জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীদের ভূমিকা/(উৎসব ১৪২৮)/ রমা ঘোষ

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীদের ভূমিকা 

রমা ঘোষ 

অতি সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে দেবীমূর্তি ( নারী অবয়বে তথাকথিত ঐশ্বরিক ক্ষমতা যুক্ত ) পূজিত হয়ে আসছে। ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সময় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ -  ১৫০০ অব্দে দেবীমূর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে সনাতন হিন্দু ধর্মে শক্তি, সম্পদ, বিদ্যা বা জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে নারী পূজিত হয়েছে । ভয়ানক আসুরিক শক্তির মহিষাসুরকে দমন করার ক্ষমতা দেব (পুরুষ অবয়বেে  তথাকথিত ঐশ্বরিক ক্ষমতা যুক্ত) বা মানব কারো পক্ষেই সম্ভব না হওয়ায় যেখানে দেবীর ক্ষমতা প্রদর্শন দেখানো হয়েছে। এমনকি বন্য হিংস্র প্রাণীর থেকেও রক্ষা পেতে মানবসমাজে দেবী মূর্তি পূজা হতে দেখা গেছে, যেমন- বাঘের উপর উপবিষ্টা দেবী শেরাওয়ালি, সর্প-পরিবৃতা দেবী মনসা প্রভৃতি। পৃথিবীর অন্য কোন সভ্যতায় দেবী মূর্তি এত বিস্তারের সাথে পূজা করা হয় না।

বাস্তবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের অবস্থান কি দেবীমুর্তির মতোই সম্মানের ? সমাজ ব্যবস্থায় কি সৃষ্টির আধার হিসেবে পুরুষ ও নারী সমমর্যাদা পেয়েছে ?
ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকেই শারীরিক শক্তির তারতম্যের জন্যই গোষ্ঠী জীবনে পুরুষ ও নারীর কর্মের বিভাজন হয়। শারীরিক দিক থেকে বেশি সবল পুরুষ যেমন যুক্ত হয় পশু শিকারের কাজে তেমনি নারী যুক্ত হয়েছিল খাদ্য অর্থাৎ গাছপালা সংগ্রহ ও গৃহস্থালির কাজে আর মূলত সন্তান প্রতিপালনে। 
এ প্রসঙ্গে মার্কসীয় ধারণা আলোচনা যোগ্য- এঙ্গেলস তাঁর "The Origin of Family, Private Property and the States" গ্রন্থে পরিবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন যে সঞ্চিত সম্পত্তি ও সম্পত্তি সম্পর্ক এবং পরিবারের কাঠামো ও পারিবারিক সম্পর্ক প্রভৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদন মাধ্যমে পরিবর্তন নির্ধারক শক্তি হিসেবে কাজ করে। মার্কসীয় ধারনা অনুসারে আদিম সমাজ ব্যবস্থায় শিকারের যুগেও খাদ্য সংগ্রহের পর্যায়ে পরিবার ব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক । কৃষিকার্যে বিকাশ ও বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে উদ্বৃত্ত ধনসম্পত্তির সৃষ্টি হয়, এই ধন সম্পত্তির মালিকানা পুরুষ শক্তির অধীনে আসে । এই ভাবেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বা পুরুষশাসিত সমাজের  উদ্ভব হয়।

সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতায় নারীরা সমাজে সম্মানের জায়গায় অবস্থান করতেন।  প্রকৃতি ও মাতৃদেবী হিসেবে নারীশক্তি পূজিত হতেন । সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা স্পষ্ট ভাবে হিন্দু ধর্মের শাক্ত আচারের আবির্ভাবের চিহ্ন বহন করে যা দেবীকে মহাবিশ্বের উদ্ভাবিকা সংরক্ষণকারিণী  এবং ধ্বংসকারিণী হিসেবে পূজা করতো । হিন্দু ধর্মীয়  গ্রন্থ বেদ, উপনিষদে এমন অনেক  নারীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁরা সেই সময় বড় পন্ডিত, কবি ও দার্শনিক ছিলেন । সমাজে স্ত্রীকে পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী রূপে গণ্য করা হতো এবং একজন অবিবাহিত পুরুষ কে অসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো । যদিও কিছু কিছু ঐতিহাসিক এই তথ্য কে অস্বীকার করছেন এবং বলেছেন যে প্রাচীন ভারত নারীশক্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছিল। 

ঋক বৈদিক যুগে নারীরা তাদের গার্হস্থ্যের ক্ষেত্রে সম্মান ও সুযোগের অধিকারিণী ছিলেন। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের স্রষ্টা, রক্ষক এবং শিক্ষাগুরু ছিলেন । বৈদিক সমাজে স্ত্রীর অবস্থান সম্মানিত  হয়েছিল বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান  সম্পাদনের ক্ষেত্রে।   স্ত্রীকে ছাড়া স্বামীরা কোন যজ্ঞ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না, কারন এটা বিশ্বাস করা হতো যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সেই যজ্ঞের  আহুতি-উপচার গ্রহণ করবেন না। পরিবার ছিল একক অর্থনৈতিক, কিন্তু সেখানে কোন লিঙ্গবৈষম্য ছিলনা। এই যুগে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের সম্পূর্ণ সুযোগ ও স্বাধীনতা ছিল । বেদ, উপনিষদ এবং অন্যান্য গ্রন্থে দার্শনিক, রাজনীতিবিদ ,শিক্ষক, প্রশাসক এবং আধ্যাত্বিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য নারীর উদাহরণ পাওয়া যায় ।  প্রকাশ্যে ভোজ, নৃত্য বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী মহিলাদের কথাও জানা যায়।

