জন্য আমি মতলব ভেবে রেখেছি
অমল বলল মতলব ভেবে রেখেছিস কি মতলব
কেদারনাথ তৎক্ষণাৎ জবাব দিল যার লেখা, তার কাছেই যাব আর তাঁর কাছ থেকে যদি একটা কাগজ পাই, টিকিটের দরকার হবে না।” একজন বন্ধু বলল, “তার মানে তুই সরাসরি শরৎবাবুর কাছে যাবি আর গেলেই।উনি তোকে পাশ দিয়ে দিয়ে দেবেন।” কেদার পাল্টা বলল, “দেবে, দেবে — তোরা দেখিস । আমি কিভাবে শরৎ বাবুর কাছ থেকে টিকিট টা আদায় করি।” শোন আমি একটা মতলব ভেবে রেখেছি ঠিক মতন বলতে পারলে আমার মনে হয় খুব একটা অসুবিধা হবে না। সবাই জিজ্ঞেস করল মতলব টা কি কেদারনাথ বলল এখন বলবো না তোরা নিজেরাই দেখতে পাবি।
কয়েক দিনের মধ্যে কেদার তাঁর প্রেসিডেন্সির বন্ধুদের নিয়ে পৌঁছে গেল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতার বাড়িতে। লেখক তখন লেখায় ব্যস্ত; লেখা থামিয়ে তিনি চোখ তুলে বললেন, “হ্যাঁ, কী ব্যাপার? কে তোমরা?”
কেদার হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বলল, আজ্ঞে“আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র; হোস্টেলে থাকি। আমার বাড়ি হুগলি জেলার পাটুলি গ্রামে। আপনি তো দেবানন্দপুরের মানুষ—একই জেলার তাই একটু সাহায্য পাবো বলে আপনার কাছে এসেছি।” বন্ধুরা চুপচাপ; কেদারের উপস্থিত বুদ্ধির তারিখ করল বুঝতে পারল কোন দিক দিয়ে শরৎ বাবুর মনের মধ্যে ঢুকতে চাইছে।
কেদার বলল, “আপনি ‘ষোড়শী’র স্রষ্টা। পাঁচ দিন চেষ্টা করেও আমরা টিকিট পাইনি। আপনি যদি শিশির বাবুকে একটু লিখে দেন, তাহলে আর অসুবিধে হবে না।” শরৎচন্দ্র মুচকি হেসে বললেন, “তাহলে কি জেলার টানেই কলম চালাতে হবে বলছ?” কেদার বলল, “আজ্ঞে, সেরকম হলেই আমাদের সুবিধা হয়।”
শরৎচন্দ্র একটু থেমে কাগজ টেনে নিলেন; কলম চালিয়ে কয়েক লাইন লিখে , ভাঁজ করে কাগজটি খামে বন্দী করে আঠা দিয়ে মেরে কেদারকে দিলেন। কেদাররা বেজায় খুশি। কিন্তু শরৎ বাবু চিঠিতে কি লিখলেন সেটা জানা গেল না।
যথারীতি পরের দিন শীতের সন্ধ্যায় কেদাররা রঙ্গমহলের সামনে দাঁড়াল। ভিড় জমে গেছে। হঠাৎ হই হই শব্দ কেদার দেখল গাড়ি থেকে নামলেন কিংবদন্তি অভিনেতা পরিচালক নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভদুড়ি। গ্রাম থেকে এসে শিশির কুমার ভাদুড়ীকে দেখা কেদারের কাছে এক বিস্ময়।কেদার ভিড় চিরে সামনে গিয়ে কাগজ বাড়িয়ে বলল, “শরৎবাবুর থেকে একটা চিঠি।” শিশিরকুমার চিঠি হাতে নিয়ে পড়ে অদ্ভুত ধরনের হাসলেন যে হাসির মানে অনেক। শিশির কুমার ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, “শুনুন — ম্যানেজার বাবু, শরৎবাবু এনাদের পাঠিয়েছেন; এরা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। আজকে এনারা আমাদের ষোড়শী নাটক দেখবেন এদের ফ্রন্ট রো-তে বসার ব্যবস্থা করে দিন, দেখবেন যেন কোনো অসুবিধে না হয়; ।
