জ্বলদর্চি

হৃদয়ের প্রদীপ /কমলিকা ভট্টাচার্য

হৃদয়ের প্রদীপ

কমলিকা ভট্টাচার্য 


একটা প্রদীপ জ্বালিয়েছি নিজের ভিতরে—
বাইরের আলো নয়,
অন্তরের সেই আলো,
যার শিখা নেভে না শত ঝড়ে,
বেদনার জলেও যার সলতে ভিজে না।

এই মাটির দেহের ভিতরে
কোনো এক অদৃশ্য আকর্ষণে
পুঁতে রাখা ছোট্ট লোহার টুকরো
মাটির কোলে শুয়ে থেকেই
শিখে যায় টান—
হয়তো স্নেহ,
হয়তো প্রাচীন স্মৃতি,
হয়তো জন্মান্তরের পরশ।

আমি ভাবি—
এ কোন ভালোবাসা,
এ কিসের গোপন ডাক
যা শিকড়ের মত টেনে রাখে
ভাঙা পাতার কোলেও জীবন?

তেমনি—
আমার হৃদয়ের শিখা
অদেখা কোনো মাটির টানে
জ্বলে ওঠে প্রতি ক্ষণে,
তাকে ছুঁলে জ্বলে,
কিন্তু তাকে বুঝলে, উষ্ণ হয়—
নরম শিখার মত, পূর্ণিমার আলোর মত।
তাই আমার হৃদয়ের শিখা
কোনো বাহিরের তেল নয়—
অন্তরের ভক্তি,
দীর্ঘ প্রতীক্ষার ধূপসুগন্ধ,
নিঃশব্দে জমা ভালোবাসার দীপ্ত কণা
জাগিয়ে রাখে আমাকে।

আজ দীপাবলি—
জ্বলছে অসংখ্য প্রদীপ
ছাদের কার্নিশে
বারান্দার কোণে,
রাস্তাঘাটে, উঠোনে, প্রাঙ্গণে—
কিন্তু মানুষদের চোখে
এখনও লোকালয়ের ঋতু,
মনের ভিতর
এখনও সুদীর্ঘ হেমন্তর রাত।

বাইরের আলো ঝলমল করে,
কিন্তু ভিতরের অন্ধকার—
প্রশ্নের মতো বসে থাকে অন্ধ কোণে
বছরের পর বছর
খেয়ালের নির্দেশ পেলে তবেই নিভে যায়
কারণ তার জ্বালানি
ব্যথার নয়—
বোঝাপড়ার স্পর্শ।

ভালোবাসা আসলে আগুন নয়—
সে আগুনে পোড়ায় না,
সে আগুন থেকে আলো তুলে
আত্মার ভেতর বসায় জ্যোৎস্নার মত ব্যথাহীন জ্যোতি।
সে শেখায়—
যা দেখা যায়, তা আলো নয়;
যা অনুভূত হয়, সেটাই উদ্ভাস।

মানুষ যত প্রদীপ জ্বালায় বাইরে
তারচেয়েও গভীরে
অদেখা কোনো প্রদীপ অপেক্ষা করে—
কারো একটুখানি উষ্ণ আদরে
জ্বলে উঠবার জন্য।

লোকালয়ে আজ দীপাবলি—
 দীপের সারি জ্বলছে ছাদে ছাদে,
রঙিন আলোয় ভেসে যাচ্ছে পাড়ার সব বাড়ি,
দরজার সামনে আঁকা রঙ্গোলি,
হাতে শিখা হাতে আতসবাজি—
কিন্তু মনের গলিতে?
কই আলো?
কোথায় দীপ?

মানুষ আগলে রাখে বাইরের ঝলক,
কিন্তু ভেতরের অন্ধকারে বসে থাকে
দীর্ঘদিনের
অভিমানের ধূপ,
বেলায় বেলায় নিভে যাওয়া স্বপ্নের ফুলঝুরি
আর জমে থাকা কথার কালি
ঢেকে রাখে সমস্ত প্রসন্নতা।

বাইরের প্রদীপেরা দেখে না
ভেতরের রাতকে—
শুধু হৃদয়ের প্রদীপই জানে
কোথায় আগুনের ভাষা
আর কোথায় আলো হওয়ার ব্যাকুলতা।

ভালোবাসা তো মানুষের শরীর ছুঁয়ে নয়—
তার ভিতরের অন্ধকার ছুঁতে শেখায়।
তার চোখের ভিতরকার জোছনাকে
স্বচ্ছ করে তোলে।

যে আলো বাইরে ঝলমল করে
সে তো আলোর প্রমাণ,
কিন্তু যে আলো ভিতরে জ্বলে—
সে নিজের অস্তিত্বের কারণ।

আজ দীপাবলির রাতে
আমি আগুন চাইনি—
আমি আলো চেয়েছি।
আমি আতসবাজি চাইনি—
আমি নিজের ভিতরের নীরব আকাশে
শ্বাস নিতে দেওয়া একটুখানি জ্যোতি চেয়েছি।

ভালোবাসা—
সে ঝলসায় না, সে দাহ হয় না,
সে দীপ্তি দেয়,
সে দিশা দেখায়
অন্ধ পথিকের কোলেও।

যা দেখা যায় — তা কেবল মুখোশের দীপ্তি,
কিন্তু যা অনুভবে জ্বলে
সে আত্মার গোপন দীপাবলি।
ভালোবাসা বাইরে জ্বলে ওঠা শিখা নয়—
সে শিখা হল এক নিঃশ্বাসের দীর্ঘস্থায়ী নীরবতা,
যেখানে তুমি শব্দহীন হয়ে থেকেও
কারও ভিতরে বাজাও উজ্জ্বল উপস্থিতি।

মানুষ বাইরে আলো খোঁজে—
কারণ বাইরে দেখা যায়;
কিন্তু যে আলো ভিতরে জন্মায়,
সে আলো কেউ দেখে না,
কেবল প্রাপ্ত মানুষ অনুভব করে।

ভালোবাসা সেখানে—
যেখানে নিঃশব্দ বোঝাপড়া
কথার থেকে বেশি উচ্চারণ হয়ে ওঠে,
যেখানে কারও চোখের ক্লান্ত রাত
কাউকে দেখে শান্তির প্রভাত পায়।

এ আলো আকাশে মেলে না,
সে আলো বুকের গোপন প্রদীপঘরে,
যেখানে অভিমানও এসে বসে আশ্রয় খুঁজতে—
যেখানে অন্ধকারও
কারও হাত ধরে
উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

তাই আজ দীপাবলিতে
আমি প্রদীপ জ্বালাইনি শুধু—
একটি উপস্থিতি, একটি প্রতিশ্রুতি
একটি নীরব রাত্রিভর ভালোবাসা
জ্বেলে রেখেছি ভিতরে।

তাই আজ
যত ঘর জুড়ে আলো জ্বলুক,
আমার কামনা—
একটি প্রদীপ অন্তত জ্বলে উঠুক
মানুষের মনেও।

কারণ—
বাহিরের দীপ তো উৎসব,
কিন্তু
হৃদয়ের দীপ—
সে মুক্তি।
সে প্রার্থনা।
সে চিরদিনের ভোর।

🍂

Post a Comment

2 Comments

  1. Replies
    1. পাতা ভরা ধন্যবাদ

      Delete