জ্বলদর্চি

পি বি শেলি / সন্দীপ কাঞ্জিলাল


"যুদ্ধ হচ্ছে রাজত্বকারীর খেলা, ধার্মিকের আনন্দ, আইনজীবীর আগ্রহ, অস্ত্র কারবারীর ব্যবসা।" -- পার্সি বিসে শেলি।

শেলি
(০৪/০৮/১৭৯২ - ০৮/০৭/১৮২২)

 স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল 

হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি সারা গায়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। স্বপ্নে দেখলাম, মাঝ সমুদ্রে প্রচণ্ড ঝড়! একটা পালতোলা নৌকা ডুবছে। অন্য একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন তা লক্ষ্য করে বলল,  "চলে আসুন, অথবা পাল নামিয়ে নিন।" ক্রুদ্ধভাবে নৌকার আরোহী উত্তর দিচ্ছে 'না'। নৌকা তিনটি পাল সমেত আরোহী, নাবিক আর তার বন্ধুকে নিয়ে ডুবে গেল। স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুবরণ। এ যেন 'কবিতার রাজা' 'বোদল্যের' এর লেখা, মৃত্যু হল এক 'সুস্বাদু যন্ত্রণা'। যে মৃত্যু চেয়েছিলেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক কবি, ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, "আমার স্বপ্নের মৃত্যু দৃশ্যটি অন্য এক কবি অনেক আগেই চুরি করে নিয়েছেন। নৌকায় কিছু সুখাদ্য, মহার্ঘ পানীয়, মনের মতো বই। তারপর নিজস্ব নৌকায় ভেসে যাওয়া, হঠাৎ ঝড়! ভেঙেচুরে উল্টে যাবে নৌকা। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবো। সে এক স্বর্গীয় মৃত্যুদৃশ্য"।
যে কবি এই স্বপ্ন দৃশ্যটি চুরি করেছেন তার নাম - 'পার্সি বিসে শেলি'। তিনি জন্মেছিলেন লন্ডনের সাসেক্সে ৪ঠা আগস্ট ১৭৯২। বাবা সংসদ স্যার টিমোথী আর মা এলিজাবেথ পিলফোর্ড। তিনি ছিলেন ক্ষণজন্মা। সংসদের সন্তান। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিকে ঘৃণা করতেন। তাই হাতে তুলে নিয়েছিলেন কবিতার বিদ্রোহী জাদুদণ্ড। তিনি পড়াশুনা করতেন ইটনের এক নামকরা স্কুলে। পরনে বিদঘুটে পোশাক, কলার-খোলা জামা, জ্যাকেট মাথায় টুপি। স্কুলের সহপাঠীরা তার পেছনে লাগতো। ভেংচি কাটতো, কেউ কেউ বলতো 'পাগলা শেলি'। এরপর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। এখানে এসে পড়লেন টমপেন, কঁদরসে প্রভৃতি বৈপ্লবিক লেখকদের রচনা। লিখলেন 'নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা' নামে এক বিপজ্জনক ইস্তাহার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া। অবশেষে ১৮১১ সালে উনিশ বছর বয়সে হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রুক নামে এক ষোল বছরের কিশোরীকে নিয়ে অন্তর্ধান। ধর্ম ও বিয়েতে বিশ্বাস না করলেও, এডিনবরায় হ্যারিয়েটকে বিয়ে করলেন তিনি।  যিনি পরবর্তীকালে লিখবেন বিদ্রোহের মহা কবিতা 'প্রমেথিউস আনবাউন্ড'।
অত্যন্ত সুদর্শন শেলি বহু নারীর স্বপ্নের পুরুষ, ইংল্যান্ডের তরুণরাও শেলির হাঁটা অনুকরণ করতো। তারই মতো কথা বলতো। তাকিয়ে থাকতো একই স্বপ্নময় দৃষ্টিতে। 
কিন্তু শেলি কি কখনো কাউকে ভালোবেসেছিলেন? নাকি মহাভারতের তৃতীয় পাণ্ডবের মতো মাত্র তিরিশ বছরের জীবনে বারংবার সরে গেছেন এক নারী থেকে অন্য নারীতে?  
প্রথম বিয়ে করেন হ্যারিয়েটকে। তিনি বছরের পর ১৮১৮ সালে ঘটে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ। ১৮১৪ সালে হ্যারিয়েট দুই সন্তান 'আয়ানথ', ' চার্লস' কে নিয়ে শেলির জীবন থেকে সরে যান। শেলি তখন দার্শনিক গডউইন কন্যা 'মেরির' প্রেমে হাবুডুবু। মেরি ও তার সৎ বোন 'ক্লের'কে নিয়ে সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে গেলেন। আটবছর চলল তাদের এই ত্রিকোণ প্রেম। শেলি এই সময় লেখা শেষ করেন তার উপন্যাস 'হত্যাকারীরা'। 

১৮১৬ সালে প্রথম স্ত্রী হ্যারিয়েট সারপেন্টাইন লেকে ডুবে আত্মহত্যা করলেন। এবার তিনি মেরিকে বিয়ে করলেন। যে মেরি তখন লিখেছেন তার বিখ্যাত উপন্যাস 'ফ্রাঙ্কেনস্টাই'। আর শেলি লিখেছেন 'হিম টু ইন্টেলেকচুয়াল বিউটি'।
শেলি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, কবিরা পারেন, শুধু কবিরাই পারেন এক ন্যায়হীন, নিপীড়নছিন্ন পৃথিবীকে দিশা দেখাতে। কবিরাই মানবজাতির পতাকাহীন বিধায়ক। 
যখন শেলির বন্ধুরা (লি হান্ট ও কীটস)  রোমান্টিক কবিতায় ঝড় তুলছেন। তখন তিনি টেমস নদীর পাশে গ্রেট মার্লোতে বসে লিখছেন 'ইসলামের বিদ্রোহ'। শেলির স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। পাওনাদারদের তাড়া, লোকের ঘৃণা ও ক্রোধের আক্রমণে দিশেহারা শেলি, চরম হতাশায় মদ ও আফিমের সংমিশ্রণে তৈরি 'লডেনাম' গ্রহণ করতে থাকেন। শেষপর্যন্ত মেরি ও শিশুপুত্র উইলিয়ামকে রেখে শেলি ইতালি পালিয়ে গেলেন ১৮১৮ সালে। রেখে গেলেন স্বর্ণাক্ষরে লেখা সনেট ও রোমান্টিকতায় ভরা ইংরেজি কবিতা। 
ইতালিতে এসে গ্রিক থেকে অনুবাদ করলেন প্লেটোর 'সিম্পোজিয়াম' স্প্যানিশ থেকে 'কালদেরন' জার্মান থেকে 'গ্যোয়েট, ইতালিয়ান থেকে 'দান্তে'। বায়রনের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে লিখলেন 'জুলিয়ান আ্যন্ড মাজলো' কবিতা। এখানেই এক কন্যা সন্তানকে দত্তক নিলেন, লিখলেন  বিষাদে পরিপূর্ণ কবিতা 'স্ট্যানজাজ রিটন ইন ডিজেকশন'।১৮১৯ সালে বসন্তকালে লেখা শেষ করলেন, সেই বিদ্রোহের মহা কবিতা 'প্রমেথিউস আনবাউন্ড'। 
 ছোট্ট মেয়ে ক্লারা আর প্রিয় সন্তান উইলিয়ামের মৃত্যু, স্ত্রী মেরির স্নায়ুবিপর্যয়। এই ১৮১৯ সাল থেকে লিরিক কবিতার ফোয়ারা। মৃত্যু পর্যন্ত  তিন বছর ধরে লিখবেন সব শ্রেষ্ঠ কবিতা। 'ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড', 'টু-লিবার্টি', 'টু নেপলস', 'টু আ স্কাইলার্ক', 'দ্য ক্লাউড' ইত্যাদি।  আর ক্রুদ্ধ রাজনৈতিক কবিতা 'সঙ টু দ্য মেন অফ ইংল্যান্ড', কাব্যনাটক 'দ্য  চেঞ্চি'।
২৯ বছর বয়সে এসে লিখলেন কবিতার বিখ্যাত প্রস্তাবনা 'ডিফেন্স অফ পোয়েট্রি' আর অসংখ্য লিরিক। 
এই সময় পরিচয় ঘটলো ইতালিয় অসামান্য সুন্দরী এমিলিয়ার সঙ্গে। আবেগপ্রবণ শেলি তাকে নিয়ে লিখলেন এক আশ্চর্য শাশ্বত রোমান্টিক কবিতা 'এপিসাইকিডিয়ন' যার অর্থ 'প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিলন'। তারপর লিখলেন 'সোলস সিস্টার'। অনেকেই বলেন যা থেকে কবি 'জীবনানন্দ দাশ 'ক্যাম্পে' কবিতায় ব্যবহার করেছেন 'হৃদয়ের বোন' শব্দটি। 
এরপর মৃত্যু পথযাত্রী, যক্ষাগ্রস্ত শ্রেষ্ঠ কবি 'কীটস'এর রোমে পৌঁছানোর খবর এল। তিনি 'কীটস' কে আমন্ত্রণ জানালেন। 'কীটস' আসবেন বললেন। কিন্তু তার আগেই, কবি 'কীটস' এর নাম লেখা হয়ে গেল 'জল' দিয়ে। সেই মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শেলি লিখলেন এক হৃদয় মোচড়ানো শোক গাথা 'আ্যডোনেস'। কীটস এর সমাধি দেখে শেলি বলেছিলেন, "এই সমাধিক্ষেত্রটি সবচেয়ে সুন্দর।" তিনি তখন জানতেন না তাঁরও সমাধি হবে এখানে, মাত্র এক বছরের মধ্যে। 