কেদার ভাবতে পারেননি যে শিশিরকুমার ভদুড়িকে এত কাছ থেকে দেখতে পাবেন । সেই রাতেই তারা সামনের সারিতে বসে ‘ষোড়শী’ দেখল; শিশিরবাবুর অভিনয় দেখে সবাই মুগ্ধ সবাই কেদারের প্রতি কৃতজ্ঞ; কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও একটা কৌতুহল কেদার ও তার বন্ধুদের মনের মধ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে শরৎ বাবু—চিঠিতে কী এমন লিখেছিলেন যা পড়ে , শিশিরবাবু এমন ভাবে হাসলেন কেনো? সকলেই স্বীকার করল শিশির বাবুর হাসির মধ্যে একটা গভীর রহস্য ছিল।
🍂
নাটক শেষে কেদার ও তার বন্ধুরা ঠিক করলো চিঠির ভেতরে রহস্যকে ভেদ করবে সেই উদ্দেশ্যে তুমি রুমে ম্যানেজার বাবুর সাথে দেখা করে চিঠিটি দেখতে চাইলো। ম্যানেজারবাবু ও চিঠি টা কেদারকে দেখল কেদার চিঠি খুলে পড়ল—
“প্রিয় শিশির,
এই ছেলে কটি বলছে আমি নাকি লিখে দিলে এদের তোমার ষোড়শী’ দেখা হয় যদি তাই হয় তবে তাই করো
ইতি — শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়”
মাত্র কয়েকটি লাইন; তবু সেই কয়েক লাইনেই কেদারনাথ এক বিশাল রহস্যের গন্ধ পেল‘তোমার ষোড়শী’ শব্দটায়।
কিছুদিনের মধ্যেই খবর পাওয়া গেল—‘ষোড়শী’ আসলে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস থেকে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তরুণ লেখক শিবরাম চক্রবর্তী;।শিশির ভদুড়ি আবার সেই লেখাকে অনেক বদল করে মঞ্চোপযোগী, সফল প্রযোজনায় পরিণত করেন এখানে বলে রাখা দরকার শিশির ভাদুড়ি শরৎ বাবুর গল্পের প্রচুর পরিবর্তন করেন যা শরৎ বাবুর মনঃপুত হয় নি কিন্তু দর্শকের কাছে নাটক মানে—শরৎচন্দ্রের নাম আর শিশিরবাবুর অভিনয়; শিবরামের নাম চাপা পড়ে যায়।
সবাই যখন এই ঘটনাটা জানতে পারলো কফি হাউসের আড্ডায় তর্ক শুরু হলো। অমল বলল, “শিবরামের অবদান ইতিহাস ভুলে গেল।” বিনয় বলল, “শরৎচন্দ্র না থাকলে নাটকই হতো না।” জগৎ বলল, “আরেবাবা শিশির ভাদুরী না থাকলে কে চিনত এদের এইভাবে কফি হাউসে কেদারনাথ ও তার বন্ধুদের মধ্যে বিশাল তর্ক বিতর্ক সকলেই উত্তেজিত। কিন্তু কেউ মীমাংসায় আসতে পারছে না
হঠাৎ কেদার সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে বলল“তোরা তর্ক কর; আমার আপত্তি নেই তোদের সব কথারই যুক্তি আছে কিন্তু আমি এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি।
সবাই একসাথে বলল পেয়ে গেছিস
হ্যাঁ পেয়ে গেছি
অমল জিজ্ঞেস করল কি করে পেলি ? কেদার বুদ্ধিদীপ্ত হেসে গোয়েন্দাদের মতো করে বলল শরৎ বাবুর চিঠিটা ভালো করে পড়েছিস লক্ষ্য করে দেখবি ওখানে একটা শব্দ-আছে তোমার ষোড়শী।” এর কিন্তু অনেক মানে হয়।
কলেজ স্ট্রিটে সন্ধ্যে নামে কফিহাউস ফাঁকা হয় বাইরে ট্রামের ঘণ্টা বাজে। কেদার প্রেসিডেন্সি হস্টেলে ফিরতে ফিরতে ভাবে তাহলে আসল নাট্যকার কে: শরৎচন্দ্র, শিবরাম নাকি শিশির কুমার ভদুড়ি? এর উত্তর অনন্তর দিকে এগিয়ে যায় কেদারনাথ বোঝে এ কাজ তার নয় আগামী দিলেন গবেষক দের কাজ ।
কেদারনাথ বহু জায়গায় তার বাড়িতে আত্মীয় মহলে এই ঘটনা অনেকবার বলেছেন।তাইএই চিঠির গল্প ছড়িয়ে পড়ে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের দিকে।
ক্রমশ
2 Comments
খুউব খুউব খুউব ভালো লাগলো লেখাটা, একটি অজানা গল্প জানতে পারলাম ,পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete