জ্বলদর্চি

বিশেষ 'ছোটোবেলা' একাদশ সংখ্যা

 আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত কবি লুৎফর রহমান রিটন ও ব্রত রায়। এছাড়াও আমন্ত্রিত লেখক হিসাবে আছেন
মধুরিমা চক্রবর্তী, মুক্তি দাশ ও গৌতম বাড়ই। গৌতম বাড়ই শুরু করেছেন বিশেষ করে ছোটোদের জন্য ধারাবাহিক। স্বনামধন্য ফোটোগ্রাফার সন্তোষ জানা আমাদের উপহার দিয়েছেন এক গ্রাম বাংলার চিত্র। গ্রামেও লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির চিহ্ন । 

হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে(৯৭৩২৫৩৪৪৮৪) অপ্রকাশিত লেখা ও চিত্র পেতে চাই আরও আরও। গল্পকার মৌসুমী ঘোষ এই বিভাগটির অধিকাংশ দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। আমরা কৃতজ্ঞ। তাঁর কাছেও লেখা ও ছবি পাঠাতে পারেন।


 তিতলির বন্ধুরা

স্নেহাদৃতা রায়
(চতুর্থ শ্রেণি, সিউড়ী উপাসনা পাঠভবন, বীরভূম)


তিতলির মনে আজ ভারি আনন্দ। কারণ আজ তার জন্মদিন। ঠাম্মি, দাদু, ভাই ,দিদি, তিতলির বাবা, মা আজ সকালে মন্দিরে পুজো দিতে গেছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে তিতলি তার ভাইয়ের সাথে খেলা করছে। বিকেলবেলা কেক কাটবে।

কিন্তু বিকেল বেলা থেকে শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি। তার ফলে তার কোনো বন্ধু তার বাড়িতে আসতে পারছে না। মন খারাপ করে ছাতা নিয়ে তিতলি ছাদে চলে গেল। ছাদের শেডে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ মনে দেখতে লাগলো বৃষ্টি।
  
তিতলি হঠাৎ দেখলো দুটো সাদা পরী আকাশ থেকে হাসতে হাসতে নেমে আসছে। একজন পরী ছাদে নেমে তিতলির সামনে এসে  বললো, 'তোমার মন খারাপ কেন?" তিতলি উত্তর দিলো, "আজ আমার জন্মদিন। তাই আমার বাড়িতে আজকে অনেক বন্ধু আসতো। আমি কেক কাটতাম। কিন্তু এই ঝড় বৃষ্টিতে কোনো বন্ধুই আসতে পারেনি। কোনো আনন্দই করতে পারছি না। তাই আমার মন খুব  খারাপ।" অন্য পরী বললো, "তাই? ঠিক আছে। তুমি চিন্তা কোরোনা। আমরা এক্ষুনি বৃষ্টি কমিয়ে দিচ্ছি।" তিতলি আনন্দে লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করলো, " তোমরা ম্যাজিক জানো?" পরীরা একসাথে উত্তর দিলো, "হ্যাঁ, আমরা ম্যাজিক জানি।" তারপর দুই পরী জাদু দন্ড আকাশের দিকে নিয়ে যাওয়া মাত্রই বৃষ্টি গেল কমে। তিতলি তো দারুণ খুশি। বললো, "তোমরা খুব ভালো। আজ থেকে তোমরা আমার বন্ধু।"
"ঠিক আছে। এবার আমরা আসি। তুমি যদি তিনবার 'পরী' বলে ডাকো তাহলেই আমরা চলে আসব," পরীরা উত্তর দিলো।
তিতলি বলল, "আচ্ছা। তাহলে এবার আমি নিচে যাই। বৃষ্টি কমে গেছে। আমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই চলে আসবে।"

এই বলে তিতলি নেমে এলো  ছাদ থেকে। কিছুক্ষণ পর তার বন্ধুরা সত্যিই চলে এলো। আর তারা মজাও  করলো অনেক। তারপর ক্লান্ত তিতলি রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্নে দেখল পরীরা ছাদে এসে তাকে গিফ্ট দিয়ে গেছে। তারপর তিতলি হঠাৎ শুনতে পেলো তার মা তাকে ডাকছে। "তিতলি ওঠ‌। সকাল হয়ে গেছে।" তিতলি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে ছাদে চলে গেল। ছাদে গিয়ে সে দেখল একটা বড় বাক্স রাখা আছে। সেটা খুলে সে দেখছে একটা সুন্দর পুতুল। পুতুলের নিচে একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা আছে "আমরা পরী। এটা তোমার জন্মদিনের গিফ্ট। একটা সুন্দর পুতুল।" তিতলি ভাবলো যে তাহলে স্বপ্ন কি সত্যি হয়ে গেল!!! সে ছাদ থেকে নেমে এসে মাকে চিৎকার করে বললো, "মা, আমাকে পরীরা গিফ্ট দিয়ে গেছে কাল রাতে।" মা তো একথা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না। বারবার বুঝিয়ে বলাতে আর পুতুলটা নিজের চোখে দেখে তিতলির মায়ের মুখেও পরীদের মত এক মুখ হাসি দেখা গেল। এখন সবাই খুব খুব খুশি।
                

রেইনবো মাউন্টেন

 সম্মিত্র ভট্টাচার্য
(চতুর্থ শ্রেণি, ড্রিম ইন্ডিয়া স্কুল, হাওড়া)


আমার নাম রশ্মি, মা আর বাবা আমাকে পুচু বলে ডাকে। আমি পড়াশোনায় খুব বাজে ছিলাম। অনেক মাস্টারমশাই এসেছেন তাও পড়াতে পারেন নি। আমার পড়াশুনো একটুও ভালো লাগতো না। তখন আমি ক্লাস 4-এ পড়তাম। মা একদিন বলেছিল GK পড়তে। GKএর চ্যাপ্টারের নাম অ্যামেজিং ফেনোমেনা। হঠাৎ দেখলাম অ্যামেজিং ফেনোমেনা চ্যাপ্টারের রেইনবো মাউন্টেন,আমি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এটা খুব সুন্দর ছিল। আমি গুগলে সার্চ দিলাম, রেইনবো মাউন্টেনের ছবি দিলো। লিখেছিলাম অসাধারণ ।ইংরেজিতে ভুল বানানে fontisustuk মানে ফ্যান্টাস্টিক। কিন্তু সেটা ছিল চায়নাতে আর আমি ইন্ডিয়াতে।
আমার বাবা একদিন কাগজে বিজ্ঞাপন দিলো "মাস্টারমশাই চাই এক মাসের বেতন 3000টাকা"। বিজ্ঞাপন দেখে এলেন একজন। তিনি ছিলেন খুব ভালো মানুষ। তিনি এসে প্রথমে তো আমার বাবাকে প্রণাম করলেন। তারপরে বললেন কে আমার কাছে পড়বে? বাবা "ওই পুচু আয়" বলে আমায় ডাকলো। আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে এলাম। বাবা বলল "ইনি তোর নতুন মাস্টারমশাই, ভালোভাবে পড়বি। যদি ও চলে যায় তাহলে তুই তো জানিস কিরকম পিটুনি খাবি।" আমি গেলাম ওনার সাথে আমাদের পড়াশোনার ঘরে।
উনি বললেন - তোমার নাম কি ?
আমি বললাম - আমার নাম রশ্মি চক্রবর্তী।       উনি বললেন তাহলে কোন বই পড়বে তুমি?    আমার কোন বই ভাল লাগতো না। তাও বললাম অংক। উনি বললেন তাহলে 4×8= কত ?        আমি বললাম 75 । ওনার মুখের ভাব দেখে লাগছিল ভুল কিন্তু বললেন -এটা ঠিক।
 আমি খুব খুশি, প্রথমবার ঠিক হলো বলে। তারপরে আরো প্রশ্ন ধরতে থাকলেন। আর আমি যত ভুল উত্তর দিচ্ছি তাও উনি বলছেন ঠিক।
 উনি রোজ পড়াতে আসতেন আর আমি খুব খুশি থাকতাম ।
 একদিন উনি বললেন -তুমি কোথায় যেতে চাও?
আমি বললাম আমি চিড়িয়াখানা যেতে চাই।
 উনি বললেন -ঠিক আছে, আমিও চিড়িয়াখানা যেতে চাই কালকেই। তাহলে আমরা যাব আর তোমাকে নিয়ে যাব।   
আমি খুব খুশি হলাম।
আমি ভালোভাবে সেজেগুজে বসে আছি কোন সময় আসবেন উনি। একটা বাস এলো আর উনি ওটা থেকে নেমে বললেন -চলো এবার যাওয়া যাক। আমি উঠে পড়লাম বাসে। আমি অনেক পাখি, জন্তু দেখলাম। আমি খুব খুশি হলাম।

 আমি আবার এসে গেলাম আমার বাড়িতে। পরের দিন উনি এসে আমায় পড়িয়েছিলেন। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম আর যত ভুল বলেছি তাও উনি  বলতেন- এটা ঠিক। 
এইভাবে আমার পড়ার ইচ্ছে বেড়ে গেল। একদিন হঠাৎ করে দেখি আমার পড়তে ভালো লাগছে। আর উনিও খুব ভালো পড়াচ্ছিলেন। 
উনি আবার বললেন- তুমি কোথায় যেতে চাও? এবার আমি বললাম -রেইনবো মাউন্টেন।
উনি একটু অবাক হলেন। তারপরে বললেন- এতে যাওয়া সম্ভব নয় আবার অসম্ভবও নয়।  বললেন- তোমার এখন ফাইনাল এক্সাম আসছে তো? আমি বললাম হ্যাঁ। উনি বললেন- তুমি যদি ফাইনাল এক্সামে সেকেন্ড বা ফাস্ট বা ভালো কিছু হয়ে যাও তাহলে আমি তোমায়  রেনবো মাউন্টেনে নিয়ে যাব। আমি বললাম ঠিক আছে। আমি এবারে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড কিছু হয়ে দেখাবো।
ফাইনাল এক্সাম শুরু হল আমি খুব ভালো  পড়ছিলাম কারণ আমি রেনবো মাউনন্টেন যেতে চাইছিলাম। তারপরে আমার এক্সাম হল ইংলিশ, ম্যাথ,বাংলা।
 যখন রেজাল্ট বেরলো আমি দেখে একটু দুঃখ পেলাম। কারণ আমি ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হতে পারিনি, আমি হয়েছিলাম ফোর্থ।
ওর পরে আমি ওনাকে বললাম- আমি ফোর্থ হয়েছি। কিন্তু উনি খুশি হয়েছিলেন। 
বলেছিলেন- তুমি যেতে পারো রেইনবো মাউন্টেন।  যেতে পারবো শুনে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। 
আমি গেছিলাম চায়নাতে আর দেখেছিলাম রেইনবো মাউন্টেন। উনি রেইনবো মাউন্টেন এর কাছে গিয়ে বললেন- আমি যে সময় তোমায় বলেছিলাম 4×8=কত ওই সময় তুমি আসলে ভুল বলেছিলে, তাও তোমার কনফিডেন্স বাড়ানোর জন্যে আমি বলেছিলাম এটা ঠিক। আমি বুঝে গিয়েছিলাম কেন উনি বলেছিলেন এটা ঠিক।
আমন্ত্রিত লেখা

আমিও মরে ভূত হবো রে! 

লুৎফর রহমান রিটন

ভূতের ভয়ে গ্রাম ছাড়িলাম 
ঘর বাঁধিলাম নদীর ধারের তেঁতুল গাছের তলে! 
অমাবস্যার নিকশ রাতে 
ঘরের চালে ভূতরা নাচে জানিস! দলে দলে! 

