জ্বলদর্চি

গ্যালারি থেকে Arena - 4/ অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়


গ্যালারি থেকে Arena - 4

আলি সাহেবের ক্রিকেট

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়
 
১৯৫৬ সালে হায়দ্রাবাদের একটি স্কুল ক্রিকেট টিমের সিলেকশান চলছে। সিলেকটাররা বেশ দ্বন্দ্বের মধ্যে আছেন একজন প্লেয়ারের নির্বাচন নিয়ে। কথাবার্তা চলছে বারংবার আদৌ এই প্লেয়ারকে টিমে নেওয়া হবে কি না! শেষ পর্যন্ত সবাই একমত হলো এই ভেবে যে, যদি এই প্লেয়ার ব্যাটে-বলে কিছু নাও করতে পারে তবু একে চান্স দেওয়া যায় শুধুমাত্র ফিল্ডিংয়ের জন্য। আউটফিল্ডে নিশ্চিত ভাবে এই প্লেয়ার দলের জন্য ৩০ রান বাঁচিয়ে দেবে। প্রাথমিক ভাবে শুধুমাত্র ফিল্ডিংয়ের জন্য একজন প্লেয়ার সিলেকশান হচ্ছে এ এক অভাবনীয় ঘটনা। হোক না স্কুল ক্রিকেট, জেতা হারা তো আছে সেখানেও। টুর্নামেন্ট শেষে দেখা গেল বেস্ট ফিল্ডারের পুরস্কারটা উঠেছে তার হাতেই। ইনিই সম্ভবত ভারতের প্রথম সবথেকে ফাস্টেস্ট এবং ফিটেস্ট প্লেয়ার। নাম সৈয়দ আবিদ আলি।

৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ সালে হায়দ্রাবাদে জন্মান আলি সাহেব। পড়াশুনো করেন সেন্ট জর্জ গ্রামার স্কুল এবং অল সেন্ট হাই স্কুলে। ১৯৫৯-৬০ সালে হায়দ্রাবাদ রাজ্য ক্রিকেট টিমের হয়ে অভিষেক করে ফেলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেভাবে সুযোগ পাচ্ছিলেন না বোলিং বা ব্যাটিংয়ের। ১৯৬৪-৬৫ সেশন থেকে নিয়মিত বোলিং শুরু করেন এবং ক্রমশ হায়দ্রাবাদ টিমের ওপেনার বোলার হয়ে ওঠেন। অথচ ইনিই তার প্রথম পাঁচ সিজনে মাত্র কুড়িটা বল করেছিলেন ।একজন প্লেয়ারের এই উত্থান এমনি হয় না, তার মনোসংযোগ, অনুশীলন, জেদ সব কিছুই মিশে থাকে। যদিও ১৯৬৭ সালের আগে পর্যন্ত ব্যাটে কোনো সেঞ্চুরি ছিল না, তবু আলি সাহেব বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তাঁর বাজের মতো ফিল্ডিংয়ের জন্য। ব্যাটিংয়ের সময় উইকেটের মধ্যেও ছিলেন মারাত্মক গতিময়। তার পার্টনার ব্যাটসম্যান তো একেক সময় হাঁফিয়ে যেত । এমনকি বহুক্ষত্রে অতিরিক্ত গতির জন্য দুই ব্যাটসম্যানই ক্রিজের একদিকে হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতো।
১৯৬৭ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর। অ্যাডিলেডে শুরু হলো ভারত-অষ্ট্রেলিয়ার প্রথম টেস্ট। মনসুর আলি খান পতৌদির চোটের কারণে অনুপস্থিতির জন্য ভারতের ক্যাপ্টেন্স ব্যান্ড চান্দু বোরদের হাতে। আর এই অনুপস্থিতিই সুযোগ এনে দিল সৈয়দ আবিদ আলির কাছে। ভারতের হয়ে অভিষেক ঘটলো তাঁর লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং মিডিয়াম পেস বোলার হিসেবে। অষ্ট্রেলিয়া প্রথম ব্যাটিং শুরু করলো। ভারতের হয়ে দুদিকে থেকে বোলিং শুরু করলো আরেক অভিষেক করা প্লেয়ার উমেশ কুলকার্নি এবং রুশি সুর্তি। দুই ওপেনার ববি সিম্পসন এবং বিল লরি কোনো অসুবিধে ছাড়াই দুই বোলারকে দিব্যি সামাল দিতে লাগলো। স্কোরবোর্ডে সচল থাকলো। উপায়ান্তর না দেখে ক্যাপ্টেন ওয়ান চেঞ্জ বোলার হিসেবে নিয়ে এলেন আলি সাহেবকে। বোধহয় আলি সাহেব নিজেও জানতেন না তারপর কী ঘটতে যাচ্ছে। ৯৯ রানে আলি সাহেব ভাঙলেন জমে যাওয়া ওপেনিং পেয়ারকে। বিল লরি ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন। ১১ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হতে না হতেই আবার আউট। এবার আলি সাহেব নিজের বলে নিজেই ধরলেন অষ্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেন সিম্পসনকে। কুপারকে থামালেন সেঞ্চুরি থেকে ৮ রান দূরে। অষ্ট্রেলিয়ান ইনিংস যখন শেষ হলো ৩৩৫ রানে আলি সাহেবের বোলিং ফিগার ৫৫/৬। স্বপ্নের অভিষেক দিয়ে ভারতের হয়ে ক্রিকেট জীবন শুরু হলো তাঁর। দুই ইনিংসেও করলেন ৩৩ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। যদিও শেষ রক্ষা হলো না। ভারত ১৪৬ রানে ম্যাচটা হেরে গেল। সেকেন্ড ইনিংসে আলি সাহেবের নামের পাশে যুক্ত হলো আরেকটা উইকেট।      
মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্টের অভিজ্ঞতা সুখের হলো না। ২০ ওভারে ১০৬ রান এবং দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৪ এবং ২১ রান। বাকি দুটি টেস্টেও বল হাতে আর জ্বলে উঠতে পারেননি আলি সাহেব। আর মাত্র এক উইকেট যুক্ত হলো পকেটে। ব্যাটিংয়ে অবশ্য দাগ কাটলেন বেশ। তৃতীয় ব্রিসবেন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে দিলীপ সারদেশাইয়ের পরিবর্তে ওপেন করতে নেমে ৪৭ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেললেন। সিডনিতে শেষ টেস্টে ওপেন করতে নেমে করলেন ৭৮ এবং ৮১ রান। কিন্তু তাতে ভারতের লাভ হলো না । চারটি টেস্ট হেরেই ফিরতে হলো ভারতকে।
১৯৬৮ সালের ১৫-ই ফেব্রুয়ারি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ডুনেডিনে প্রথম টেস্ট। আবারও বল হাতে জ্বলে উঠলেন আলি সাহেব। প্রথম ইনিংসে ২৬ রানে তুলে নিলেন ৪ উইকেট। ভারত প্রথম দেশের বাইরে টেস্ট জিতলো। বাকি সিরিজ ব্যাট বা বলে খুব ভাল গেলো না। টোটাল ১২৪ রান। তবু ভারত আনন্দে ছিল। কারণ প্রথমবার দেশের বাইরে টেস্ট সিরিজ জিতলো ৩-১ ফলে।

তবে ১৯৭১ সাল ছিল আলি সাহেবের জীবনের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ সময়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পোর্ট অফ স্পেনে ভারতের ঐতিহাসিক জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। ম্যাচের প্রথম বলেই আউট করেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওপেনার রয় ফ্রেডরিক্সকে। তারপর মাত্র ৭ রানে তুলে নেন ক্যাপ্টেন ক্লাইভ লয়েড-কেও। ওখানেই বাঁধা হয়ে গিয়েছিল জয়ের সুর। ১২৫ রান তাড়া করতে নেমে সুনীল গাভাস্কার যখন উইনিং স্ট্রোক নিচ্ছেন ক্রিজের অপর প্রান্তে তখন সৈয়দ আবিল আলি। দুজনের জুটিতে যুক্ত হয়ে গেছে ৪১ রান এবং ভারত দেখে ফেলেছে জয়ের মুখ। কিছু মাস বাদেই ইংল্যান্ড ট্যুরে, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিনই আলি সাহেব তুলে নিলেন ৬৪ রানে ৪ উইকেট। ওভালে পরের টেস্টে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ৩ রান এনে দিলেন বাউন্ডারি মেরে। ইংল্যান্ডে ভারতের প্রথম টেস্ট জয়।

১৯৭৪ সালের শীত ছিল আলি সাহেবের জীবনের টেস্ট কেরিয়ার শীতঘুমে যাওয়ার বছর। দিল্লিতে সেকেন্ড টেস্টে ভিভিয়ান রিচার্ডস এর হাতে তুমুল মার খাওয়া ( ৭ ওভারে ৪৭ রান) দুই ইনিংসে রান না পাওয়ার পরেই বাদ পড়েন টিম থেকে। আর কোনোদিন টেস্ট টিমে সিলেকশান হয়নি। তখন আলি সাহবের বয়স ৩৩ এবং দলের সব থেকে ফিট প্লেয়ার। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে তিনটি ম্যাচই খেলেন। প্রথম দুই ম্যাচে ২ টো করে উইকেট নেন। তৃতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটে-বলে মাত করে দেন। ব্যাটে ৯৮ বলে ৭০ রান এবং বল হাতে ৩৫ রানে ২ উইকেট। এই ম্যাচটি ছিল ওয়ান ডে ক্রিকেটের জীবনে তার শেষ ম্যাচ।

মানুষের জীবন এবং সৈয়দ আবিদ আলির ক্রিকেট কেরিয়ার যেন সমার্থক। কখনও আলো, কখনও আঁধার। এই উঠছে,এই পড়ছে। সদ্য ভারতের ক্রিকেটে পেস বোলারদের যে জোয়ার এসেছে, তখন তা ছিল না। পেস বোলারদের কাজ ছিল বলকে কিছুটা পুরানো করে দেওয়া যাতে স্পিনাররা সুবিধে পায়। ১৯৬৭ সালে অভিষেক ঘটানো থেকে ১৯৭৪ শেষ টেস্ট খেলা পর্যন্ত যেখানে বিষেন সিং বেদি ১১৯৯৪ টা বল, এরাপল্লি প্রসন্ন ৯৭৭৭ বল, ভেঙ্কটরাঘবন ৫২৯৮ টা বল করেছিল, সেখানে আলি সাহেব মাত্র ৪১৬৪ টা বল করার সুযোগ পেয়েছিল। তবু মাত্র ২৯ টেস্টে ১০১৮ রান, ৩২ টা ক্যাচ এবং ৪৭টা উইকেট নিয়ে ভারতের হয়ে ক্রিকেট জীবন শেষ করেন। কপিলদেব, মহিন্দার অমরনাথ,যুবরাজ সিং পূর্ব ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার ছিলেন সৈয়দ আবিদ আলি একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


আরও পড়ুন।
'সাদা কালো ব্রিগেডের একটি জয় এবং জবাব'

Post a Comment

0 Comments