পরবর্তী বৈদিক যুগের রামায়ণ মহাভারতে নারীদের স্বয়ংবর বা নিজের পতি নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে । আবার নিজের চরিত্রের সততা প্রমাণ করার জন্য রামায়ণের সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতন নির্মম ঘটনার বর্ণনাও পাওয়া যায়।
 ধর্ম সূত্রে বলা হয়েছে যে বিবাহ একটি চুক্তি নয়, কিন্তু এটি একটি পবিত্র মিলন যেখানে এক নারী সম্মানিত হয় এবং জীবনে স্বাধীনতা ভোগ করে । সমাজে পুনর্বিবাহ ছিল বিরল।

মনু স্মৃতিতে চার বর্ণের বিভাজন এবং তাদের কর্তব্যকর্মের কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে । মনু স্মৃতিতে নারীদের তার পরিবারের পুরুষ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে ও কর্তৃত্বের থাকার কথা বলা হয়েছে । নারীরা  শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সুরক্ষিত থাকবে । মনু স্মৃতিতে নারীদের একক স্বাধীনভাবে থাকার কথা অস্বীকার করা হয়েছে । মনু, পরিবারে স্বামীদের ভগবানের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন যে প্রথমা স্ত্রীর দ্বারা সন্তুষ্ট ( pleasure ) না হলে প্রথমা স্ত্রীর বর্তমানে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন, এমনকি যদি স্বামী তার স্ত্রীর বর্তমানে অন্য কোন নারীর সঙ্গে অবৈধ  সম্পর্কে যুক্ত থাকেন, তবুও স্ত্রী তার স্বামীকে ভক্তি করতে বাধ্য থাকবে ।  এমনকি কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্ত্রী তার স্বামীর দ্বারা অস্বীকৃত হতে পারতেন।  বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং তার স্বামীর প্রতি অনুগত থাকতে নারীরা বাধ্য থাকতেন । মনুস্মৃতিতে সমাজে মহিলাদের বেদ পাঠ , মন্ত্রোচ্চারণ নিষিদ্ধ হয় ।মহিলারা শিক্ষার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। পরবর্তী বৈদিক যুগে সমাজে মহিলাদের এই নিম্ন অবস্থানের জন্য মনুস্মৃতি অনেকখানি দায়ী।

মৌর্য শাসন বা পৌরাণিক যুগে মহিলাদের  বিবিধ ব্রত-এর কথা পুরাণে উল্লিখিত আছে । স্বামী এবং পুত্রের মঙ্গলের জন্য মহিলাদের ব্রত করার কথা উল্লিখিত আছে ।পুরাণে বলা আছে স্বামী, স্ত্রীর সম্পূর্ণ অংশ জুড়ে থাকবে এবং স্ত্রী, স্বামীর প্রতি বিশ্বাসী ও দায়িত্বশীল থাকবে। উপনিষদে মহিলারা কখনোই সেভাবে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়নি। মহিলারা তাদের বিবাহিত জীবনের সুরক্ষা, পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য ব্রত বা কালো-জাদুর প্রয়োগে অন্য মানুষের ক্ষতি সাধন ইত্যাদি কাজে লিপ্ত থাকে --- এইভাবে সমাজে তাদের অবস্থান বর্ণিত হয়েছে। 

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । তাঁদের মতে, প্রাচীন ভারতীয়  সমাজে নারীরা বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা, কন্যা ভ্রুণ হত্যা ,বধু হত্যার শিকার ছিল । পৈতৃক সম্পত্তিতে তাদের অধিকার স্বীকৃত ছিল না । জওহর ব্রত বা সতীদাহ প্রথার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল । উচ্চ যৌতুকের হাত থেকে রেহাই পেতে কন্যাভ্রূণ হত্যা চলত । মহিলাদের জন্য সামাজিক বিধি নিষেধ ছিল খুবই কঠোর । রামায়ণের সীতার অগ্নিপরীক্ষার কথা বা রামচন্দ্রের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের অপরাধে সূর্পনখার নাক-কান কেটে শাস্তি প্রদানের কথা এক্ষেত্রে বিবেচ্য।

মৌর্য যুগে যদি কোন নারী বৈবাহিক সম্পর্কে দোষী সাব্যস্ত হতেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো ।আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় তক্ষশীলায় অ্যারিস্টোবুলুস দেখেছিলেন যে, দরিদ্র মানুষেরা তাদের কন্যা দের প্রকাশ্য স্থানে বিক্রয় করছে। গুপ্ত যুগে 'কামসুত্র' গ্রন্থে যৌনজীবনে পুরুষের সর্বোচ্চ সুখ লাভের জন্য এবং উপযুক্ত স্ত্রী হয়ে ওঠার জন্য নারী প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ।মেয়েদের অল্প বয়সে মূলত বয়ঃসন্ধির আগে বিবাহ দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এই যুগে  দেখা যায় । যদিও রাজ পরিবারের নারীরা লেখাপড়া,কাব্যচর্চা, সংগীত, নৃত্য, বাদ্য প্রভৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । এক্ষেত্রে বাকাটক শাসক প্রভাবতী গুপ্তার কথা উল্লেখ্য। 

সাধারণ ভাবে বলতে গেলে বৈদিক যুগে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রাচীন ভারতীয় সমাজে সাধারণ মহিলাদের স্বাধীন অস্তিত্বের কথা অস্বীকৃত  হয়েছে । পরিবর্তে, নারীদের স্ত্রী  এবং মাতৃরূপই  সমাজে স্বীকৃত ও আদৃত হয়েছে ।।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments