অয়ন মুখোপাধ্যায়
গঙ্গার বাঁকে তিন ছায়া
আগমন
বিকেলের ট্রেনে নেমে যখন অমৃত তার পুরনো শহর কালনার ঘাটে এসে দাঁড়াল, আকাশে তখন সোনালি আলো। গঙ্গার বাঁকটা যেন হঠাৎ খিলখিল করে হাসছে। কোথাও ভিড় নেই, অথচ নদীর হাওয়ায় মিশে আছে এক অদ্ভুত গন্ধ—কখনো ধূপের ধোঁয়া, কখনো নোনাজল, কখনো মাটির কাঁচা গল্প।
অমৃতের বুক কেঁপে উঠল। মনে পড়ে গেল কত বছর আগে সে এইখানে ঘুরে বেড়াতো তনিমার সঙ্গে। তখন কলেজ ছুটি, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেড়াবার অজুহাত, অথচ আসল উদ্দেশ্য ছিল অন্য—তনিমাকে নিয়ে সকলের আড়ালে একদিন সময় কাটানো।
তনিমার গলা আজও অমৃতের কানে বাজে—
“অমৃত, জানো তো, গঙ্গার বাঁক মানেই জীবনের বাঁক। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সবকিছু পাল্টে যেতে পারে।”
আজ সত্যিই সব পাল্টে গেছে। তনিমা আর নেই অমৃতের জীবনে, আছে শুধু তনিমার স্মৃতি।
সাত নদীর জল
সেনবাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ল পুরনো দালান। দেওয়ালে শ্যাওলা, বারান্দায় ভাঙা পিলার, তবু কোথাও এক রাজকীয় গাম্ভীর্য। ভেতরে ভিড় জমেছে। ঢাক বাজছে, ধুনুচির ধোঁয়া উঠছে, অথচ পূজার আসল রহস্য লুকিয়ে আছে স্নানে।অমৃতের এসব জানা এই বাড়ি এই উঠোন ওর ভীষন পরিচিত।আর এই বাড়ি এই শহরের মানুষেরজনের কাছে ও অমৃত খুব পরিচিত কারন এই শহরের স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে পাস করে আজ প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার।
বৃদ্ধ সুবল সেন অমৃত কে দেখতে পেয়েই হাত ধরে অমৃতকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কপালে চন্দন, মুখে শান্ত হাসি।
🍂
সুবল সেন:বললেন“এসো বাবা, পূজার মূল রীতি দেখবে? সাত নদীর জল ছাড়া আমাদের দেবী স্নান করেন না।”
অমৃত: সাত নদীর জল! আজও?”
সুবল সেন (মৃদু হেসে):
“হ্যাঁ, পদ্মা থেকে দামোদর, ভাগীরথী থেকে অজয়—যতটুকু পারা যায়, জোগাড় করি। সমুদ্রের জলও আসে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বণিক, জাহাজ করে গেছেন দুর দূরান্তে বিভিন্ন দেশে। তখন দেবীর কাছে প্রার্থনা করতেন—আমাদের রক্ষা করো। সেই থেকেই এই রীতি।”
অমৃতের মনে পড়ল সেই প্রথমবার। তনিমার হাত ধরে সে এই উঠোনেই দাঁড়িয়েছিল। তনিমা হেসে বলেছিল—
“অমৃত, দেখো, ঠাকুর কে সাত নদীর জল দিয়ে স্নান করানো হচ্ছে। অথচ আমাদের সম্পর্কটা যদি একটা নদীর মতো শুকিয়ে যায়?”
তখন অমৃত হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। আজ, এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হলো—তনিমার সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। জাহাজ নেই, সমুদ্র আর ডাকে না, শুধু জল আছে। সম্পর্কও তাই—প্রবাহ হারিয়ে গেলে কেবল স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকে।
তিন পুতুলের সরলতা
পরদিন সকালে অমৃত গেল ভট্টাচার্যদের বাড়ি। মাটির উঠোন, চারদিকে টিনের চাল, আর মাঝখানে তিনটে পুতুল সাজানো। না আছে চকমকি সাজ, না সোনার গয়না। কিন্তু তাদের চোখে যেন এক অদ্ভুত দীপ্তি।
প্রবাল ভট্টাচার্য, ওই পরিবারের ছেলে, এগিয়ে এল। প্রবালের সাথে আলাপ অনেক আগেই ছিল অমৃতের। কথা বলতে কোনো অসুবিধে হলো না।
প্রবাল:অমৃতদা, আমাদের পূজায় প্রতিমা নেই, আছে এই তিন পুতুল। কারণ, আমাদের পূর্বপুরুষদের ধণ দৌলত ছিল না। তারা শুধু বিদ্যা বুদ্ধি নিয়ে নবদ্বীপ থেকে এখানে এসেছিলেন। তাই দেবীকেও দেখলেন সরল রূপে।”
অমৃত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
