জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্কপর্ব- ৪/ অসীম ভুঁইয়া

Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক

পর্ব ৪

অসীম ভুঁইয়া

বাক্যের কত ঢং! 

আজকের আলোচনার বিষয়: ঢং বা অর্থ অনুযায়ী বাক্যের শ্রেণি নির্ণয়। তার আগে জেনে নিতে চাই,  বাক্য আসলে কী? এক বা একাধিক শব্দ পাশাপাশি বসে যখন অভিজ্ঞতালব্ধ একটি স্পষ্ট অর্থ প্রকাশ করে তখনই আমরা তাকে বাক্য বলে ফেলি। 

   অর্থ অনুযায়ী প্রথাগতভাবে বাক্যকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়। এরা হল:  নির্দেশক বাক্য, প্রশ্নবোধক বাক্য, অনুজ্ঞাসূচক বাক্য, প্রার্থনাসূচক বাক্য, সন্দেহবাচক বাক্য, আবেগসূচক বাক্য ও শর্তসাপেক্ষ বাক্য।  

   তবে এদের আমরা একটু সহজ নামে ডাকতে চাই।তাই এদের নতুন নাম: নির্দেশ- বাক্য, প্রশ্ন- বাক্য,  প্রার্থনা- বাক্য, অনুজ্ঞা বাক্য, সন্দেহ- বাক্য, আবেগ -বাক্য ও শর্ত -বাক্য।  বাক্যের ধরন অনুযায়ী একটি করে উদাহরণ দেওয়া যাক।

 ১. এক এক গ্লাস জল দিতে বলেছি।-  নির্দেশ বাক্য। 
২. এক গ্লাস জল কি দেবে না? - প্রশ্ন বাক্য। 
৩.  এক গ্লাস জল দাও। - অনুজ্ঞা বাক্য। 
৪. এক গ্লাস জল দেওয়া হোক।- প্রার্থনা বাক্য।  
৫. বোধহয় এক গ্লাস জল দিতে বলেছি।-  সন্দেহ বাক্য।
৬. আহ্! এক গ্লাস জল দাও তো। - আবেগ বাক্য।
 ৭. এক গ্লাস জল চাইলে দেবে।- শর্ত বাক্য। 

  এখানে দেখা যাচ্ছে বাক্যগুলির মূল বিষয় একই। জল দেওয়া বা চাওয়ার ব্যাপারে বলা হচ্ছে, কিন্তু প্রকাশভঙ্গির বৈচিত্র্যে বাক্যগুলির অর্থ ভাবনাও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। তা সত্বেও এদের অর্থ অনুযায়ী শ্রেণিভাগ কথাটি একটু বেমানান।  বরং ড. পবিত্র সরকারের দেওয়া ঢং অনুযায়ী শ্রেণীভাগ নামটি বেশি যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হয়। 

   যাইহোক, এই বাক্যেগুলির ঢং পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে চালু ব্যাকরণে যে সাতটি বাক্যের কথা বলা হল তা আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করতে করতেই বিতর্কে ঢুকে পড়ব।  তার আগে বলে নিই, ওপরে  একটি বিষয়কে স্থির রেখে যে ৭ টি বাক্য আমরা সাজালাম তার পারস্পারিক পরিবর্তন হয়তো ঠিকঠাক হয়নি। অবশ্য সমস্ত বাক্য প্রতিটি বাক্যে ঠিকঠাক পরিবর্তন করা যায়ও না।  আর পরিবর্তন করতে চাইলেও অর্থে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। 

   ১. নির্দেশ বাক্য: এই বাক্যে সাধারণত কোনো বিষয়, ভাবনা বা সংবাদকে সাধারণভাবে জানানো হয়ে থাকে। যেমন: i. " মুনিয়া সমস্ত দিন বাঁধা ছিল।"  ii. গতকাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছিল।  চালু ব্যাকরণে নির্দেশক বাক্যেকে দুটি শ্রেণিতে দেখা হয়ে থাকে।  হ্যাঁ-বাচক বাক্য ও না -বাচক  বাক্য। হ্যাঁ- বাক্য: "জলের পরে চড়ে বেড়ায় হংসরাজ।" আর, না - বাক্য: "জলের পরে হংসরাজ চড়ে বেড়ায় না এমনটা নয়।" মনে রাখতে হবে হ্যাঁ বাচক ও না-বাচক বাক্যের পারস্পরিক পরিবর্তনজনিত অর্থ কিন্তু একই থাকবে। না সূচক শব্দগুলো - না, নয়, নি, নেই প্রভৃতি।  তবে মনে রাখতে হবে সমস্ত বাক্যকেই হ্যাঁ- বাচক ও না- বাচক করা যায়।  তাই চালু ব্যাকরণে শুধু যে নির্দেশক বাক্যকেই না এবং হ্যাঁ হিসাবে দেখানো হয় তা ঠিক নয়। আরেকটি বিষয়, নির্দেশ কথার অর্থ এখানে আদেশ বা উপদেশ নয়।  কোনো তথ্য বা সংবাদ জানানো মাত্র। 

 এবার আসি প্রশ্ন বাক্যে:  প্রশ্ন বাক্যে সাধারণত কোনো বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য থাকে বা প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। যেমন: সে কি আসবে?  এবার খুব গরম পড়বে, না?  তুমি কি যাবে না?  ইত্যাদি।  তবে প্রশ্নচিহ্ন ছাড়াও প্রশ্ন বাক্য নির্মিত হতে পারে। ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্য এ ধরনের বাক্যকে 'ছদ্মপ্রশ্ন ' নাম দিয়েছেন এবং তিনি বেশ সুন্দর উদাহরণও দিয়েছেন।  যেমন: "তার মনে দয়া মায়ার লেশমাত্র নেই। কেন-ই বা থাকবে।" আমরাও এধরনের আরো উদাহরণ দিতে পারি।  যেমন:  করোনা ভাইরাসের জন্য দেশে লকডাউন। আর হবে না-ই বা কেন। 
 সুভাষ ভট্টাচার্যের মতে, "এসব প্রশ্নের মধ্যেই একটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক উত্তর নিহিত আছে।  প্রশ্নচিহ্ন নেই, কিন্তু সুরটা  প্রশ্নাত্মক।"  

   প্রশ্নের ক্ষেত্রে কি এবং কী - এর পার্থক্য জানা জরুরি। যেমন:" সে কি আর আসবে না?"  এটি দুর্বল কি।  এর উত্তর হ্যাঁ অথবা না হয়। আর যদি বলি, তোমার নাম কী? এর উত্তরে নামটি বলে দিতে হয় বা না বলতে চাইলে সেটাও বলতে হয়। এটিকে সবল কী এবং তথ্যপ্রশ্ন বলা হয়। এই ' কী ' এর ওপর একটা অতিরিক্ত জোর পড়ে।  লেখালেখির ক্ষেত্রে এই কী/কি  এর পার্থক্য অনেকেই করেন না, যার ফলে অর্থবোধের ক্ষেত্রে  ভীষণ সমস্যা হয়। 
 
   অনুজ্ঞা বাক্য: এখানে সাধারণত আদেশ, অনুরোধ, মিনতি, উপদেশ প্রভৃতি প্রকাশ পায়।  যেমন: "সংযত হয়ে কথা বলো।" এটি একটি আদেশ। আবার যদি বলি, " আমরাও নিয়ে যাই চলো/ হৃদয়ের রাজার মুকুট।" এটা উপদেশ। "কেউ এসে বলুক আজ দারুণ খবর আছে।" একে ইচ্ছা বা  প্রার্থনা বলা যায়। 
   
  অনুজ্ঞা - বাক্যে না ব্যবহারের বৈচিত্র্য রয়েছে।  যেমন: তুমি আর  খেয়ো না।  এটি নিষেধ -সূচক না।  আর যদি বলি,  তুমি একটু খাও - না গো।  এটি বায়না বা জোর সূচক না।  একইভাবে, "কী হয়েছে বলবেন না।" আর, "কী হয়েছে বলুন - না।"  ইত্যাদি ইত্যাদি।  
একটি বিষয় মনে রাখতে হবে অনুজ্ঞা শুধু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালেরই হয়, এর কোনো অতীত নেই। 
   
   এবার ইচ্ছা বা প্রার্থনা বাক্য:  "ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।"  "তোমাদের আরো ভালো হোক।" এখানে একটি মনের ইচ্ছা বা প্রার্থনা  প্রকাশ পেয়েছে। তাই এগুলো ইচ্ছাসূচক বাক্য। তবে এ বিষয়ে একটু বলার আছে। ইচ্ছা -বাক্য নিয়ে মূলত দু'টি কথা বলতে চাই- এক: প্রার্থনা বা ইচ্ছা প্রকাশকে চালু ব্যাকরণে সদর্থক অর্থেই দেখানো হয়ে থাকে।  যেমন:  ভালো থেকো। কল্যাণ হোক। ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাকরণগতভাবে তো নেতিবাচক বাক্য তৈরি করাই যায়। যেমন: তোমার ভালো না হোক। তোমার ছেলে চুলোয় যাক প্রভৃতি। আর বাস্তবেও তো কেউ অন্যের খারাপ চাইতেই পারে।  তাহলে এ ধরনের বাক্যকে কী বলা যাবে?  আমাদের মতে, দুটি ধরনকেই ব্যাকরণগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইচ্ছা- বাক্য বলা যেতেই পারে। আর দুই:  প্রথাগত ব্যাকরণের কিছু কিছু ইচ্ছা -বাক্য  অনুজ্ঞা বাক্যের মতো।  যেমন:  ফিরে আসুক।  রক্ষাকর্তা তোমার সহায় হোন।  তাহলে এই ধরনের বাক্যকে কী নাম দেওয়া যেতে পারে?  আমাদের মতে, এদের নতুন একটি শ্রেণিনাম করা হোক।  তা ইচ্ছাসূচক অনুজ্ঞা অথবা অনুজ্ঞাসূচক ইচ্ছা বাক্য।  

   এবার সন্দেহ বাক্য:  এখানে কোনো বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ করা হয়ে থাকে। যেমন: "সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে।" অথবা
 "তুমি যাবে বুঝি।" 
" তিনি হয়তো এ কথা বলে বলে থাকতে  পারেন।" 
 এই বাক্যগুলিতে একটা সন্দেহ ভাব আছে। তাই সন্দেহ বাক্য। তবে একটা বিষয় লক্ষ করার আছে। এখানে সন্দেহ সূচক শব্দ:  হয়তো, বোধহয়, যেন, বুঝি, মনে হয়, এরা হ্যাঁ বাক্যে থাকলে বাক্যের ভাব বা অর্থটি হ্যাঁ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, আর না-বাক্যে থাকলে না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।  যেমন:  আজ বোধহয় বৃষ্টি হবে।-  এখানে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি মনে হচ্ছে। আর যদি বলি, আজ বোধহয় বৃষ্টি হবে না। এখানে বৃষ্টি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। 

  তবে  এই বিভাজনটিও কিছুটা বিভ্রান্তিকর। কারণ এক ধরনের সন্দেহবাচক বাক্যে প্রশ্ন চলে আসতে পারে।  অর্থাৎ সন্দেহ বাক্যের মধ্যে প্রশ্ন বাক্যের সম্ভাবনা থেকে যায়। যেমন: "সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলংকার?" এখানে সন্দেহ এবং প্রশ্ন দুটোই রয়েছে। আবার "তুমি বুঝি যাবে না?" এখানেও সন্দেহ এবং প্রশ্ন রয়েছে।  এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা অন্য একটি শ্রেণিনাম ভাবতেই পারি।  আমাদের মতে এদের নাম হোক, সন্দেহসূচক প্রশ্ন বাক্য অথবা প্রশ্নসূচক  সন্দেহ বাক্য।  

  এবার আবেগ বাক্য দেখে নেওয়া যাক।  আবেগ বাক্যে সাধারণত মনের আবেগ প্রকাশ পায়। আবেগকে ব্যাপক দৃষ্টিতে নানা অর্থে দেখা হয়ে থাকে। যেমন:  দুঃখ, আনন্দ, ভয়, ঘৃণা, উচ্ছ্বাস শোক,  প্রভৃতি। যেমন: বাপরে বাপ, কী ভয়ানক!  বাহ! কী সুন্দর দেখতে মেয়েটা!  কতকাল পুষে রেখেছে বুকে পিতৃ হারার ব্যথা!  ইত্যাদি। 

   চালু ব্যাকরণে আবেগসূচক বাক্য নিয়েও বেশ ঝামেলা আছে। কারণ, আবেগসূচক বাক্যের মধ্যে প্রশ্ন থাকতে পারে, অনুজ্ঞা থাকতে পারে আবার নির্দেশক বাক্যের ভাবও থাকতে পারে।  যেমন-  ছিঃ ছিঃ! কী করে বললে গো?  এখানে আবেগ ও প্রশ্ন রয়েছে। আবার আহ!  হাতটা ছাড়তে বলেছি। এখানে আবেগ ও নির্দেশ রয়েছে। আর যদি বলি,  আহ্! হাতটা ছাড়ো। এখানে আবেগ ও অনুজ্ঞা রয়েছে। তাই আমাদের মতে, আবেগ সূচক বাক্য তিন ধরনের হওয়া উচিত।  ১. প্রশ্নযুক্ত আবেগ বাক্য ২.  অনুজ্ঞাযুক্ত আবেগ বাক্য ও নির্দেশযুক্ত আবেগ বাক্য।

  অনেক সময় আবার উচ্চারণ বা স্বরের ওঠা নামার ওপরও বাক্যের ভঙ্গিমা নির্ভর করে। যেমন:  তুমি যাবে!- আবেগ বাক্য।  তুমি যাবে?-  প্রশ্ন বাক্য।  তুমি যাবে। - অনুজ্ঞা বাক্য। 

   প্রথাগত ব্যাকরণের আরেকটি  বাক্য  শর্ত- বাক্য।  শর্ত বাক্যে সাধারণত দুটো খন্ডবাক্যের ভাব থাকে। একটি অন্যের ওপর নির্ভর করে অর্থাৎ একটি অংশ অন্য অংশটির শর্ত হয়ে থাকে।  যেমন:  যদি তুমি ডাকো তবে আসবো।  "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।" ইত্যাদি। এই বাক্যটি নিয়ে সামান্য কিছু বলার আছে। সাধারণত জটিল বাক্যগুলির বেশিরভাগই শর্ত বাক্য।  সাপেক্ষ শব্দজোড় এখানেও ব্যবহৃত হয়, তবে এই জোড় ছাড়াও বাক্য হতে পারে। আর এক্ষেত্রেও একটি বাক্যের মধ্যে দুটি বাক্যের সম্ভাবনা থাকে। কখন আবার  সমাপিকা ক্রিয়া যুক্ত দুটি বাক্য পরিষ্কার লক্ষ করা যায়। 

   চালু ব্যাকরণের এই শর্ত- বাক্যটিকে অতি সরল করতে গিয়ে আসল জায়গাটি ধরা হয়নি।  কারণ শর্ত -বাক্যের মধ্যে অন্যান্য বাক্যগুলো থেকে যেতেই পারে। তাই শর্ত- বাক্যকে অন্যান্য বাক্যের সঙ্গে সমান্তরালে শ্রেণিভাগ করা মোটেই  ঠিক হয়নি।  যেমন:  যদি আমি যাই তুমি যাবে তো?  এখানে শর্ত বাক্যের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন,  এটি শর্ত বাক্য না প্রশ্ন বাক্য?  আবার এর মধ্যে প্রার্থনা, অনুজ্ঞা, নির্দেশক, সন্দেহ প্রভৃতিও থাকতে পারে। " যেহেতু সে বলেছে তাই তুমি কাজটি করবে।" এখানে শেষ অংশটি অনুজ্ঞা।  অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে শর্ত- বাক্যকে যদি এই শ্রেণিভাগের সমান্তরালে রাখতেই হয় তাহলে এভাবে শ্রেণিনাম করা যেতে পারে। প্রশ্নসূচক শর্তবাক্য, অনুজ্ঞাসূচক শর্তবাক্য, প্রার্থনাসূচক শর্তবাক্য ইত্যাদি ইত্যাদি। 

    এভাবে  অর্থবোধ বা ঢং অনুযায়ী চালু ব্যাকরণের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা বাংলা বাক্যের নতুনভাবে শ্রেণিনাম ও শ্রেণি নির্মাণ করতে চাই।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments