জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান / অনিন্দ্যসুন্দর পাল

ধারাবাহিক-প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

একাদশ পর্ব
.
"ঐতিহাসিক উৎস, প্রকারভেদ ও ধারণা- ৮"

দেশীয় লেখকদের বিবরণী নিয়ে আলোচনা করার পর যে আলোচনাটা আসে সেটা বৈদেশিক সাহিত্যের কথা। যেখানে বিদেশী পর্যটক ও বিদেশী পরিব্রাজক উভয়দেরই ভারতবর্ষ পরিভ্রমনকালের পরবর্তী ধারণা ও তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়, যার সূত্র ধরেই তৈরি হয় বা হয়েছে বৈদেশিক সাহিত্য। তাই ঐতিহাসিক পর্যালোচকরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার্যের পর ঠিক করছিলেন এই বৈদেশিক সাহিত্যকে দুই ভাগে বিন্যস্ত করবেন- যেমন
১. যেসব বিদেশীদের দ্বারা বিবৃত ভারতবর্ষ সম্বন্ধীয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ধারাবিবরণী এবং
২. ভারতবর্ষে পরিভ্রমনে না এসে অপরের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে রচিত বিবরণী

প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভালো এই দুই শ্রেণীর অন্তর্বর্তী দুই বা শেষ শ্রেণীর রচয়িতাদের মধ্যে "হেরোডেটাস" বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদিও ভারত সম্পর্কে হেরোডেটাসের সম্পূর্ণ উল্লেখিত তথ্যাদি কিন্তু গ্রহণযোগ্য নয়। তবে একথা অনস্বীকার্য সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি ভারত সম্পর্কে যে বিশেষ একটি তথ্য দিয়ে গেছেন,তা সর্বোত্তমভাবে গ্রহনযোগ্য, তিনি উল্লেখ করেছেন-
"পৃথিবীর সমস্ত দেশের মধ্যে ভারতবর্ষ সর্বাপেক্ষা জনবহুল"
ঠিক একই ধরনের একটি মন্তব্য আরএকজন গ্রীক লেখক "টিসিয়াসের (৪১৬-৩৯৮ খ্রিঃপূঃ)" বিবরণীতে পাওয়া যায়। যা থেকেই আমাদের স্পষ্ট ধারণা করতে অসুবিধা হয় না, কেন আদিকাল থেকে ভারতবর্ষ পরিব্রাজকদের অন্যতম আকর্ষণের অভিকেন্দ্র ছিল।

    যাইহোক,  এত গেল সূচনার কথা। তবে এই মুহূর্তে বৈদেশিক বিবরণ নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনায় আসার পূর্বে বৈদেশিক বিবরণী সম্পর্কে একটি সহজাত ধারণা রাখা অত্যন্ত আবশ্যক, যেমন, কয় প্রকার, কি কি প্রভৃতি। তাই, এই ধরনের ধারণামূলক অথবা প্রকরণমূলক বিষয়গুলো নিয়ে একটু আলোকপাত করার চেষ্টা রাখি। 
প্রসঙ্গত, আমরা জানি প্রাচীনকালে বিভিন্ন সময় ধর্ম, বাণিজ্য, ভ্রমণ, রাজ্যজয় প্রভৃতি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পর্যটক ভারতে এসেছিলেন এবং তাঁরা অনেকেই তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখে গিয়েছেন যা আজকের দিনে ইতিহাস রচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর মধ্যে গ্রিক, রোমান, চৈনিক, তিব্বতীয়, আরবি প্রমুখ পর্যটকদের বিবরণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।  যেমন-

