জ্বলদর্চি

সুধীর দত্ত


সু ধী র  দ ত্ত


মহাপৃথিবী 

যতটা ভেবেছি, তুমি তারও বেশি নিষ্ঠুর ও পরিহাসপ্রিয়। 
চারদিকে তাসেরা বাজে ,
একটি পরম পদ গলায় পেঁচিয়ে অনু উপসর্গের দড়ি 
ঝুলে আছে বাসস্ট্যান্ডের মাথার উপর।
তার কি ভিসেরা হবে?
শব্দরাও এরকম আত্মহত্যাপ্রবণ !
কেউ কি আঘাত করল ?একলষেঁড়ে কেউ ?
ছুটে আসে অ্যাম্বুল্যান্স, শববাহক গাড়ি। 
এদিকেও গূঢ়তর আর এক প্রেরণায় 
তাক লাগিয়ে জলে ভাসল শিলা 
এবং সবাই দেখল অবিশ্বাস্যভাবে এক সেতু  
শাসন করল জল-স্থল ;
ধড় থেকে খসে পড়ল গামে আঁটা দশ দশটি মাথা। 
ইতস্তত পড়ে রইল কাট আউট, বাঁশ, খড়, হাওয়ায় ছড়ানো শালপাতা ।
হতবাক গাঁ-বুড়োরা, আমাদের এন্টেনার ঘিলু 
হাওয়ার দুরন্ত ঘুর্ণি, পড়তেই পারেনি তার জাদুবাস্তবতা। 

প্রেরণা শব্দটি আজ বড়ো বেশি গোলমেলে ঠেকে।
কে যে লেখে ধ্বংসগাথা---এমন নিঃশব্দে,  অলৌকিক ? 
যেমন পতঙ্গ ধায় আগুনের দিকে
তোমার ক্ষুধার্ত গ্রাস
ঝলসে খাচ্ছে বুদ্ধি, স্মৃতি ; অপোহন হে আত্মবিনাশ, 
পুরাণ তো ইতিহাসই।কতিপয় বুদ্ধিজীবী তবু
তাওয়া-গরম রুটির লোভেই
নিজেদের থুথু গেলে, দানাপানি, নুন ও বাতাসা।
আর তুমি তামাশা দ্যাখ, ছাদে ওঠো, শিস দাও এই বয়সেও ! 

বয়স বেড়েছে বুঝি? দাঁতে ধার, টুঁ শব্দটি যে কোন প্রান্তের 
নড়ে ওঠে, সাড়া দিই, দেখি 
মাৎস্যন্যায়, উটযুদ্ধ --আয়েশা এখনও তরিবারি
ঘোরাচ্ছেন; দৃশ্যের ভিতর গাঢ়, ওতপ্রোত,  সেঁধিয়ে আমূল, আছি নিসর্গসমেত। 
এক কবির্মণীষী 
বিন্যাস করছেন শব্দ,চিত্রকল্প; খণ্ডকবিতার;
যুগ শেষ হয়ে এল, বিধান করছেন যথাতথ। 
একেই কি বিশ্বযোগ বলো! 
বুকে হাত দিয়ে দেখি, তিলার্ধও আকাশ রাখিনি। 
কার্নিশ ভেঙে পড়ছে, ফ্লাই-ওভার ; সালভাদোর দালি
গলাচ্ছেন পকেটঘড়ি, চতুর্মাত্রিক। 
তবু আমি ছাদে উঠি, 
দূর ছায়াপথ থেকে 
তুলে নিয়ে আসি কিছু তারা। 
নারীর হৃদয়ে তারা প্রেম হয়, শিউলিফুলের মতো অগ্রহায়ণে জেগে থাকে।
আমার কি ধর্ম আছে ? 
যদি থাকে, আয়তনবান, শুধু বলি---
সমবেত একটি হৃদয়, সাম, গান হয়ে ওঠো ।