ইতিমধ্যে এক বন্ধুপত্নী 'জেন উইলিয়ামস'কে নিয়ে লিখেছেন চারটি বিখ্যাত কবিতা তার মধ্যে একটি 'টু জেন'।
এইসময় শেলির কাছে হাজির 'লি হান্ট', ও 'বায়রন'। শেলি আবার নতুন উদ্যমে লিখলেন গ্রিক স্বাধীনতা -সংগ্রাম প্রভাবিত তাঁর সর্বশেষ কবিতা 'হেলাস'(১৮২২)।
শেলি নিজে নাস্তিক। তাই তাঁর কবিতায় দেখা যায় নাস্তিকতার প্রভাব। প্লেটোর এবং এডুনিয়নের দর্শন দ্বারাও তিনি  প্রভাবিত হন। তাঁর নিজস্ব একটা দর্শনও ছিল। রোমান্টিক যুগের অন্য কবির মতো তিনিও ছিলেন মানবদরদী। তাই তাকে বলা হয়,--'The poet of hope in despair'। অনেকে বলেন শেলির কবিতা ভাবপ্রধান। কিন্তু এই শেলির কবিতা বাংলা সাহিত্যে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী, কবি জীবনানন্দ দাশ সহ অনেকের উপর তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর থেকে বোঝা যায় তিনি কত বড় মাপের কবি ছিলেন। 
এত লিখেও তবু মন ভালো নেই। এত লিখেও মেরুদণ্ড ভাঙা সাহিত্যের পাইকারি বাজার তাঁকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। অনেক প্রবঞ্চনা, প্রতিকূল পরিবেশ ও হতাশার শিকার হয়েছেন। তা সত্বেও তিনি তাঁর স্বল্প পরিসর জীবনে ইংরেজি সাহিত্যে যা দিয়ে গেছেন তা রীতিমতো অবিস্মরণীয়, অতুলনীয় দুর্লভ। 
এই সময় শেলিকে পেয়ে বসেছে এক মারণ খেলা। বিদ্যুৎগতিতে সমুদ্রে নৌকাবিহার।তাঁর নৌকাগুলির নাম, 'এরিয়েল','ডন জুয়ান', এবং 'স্কুনার'। সমুদ্রপথে 'লিভোরনো' থেকে ফিরছিলেন। আর এই পথেই পেয়ে গেলো মৃত্যুর 'সুস্বাদু যন্ত্রণা'।সমুদ্রের বালিয়াড়ির উপর পড়ে থাকলো, এক উৎকণ্ঠা, এক আশা, আর নির্যাতন, যা কর্কশ আর সুস্বাদু, যা চেনা জানা পৃথিবী থেকে তাঁকে ছিন্ন করে, মুক্ত করে দিল। কী কষ্টকর আর তৃপ্তিদায়ক সে যন্ত্রণা।সারাজীবন একটু একটু  পুড়তে পুড়তে, এবার গেলেন চিরবিশ্রামে। সব পথ মিশে গেলো রোমে।

------

Post a Comment

2 Comments

  1. বাহুল্যহীন বিস্তৃত রচনা। পড়ে আনন্দ পেলাম/ পার্থ প্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর মিঠে রোদ্রুর মহাজাগতিক অশ্রুবিনোদন l

    ReplyDelete