জ্বলদর্চি

শ্রীঅরবিন্দ : স্বামী ও আসামী পর্ব- ৩


শ্রীঅরবিন্দ : স্বামী ও আসামী 

পর্ব- ৩

মু ক্তি দা শ  

“Two men looked out from prison-bars,

One saw the mud and other saw the stars!”

স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া মৃণালিনীর সেইসব চিঠিগুলি – যা এতকাল হৃৎপিন্ডের মতো তার জীবনকে স্পন্দিত করেছিল, যা ছিল তার একান্ত নিজস্ব, গোপন স্মৃতির ঝাঁঝালো অনুভূতি – এখন বিচারকের টেবিলে কেমন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে!

আসামীর কাঠগড়ায় অরবিন্দ। মুরারীপুকুর বোমা মামলার প্রধান আসামী অরবিন্দ ঘোষ। মূল ষড়যন্ত্রকারী। রাজদ্রোহী। দীর্ঘদিন হাজতবাসে শরীর ভগ্ন, ক্লিষ্ট, অবসাদগ্রস্ত হলেও ঋজু। সারা মুখমন্ডলের মধ্যে চোখ দুটিই শুধু প্রখরদীপ্ত। যেন এক অনির্বচনীয় আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে!

আলিপুর জজ আদালতে জেলা ও দায়রা জজ মিঃ চার্লস পোর্টেন বীচক্রফ্‌ট (Mr. Charles Porten Beachcroft)-এর আদালতে মুরারীপুকুর বোমা মামলার সূচনা হয়েছিল সেই ১৯০৮ সালের ১৯শে অক্টোবর। এখন ১৯০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মামলার অন্তিম পর্যায়। সরকারি পক্ষের কৌঁসুলি মিঃ ইয়ার্ডলি নর্টন (Mr. Eardley Norton) গত ৪ই মার্চ তাঁর সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব সমাধা করেছেন। প্রায় দু-সপ্তাহ ধরে সওয়ালও করেছেন। তারপর অন্যান্য সহ-আসামীদের পক্ষে বিভিন্ন আইনজীবীরাও রেখেছেন তাঁদের জোরালো বক্তব্য। এবার চিত্তরঞ্জন দাশের পালা। চিত্তরঞ্জন অরবিন্দের পক্ষে কৌঁসুলি। প্রথমদিকে অরবিন্দের পক্ষে কৌঁসুলি দাঁড়িয়েছিলেন আইনজীবী ব্যোমকেশ চক্রবর্তী। পরে চিত্তরঞ্জন দাশ। যদিও চিত্তরঞ্জন তখন ‘a briefless Barrister with little Court-room experience’। জীবনের বেশিরভাগ সময়্ই তো তিনি সাহিত্যসাধনা ও দেশসেবায় নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে। গভীর আইনচর্চার আর সময় কোথায়? কিন্তু এই মামলার কথা আলাদা। এই মামলা ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর চ্যালেঞ্জ। এ যেন আইনব্যবসার মলাটে প্রচ্ছন্ন দেশসেবা।

চিত্তরঞ্জন তাঁর সওয়াল শুরু করলেন এইভাবে – “May it please your Honour and gentlemen assessors. It is a matter of congratulation for us all that at least this trial has come to a close. It is especially a matter of congratulation for the prisoners at the bar because they have been in jail for the best part of a year and the time has now come, gentlemen, for you to consider the evidence which have been placed before you."

মিঃ নর্টন অরবিন্দকে দোষী ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দেখাতে মূলত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘বন্দে মাতরম’ ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কিছু নিতান্তই পারিবারিক চিঠিপত্র এবং স্ত্রীর কাছে লেখা অরবিন্দের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি। চিত্তরঞ্জন তাঁর সওয়ালের প্রথমদিকে আলোচনা করলেন সেইসব পারিবারিক চিঠিগুলো নিয়ে যা রাজদ্রোহিতার ক্ষেত্রে বারীন ঘোষ ও অরবিন্দ ঘোষের সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেছে বলে মিঃ নর্টন তাঁর তীক্ষ্ণ আইনীচাতুর্যে প্রমাণ করে গেছেন। এবং তারপরই তিনি এলেন মৃণালিনীকে লেখা অরবিন্দের চিঠিগুলোর প্রসংগে। আইনের শানধার ছুরিতে মিঃ নর্টন এই চিঠিগুলোর ভাষা ও বক্তব্যকে এমন পেঁচিয়ে ফালা ফালা করেছেন যেন মর্গের টেবিলে শোয়ানো শবের ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু চিত্তরঞ্জন ছাড়বার পাত্র নন। প্রথমেই তিনি ২রা জুলাই, ১৯০২ তারিখে অরবিন্দের বাংলাভাষায় লেখা একটি চিঠি পাঠ করেই প্রশ্ন রাখলেন – “How do you find Sedition or Waging of war against the Government in this letter?”

এরপর ২০ আগস্ট, ১৯০২ সালের একটি চিঠি। চিঠিটি ইংরেজিতে লেখা। এবং মৃণালিনীকে। এটিও আদালতক্ষে পাঠ করলেন চিত্তরঞ্জন। আগাগোড়া। চিঠিতে সত্যিই সন্দেহজনক কিছু ছিল না। শুধু –

চিত্তরঞ্জন বললেন – “This letter refers to his promotion and so on. There is nothing important in that letter except that soon before that time Arabinda considered himself a strict member of the Hindu-Society. Those are all the letters which we get and which we preserved to give us an idea as to what the trend of his mind was in 1902.”

এবার চিত্তরঞ্জন ১৯০৫ সালের ৩০শে আগস্ট স্ত্রীকে লেখা অরবিন্দের সেই বিতর্কিত মননশীল দাশর্নিক ভাবসমৃদ্ধ দীর্ঘ চিঠিটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে প্রয়াসী হলেন। চিঠিটির এক জায়গায় সেই যেখানে লেখা আছে – “…তুমি কি কোণে বসিয়া কাঁদিবে মাত্র, না তার সঙ্গেই ছুটিবে, পাগলের উপযুক্ত পাগলী হইবার চেষ্টা করিবে? অন্ধ রাজার মহিষী চক্ষুদ্বয়ে বস্ত্র বাঁধিয়া নিজেই অন্ধ সাজিলেন। হাজার ব্রা্‌হ্মস্কুলে পড়িয়া থাক তবে তুমি হিন্দু ঘরের মেয়ে, হিন্দু পূর্বপুরুষের রক্ত তোমার শরীরে, আমার সন্দেহ নাই, শেষোক্ত পথই তুমি ধরিবে।” –এর উল্লেখ করে চিত্তরঞ্জন বিচারক ও জুরীদের দিকে চেয়ে বললেন – “অন্ধ রাজার মহিষীকে নিশ্চয়ই আপনাদের স্মরণে আছে। এখানে পরোক্ষভাবে গান্ধারীর উপমাই দেওয়া হয়েছে – যিনি তাঁর জন্মান্ধ স্বামীর জন্যে দুচোখে কাপড় বেঁধে স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব বরণ করে দৃ্ষ্টিসুখ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন নিজেকে। মহামান্য আদালত, লক্ষ্য করে দেখুন, অরবিন্দ এই চিঠিতে নিজেকে ‘পাগল’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং স্ত্রীকে এই সিদ্ধান্তে আসতে বলেছেন যে, কোন পথ তিনি ধরতে চান? পরক্ষণেই গান্ধারীর দৃষ্টান্ত এনে তিনি এই সত্যের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে, যেহেতু মৃণালিনীর শিরা ও ধমনীতে হিন্দুধর্মের রক্ত প্রবাহিত, সেইহেতু মৃণালিনী যে তাঁর কর্মধারা পথ অবলম্বন করবে – এ তাঁর স্থির বিশ্বাস। The life is sketched out here he followed literally. একটা মানুষ তার সারা জীবনের উপার্জন অকুন্ঠচিত্তে দেশের মঙ্গলসাধনের জন্যে, দেশবাসীর সেবার জন্যে ব্যয় করে গেল। ‘আমার যাহা পরিবারের ভরণপোষণে লাগে, আর যাহা নিতান্ত আবশ্যকীয় তাহাই নিজের জন্য রাখিয়া খরচ করিবার অধিকার, যাহা বাকী রহিল, ভগবানকে ফেরৎ দেওয়া উচিৎ’ It is his duty to spend as little as possible for himself for the purpose that he may continue to live and to give the rest to God. How? By doing God’s work, namely, by feeding those who are hungry and by assisting those who are in need. It is then and then only that you can give back what you owe to God. If a man does not do it he is then a thief. It is not for his own selfish end. He is determined to lead that life. He will keep for himself only what is absolutely necessary for bare subsistence and the rest he will give back to God. The only way you can do that is by way of charity, by feeding the hungry and by rendering assistance to those who are in need of it."

অরবিন্দ ওই চিঠিরই একজায়গায় লিখেছেন : “আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি। মার বুকের উপর বসিয়া যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত, তাহা হইলে ছেলে কি করে? নিশ্চিন্তবোধে আহার করিতে বসে? স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আমোদ করিতে বসে? না, মাকে উদ্ধার করিতে পৌরহিত্য করে?”

চিত্তরঞ্জন তাঁর বৈদগ্ধপূর্ণ সওয়ালে এরও সুচারু ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন : “What is the meaning of that? It is only an analogy. He says that he regards his country not as merely a collection of fields, hills, rivers and so forth but her as his mother. Does not it mean that regarding the fact that the country is in a wretched condition, it is far away from freedom, it is in bondage? So it is the duty of every man in India to see himself to realize the ideal of freedom. His basis of patriotism is that he regards his country as mother.

মৃণালিনীকে লেখা অরবিন্দের ১৯০৭ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি তারিখের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠিতে লেখা ছিল : “8th জানুয়ারি আসিবার কথা ছিল, আসিতে পারি নাই, সে আমার ইচ্ছায় ঘটে নাই। যেখানে ভগবান নিয়া গিয়াছেন সেইখানে যাইতে হইল। এইবার আমি নিজের কাজে যাই নাই, তাঁহারই কাজে ছিলাম। আমার এইবার মনের অবস্থা কিরূপ হইয়াছে সেকথা এই পত্রে প্রকাশ করিব না। তুমি এখানে এস, তখন যাহা বলিবার আছে, তাহা বলিব। কেবলই এই কথা এখন বলিতে হইল যে, এরপরে আমি আর নিজের ইচ্ছাধীন নই, যেইখানে ভগবান আমাকে নিয়া যাইবেন, সেইখানে পুতুলের মত যাইতে হইবে, যাহা করাইবেন তাহা পুতুলের মত করিতে হইবে।…”


চিঠির এই অংশের বিশ্লেষণে চিত্তরঞ্জন বললেন : “This letter shows where he did go, various witnesses also spoke about it in the course of the trial. The contents of the speeches he delivered will show in what way  and other saints engaged in, were based on religion. Your Honour will see how Arabinda’s convictions were getting deeper and deeper everyday. You are familier with the Hindu thought on the point. In this connection I may point out to Your Honour the utterances of Ramkrishna Paramhansa and other saints. The man considering himself as the actor is in consistent with the principles of Hindu religion, the very essence of which is তমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র, i.e. you are the player of the instrument and I am the instrument itself. You are also aware of the line in the ‘Geeta’ – ত্বয়া হৃষিকেশ হৃদি স্থিতেন যথা নিযুক্তো্স্মি তথা করোমি। i.e. Thou dwellest inside me and I do whatever Thou dost engage me in. Does it suggest Bombs? It marks the beginning of his religious convictions. Arabinda says further on in the letter that God will show His mercy her also, He will show her also the way. Does it suggest that his wife is to join the conspiracy and engage in the preparation of Bombs to kill Englishman?”  