যতটা ভেবেছি তুমি তারও বেশি নিষ্ঠুর ও পরিহাসপ্রিয়, হে সময় ! 
যে বৃক্ষের ঝুরিগুলো সুগভীর মাটির নীচেই
যেন সমান্তর থাম, 
ধরে রেখেছিল দৃঢ় পৃথিবীর ছাদ , 
আমরা সেই বোধিগাছ মূলসমেত উপড়ে ফেলেছি ; 
তারপর খ্রিষ্টের নামে, কখনও আয়াত আওড়ে, 
সংহিতা চিবিয়ে ধূর্ত, হিংস্র হয়ে উঠেছি বার বার।
মৃত-সাগর খুব দূরে বুঝি ! 
নিকটে যে সেমেটিক পাথর-নগর, কিছু দূরে 
ক্রীট ও অ্যাজটেক, মায়া ;
আমরা তো সামান্য জন, নদীতমে তুমি সরস্বতী, 
কীভাবে যে লুপ্ত হলে? কীভাবে যে নেভা-নদী  তার 
ভেসে থাকা নৌবহর, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, 
ব্যক্তিগত লোভ ঈর্ষা আধিপত্যকামী মানুষের, 
দেখেছিল ধস আর নদীর ভাঙন।
ভুগর্ভে শুকিয়ে আসে জল ?
জঠরে অসহ্য ক্ষুধা, নান্দনিক নিষ্ঠুরতায়
খেয়ে ফেলি শস্যবাড়ি, ভূতকাল ; আমাদের খণ্ডকবিতার 
দিন শেষ হয়ে এল? অনন্তের ছটাকখানেক আলো 
মেঘের কিনার ভেঙে উপচে পড়েছে ,  সংকেত পাঠায়,  ক্রমাগত !  

ঋষি অথর্বানের আজ্ঞায়

মশক পাহাড় ছেড়ে তুমি তো কাঁকড়াদাঁড়া গিয়েছ ক'বার।
একটি বার বলে দ্যাখো ,কাঁকড়াটি দাঁড়ার বিষ তুলে নেবে, ছত্রাকের মতো 
যা বিস্তার করছে বংশ ,ঘিলু খাচ্ছে, ফুসফুসের স্বাদু মাংস, সুকোমল প্লীহা ও যকৃত। 

সন্তানের কাতরতা তাঁকে  বড়ো বিহ্বল করে

আমি কি পিতার সংগে এক, তুমি বিশ্বাস করো?
তা যদি বিশ্বাস কর 
মুহূর্তে  শিথিল হোক সকল সংশয়-গ্রন্থি,
ভাঙুক মাটির ঘট, এই বিদেহ আমি
খুলে ফেলছি পঞ্চকোষ, অন্নদেহ, আতিবাহিক, 
বিশ্বাস সত্য হোক, অন্ধ যেরকম ফিরে পেয়েছিল চোখ,  
যেরকম ত্বক থেকে নিমেষে উধাও হয়ে গিয়েছিল কুঠ, 
তোমার দৃষ্টির নীচে 
ভবন্তু সুখীনঃ সর্বে, সন্তু নিরাময়।

এই নাও আয়ু তবে, নাও ক্ষুদ্র জীবৎকাল, আয়ু। 
শান্তি, শান্তি, ওঁ শান্তি ; ভেদ করুন অগ্নি মিত্র বায়ু ও বরুণ 
ষাটকৌশিক এই দেহ,পঞ্চ প্রাণ ; ঋষি অথর্বানের আজ্ঞায়
ধায় বাক, ব্রহ্মবাক ৷  ওষধিসকল 

যাও শুশ্রুতের কাছে , হে শুশ্রূষা ওসিমার্টিনিব*
তৃতীয় পুরুষে জন্ম
শোণিতপ্রবাহে  ধাও , ধাও করোটির নীচে, 
ধংস করো, শুষে খাও 
ত্বরিতে সমূহ কূট বিষ 
(এ-টি একটি আধুনিকতম টারগেটেড থেরাপি)


শব্দতান্ত্রিক এক কবি

এই তাঁর আসন। রোজ দেখি -----
শব্দদের উপর ঠায় অর্ধ-উন্মাদ এক কবি, সমকায়- শির ও গ্রীবা, দূরাগত তারাদের সংগে কথা বলে। জনমনিষ্যিহীন 
চার দিকে মৌনী গাছ,  বৈঁচিবন,  হু হু হাওয়া; দূরে 
শিয়াল ক'টি হাঁক পাড়ছে প্রহরে প্রহরে : 
আয়ু গেল।
আয়ু যায় -------
দণ্ড ও মুহূর্ত  ধায়, ধায় চন্দ্র মেঘের ভিতর ; শেষ যামে
হঠাৎ-ই দেখলেন কবি, নড়ে উঠছে শঙ্খিনী বাক। 
বাক কি অম্ভৃণ-কন্যা,  নাকি যমী, আদি সহোদরা?
লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি চন্দ্রালোকিত
তার নগ্ন মসৃণ উরু, অমর্ত্য নিতম্ব, শ্রোণীভার, আর শব্দ-তান্ত্রিক সেই কবি
পাঠ করছেন মন্ত্র ---
মন্ত্রের ভিতরে গুপ্ত ঋষি অথর্বান
বললেন, শব্দরা হোক  কবির সমিধ, যথাযথ  বিনিয়োগে কবি
ঈশ্বরের সমতুল, প্রতিস্পর্ধী ; দেবী 
স্বয়ং গমন করবেন, সম্ভাষণ ও পানপাত্র হাতে।


আর এক বিশ্বরূপদর্শন

বুঝতেই পারছি না, ঠিক কোন বাঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছি, সনাতন ! 
বাঁ'দিকে তো লালগড়, 
মাকড়া পাথর ভেঙে মায় কোনো শুঁড়িপথ 
দেখাই যাচ্ছে না।
দশ দিক গেরুয়াজল আসমুদ্র হিমাচল, এমনকী পাদদেশে চা-বাগানগুলি। 
তৃণহীন পাহাড় ও জংগল। 
এবার কি মেঘ ভেঙে রোদ উঠবে খুব? কমলালেবুর আভা মুখে মেখে বিনয় তামাং 
শুধুই আকাশ দ্যাখে ; বলো সনাতন---
ওই যে খেজুরগাছে কাকে বেঁধে পেটাচ্ছে ক'জন? 
হায় ঋষিগণ, আপনারা তো গোঘ্নই ছিলেন ! 
চুপ করে থাকবেন না ,কিছু বলুন ! 
বুঝতেই পারছি না 
কোন সমাপতনের দিকে বাঁক নিচ্ছে এই দেশ বহুত্ববাদীর ! 
আব্রহ্ম শুনেছি স্তম্ব তাঁর আবেশ, ক্রমাগত দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে এই চলা একদিন সম্পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাবে, মানুষেরা দেবকাম হবে? 
তবে এই কিশোরটিকে হত্যা করে কারা-বা ঝুলিয়ে গেল গাছে? 
চেতাবনি লিখে রেখে গিয়েছিল পিঠে? 
আর এই যে পাঁজর নিঙড়ানো হা-হা
সারা ভাঙিপাড়া জুড়ে, 
একেই কি দ্বান্দ্বিকতা বলো? 
মাও সে তুং একদিন পৃথিবীর শেষ পয়গম্বর ছিলেন। 
এবং হ্রদের তীরে বক তাঁকে জিগ্যাস করলেন : বার্তা কী ? 
নিঃশঙ্ক উত্তর ছিল : বন্দুকের নল।
এবং বসন্তকাল। চমকাল বিদ্যুৎ। 
জমানো ধুলো ও বালি, মেঘে মেঘে গর্জে উঠল বাজ। 
সকল কদলিগাছ বুক পেতে ধারণ করল বজ্রসুঁই ৷ 
বাকিটুকু ইতিহাস, আমাদের কাবা আর ফাঁসিদেওয়া গ্রাম। 
আমরা বুঝিনি সেই হাতের তালু ও তার পাঁচ-আঙুল নীতি,
বুঝিনি ফেরেব্বাজ সুচতুর হাসি।
তারও আগে স্তালিনের বুট প'রে আমাদের লিকলিকে পা, 
হাভানা চুরুট থেকে ছড়িয়েছে বিস্তর ধোঁয়া।
সত্যিই রেশমপথ আমাদের কোনো দিন ছিল?

অতিকায় বাদুড়ের মতো অন্ধকার ঝুলে আছে মাথার উপর। 
আমরা রোদ্দুর হতে চেয়ে অবিমৃষ্যকারিতায় 
আরও ঢের অন্ধকারে আত্মহা হয়েছি। 
তবু বলো, যুদ্ধ করো, ঘরের ভিতর ঘর, ভাঙো ! 
বুঝতেই পারছি না সনাতন, 
তোমার দাঁতের খাঁজে কার কার চূর্ণিত মাথা, মাংস লেগে আছে?
তিনি আসবেন

এখন সময় হল বুঝি ! কিংবা আজও হয়নি সময়। 
ব্রততীকে ভালোবেসে অশ্বত্থ তরুটি ক্রমাগত 
ব্রততী হয়েছে ! 
কে কার স্বরূপ পাবে, ঊর্ধ্বমূল অধঃশাখ আমি 
চাইনি অসঙ্গ শস্ত্র, চাইনি ইঁদুরগুলি কেটে দিক অবান্তর মূল। 
কেননা অপ্রাসঙ্গিক বলে কিছু নেই। শুধু
প্রকরণ-আঙ্গিক বদলায়।
তিনি আসবেন। এবং 
এই সেই গর্ভকাল, আমাদের কোয়ারেনটাইন। 
কে-বা  আনন্দ ছাড়া বাঁচতে চেয়েছে ? 
পৃষ্ঠারা হলুদ হয়ে গেছে, তবু শৌনক ঋষি
ভুবন সোমের মতো পৃথিবীকে আশ্চর্য এক কবিতা জেনেছেন :
দেবতার এ-কাব্য মরে না , মাত্র তার জীর্ণ শরীর বদলায়। 
এই কি তপস্যা নয় ? পৌনঃপুনিক 
সহন করেছি তাপ, ঝরিয়েছি মেদ আর অভ্যাসতাড়িত ভূভার। 

কল্প যায়, কল্প আসে, জলজ শৈবাল ক্রমে স্থলবাসী ; উষ্ণ,স্যাঁতসেঁতে মাটি, জলে ও কাদায় সেইসব 
কনিফার দানব বৃক্ষেরা শুয়ে আছে , আর মেসোজয়িক প্রাণীরা
স্তন্যপান করে চলে গেছে। 
আমিও সস্নেহে 
বুকের পাঁজর ফেঁড়ে হিমবন্ত, আন্দিজ ও রকি,
মানবের জন্য ফুল, ফলের গোপনে বীজ লুকিয়ে রেখেছি। 
চতুর্থ তুষার যুগ এল।
এখন সময় হল তার , কিংবা আজও হয়নি সময়। 
ব্রততীকে ভালোবেসে তরুটি কি ব্রততী হয়েছে ? নাকি 
ব্রততী অনেক দূরে থাকে ?  

যে উল্লাস উপচে পড়ে আনন্দের প্রচুরতা থেকে, 
আমি সেই আদি ক্ষেত্র, 
ভেঙে ভেঙে টুকরো হই, অগ্নি ও আদিত্য হই,
মাটি ও আকাশ হই, চ্যূত কোন নক্ষত্রের দেহ থেকে প্রতিরূপ গড়ি। 
এবং ঘুরে ফিরে আসি , দেখে যাই ---
মানবের মগজের ভিতর হৃদয়
কতখানি প্রশস্ততা পেল। 
কেননা কোয়ান্টাম লাফে 
যখন মস্তিষ্ক তার বিস্ফারিত  হল, 
যখন সে  জয় করল অন্ধকার, হিম আর ভয় 
সে আত্মকেন্দ্রিক হল। ভেঙে গড়ল বিকল্প ভুবন। 
শুধুই বিচ্ছিন্ন হল, মাকে ভুলল, 
বিচ্ছিন্ন, বিচ্ছিন্ন আর বিচ্ছিন্ন হতে হতে
একদিন সে হত্যা করল সহোদর, সহোদরা,  প্রিয় নদীদের ;
দোহন করল মাটি, মাটির গোপন শস্য, বাতাসের মধু। 
অথচ সুকৃত এই দেহ।
অথচ হৃদয় ছাড়া অন্নগত মানুষের প্রাণ 
রাক্ষসের মতোন আত্মহা, 
পণ্ড করে বহুহিতে যে যজ্ঞ, সুখায়। 
এবং সময় হয়ে এল। 
কেননা সময় ও তার মন্থরতা ক্রমে 
বাড়ায় ত্বরণ , যেন মহাজাদুকর 
জাল দিয়ে চলেছেন ফুটন্ত কড়াইয়ে, নীচে গনগনে আগুন। 
বইছেও উত্তুরে হাওয়া, ইউহান থেকে আততায়ী । 
পুরনো লক্কড় যত, মূল্যবোধ, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং বাজার, 
ভূস্বর্গে বরফ পড়ছে, বরফের ভিতর আগুন,
দেখে আসি---
কীভাবে গলানো হচ্ছে ভেঙে চুরে টুকরো টাকরা, নীলনক্সা হাতে।  

এদিকে অশ্বত্থ তরু এবং ব্রততী
ক্রমশই ঘন হয়, শ্বাসাঘাতে, চতুর্থ মাত্রিক
---------

Post a Comment

5 Comments

  1. 'শব্দরাও একরকম আত্মহত্যাপ্রবণ' লাইনটি খুব ভালো লাগলো!

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  3. শাশ্বতী সান্যালJune 1, 2020 at 12:59 PM

    প্রতিটি লেখাই অনন্যপূর্ব ও অসামান্য

    ReplyDelete
  4. অসামান্য। প্রতিটি লেখাই স্তব্ধ করে দেয়

    ReplyDelete