ভূতের নৃত্য-গীতের আসর 
বসে যখন, কী অপরূপ! বলবো কী আর তোকে--
ওদের নাচ আর গানের ভেলায়
ভূতরা আমায় যায় নিয়ে যায় অচিন স্বপ্নলোকে। 

অচেনা এই দূরের গাঁয়ে
ভূতই এখন বন্ধু আমার, আমার আপন স্বজন। 
সেদিন ওদের সমাবেশে 
গুণে দেখি ভূতের সংখ্যা সাকুল্যে তিন ডজন! 

তিন ডজনের অর্থ হলো
ছত্রিশ জন। বাচ্চাকাচ্চা-নারী-পুরুষ-বুড়ো--
সব বয়েসী ভূতের মেলায়
মাছ ভাজা তো থাকেই, থাকে কাতলা মাছের মুড়ো... 

ভূতের প্রিয় কাতলা-ইলিশ
শিঙ্গি-মাগুর-রুই-পাঙ্গাস-বোয়াল ও রূপচাঁদা। 
বাচ্চা ভূতের কাছে প্রিয় 
মৌরলা মাছ গুড়োচিংড়ির ভর্তা শাদা শাদা... 

ভূত ছানাদের ইশকুল নেই
সপ্তাহে সাতদিনই থাকে ওদের মজার ছুটি। 
তাইতো ওদের দিবারাত্রি 
কেবলই গান কেবলই নাচ কেবল হুটোপুটি।

ভূতের সঙ্গে থাকতে থাকতে 
আমার কেমন ভূতের স্বভাব গজিয়ে গেলো আরে!--
নানান ছুতোয় রাত নিশিথে 
ঘুরে ফিরে কেবল আসি তেঁতুল গাছের ধারে! 

আমিও মরে ভূত হবো রে! 
নইলে কেনো মাংস ছেড়ে নজর মাছের পানে? 
আমি কেনো উঠবো মেতে
কেবল ভূতের গল্প ছড়া ভূতের ছন্দ গানে? 

আমি ভূতের আত্মীয় হই
দেখলে ওদের আগের মতো হই না তো আর ভীত... 
চেহারাটাও ভূতের মতোন, 
ঝগড়া হলে এই খোটা দেয় বউটা নিয়মিত! 

কথাবার্তাও ভূতের মতোন
ভূতের মতোই নেকো সুরে আমার কাঁদা হাসা! 
কন্ঠে কেমন চন্দ্রবিন্দু 
উড়ে এসে জুড়ে বসে, ভূতের যেমন ভাষা!

সত্যজিতের ভূত দেখিসনি?
গুপী-বাঘায় নেচেছিলো কী অপূর্ব তালে!
ভূতের রাজা বর দিলো আর 
জুতো দিলো, জাদুর জুতো! লাগতো ভ্রমণকালে। 

তিনটি বরেই গুপী-বাঘার 
পালটে যাওয়া জীবন হলো মিষ্টি-মিঠাই মোড়া। 
ইচ্ছে মাফিক পোশাক পাওয়া 
গান গাওয়া আর খাওয়া-দাওয়া, দেশ-বিদেশে ঘোরা... 

তেমন একটা জীবন পেলে
বর্তে যেতাম। তাই তো থাকি ভূতের দলে মিশে।
স্বপ্ন দেখি আসবে সুদিন 
(অভাব এবং অনটনের জীবন আমার ক্লিশে)... 

তেঁতুল গাছের ভূতরা আমায় 
বর দেবে কি? তিনখানা বর? বল্‌ না দেবে নাকি! 
ভূতরা কখন সদয় হবে 
রোজ প্রতিদিন আমি তো সেই আশায় আশায় থাকি। 

কিন্তু জীবন সিনেমা নয়, 
হয়নি পাওয়া তাই কোনো বর। কেটেছে সংশয়-- 
ভূতের সাথে বাস করেও 
পালটে যায়নি জীবন আমার, জীবন কর্মময়...


ইজিচেয়ার

ব্রত রায়

ইজিচেয়ার ইজিচেয়ার ইজিচেয়ার ইজি
সকাল দুপুর সন্ধে বিকেল ইজিচেয়ার বিজি

ইজিচেয়ার ইজিচেয়ার পাতাই দেখি থাকে
দাদু বসে পেপার পড়েন, ঘুমান ফাঁকে ফাঁকে 

কাপড় যখন ছিঁড়ে গেল নতুন আনেন কিনে
দাদুর সাথে সেও দেখি রোদ পোহায় শীতের দিনে 

ইজিচেয়ার ইজিচেয়ার ইজিচেয়ার ফাঁকা
নেই দাদু আর দাদুর ছবি হয় দেয়ালে রাখা

ইজিচেয়ার ইজিচেয়ার তৈরি সে তো কাঠে
কাঠের হলেও কষ্টে তারও বুকটা দেখি ফাটে

ইজিচেয়ার ইজিচেয়ার ইজিচেয়ার একা
ইজিচেয়ার এবার পেল নতুন সাথীর দেখা

ইজিচেয়ার ইজিচেয়ার উঠল আবার মেতে
বাবা এখন বসে থাকেন ইজিচেয়ার পেতে।


শ্রুতিমধুর  

মধুরিমা চক্রবর্তী 

বুধো গেছে দিদার বাড়ি। মা তরকারি পাঠিয়েছেন। না হলে সে স্বেচ্ছায় এই সময়ে বড়ো একটা যায় না সেখানে। না যাওয়ার একটাই কারণ। দিদা কানে কিছুই শোনেন না। শোনার যন্ত্র আছে। তবু দিদা সেটা পরতে চান না। পরেন শুধু টিভি দেখার সময়। সাইকেলে স্ট্যাণ্ড দিয়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকল বুধো। হাঁপ ছাড়ল। জানালা দিয়ে দিদাকে দেখা যাচ্ছে। চেয়ারে বসে আছেন তিনি। বাঁচা গেল। নইলে ডাকাত-পড়া চিৎকারে ডাকতে থাকলেও দিদা কানে কিছুই শুনতে পান না। বুধো জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। দিদাকে সে পাশ থেকে দেখতে পাচ্ছে। দিদা সামনের দিকে তাকিয়ে টিভি দেখছেন। গভীর মনোযোগ। বুধো দেখে নিল কানে মেশিন পরা আছে। নিশ্চিন্ত হয়ে ডাক দিল,"দিদা...। ও দিদা...।" কিন্তু দিদা কোনো সাড়া দিলেন না। বুধো সামান্য গলা চড়াল,"ও দিদা..."। দিদা তার দিকে তাকিয়েই দেখছেন না। বুধোর গলা ক্রমশ চড়ছে।
-"দিদা গো...। দরজা খোলো।"
অনেক বার ডেকেও দিদার কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। অথচ ভেতর থেকে টুংটাং বাজনার আওয়াজ আসছে। এই সময় দিদা টিভি দেখছেন! এত মন দিয়ে কী দেখছেন যে কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না! হ্যাঁ... ঠিক। দিদা টম অ্যাণ্ড জেরি দেখছেন। বুধোও আগে আগে যখন মামাবাড়িতে থাকত তখন প্রায়ই দিদার সঙ্গে বসে দেখত। দিদার প্রিয় অনুষ্ঠান। বড়োমামা, ছোটোমামা অফিস চলে গেছেন। দিদা এখন বাড়িতে একা। বুধো বুদ্ধি করে ছাতাটা নিল। ডাঁটিটা লম্বা করে জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। দিদার মাথায় ঠুকঠুক করল। এইবার দিদা বুধোর দিকে তাকিয়েছেন। তাকানো মাত্র অ্যাকশন। দরজা খুলে গেল। বুধো ঘরে ঢুকে তরকারির কৌটোটা দিদার হাতে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল,"কী করছ দিদা?" দিদার কানে মেশিন। দিব্যি শুনতে পাচ্ছেন। দিদা বললেন,"টিভি দেখছি রে। টম-জেরি।" বুধো বলল,"এখনো রোজ দেখো?"
-"রোজ দেখি।"
-"কিন্তু টিভি তো এমন কিছু জোরে চলছে না! তবুও শুনতে পাচ্ছিলে না? দরজা খুলছিলে না কেন?"
-"ওমা! বলিস কী? ডাকতেই তো দরজা খুলে দিলাম।"
-"সে তো এখন খুললে। আমি সেই কখন থেকে ডাকছি।"
-"তাই নাকি!"
-"হুঁ। ডেকে ডেকে ফিরে যাব ভাবছিলাম।"
-"ওমা! তাই?  তা, কী বলে ডাকছিলি বল দিকি?"
বুধো রাগত গলায় বলল,"দিদা বলেই ডাকছিলাম। দিদাকে কি মেশোমশাই বলে ডাকব নাকি?"
-"অনেকক্ষণ থেকে 'দিদা' 'দিদা' বলে বিকট চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম বটে!"
বুধো অবাক হল। জানতে চাইল,"শুনতেই যদি পাচ্ছিলে তো সাড়া দিচ্ছিলে না কেন?"
দিদা দারুণ স্বাভাবিক স্বরে বললেন,"কী করে বুঝব তুই আমাকে ডাকছিস? আমি তো টিভি দেখছিলাম। ভাবলাম টিভিতে কেউ কাউকে ডাকছে।"
বোঝো! হতবাক বুধোর মুখ দিয়ে আর বাক্যি সরল না। সে চিন্তা করতে করতে টিভির দিকে ফের তাকালো। টম জেরির পেছনে দৌড়ে চলেছে। জেরি ছুটতে ছুটতেই পেছন ফিরে মুখ নেড়ে নেড়ে কিছু বলছে। কী বলতে পারে? বোধ হয় দিদা।


টইটম্বুর 

মুক্তি দাশ 

দুই ছেলে শম্ভুর 
টই আর টম্বুর। 
টই থাকে বিদেশে,
বড় সাদাসিধে সে। 
রুগী-মারা ডাক্তার 
বলে নামডাক তার। 
টম্বুর? ক্রিকেটার। 
নাম চারিদিকে তার। 
চারখানা ক্যাচ মিস
শেষে খেলা ডিসমিস। 
শম্ভুর পায়াভারি, 
দুই কৃতী ছেলে তারই!

জ্বলদর্চি কুইজ।  ক্লিক করে দেখে নিন সঠিক উত্তর। 


সাঁতরাইচেঙ্গার রহস্যময় সাতকাহন - ১

গৌতম বাড়ই

(একদিন রাতের অন্ধকারে গ্রামের মাঠে নেমে এল এক আলোর চাকি বা চাকতি। তারপর গ্রামে ঘটতে থাকলো একের পর এক রহস্যময় ঘটনা। অনুপ, সুশান্ত এবং বুদ্ধদেবের সেই ডুয়ার্সের চিরসবুজ গ্রামে। যেখানে কলকল করে বয়ে যায় মুজনাই নদী।)

তিনদিকে তার ঘিরে আছে মুজনাই নদী। সবুজ ধানের মাঠ। গমের মাঠ। হলদে সর্ষের। রাই-সর্ষের।ধান যখন পেকে সোনালী হত, ডুয়ার্সের গ্রামে-গ্রামে হাতির পাল আসত খাদ্যের সন্ধানে। যতটা না খেতো তারচেয়ে বেশি নষ্ট করত। শীতের কুয়াশায় অস্পষ্ট দূরের ভূটান পাহাড়। গ্রাম কী কখনও মানুষের মতন হয়? হ্যাঁ হয়। আমি যে-বারে কলকাতার কলেজে সদ্য পড়তে গিয়েছি। এই সবুজ নদী-নালা প্রকৃতি ছেড়ে সারাদিন মন খারাপ করত। রাস্তায় নামলে লাখো লোক অথচ কেউ আমায় চেনে না। বাসের শব্দ,গাড়ির শব্দ, ট্রামের ঘর্ঘর শব্দ আমার বুকের যন্ত্রণা হাজারটা গুণ বাড়িয়ে দিত। আমার খুব মনে হত আমি একদম একা এই মহানগরে। আমার খোলামেলা চিন্তার সেই মাঠ-ঘাট অনন্ত জগত কোথায়? বন্ধু-বান্ধব সাথী-পড়শী, আমার চেনা গাছপালা নদীনালা কেউ নেই। কাদের সাথে মনের কথা বলব?

পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেছি। আমাদের বাড়ির জমিতেই ছিল তিনটে বড়-বড় মাদার গাছ। সবচেয়ে বড় মাদার গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে তার কাণ্ডে হাত বোলাচ্ছি, অমনি শীতের সন্ধ্যায় সেই গাছ আমায় স্পষ্ট বলছে---খুব কষ্ট না বুদ্ধ তোর?  ঐ কলকাতায় পড়তে গিয়ে? আমারও। তুই তো শীতে-গ্রীষ্মে আমার কাছে আসতি। আমি স্পষ্ট শুনলাম আর দৌড়ে ঘরের ভেতর মায়ের কাছে গেলাম। মা বললে--কি রে! ভয় পেয়েছিস না?
 আমি বললাম--না। মা বললে-বললেই হবে। তুই এখন কলকাতার মতন বড় শহরে থাকিস। কত আলো গাড়ি ঘোড়া লোকজনের মধ্যে আমাদের পাড়াগাঁয়ের থেকে গিয়ে। অন্ধকারে ভয় পেতেই পারিস।

তখনও আমাদের সাঁতরাইচেঙ্গা গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। আমি সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা যুবক। তাই স্পষ্ট শুনেছিলাম ঐ কথা। কেউ শহরে বিশ্বাস করবেই না। আমিও নিজের বিশ্বাসটা চিরটা-কাল নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখি। বাবা গ্রামের হাই-স্কুলের মাষ্টারমশাই। একটা ছোট মফসসল শহর ফালাকাটা আমাদের গ্রাম ছুঁয়ে। এখানে সেইসময়ে কলেজ হয়নি। জেলাসদরের কলেজে বাবা পড়াবেন না। অগত্যা দ্বাদশ শ্রেণির অর্থাৎ উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করবার পর যেতেই হল কলকাতার কলেজে। মন থেকে সায় দেয়নি কিন্তু একটা বড় মানুষ তো হতেই হবে, তাই যেতেই হল।

অনেক মাদার গাছ বা শিমূল গাছে ভরা আমাদের গ্রাম। শাল সেগুন আম কাঁঠাল বট অর্জুন ছাতিম জলপাইগাছ ছিল। কাঠ-ঠোকরা গ্রীষ্মের দুপুরে মড়া ডালে ঠকঠক করত। আমরা খুব কাদা মেখে ফুটবল খেলতাম বর্ষায়।

একদিন অনুপ কানে-কানে বলল-- বুদ্ধ একটা রহস্যময় চাকতি কালকে রাতে ভুটনীরঘাটে ওপারে স্কুলের মাঠের কাছে পড়েছে। এখনও গর্ত হয়ে  আছে শুনলাম। আমি তুই আর সুশান্ত দেখতে যাব। যাবি?

আমি লাফিয়ে উঠে বললাম--হ্যাঁ যাবই।
তারপর অনুপকে বলতে শুরু করি, আরে আমি তো কালকে রাতে খোলা জানলায় অন্ধকার আকাশে তাকিয়ে তারা দেখতে গিয়ে ঐ উড়ন্ত চাকি দেখেছি। বিশ্বাস কর। আলোর এক গোলাকার চাকতি ঐ ভুটনীর ঘাটের।
অনুপ আমার আরও কাছে এসে অবাক চোখে চেয়ে বলে-- সত্যি! (পরের রবিবার) 


জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. ক্রমেই ছোটোবেলা ব্লগজিনে একটা জায়গা করে নিচ্ছে,বুঝতেই পারছি।ছোটোরা এর থেকে অনুপ্রাণিত হলে খুব ভাল লাগবে।

    ReplyDelete