অমৃত:“তবু মনে হচ্ছে এই সরলতার মধ্যেই আসল শক্তি লুকিয়ে আছে।”
প্রবাল (চোখ নামিয়ে):
“ঠিক তাই। শক্তি সবসময় রাজাদের আঙিনায় নামে না। কখনো দরিদ্রের উঠোনে ও নেমে আসেন তিনি।”
অমৃতের বুক কেঁপে উঠল। যেন দেবী সরাসরি তনিমার নাম উচ্চারণ করলেন। তনিমাও তো চেয়েছিল সরল এক সংসার—কোনো আড়ম্বর নয়, শুধু ভক্তি আর প্রেম। আজ সেই সংসার নেই, আছে কেবল তিনটি পুতুলের মতো শূন্যতা।
ইতিহাসের প্রতিধ্বনি
সন্ধ্যায় গৌরাঙ্গ মাস্টারমশায়ের সঙ্গে অমৃত বসেছিল নদীর ঘাটে। আকাশে তখন চাঁদ উঠেছে, গঙ্গার জল টলমল করছে।
গৌরাঙ্গ:“তুই জানিস অমৃত, এই পূজার আড়ালে রাজনীতিও আছে। বর্ধমান রাজারা নবাবের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে তারা নিরপেক্ষ থেকেছিল। যদি তখন তারা অন্যরকম ভূমিকা নিত, তবে হয়তো বর্ধমান রাজ পরিবারই বাংলার প্রধান শক্তি হয়ে উঠত। আর কালনা হয়ে উঠত বাংলার বার্মিংহাম।
অমৃত (চুপচাপ):থেকে বলল“হয়তো। কিছুক্ষন পর বলল কিন্তু মাস্টারমশাই কামানের আওয়াজেই কিন্তু ইতিহাস লেখা হয়।”
অমৃত হঠাৎ মনে করল, তার আর তনিমার সম্পর্কও তো একদিন এমনই ভেঙে গিয়েছিল। কোনো এক অদৃশ্য কামানের গর্জনে—শব্দ হয়নি, ধোঁয়া ওঠেনি, কিন্তু ফাটল ধরেছিল গভীরে মনের অনেক ভিতরে। তারপর থেকেই ইতিহাস পাল্টে গেছে।
শেষ রাত্রি
শেষ রাত। সেনবাড়ির আলো নিভে এসেছে, ধুনুচির ধোঁয়া মিলিয়ে গেছে। তিন পুতুল নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে ঠাকুর দালানে। গঙ্গার বাঁকে বাতাস বয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, যেন কোনো অজানা সুর বাজাচ্ছে।
অমৃত একা দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল—তনিমা, তুমি আজ কোথায় আছ? এই শহরের প্রতিটি পূজা যেন তোমার ছায়া হয়ে আমাকে ঘিরে রাখছে।”
ঠিক তখনই গঙ্গার জলে চাঁদের আলো হঠাৎ ঝিকমিক করে ভেঙে গেল। মনে হলো, সাত নদীর জল একসাথে ঢেউ তুলছে। অমৃত তাকিয়ে দেখল—জলের উপর একটা নৌকা ভেসে উঠছে। পুরনো কাঠের জাহাজ, কালো পাল টানটান। কিন্তু আশ্চর্য—নৌকায় কোনো মানুষ নেই, কেবল দেবীর লাল আঁচল হাওয়ায় উড়ছে।
অমৃতের বুক কেঁপে উঠল। সে দৌড়ে ঘাটে গেল। হঠাৎ মনে হলো, কেউ যেন তার হাত ধরে টানছে।সে তাকাল—তনিমা! সাদা শাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে হালকা হাসি।
তনিমা:অমৃত, দেখো, মিআমাদের ডাকছেন।”
অমৃত চোখ মুছে আবার তাকাল। কেউ নেই। শুধু বাতাসে ধূপের গন্ধ, আর নদীর জল ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে।
সে আবার মণ্ডপে ফিরল। তিনটি পুতুল অদ্ভুতভাবে জ্বলজ্বল করছে। যেন মাটির চোখের ভেতরে জীবন্ত আগুন। অমৃত তাকিয়ে থাকতেই পুতুলগুলো ফিসফিস করে বলল—
“স্মৃতিই আসল পূজা। প্রেম ভালবাসাই আসল দেবতা।
অমৃত ভয়ে নয়, বিস্ময়ে কেঁপে উঠল। তার মনে হলো, ঠাকুর যেন তাকে আশীর্বাদ করলেন—তার হারানো প্রেমকে, তার অতীতের প্রশ্নকে।
গঙ্গার হাওয়ায় ঢাকের শব্দ ভেসে উঠল, অথচ কোথাও কোনো ঢাক নেই ঢাকি নেই ।
অমৃত বুঝল—কালনা শুধু শহর নয়, এক অলীক উপস্থিতি।
যেখানে ইতিহাস, পূজা আর প্রেম মিশে গেছে বার বার ভেঙে গেছে সত্যি-অসত্যির সীমারেখা
2 Comments
ভীষন ভালো লাগলো,,পূজা , প্রেম ,, স্মৃতি ইতিহাস এভাবে মিলেমিশে একাকার ,এরকম লেখা কখনো পড়িনি ,,একরাশ ভালোলাগা 👌
ReplyDeleteপড়লাম -খুব ভালো লাগলো-এমনি ইতিহাসকে ভিত্তি করে প্রেম,পূজাকে এক করে লেখা -আগে পড়িনি। জানিনা আমি ঠিক কি না-তবে একটা খিদে রইল পরের আশায়।ভালো বেশ ভালো।
ReplyDelete