ওই চিঠিরই শেষদিকে, যেখানে লেখা আছে – “এই পত্র কাহাকেও দেখিতে দিবে না। কারণ যেকথা বলিয়াছি, সে অতিশয় গোপনীয়। তোমায় ছাড়া আর কাহাকেও বলি নাই, বলা নিষিদ্ধ।” – এই অংশের উল্লেখ করে চিত্তরঞ্জন বললেন : “That portion of this letter which says, বলা নিষিদ্ধ – i.e. what writes is not allowed to divulge. If a man takes the ‘মন্ত্র’ he is not to divulge it to any one, even to his wife unless he gets permission from his ‘Guru’. Arabinda says that matter is ‘গোপনীয়’, i.e. secret. I submit that even if the language of this letter is strained no other construction could be put upon this. He says, ‘তোমাকে ছাড়া কাহাকেও বলি নাই, বলা নিষিদ্ধ’ i.e. I have not said it to anybody else except you and I am not allowed to divulge it. Why? If it is a matter of conspiracy, the conspirators know it. The Government translation of this is – ‘I have been specially forbidden to disclose it. I submit that this not a proper translation. The correct translation would be ‘it is not allowable’.   

এইভাবে একে একে চিত্তরঞ্জন তাঁর আইনের বিশ্লেষণী আলোর নিচে মেলে ধরলেন অরবিন্দ-মৃণালিনী তথা অন্যান্য সহ-আসামীদের উদ্দেশে লেখা বেশ কিছু বিতর্কিত চিঠিপত্র এবং পত্র-পত্রিকা যেগুলিতে ছিল অরবিন্দের লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ। জোরালো যুক্তি দিয়ে একেবারে নস্যাৎ করে দিলেন সরকারী উকিলের ক্ষুরধার সওয়াল। যে-ক’দিন চিত্তরঞ্জন সওয়াল করেছেন, সেই ক’দিনই অরবিন্দ স্তম্ভিত বিস্ময়ে অপলক তাকিয়ে রয়েছেন চিত্তরঞ্জনের দিকে। কি অসাধারণ শাণিত যুক্তি! কি সাংঘাতিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা! অরবিন্দ নিজেও কি কোনোদিন এইভাবে নিজেকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন? এতকাল অরবিন্দ তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে দিশেহারার মতো পথ খুঁজে বেড়িয়েছেন, অন্ধগলির গোলকধাঁধায় বারে বারে ঠোক্কর খেয়েছেন। আজ চিত্তরঞ্জনের বলিষ্ঠ হাত ধরে অরবিন্দ যেন সেই ঈপ্সিত পথের দিশা পেয়ে গেলেন। অরবিন্দ মুক্ত হলেন। এখন তাঁর পরিশীলিত মন অতিমানস সত্যের সন্ধানে ব্যাপৃত। কী সেই সত্য? অরবিন্দের কথাতেই তা শোনা যাক –“The power that governs the world is at least as wise as you and it is not absolutely necessary that you should be consulted or indulged in its management, God is seeing to it.”  

কংসের কারাগারে বন্দিনী দেবকীর গর্ভে লীলাময় কৃষ্ণের জন্ম জগতের পরিত্রাতা রূপে। আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কারাগারে অরবিন্দের মানসলোকে মহান পরিত্রাতা হিসেবে জন্ম নিল কৃষ্ণরূপী অধ্যাত্মবাদ। অগত্যা অরবিন্দকে পালন করতে হলো বসুদেবের ভূমিকা। কারাগারের উন্মুক্তপথে সেই কৃষ্ণরূপী আধ্যাত্মিক-চেতনাকে মস্তকে ধারণ করে সারা দেশময় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে তিনি এগিয়ে চললেন। তাঁর মস্তকস্থিত সেই সদ্যজাত অধ্যাত্মচেতনাবোধকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্যে বাসুকীনাগের সহস্রমুখী ফণার মতো যথারীতি মাথার ওপর জেগে রইল চিত্তরঞ্জনের সেই অবিস্মরনীয় সওয়ালের শেষ কয়েকটি লাইন –“…Long after this turmoil, long after this controversy will be hushed in silence, long after he is dead and gone he will be looked upon as the poet of patriotism, as the prophet of nationalism and the lover of humanity. Long after he is dead and gone his words will be echoed and re-echoed not only in India but across distant seas and land…”

অরবিন্দের সেই উদ্দাম পথচলা অবশেষে যে নন্দের আলয়ে এসে থামলো, তার  নাম-পন্ডিচেরী। এবং সেই অতিলৌকিক পথচলার সংগে তাল মিলিয়ে চলার সামর্থ বা উপযুক্ততা মৃণালিনীর আদৌ ছিল কি? বোধহয় না। আর মৃণালিনীকে তাই, স্বাভাবিক কারণেই, ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে হলো। দূরত্ব ক্রমশ বাড়তেই থাকলো। যেন কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরে মৃণালিনী রইলো একাকিনী, নিঃসঙ্গ। কিন্তু সে তো তার রক্তমাংসে গড়া পার্থিব শরীরটাই শুধু। আর তার মন? তার স্বামীসঙ্গসুখ পিয়াসী হৃদয়? সে কি বল্গা-ছাড়া হরিণের মতো অন্তরের ব্যাকুল আর্তি নিয়ে ছুটে বেড়ায়নি দেহাতীত আকাঙ্ক্ষায় স্বামীর অভীষ্ট পথের যোগ্য সঙ্গিনী হতে?

এর উত্তর পাওয়া যাবে আরও পরে, ১৯১৮ সালে। মৃণালিনী তখান বত্রিশ বছরের পরিপূর্ণা যুবতী, কিন্তু সারা শরীরে বেলাশেষের ম্লান আলো। শরীরটাও যেন আর তার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। রক্তমাংসের একটা দেহ, তার সংগে যেন জোর করে কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জুড়ে দিয়ে অত্যন্ত অবহেলায় ও অন্যমনস্কতায় ‘মৃণালিনী’ নামধারী একটা মনুষ্যশরীর তৈরি করে রেখেছে কেউ – যা তার আত্মা থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত। এবং ততদিনে শ্রীঅরবিন্দের যোগসাধনায় সিদ্ধিলাভ সম্পূর্ণ, ঋষিত্বপ্রাপ্তির পথে। তিনি পন্ডিচেরী থেকে মৃণালিনীকে আহ্বান জানিয়ে লিখলেন – “আমার সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়েছে। এখন জগতের জন্য আমাকে অনেক কাজ করতে হবে। তুমি এখন এসে এই মহান কজে আমার সাথী হও।”

তা আর হলো কই? বড্ড দেরি হয়ে গেছে যে! মৃণালিনী তখন রোগশয্যায় মৃত্যুর দিন গুনছে। অবশেষে ১৯১৮ সালের ১৭ই ডিসেম্বর মৃণালিনীর আত্মা তার অনাবশ্যক শরীরের বোঝা নামিয়ে রেখে পঞ্চভূতে বিলীন হলো, স্বামীর অমোঘ আহ্বানে সাড়া দিতেই বুঝি বা!

যথারীতি একটি টেলিগ্রাম পন্ডিচেরীতে বয়ে নিয়ে এলো মৃণালিনীর মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ। একজন সিদ্ধপুরুষ, হাতে স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ বয়ে আনা টেলিগ্রামের কাগজ নিয়ে স্তব্ধ-হতবাক শোকে নিস্পন্দ বসে আছেন, চোখের কোণে মুক্তোদানার মতো দু’ফোঁটা টলটলে অশ্রুবিন্দু এই গড়িয়ে পড়লো বলে! – এই দৃশ্য যেমন হৃদয়বিদারক, তেমনই মনোরম। মৃণালিনীর অস্তিত্ব, মৃণালিনীর ভালোবাসা যে অরবিন্দের হৃদয়ে কতখানি জায়গা জুড়ে ছিল, বুকের কোন অন্তঃস্থলে যে লুকিয়ে রেখেছিলেন যাবতীয় মৃণালিনী-ঘটিত হৃদয়ানুভূতি, তার হদিশ পাওয়া ষাবে স্ত্রীর মৃত্যুর মাসদুয়েক পর ১৯১৯ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি তারিখে শ্বশুরমশায়কে লেখা অরবিন্দের একটি চিঠিতে – “My dear father-in-law, I have not written to you with regards to this fatal event in both our lives, words are useless in face of the feelings it has caused, if even they can ever express our deepest emotions. God has seen good to lay upon me the one sorrow that could still touch me to the centre. He knows better than ourselves what is best for each of us and now that the first sense of the irreparable has passed. I can bow with submission to His divine purpose. The physical tie between us is, as you say, Severed, but the tie of affection subsists for me. Where I have once loved, I do not cease from loving. Besides, she who was the cause of it still is near though not visible to our physical vision. 

