মধুবাবুর ডায়েরি
কমলিকা ভট্টাচার্য
সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ছেলের ফোন এলো। সে তার নতুন ইনভেনশনের কথা জানাল। ছেলে ফোন রাখতেই মধুবাবু গর্বের সঙ্গে বললেন, “এই না হলে আমার ছেলে!”
কল্যাণীদেবী শুধু একবার মধুবাবুর দিকে তাকিয়ে হাসলেন আর বললেন, “সেই তো তোমারই ছেলে। ছেলে আবিষ্কার করলে কিংবা তোমার মনের মতো কথা বললে ,আর ‘আমার ছেলে’—যখন তোমার মনের মত কিছু হয়না, সব দোষ তখন আমার ,আমার শিক্ষাই খারাপ!”
মধুবাবু বললেন, “দেখো, আমার অঙ্কের মাথাটা ও পেয়েছে, তুমি যাই বলো।”
কল্যাণীদেবী বললেন, “অথচ কোনোদিন তো ছেলেকে অঙ্ক পড়িয়েছো বলে মনে পড়ে না।”
এরপর কল্যাণীদেবী বললেন, “ছেলে আসছে নেক্সট উইক—খেয়াল আছে তো? আগেই বলেছি উপরের ঘরটা খালি করে রাখতে। সারাদিন ওর অফিস চলবে, তোমার সারাদিন ধরে গলা বাজি চলবে না। যাও, গিয়ে ঘরটা খালি করো। দুনিয়ার বই জড়ো করে রেখেছ। এতদিন বলে এসেছো ছেলে ওই সব অঙ্কের বই পড়বে—ছেলে তো পড়লই না, নাতিও না। এবার কি পুতির জন্য জড়ো করছ? নিজে খালি করো, না হলে আমি কিছু দেখব না—সোজা বিক্রি করে দেব।”
অগত্যা মধুবাবু উপরে গেলেন। মুখে গামছা বেঁধে বই নামাতে শুরু করলেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ধুলোর পরত পড়ে গেছে। যত পুরোনো বই নামাতে লাগলেন, চোখের ওপর ভেসে উঠতে লাগল এক-একটা স্মৃতি—কখনও স্কুলের অঙ্ক স্যারের, কখনও বা কোনো বন্ধুর, যারা আজ কোথাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু বইয়ের ওপর হাত বুলিয়ে সেই স্মৃতিটুকু মনে করে এক অদ্ভুত তৃপ্তি পেলেন।
কিছুক্ষণ পর কল্যাণীদেবী রান্নাঘরের কাজ সেরে উপরে এলেন। বললেন, “আমি কাবাড়িওয়ালা ছেলেটিকে ফোন করে দিয়েছি। বলেছি ঘণ্টাখানেক পরে আসতে। কিন্তু তুমি তো সব ছড়িয়ে বসে আছ! এতক্ষণ ধরে অঙ্ক কষছিলে নাকি?”
মধুবাবু অত্যন্ত ভাবুক হয়ে বললেন, “তা বলতে পারো। স্মৃতিতে পাওয়া-না-পাওয়ার অঙ্ক মেলাবার চেষ্টা করছিলাম।”
🍂
কল্যাণীদেবী বললেন, “অনেক হয়েছে। আমাকে যে বইগুলো রাখবে সেগুলো বেছে দাও—আমি ডিভানে ভরছি। আর যেগুলো ফেলবে সেগুলো ওই কার্টুনে ভরো। তাড়াতাড়ি করো।”
কিন্তু একটু বই মধুবাবু হাতে নেন আর ভাবুক হয়ে পড়েন। মনে পড়ে যায়—বাড়িতে পড়ার জায়গা ছিল না। তাই দূরে একজনের বাড়ির বাইরে দোকানঘর লাগোয়া গোয়ালঘরে বসে পড়তেন। বাড়ির মালিকের তাতে সুবিধা ছিল—রাতে দোকানঘরের বিনা পয়সায় পাহারা হয়ে যেত। কিন্তু ঐ বাড়ির মাসিমা রোজ শুতে যাওয়ার আগে মাথায় হাত বুলিয়ে এক কাপ চা রেখে যেতেন।
কল্যাণীদেবী মধুবাবুর হাত থেকে বইটি নিয়ে ডিভানে রাখলেন।
প্রতিটি বইয়ের পিছনে এক-একটা গল্প। প্রতিটি বই সুন্দর করে খবরের কাগজের মলাট করা। কল্যাণীদেবীও অবাক হয়ে দেখছিলেন—বইগুলোর কভার এতটুকুও নষ্ট হয়নি। টপোলজির বইটি হাতে নিয়ে মধুবাবু বললেন, “এমএসসিতে এই সাবজেক্টে সবচেয়ে বেশি পেয়েছিলাম। এই বইটা ফেলো না।”
কল্যাণীদেবী আগে থেকেই জানতেন—কোনো বই শেষমেশ আর ফেলা হবে না। তিনি বললেন, “বই না ফেলো, নোটবুকগুলো তো ফেলে দাও। পাতাগুলো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে।”
মধুবাবু খাতার বান্ডিল হাতে তুলে নিলেন। বললেন, “দেখো কল্যাণী, কত সুন্দর হ্যান্ডরাইটিং—একদম সোজা লেখা। পাতার পর পাতা অঙ্ক করতাম। প্রতিটি খাতার ভেতর খুলে দেখো, একটা-একটা কোট লেখা আছে—কোনো না কোনো ম্যাথমেটিসিয়ানের বা কোনো বড় ব্যক্তির।”
তারপর একদম নষ্ট হয়ে যাওয়া একটি খাতা তুলে মধুবাবু বললেন, “এর পাতাটা দেখো—পয়সা ছিল না। দিদির বিয়ের খাবার টেবিলের ওপর বিছানোর বেঁচে যাওয়া রোল কাগজ দিয়ে বানানো। তাতেও অঙ্ক করতাম।”
কল্যাণীদেবী বিরক্ত হয়ে বললেন, “কি করব বলো—রাখব না ফেলব?”
মধুবাবু উঠে জানলার কাছে দাঁড়ালেন। হাতে একটা ডায়েরি। কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে বললেন, “আমি মরে গেলে না হয় ফেলে দিও, কল্যাণী। ততদিন রেখে দাও সব।”
কল্যাণীদেবী দেখলেন মধুবাবু একটু বেশিই ভাবুক হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে বললেন, “এত জিনিস দেখালে কিন্তু ডায়েরিটা যে লুকিয়ে নিলে—ওটা দেখি। ওটার মধ্যে কি প্রেমপত্র রাখা আছে?”
মধুবাবু ডায়েরিটি খুলে ভেতর থেকে বের করলেন একটি শুকনো পাতা—ঠিক প্রজাপতির মতো। বললেন, “আমি যখন অঙ্ক করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম, তখন এই গাছের সবুজ পাতার দিকে তাকিয়ে মনে হতো গাছটায় যেন রংবেরঙের প্রজাপতি ভরা। মন খুশিতে ভরে যেত, আবার অঙ্ক কষা শুরু করতাম। তাই গ্রাম ছেড়ে আসার সময় এই পাতাটা ওই গাছের স্মৃতিতে রেখেছিলাম। আজ প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেল।”
তারপর সেই ডায়েরির ভেতর থেকে বের করলেন ভারতবর্ষের কিছু বড় ইনস্টিটিউট ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রমাণপত্র—যেখানে এডমিশন ফি-এর অভাবে পড়া হয়নি।
কল্যাণীদেবী জানতেন মধুবাবুর সেই সব কষ্টের কথা—কিভাবে আত্মীয়রা বাড়িতে কুকুর পোষার বিলাসিতা করেছে, কিন্তু পড়ার জন্য সাহায্য করেনি, উল্টো অপমান করেছে।
মধুবাবু ভারী গলায় বললেন, “তুমি বলছিলে না—কোনো প্রেমপত্র আছে? এই ডায়েরিটাতে আমি নিজের যোগ্যতায় যা পেয়েছি, কিন্তু ভাগ্য না থাকায় হারিয়েছি—সেই সবই রাখা।”
কল্যাণীদেবী বললেন, “আর ওই খামের ভেতর একটা ছবি মনে হচ্ছে। দেখি ওটা কার? কাকে পেয়েও আর পাওয়া হয়নি?”
মধুবাবু হেসে নিজের কিছু ছোটবেলার ছবি বের করে বললেন, “দেখো, কত সুন্দর দেখতে ছিলাম! এই রূপও তো আর ফিরে পাওয়ার নয়—তাই রাখা।”
কল্যাণীদেবী বললেন, “না না, আরেকটা ছবি আছে মনে হচ্ছে। দেখাও দেখি—নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের।” বলে খামটা মধুবাবুর হাত থেকে কেড়ে নিলেন।
কাড়াকাড়িতে খাম থেকে ছবিটা পড়ে গেল। কল্যাণীদেবী দেখলেন—হলুদ শাড়ি পরা ছবিটি তারই, যেটি সম্বন্ধের জন্য মধুবাবুর বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল।
ছবিটি কুড়িয়ে নিয়ে কল্যাণীদেবী বললেন, “এই ছবিটা তোমার কাছে ছিল? কিন্তু যখন আমাদের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল, তোমরা বলেছিলে বাকি জিনিসের সঙ্গে ফেরত দিয়েছিলে—কিন্তু আমরা পাইনি। তুমিও তো কোনোদিন বলোনি। এই ছবিটা কত খুঁজেছি!”
মধুবাবু বললেন, “যখন তোমাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছিলাম, তখন আমার না-পাওয়ার স্মৃতি ডায়েরিতে রেখেছিলাম।”
কল্যাণীদেবী এবার হেসে বললেন, “কিন্তু আমাকে তো তুমি পেয়েছ—তবে কেন?”
মধুবাবু কল্যাণীদেবীর হাত দুটো ধরে বললেন, “রেখেছিলাম, কারণ সেদিন জিনিস সব ফেরত পেয়ে তুমি নিশ্চয়ই ভেবেছিলে আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিল। কিন্তু সেদিন অন্য সব জিনিস ফেরত দিলেও আমার ভালোবাসা ফেরত দিইনি।”
“সেদিন ফেরত দিইনি বলেই আজ অঙ্কপ্রেমী মধুবাবুর জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটি উদ্ধার করে তোমার মুখের খুশির হাসিটা দেখতে পেলাম—যে হাসিতে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের পঁয়ত্রিশ কোটি বার জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের সরল সমাধান উইথ প্রুফ প্রমাণিত হয়ে গেল, একদম পাক্কা ম্যাথমেটিশিয়ানের মতো।”
কল্যাণীদেবী এবার ডায়েরির কোণে লেগে থাকা একটি টিপ দেখিয়ে বললেন, “এই ডেসিমাল চিহ্নটি কার, শুনি?”
মধুবাবু হাতজোড় করে বললেন, “তোমার সন্দেহ—প্রুফস থিওরি অফ ইনফিনিটি।”
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
6 Comments
পরিণত মনস্ক প্রেমের গল্প। খুব সুন্দর!!
ReplyDeleteThank you
Deleteভারি মনকাড়া উপস্থাপনা!
ReplyDeleteThank you
Deleteস্মৃতির দোলা
ReplyDeleteThank you
Delete