জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ - ১৯ (শেষ পর্ব)/ কালীপদ চক্রবর্ত্তী


দিল্লি দর্পণ - ১৯   (শেষ পর্ব)

কালীপদ চক্রবর্ত্তী 

মেসোমশাই দিল্লি ছাড়লেন 

আমি তখন সবেমাত্র দিল্লিতে এসেছি। বাঙালি দেখলেই খুব খুশী হই। যেচে আলাপ করি। সৌভাগ্য বশতঃ সফ্‌দরজঙ্গ এনক্লেভের কৃষ্ণনগরে এক বাঙালির বাড়ীতে বর্ষাতিতেও (বর্ষাতি হল ছাদের বা চিলেকোঠার ঘর ) ভাড়া পেয়ে যাই। ধীরে ধীরে কিছু বাঙালি প্রতিবেশীদের সাথেও আলাপ হয়। তারমধ্যে পীযূষদের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতা খুব বেড়ে ওঠে, কারণ পীযূষ ছিল আমার সমবয়সী আর পীযুষের বাবা ও মা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। পীযূষরা যে বাড়িটাতে থাকতো সেটা বেশ পুরনো। বেশ কষ্ট করেই ওদের থাকতে হতো। একবার একটা ঘটনা আমাকে খুব অবাক করেছিল। আমি ড্রইং রুমে বসে ওনাদের সাথে গল্প করছিলাম। এমন সময় মাসিমা উঠে বাথরুমে যাবার আগে টেবিল থেকে একটি চামচ নিয়ে বাথরুমে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে মেসোমশাইও ঠিক তেমনটাই করলেন। এসব দেখে আমি আর মনের জিজ্ঞাসা দমিয়ে রাখতে পারছিলাম না, কিন্তু কি ভাবে এই চামচ রহস্য উদ্‌ঘাটন করবো বুঝে উঠতে না পেরে, নিজেই বাথরুম যাবার জন্য তৈরি হতেই, পীযূষ আমাকে বলল – তুই কি বাথরুমে যাবি?

আমি বললাম – হ্যাঁ। 

পীযূষ বলল -  তাহলে এই চামচটা সঙ্গে নিয়ে যা। 

আমি বললাম – বাথরুম যাবো তাতে চামচের কি দরকার হবে?

পীযূষ- সেটা এখন বুঝবি না। ভেতরে গেলেই বুঝবি। আমরা বহুদিন ধরে বাড়িওয়ালাকে বলছি যে আমাদের বাথরুমের সেকলটা খারাপ হয়ে গেছে কিন্তু উনি কিছুতেই ঠিক করাচ্ছেন না। তাই এই স্টপগ্যাপ সমাধান। একেই বলে বুদ্ধির কাজ কৌশলে করে ......

-এক কথায় বল জোগাড়, হিন্দিতে যাকে বলে জুগার। তাই না। দেশটা মনে হয় এই জুগারেই চলছে।
এরপরে বাথরুমে চামচ নিয়ে যাবার রহস্যটা আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। 

মাসিমা ও মেসোমশাই ছিলেন খুবই ভাল লোক। ওদের বাড়ী কয়েকদিন না গেলেই ওনারা খুব অভিমান করতেন। ক্রমশ আমিও ওদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। পীযূষদের পরিবার মাত্র তিন জনের। বাবা, মা এবং পীযূষ। ওরাও দোতালায় বর্ষাতি ভাড়া নিয়ে থাকতো। সামনে বিরাট ছাদ। দিল্লিতে গরমের সময় ধনী-গরীব নির্বিশেষে ছাদে বা ঘরের বাইরে খাটিয়া পেতে শুতো। আর বাড়ীগুলোর বিশেষত্ব হল প্রত্যেকটি বাড়ী প্রত্যেকটি বাড়ীর সাথে যুক্ত বা লাগানো। অর্থাৎ দুটি বাড়ীর মধ্যে কোন ফাঁকা জায়গা বা খালি জায়গা নেই। এমনকি একজনের দেওয়ালকেই পাশের বাড়ীর ঘরের দেওয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নতুন করে দেওয়াল বানানোর খরচ অনেকেই বাঁচায়।  আর সে কারণেই হয়তো ভূমিকম্পে দিল্লির বাড়ীগুলো আজও টিকে আছে।

পীযূষের বাবা অর্থাৎ মেসোমশাইর থেকে দিল্লি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছিলাম। যেমন একবার আর.কে. পুরমে এক বন্ধুর গর্ভরমেন্ট কোয়ার্টারে গিয়ে দেখেছিলাম সিলিং ফ্যানের গায়ে হিন্দিতে লেখা কে.লো.নি.বি.। বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেও এর প্রকৃত কথাটি খুঁজে পাইনি। যেমন পাইনি দিল্লি স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাসের গন্তব্য স্থানের জায়গায় লেখা গু.তে.বা. নগর-এর প্রকৃত নাম। বহুদিন এই কে.লো.নি.বি. ও গু.তে.বা. নগর আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকালেই ক্রশওয়ার্ড পাজলড্‌ এর মত এগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়াতো। শেষ অব্ধি একদিন এই মানসিক কষ্ট লাঘব করতে পীযুষের বাবা অর্থাৎ মেসোমশাইকে জিজ্ঞাসা করলাম - মেসোমশাই, কে.লো.নি.বি.-র পুরো কথাটা কি বলুনতো?
- কোথায় দেখেছো আগে বল?
- Govt. Quarter- এ সিলিং ফ্যানের গায়ে।
- আসলে ওটার পুরো কথা হল – কেন্দ্রীয় লোক নির্মাণ বিভাগ, সংক্ষেপে এরা লেখে কে.লো.নি.বি., ইংরেজিতে C.P.W.D.  তুমি তো দিল্লিতে নতুন ধীরে ধীরে সব শিখে যাবে। যেমন আমি শিখেছি। 
- আচ্ছা মেসোমশাই, গু.তে.বা. নগর বলতে কি বোঝায়? এটা মুদ্রিকা বাসে অর্থাৎ রিং রোডের বাসে লেখা দেখেছি।
হাসতে হাসতে জবাব দিলেন – গুরু তেগবাহাদূর নগর। একটা জায়গার নাম। সংক্ষেপে গু.তে.বা. নগর লেখা। অর্থাৎ বাসটা গুরু তেগবাহাদূর নগর অব্ধি যাবে। দিল্লিতে তুমি নতুন তাই কথাটথা একটু সাবধানে বলবে নয়তো বিপদে পড়বে। যেমন, আমি একবার খুব মুস্কিলে পড়েছিলাম। আমি যখন নতুন দিল্লিতে আসি তখন অফিসের কাজে হিমাচলের কিন্নর জেলায় আমাকে পাঠান হয়। আমি প্রতিবেশীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – কিন্নর কিধার হ্যাঁয়? ভদ্রলোক প্রথমে অবাক হলেন এবং পরে আমার ভুলটা বুঝতে পেরে বুঝিয়ে দেন যে হিন্দিতে কিন্নর বলতে নপুংসকদের বলা হয়।

মেসোমশাই-র এসব কথা শুনতে বেশ ভালই লাগতো সে বয়সে এবং জ্ঞানও বাড়ত। একদিন মাসীমা বসে বসে আমাদের কথা শুনছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন – তোমার মেসোমশাই ভুল হিন্দি বলার জন্য একবার মার খেতে খেতে বেঁচে গেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম -

- সেটা কি রকম মাসিমা ?
- আমরা তখন বিয়ের পর পর নতুন দিল্লিতে এসেছি। বাস ধরার জন্য বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছি। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। তোমার মেসোমশাই ছাতা খুলে দাঁড়িয়ে গেলেন আর আমিও ছাতা খুলে বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাচ্ছি। তখন দিল্লিতে সব বাসস্টপেজে এরকম বসার বা দাঁড়ানোর শেড ছিল না। একটা আশ্চর্যের ব্যাপার তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো এতদিনে, যে কোন লোক বা মেয়েরা সাধারণত রোদে বা বৃষ্টিতে খুব কমই ছাতা ব্যবহার করে। হয়তো এখানে এত বেশী বৃষ্টি হয় না বলেও হতে পারে বা স্টাইলের খাতিরেও হতে পারে। সে সময় এক বাসস্টপেজে দু’তিনটি কলেজের ছাত্রীকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে তোমাদের মেসোমশাই-র দয়া হয়। তখন উনি বাঙালি স্টাইলের হিন্দিতে ছাত্রীদের লক্ষ্য করে বলেন – তুমলোগ ভিগ-অ মত। হামারা ছাতিমে আ জাও। দু’তিন বার এরকম বলাতে আশেপাশের লোকেরা ও মেয়েগুলো তোমাদের মেসোমশাইকে প্রায় মারতে উদ্যত হয়। আমি কোন রকমে তাদের বুঝিয়ে সে যাত্রা মারের হাত থেকে ওকে রক্ষা করি।

মেসোমশাই-র কথাগুলো যত শুনি ততই মনে হয় ভদ্রলোক সত্যিই খুব সাদাসিধে এবং সরল। এ যুগে এমন লোক সচরাচর দেখা যায় না। মোটামুটি প্রতি রবিবার প্রাতরাশের ব্যাপারটা পীযূষের সাথেই সারতে হত। কারণ মাসীমা ও মেসোমশাই-র সেরকমই হুকুম ছিল। এই আদেশের নড়চড় হলেই খুব ধমক খেতে হত। এই স্নেহভরা ধমকের মধ্যে এক অন্তরঙ্গতা ও অন্তরের নিবিড় ভালবাসা ছিল, তাই তাদের কথা অমান্য করতে পারতাম না। একবার গরমকালে রবিবার সকালে ওদের বাড়ী পৌঁছে দেখলাম, পরিবেশটা বেশ থমথমে। পীযূষকে কারণ জিজ্ঞাসা করাতে জানলাম, মেসোমশাই-র নাকি মেজাজ খারাপ আজ। দিল্লি ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভাবলাম গতকাল সন্ধেবেলাও তো আমি এখানে এসেছি, তবে একরাতে এমন কি ঘটলো? কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম – মাসিমা কি ব্যাপার বলুন তো?

- আর বোল না বাবা, তুমিতো জানই যে গতকাল রাতে সারা দিল্লিতে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই এই গরমে প্রায় সকলকেই বাইরে শুতে হয়েছিল। এমনকি তোমার মেসোমশাইকেও ছাদে খাটিয়ায় শুতে হয়েছে। উনি লুঙ্গি পড়ে শুয়েছিলেন।

- তাতো জানি। কিন্তু কি এমন কাণ্ড হল যে মেসোমশাই দিল্লি ছাড়তে চাইছেন।

- প্রথমত গত রাতে চোরেরা এসে তোমাদের মেসোমশাইর লুঙ্গীটা চুরি করে নিয়ে গেছে বা কেউ বদমাইশি করে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়তঃ আমাদের বাড়িওয়ালা আজ সকালে এসে বলে গেছে বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দিয়েছেন তাই কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়ি ছাড়তে হবে। তুমিতো জানই যে তোমার মেসোমশাই রিটায়ার্টমেন্টের পর বেশি টাকাপয়সা পাননি, আর এই মুহূর্তে এত কম টাকায় বাড়িভাড়াও পাওয়া যাবে না দিল্লিতে, তাই মেসোমশাই ঠিক করেছেন কলকাতাতেই ফিরে যাবেন। ওখানে সস্তায় বাড়িও পাওয়া যাবে আর খাওয়া দাওয়াও খুব সস্তা। 

এতক্ষণে বুঝলাম মেসোমশাই-র দিল্লি ছাড়ার আসল কারণটা কি এবং এই রাগের বশবর্তী হয়েই মেসোমশাই শেষঅব্দি দিল্লি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। পরে খবর নিয়ে জেনেছি, কলকাতাতেও উনি শান্তি পাননি। উঁচুতলার চোরেরা তাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। অনেক খোঁজখবর নিয়েও মেসোমশাই-র পরের খবর আর পাইনি।  দুর্ভাগ্য তার পথ ছাড়েনি বুঝলাম।
-------------
আরও পড়ুন 

Post a Comment

4 Comments