It is needless to say much about the matters of which you write in your letter. I approve of every thing that you propose. Whatever Mrinalini would have desired, should be done, and I have no doubt this is what she would have approved of. I consent to the chudis being kept by her mother, but I should be glad if you would sent me two or three of her books, especially if these are any in which her name is written. I have only of her letters and a photograph.

-Auribindo”

এ তো চিঠি নয়, যেন মৃণালিনীর ভালোবাসার মরণোত্তর স্বীকৃতিপত্র। “Where I have once loved, I do not cease from loving. Besides, she who was the cause of it still is near though not visible to our physical vision.” অর্থাৎ, একবার যেখানে ভালোবেসেছি, সে ভালোবাসা থেকে আমি কখনো বিরত হই না। তাছাড়া যে-নারী তার কারণ, স্থূলদৃষ্টিতে তাকে দেখা না গেলেও, সে তো কাছেই রয়েছে – এর চে্য়ে স্পষ্ট স্বীকৃতি আর কী হতে পারে? তন্নিষ্ঠ সাধক হয়েও এ যেন শ্রীঅরবিন্দের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। নইলে স্ত্রীর স্মৃতিকে হৃদয়ে চিরকালের মতো জিইয়ে রাখার জন্যে মৃণালিনীর স্বাক্ষরযুক্ত দু’তিনখানি বইয়ের আশায় যোগীপুরুষের এত আকুলি-বিকুলি কেন শ্বশুরের কাছে, মৃণালিনীর কয়েকটি চিঠি ও একখানি ফটোগ্রাফ থাকা সত্বেও?

নারীর ভালোবাসা কতখানি শক্তিশালী হলে নির্বাণলাভ ও পরমব্রহ্মে বিশ্বাসী একজন যোগী ও সিদ্ধপুরুষের তদ্গত চিত্তকে, ক্ষণিকের জন্যে হলেও, মানুষী দুর্বলতায় আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে – মৃণালিনীর ভালোবাসা তার চূড়ান্ত নিদর্শন।

শ্রীঅরবিন্দের অধ্যাত্মদর্শনের সংগে মৃণালিনীর ঐহিক বাসনামুক্ত বিদেহী আত্মার এই অপার্থিব মিলনের পথই যে ঈশ্বর-প্রাপ্তির নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবমান – এই পরমসত্য আর  একবার উদ্ঘাটিত হলো। এবং শ্রীঅরবিন্দের নবজন্ম হলো ঋষি অরবিন্দ রূপে।

___________________________

ঋণ স্বীকার –

। The Bomb in Bengal by Peter Heehs ২। কারাকাহিনী –শ্রীঅরবিন্দ ৩।স্মরণীয় বিচারসংগ্রহ (সংগ্রহশালা) আলিপুর জাজেস কোর্ট, কলকাতা।

               

       



Post a Comment

6 Comments

  1. অরবিন্দ ঋষি হলেন বটে।পণ্ডিচেরীর আশ্রমে বিদেশিদের আনাগোনা অনেক আজও।
    কিন্তু দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য তিনি কী করলেন!?
    এটি আমার মতে পলায়নী মনোভাব। এর বেশি কিছু মন্তব্য করতে গেলে প্রবন্ধ লিখতে হবে।

    ReplyDelete
  2. খুব ভাল লাগলো। ইতিহাস আর একবার রিভাইস করলাম।

    ReplyDelete
  3. অনবদ্য রচনা / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  4. অনবদ্য রচনা / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  5. Situs DominoQQ Terpercaya dan Resmi yang menyediakan 9 permainan poker online dengan winrate tertinggi.

    ReplyDelete