এক, গ্রিক বিবরণ— আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পূর্ববর্তী গ্রীক লেখকদের মধ্যে দুটি নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। একটি "হেরোডোটাস" ও অপরটি "টেসিয়াস" । হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয়। তিনি কখনো ভারতে না এলেও তাঁর রচিত গ্রন্থ 'Persae' বা ইতিহাসমালা থেকে আমরা পারসিকগণ কর্তৃক উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণ ও অধিকারের কথা জানতে পারি। টেসিয়াসের ইন্ডিকা নামক গ্রন্থও সমকালীন ভারতের নানা তথ্যে সমৃদ্ধ। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায় তার তিন অভিযান-সঙ্গী নিয়াকাস, এরিস্টোবুলাস এবং ওনেসিক্রিটাসের রচনায়। সিসিলির ডায়োডোরাস রচিত বিবলিওথেকা হিস্টোরিকা, এরিয়ানের আনাবাসিস, জাস্টিনের এপিটোম, প্লুটার্ক-এর আলেকজান্ডারের জীবনী প্রভৃতি গ্রন্থে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায়। গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে ভারতে এসেছিলেন । তাঁর লেখা ইন্ডিকা গ্রন্থটি সমকালীন ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। পলিবায়াসের সাধারন ইতিহাস থেকে ভারতের বাহ্লিক গ্রিক আক্রমণের কথা জানা যায়। এ ছাড়া, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে জনৈক গ্রিক নাবিকের লেখা 'পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সী' বা ভারত মহাসাগরে ভ্রমণ, এবং টলেমির ভূগোল থেকে তৎকালীন ভারতের ব্যবসাবাণিজ্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। 

দুই, রোমান বিবরণ—  রোমান লেখক কুইন্টাস কার্টিয়াসের রচনায় আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায় । প্লিনির প্রাকৃতিক ইতিহাস থেকে সমকালীন সমুদ্রপথ এবং ভারতের সঙ্গে রোম ও গ্রিসের ব্যবসাবাণিজ্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।  

তিন, চৈনিক ও তিব্বতীয় বিবরণ— প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের প্রথম দিকের জন্য গ্রীক গ্রন্থসমূহের মত, চীনের ইতিবৃত্ত শেষের দিকের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ। চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে ভারতে এসে এদেশে দীর্ঘদিন, প্রায় ১৫ বৎসর অতিবাহিত করেন। তাঁর রচিত ফো-কুয়ো-কি একটি মূল্যবান গ্রন্থ। হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনের আমলে ভারতে এসেছিলেন এবং তাঁর রচিত সি-ইউ-কি নামক গ্রন্থে তাঁর ভারত ভ্রমণের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এ ছাড়া, ইৎ সিং-এর ভারতে বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত বিবরণী এবং ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তিব্বতীয় ইতিহাসবিদ লামা তারকনাথের ভারতে বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি গ্রন্থটি মূল্যবান ঐতিহাসিক উপাদান। 

চার, আরবীয় বিবরণ— অনেক আরব পর্যটক ভারতে এসেছেন ও তাদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁদের লেখা বিবরণী থেকে ভারতে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিবরণ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে সুলেমান, আল মাসুদি, আল বিলাদুরি, হাসান নিজামি, আল-বেরুনি প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুলেমান নবম শতকে পাল রাজ দেবপালের রাজত্বের শেষদিকে আসেন ও ৮৫১ সালে একটি ভারত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। আল মাসুদি ৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মহীপালের রাজত্বকালে প্রতিহার রাজ্যে আসেন। আরবীয় পর্যটকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন পণ্ডিত আল-বিরুনী। তিনি ১০২৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদের সঙ্গে ভারতে আসেন। ১০৩০ সালে প্রকাশিত তাঁর তহকিক-ই-হিন্দ গ্রন্থে তৎকালীন ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুদের ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার কথা বিশদ ভাবে জানা যায়। 

      এতকিছুর পরও এটা জানিয়ে রাখা ভালো, দেশীয় সাহিত্যের মতো বৈদেশিক বিবরণীরও সীমাবদ্ধতা থেকে গেছে, যথা- ভারতের সঙ্গে সংযোগের অভাব অর্থাৎ বিদেশি পর্যটকরা ভারতে খুব বেশিকাল কাটাননি বা তাঁরা ভারতের ভাষা, রীতিনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তাই তাঁদের রচনার ভিত্তি দুর্বল। দুই, জনশ্রুতি, খুব স্পষ্টভাবে বললে দাঁড়ায়- অনেক সময় বিদেশি পর্যটকরা লোকমুখে শোনা কথা বা কিংবদন্তির ওপর ভিত্তি করে তাঁদের বিবরণ রচনা করায় গল্পকাহিনীতে পরিণত হয়েছে আর সর্বশেষ যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পক্ষপাতিত্ব, যা নিরপেক্ষতা ছেড়ে বিদেশি পর্যটকরা অনেক সময় নির্দিষ্ট শাসকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন।
(ক্রমশ....)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments