জ্বলদর্চি

ছোবলের ছবি আর কত কী ভাবি!/গৌতম বাড়ই

ছোবলের ছবি আর কত কী ভাবি!

গৌতম বাড়ই

আজ রবিবার। শীত বিদায় নিয়ে  বসন্ত এসে গেছে।প্রকৃতি এখনও স্নিগ্ধ কিন্তু রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমশ চড়ছে। গেল রোববারের ব্রিগ্রেড দেখে কী জানতে পারলাম? একটা উৎসব হবে, আর সেই উৎসবে আমাদের সবাইকে যোগদান করতেই হবে। জনগণের কথা কোথায়? সেইসব সাধারণ জনগণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ আমাদের বেঁচে থাকবার রাস্তাগুলো কী হবে? স্বাধীনতার পর মানুষের রোজগারের সঙ্গে নূন্যতম আরও দুটো মূল দাবী ছিল শিক্ষা আর স্বাস্থ্যকে সরকারের তত্ত্বাবধানে রেখে একে প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে সুবিধা প্রদাণ করতে হবে। অথচ আজ এক ভয়ানক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে শিক্ষা আর স্বাস্থ্য-- পুরোটাই বেসরকারী ক্ষেত্রের দখলে। স্বাস্থ্যের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যের স্বাস্থ্য- পরিকাঠামো এক নয়। যতই ভোটের মুখে স্বাস্থ্যর জন্য প্রকল্প ঘোষিত হোক, এখনও মানুষকে জমি- জমা- ঘটি- বাটি বেচে সর্বস্বান্ত হয়ে দূরের রাজ্যে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়। মানুষের সেইসব দুঃখের রোজ- নামচার দূরীকরণের কথা নেই, চলল ফিল্মী কায়দায় কেউটে সেজে ছোবলের কথা। সাধারণ আমরা কম বুঝি-- এ কি হিংসার কথা নয়? আগুন জ্বলবে মানুষ মরবে আর  সিংহাসন দখলের জন্য নাটক চালিয়ে যাবে? মনের ভেতর কথাগুলো গুনগুন করে আর সপ্তাহের বাজারে চলি তাই। আজ রোববারের বাজার। পুরো রাজনীতির মঞ্চ তো আদতে রঙ্গমঞ্চ।

বাজারে ঢুকতেই আমি নিজে থেকে দিনুদাকে নজর করি। দিনুদা দেখতে পেয়েই হাঁক দিল -- ভায়া এদিকে এসো। একটা প্রবাদবাক্য বলছি, সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়। তা ভায়া নদীতে যদি শ্যাওলা আর জঞ্জালপূর্ণ থাকে স্রোত কি স্বাভাবিক বইতে পারে? এবারের বিধানসভা ভোট পশ্চিমবঙ্গের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন জান ভায়া? 

-- দিনুদা বলো। শুনি।

-- আমার কাছে সব নথিপত্র রেডি। স্বাধীনতার পর প্রথম বিধানসভা নির্বাচন হয় সেই ১৯৫২ সালে। তার আগে স্বাধীনতার পর রাজ্যে- রাজ্যে আইনসভা কাজ চালাচ্ছিল। মুখ্যমন্ত্রী হন আধুনিক বাংলার রূপকার ডা. বিধান চন্দ্র রায়। জাতীয় কংগ্রেস দলের। তাঁর সাথে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বন্ধুত্বপূর্ণ  সম্পর্ক ছিল। কমিউনিস্টরা প্রধান বিরোধী দলের তকমা পান। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই থেকে প্রাক্তন এবং  প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বরানগর থেকে জয়লাভ করেন। 

তারপর গড়গড় করে বলে যান দিনুদা- 

২য় বিধানসভা ১৯৫৭ কংগ্রেস ২৫২ আসনের মধ্যে ১৫২ বিধান চন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী ৩য় ১৯৬২ কংগ্রেস ২৫২ আসনের মধ্যে ১৫২ প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান রায়, বিধান রায়ের হঠাৎ পরলোক গমন করেন ঐ বছরের ১লা জুলাই তারপর প্রফুল্ল চন্দ্র সেন দায়িত্ব ভার সামলান ৪র্থ বিধানসভায় কংগ্রেসের ভরাডুবি এবং ১৯৬৭ যুক্ত ফ্রন্ট গঠন ২৮০ আসনের মধ্যে ১৩২ মুখ্যমন্ত্রী অজয় কুমার মুখার্জি। এরমধ্যে অনেক টানা পোড়েন বিধানসভা ভেঙ্গে ভোট, সারারাজ্য জুড়ে সন্ত্রাসের আগুন, উপদ্রুত এলাকা হল পশ্চিমবঙ্গ, কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী সিআরপিএফ- র দখলে গেল রাজ্য, ঐতিহাসিক নকশাল আন্দোলন, পঞ্চম আর  ৬ষ্ঠ বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন যথাক্রমে অজয় মুখার্জী এবং ১৯৭১কংগ্রেস  প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ ৭ম বিধানসভায় আবার এলো কংগ্রেস ১৯৭২ সালে, কংগ্রেস ২৮০ আসনের মধ্যে ২১৬ মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ৮ম ১৯৭৭ বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৭৮ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ৯ম ১৯৮২ বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৭৪ জ্যোতি বসু ১০ম ১৯৮৭ বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৮৭ জ্যোতি বসু ১১তম ১৯৯১ বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৮৯ জ্যোতি বসু ১২তম ১৯৯৬ সালে বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের মধ্যে  ১৫৭ জ্যোতি বসু ১৩তম ২০০১ বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৪৩ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ১৪তম ২০০৬ সালে বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের মধ্যে ২১২ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ১৫তম ২০১১ সালে এবং ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মা- মাটি- মানুষের তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেন ২৯৪ আসনের মধ্যে ১৮৪ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন। ২০১৬ সালে তাদের আসন সংখ্যা লাফিয়ে দুশোর ওপর গেল। দ্বিতীয়বারের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন। এই হল আমার বিধানসভার লিখে রাখা যাবতীয় ইতিহাস।

তারপর একটি কাগজ মুখের সামনে মেলে ধরলেন। আর বলতে লাগলেন- কেউ চিরদিন ক্ষমতায় থাকেনি বা থাকবে না। জনগণের সেবা করতে এসেছ করে যাও, মানুষ সব হিসেব কষেই ভোট দেবে। গায়ের জোরে, চুরি- চামারি, সিন্ডিকেট বা ক্লাববাজি করে বড়জোর একটা- দুটো ভোট বৈতরণী পার করা যায় কিন্তু যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ চাইবে তখন পরাজিত শব্দটি ছাড়া আর কিছু থাকবে না পড়ে। আর একটি দামীকথা বলি ভায়া, আমাদের টিভি বা ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখনও এদের সময় আছে সত্যনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের। টিভির আলোচনায় যে লোকটি আজ যে পার্টির হয়ে বলছে, কিছুদিন পর আবার সেই পার্টির  বা সেই  রাজনৈতিক দলের বিরূদ্ধাচারণ করছে। এদের ন্যায়- নীতির কিছু নেই, এদের বর্জন করে সে যতই ছোটোদল হোক না কেন যারা মানুষের কথা বলে, দেশের কথা বলে তাদের আলোচনার সুযোগ দেওয়া উচিত। তাহলে না  হয় সংবাদপত্রগোষ্ঠীকে গণতন্ত্রের চতুর্থ- স্তম্ভ বলব? এতেই প্রকৃত কল্যাণ দেশের ও দশের । সবকিছু বাজার আর টাকার কথা ভেবে করলে এইরকম মরণ দশার সন্মুখীন হতে হবে। কারণ স্বাধীনতার পর এই প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গের ভোট হচ্ছে ব্যাপক দূর্নীতি আর ধর্মের ভিত্তিতে। আশা করছি মানুষের শুভ- বুদ্ধির জয় হবে। একটা বিষয় এখানে দেখবার মতন তা হল, যেবারে আসন ভোটের ফলে দুশোর ওপরে ঠিক তার পরের বারে সাধারণত আগের সরকারের পতন হয়েছে। প্রত্যাশা যখন তুঙ্গে, তখনই মানুষ বিফল মনোরথ হয় নানান কারণে। এবার এটাই দেখবার। মানুষ কাকে বেছে নেয়।

এইভাবে গড়গড় করে বলেই দিনুদা থামলেন। আজ দিনুদা এক্কেবারে টপফর্মে ছিলেন। দিনুদা সিগারেট খান না। না হলে বলতাম একটা লম্বা কিছুর ধোঁয়া উদগীরণ করো। সামান্য পেসাদী দিনুদাকে ধরিয়ে  দিয়েই বাজারে ঢুকলাম। সেই লাল- চা আর বিড়ি।

এবারে বাজার থেকে বাড়ি। বাজার রাখলাম। গিন্নী এগিয়ে এসে গদগদ বললেন-- আর একটি মাস পরে কী বলতো? আমি বললাম, তার পরের মাস। আবার কী? না- গিন্নী বললেন। পয়লা বৈশাখ। নববর্ষ। আমি বললাম-- ও মাথায় তুলে নাচো। এখনও দেশ থেকে করোনা গেলো না। দিনদিন বাড়ছে। আর সামনে ভোট উৎসব। দৈনিক খবরের কাগজ পড়বে না, কী করে জানবে?
গিন্নী বললে-- ও মা তাই! 

আমি মনে- মনে বেজায় খুশি। যাক আজ আর ঐ পয়লা বৈশাখের জন্য শপিং- মলে ছুটতে হবে না। গতর আর টাকা দুটোই বিশ্রাম পাবে। মুখে গাম্ভীর্য এনে বললাম-- হুম তাই! ভয়ানক অবস্থা দেশে। খবর- ই রাখো না।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments