জ্বলদর্চি

আমি কেন লিখি /মলয় সরকার

আমি কেন লিখি

মলয় সরকার


আমি কেন লিখি, এ প্রশ্ন যেমন বাইরে থেকে প্রচুর আসে, নিজের বুকের ভিতর থেকেও মাঝে মাঝে ভেসে আসে একই প্রশ্ন। বাইরের ঝড়কে ঠেকাতে পারলেও, অন্তর্ঝটিকাকে সামলানো মুস্কিল হয়ে পড়ে।তাকে বাঁধ দিতে মাঝে মাঝে নিজেকেই নামতে হয় মাঠে।

এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বড় সহজ হয় না আমার কাছে। একটু ইতিহাস খুঁড়ে দেখতে গেলে স্মৃতির অতলে ডুব দিলে ভেসে আসে কয়েকটি বাল্যছবি।যার বেশির ভাগটাই হল, মাঝে একটি খাতা খোলা, আমার হাতে পেন্সিল, আর দুই ভাই, দাদা আর আমি শব্দের সমুদ্রে জাল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মিলের শব্দটা ধরব বলে।বয়স তখন ছয় কি সাত।তবে আজ বুঝি, সেই পোকা নড়ার কারণ আর কিছুই নয়, কৃত্তিবাসী রামায়ণ আর কাশীদাসী মহাভারত তখন ঠাকু’মার কাছ থেকে নিয়ে পড়া চলছে, শোনাও হচ্ছে। তারই পয়ারের পোকা ‘’ কানের ভিতর দিয়ে মরমে” প্রবেশ করে মাথায় কুটকুট করে কামড়াচ্ছে আর অসহনীয় যন্ত্রণায় কলম ধরতে বাধ্য হতে হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে এই শুরুর ব্যাপারটা বোধ হয় কবিগুরুর সঙ্গে একই ;পরবর্তীতে, যদিও তাতে বদল হয়েছে অনেকখানিই। ছেলেবেলার সেই সমস্ত সাহিত্যকীর্তি কবে যে মুদির দোকানের কাজে লেগে গেছে, তার আর হিসাব রাখা হয় নি।তবে এটা বলা যায়, তারপর কোন এক সময় ম্যালেরিয়ার মতই মনে করা হয়েছিল, রোগটা নির্মূল হয়ে গেছে, পরে দেখা গেল সত্যিই সেটা নির্মূল হয় নি। বরং ফিরে এসেছে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বেগে।এতদিন মনের গভীরে বাসা বাঁধবার অধিকার পেয়ে সে তার উপর অধিকারের থাবা বসিয়েছে। 
আর যদি এর কারণ খুঁজি, বলা যাবে না কিছুই। তবে এটা বলা যায়, লিখব বললেই লেখা যায় না, যেমন ইচ্ছা করলেই সম্ভব নয়, যে কোন গাছে ইচ্ছামত যে কোন সময়ে ফুল ফোটানো।
🍂

আবার বিপরীতটাও সত্যি, যখন মনের ভিতর থেকে তাগিদ আসে, সেটা রাত দুপুরই হোক আর রাস্তায় চলতে চলতেই হোক, কলম ধরতে হবেই। এটা ঠিক একটা রোগের মত, যেমন যন্ত্রণায় ছটফট করলে ওষুধ খেতেই হবে যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে বা পেটের খিদেয় ছটফট করলে,  কিছু খেতেই হবে সেই খিদের তৃপ্তির জন্য।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, ফুলটা ফুটবে কেমন? শিক্ষিত অভিজ্ঞ চাষীর হাতের ফুল এগজিবিশনে যাওয়ার মত হয়, আর মাঝারী চাষীর ফুল আশেপাশের পরিচিত লোককে ডেকে দেখানোর মত হয়, আর একেবারে আনকোরা বা অনভিজ্ঞ চাষীর ফুল, নিজের মনের আনন্দের খোরাক জোগাতেই সক্ষম।তা আর প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের যোগ্য হয় না। লেখা বা কবিতাও তাই।যার যেমন ক্ষমতা তার তেমন হয়।

তবে যাদের আগ্রহ অপরিসীম, তারা ফুলের চাষ সম্বন্ধে পড়াশোনা করে, ভাল চাষীর সঙ্গ করে,  অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয় হাতে কলমে। কালে হয়ত তারাই একদিন সফল আর বড় চাষী হয়ে ওঠে। এর পরেও যে কথাটা আছে, তা হল মস্তিষ্কের ক্ষমতা। সেই জায়গাটার শিক্ষা নেওয়া যায় না। ওটা যার যার নিজস্ব চেতনার অভিব্যক্তি। সেখানেই ফুলের আসল পার্থক্য ধরা পড়ে গুণীর চোখে।এইটি কিন্তু আর দেওয়াও যায় না, শেখানোও যায় না। কঠোপনিষদ বলছে, “নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন” - এই আত্মা ( বা জ্ঞান) একমাত্র ঈশ্বরের অনুগ্রহ ছাড়া লাভ হয় না। অর্থাৎ সকলের পক্ষে এই জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়া সম্ভব নয়। তখনই সেই অমোঘ কথা এসে যায়, “ সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। কিন্তু কে কবি আর কে কবি নয়, সে বিচার কে করবে! জীবনানন্দ দাশ বলতে চেয়েছেন, যে সবাই কবি হতে পারে না, বরং কিছু বিশেষ গুণাবলী ও প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিরাই প্রকৃত কবি। এই উক্তির মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে কবিতা সৃষ্টি করার জন্য নির্দিষ্ট মানসিকতা, সৃজনশীলতা এবং সংবেদনশীলতার প্রয়োজন হয়। 
এবার কথা হল, এর বিচারের ভার কার উপর! এই উক্তির বক্তা নিজেই তো সারাজীবন ধরে কবিখ্যাতি তেমন করে অর্জন করতে পারেন নি, যতটা তিনি মৃত্যুর পর পেরেছেন। তাহলে বোঝা গেল, একমাত্র মহাকালই এর প্রকৃত বিচারক।

এবারে ফিরে আসি আগের কথায়। তাহলে আমরা কি সবাই বসে থাকব,  কে সাহিত্যিক বলে গণ্য হবে আর কে হবে না সেই অপেক্ষায়? আমরা কি নামের খ্যাতির লোভে লেখার জগতে থাকব! 
আর কে কি করে জানি না। এই জায়গাটায় অন্ততঃ সততার প্রয়োজন আছে বলেই মনে হয়। নিছক নামের লোভে তো আর লেখা বা সাহিত্যকীর্তি ভাল হতে পারে না। এ যেন সেই সাধুর বেশ ধরা ভণ্ড সাধুর ভণ্ডামির মত। তাতে কি ঈশ্বর লাভ হয়! আমাদের গানে বলে, ‘মন না রাঙায়ে কি ভুল করিলি, কাপড় রাঙালি যদি’। 
আমি জানি না,  ঈশ্বর লাভ করার ক্ষমতা আমার আছে কি না, বা ঈশ্বরকে লাভ করতে পারব কি না। তবে এটা বুঝি, নিজের ভিতরের সেই ঈশ্বরকে পাওয়ার পিছনে চেষ্টায় আমার অসততা নেই। মিথ্যে নামের মোহও আমার নেই। বুঝি, সে তো সাময়িক। এই পাওয়া কি আসল বা পরম পাওয়া! 
আমি বুঝি,  ‘আত্মানং বিদ্ধি’। নিজেকে জানার চেষ্টা, নিজের কাছে নিজেকে সৎ রাখার প্রচেষ্টা আর এর সঙ্গে নিজের অন্তরাত্মার সাথে মিলনের যে প্রচেষ্টা, তার সাধনাই আমার নিজের কাছে নিজের কর্তব্য। ‘মিলন হবে কত দিনে,ও আমার মনের মানুষের সনে’। লেখা বা মনের প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে বা নিজের অন্তর ঈশ্বরকে খুঁজে চলা এই আমার সাধনা।এর জন্য ‘’ যশ প্রতিষ্ঠা শুকরীবিষ্ঠা-’ এগুলো সবই বাহ্যিক আবরণ। হলে ভাল, না হলেও কোন ক্ষতি নেই। কারণ তার জন্য আমার সাধনা নয়।
আমি না লিখলে কি পৃথিবীর কোন ক্ষতি হত, বা লিখেই কি কিছু উন্নতি হবে?কে পড়বে আমার লেখা, তাতে সাহিত্যসরস্বতীর কি কিছু নতুন আভরণ বৃদ্ধি হবে? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে ওই ‘মনে বনে আর কোণে’’ র যে সাধনা, তাই আমার শ্রেয়। অজানা বনফুলে জঙ্গলের এক শান্ত প্রান্তে নির্জনে নিজের হৃদয় দেবতার পায়ে অন্তরের অর্ঘ্য অর্পণই আমার সাধনা।

কাজেই,  আমি লিখি আমার সাধনায়, আমার হৃদয়ের তাড়নায়, মনের শান্তির খোঁজে আর অন্তর্দাহের প্রশমনের কারণ হিসাবে। এবং এটা সেই গীতার অমরবাণী অনুসরণ করেই-
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি ॥”

Post a Comment

3 Comments

  1. Kamalika BhattacharyaOctober 22, 2025

    সত্যি কথা,আমির সাথে কিছু আত্মালাপই হয়ত কবিতা হয়ে যায়।

    ReplyDelete
  2. সত্যি খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছো, কোনো লেখো? এটাও আমার প্রশ্ন। আমি যে কোনো জায়গা থেকে ঘুরে এসে ট্রাভালগ লিখো, তখন আমিও বুঝিনা কেনো লিখক।। এখ বুঝতে পারছি হয়ত আত্মপলব্ধি আমাকে দিয়ে লেখায়।

    ReplyDelete
  3. ভালো লাগল কেন লিখির উত্তর

    ReplyDelete