জ্বলদর্চি

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা-৯/ বিমল মণ্ডল

Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
     
বিমল মণ্ডল   

পর্ব-৯

তৃতীয় অধ্যায় --রূপতত্ত্ব(Morphology)  

ভাষাতত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য শাখা হল রূপতত্ত্ব। এই রূপ হল ভাষার সবচেয়ে ছোটো অর্থপূর্ণ একক।যে কোন ভাষার সবচেয়ে মৌলিক ও ক্ষুদ্রতম একক হল ধ্বনি। আবার একাধিক ধ্বনি  পাশাপাশি বসে ধ্বনির চেয়ে বৃহত্তর যে এক একটি অর্থপূর্ণ  একক গড়ে তোলে তা হল শব্দ।  রূপতত্ত্বের কাজ পদের ছোটো  অর্থপূর্ণ অংশের রূপ নিয়ে।   কয়েকটি ধ্বনি পাশাপাশি বসিয়ে দিলেই তা যথাযথ শব্দের চেহারা পায় না।  তাই শব্দকে আমরা অভিধানে পাই সম্পূর্ণ  একক রূপে। আর ভাষা ব্যবহারের সময়  শব্দের পরিচয় পাল্টে যায় পদে। আর কাজের ভিত্তিতে ব্যবহার  অনুযায়ী তা হয়ে যায় পদ। তবে  চল্লিশের  দশকে  ব্লুমফিল্ড(Leonard Bloomfield) যুগের পর  আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে,
ধ্বনির ঠিক পরবর্তী বৃহত্তর এককটি শব্দ নয়,সেটি হল রূপিম বা মূলরূপ বা রূপমূল (Morpheme)।  রূপিমই হলো শব্দ গঠনের মূল উপাদান এবং রূপিমই  বাক্যের মধ্যে শব্দের রূপ বৈচিত্র্য সাধন করে। 

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা যে উপভাষা  ব্যবহৃত হয় তা এই রূপিমের সাহায্যে। এই জেলার উপভাষায় শব্দ গঠন-প্রক্রিয়া এছাড়া রূপিমের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিয়ার কাল, পুরুষ, কারক, লিঙ্গ, বচনের প্রকারভেদ প্রভৃতি ব্যকরণগত দিক থেকে এই জেলার কথ্যভাষায় যে রূপ বৈচিত্র্য সাধন করে তার সেই মূল বৈশিষ্ট্যগুলো এখানে আলোচনা করা হল। 

১. রূপিমের(Morpheme)  সাহায্যে পূর্ব মেদিনীপুরের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় শব্দ গঠন প্রক্রিয়া    
রূপিমের সাহায্যে এই জেলার কথ্যভাষায় যে উপভাষায় শব্দ প্রধানত দুটি উপায়ে গঠিত হয়। যেমন- 
১.১ একটি মাত্র  রূপিমের সাহায্যে:-

ইঁট(ইট),আনিজ(সবজি),ওঁঠ(ঠোঁট), কাই(কোথায়), থোপ্(থুথু), দড়া(দড়ি), দাউলি(কাটারি),কাদু(কাদা),কেঁচুয়া(কেঁচো), গেড়িয়া(পুকুর), চুমুড়(চিংড়ি), লাথ(লাথি) , রসা (জুস),ভাতার (স্বামী) , ভঁদা (মোটা) , পিঠা (পিঠে) বউড়ি(বউ মা), সিঁথা (সিঁথি)। 
১.২ একাধিক রূপিমের  সমবায়ে  গঠিত রূপিম এই উপভাষায় চার ভাবে লক্ষ্য করা যায়। তা হল—

ক. মুক্ত রূপিম (Free Morpheme) + বদ্ধ রূপিম (Bound Morpheme) : 

টকা +গুয়া =টকাগুয়া (ছেলেগুলো) 
মাইঝি +মনে =মাইঝিমনে (মেয়েরা) 
মাউগ+টা=মাউগটা (স্ত্রী টি) 
মাসটার+ই=মাসটারি (মাস্টারি) 
গেড়িয়া+ধারে =গেড়িয়াধারে (পুকুরধারে) 
গাচ+নু=গাচনু (গাছ থেকে) 
জমিন+নু=জমিননু(মাঠ থেকে)
ভেড়া +ধারে =ভেড়াধারে (বড় বাঁধের ধারে) 
আস্+থ্যালা =আসথ্যালা (এসেছিল) 

খ.বদ্ধ রূপিম +মুক্ত রূপিমের গঠন:
অ+সভ্য=অসভ্য, অ+পরিচ্ছন্না=অপরিচ্ছনা
( পরিষ্কার নয়)  
বে+দুয়া=বেদুয়া (বেজন্মা), ও+উঠি =ওউঠি(এখানে), আ+ফুয়া=আফুয়া (মিথ্যাবাদী), উ+ধার =উধার (ধার নেওয়া),
তি+লোচন=তিলোচন(ত্রিলোচন) , বো+অসটম=বোসটম (বৈষ্ণব),

গ. বদ্ধ রূপিম+বদ্ধ রূপিমের সমবায়ে গঠনঃ

শুক্+লা=শুকলা (শুকনো) , হুড়্+কা= হুড়কা( পেছনে লাগা বা বাঁশ দেওয়া বা ক্ষতি করা), খাউ+কি=খাউকি (যে বেশি খায়), পেঁদা+আনি=পেঁদানি (শাসন করা), তো+নে=তোনে (তোরা),  গাঙ+এ=গাঙে (নদী) , মাঝু+নু=মাঝুনু(মাঝখানে),আমান+কে=আমানকে (আমাদের),

ঘ. মুক্ত রূপিম +মুক্ত রূপিম সমবায়ে গঠনঃ

হারাম+জাদা=হারামজাদা (গালি বিশেষ), 
সাপা+করা =সাপাকরা (পরিষ্কার),
সিজি+লওয়া= সিজি লওয়া (সিদ্ধকরা), 
ল্যাপাল্+মুসা= ল্যাপালমুসা (কাঠবিড়ালি ) , 
মেনুয়া +মুস্কা =মেনুয়া মুস্কা (চুপচাপ থাকা), 
লুক+লুকাঞি+মাল =লুকলুকাঞিমাল(বদমায়েশ লোক), 
ফুসুর+ফুসুর =ফুসুরফুসুর (আস্তে আস্তে কথা),ভাত+খাওয়াঞিঁ=ভাত-খাওয়াঞিঁ (অন্নপ্রাশন) , ব্যান+ধান=ব্যানধান (বীজ ধান) 

রূপিমের এই গঠন-প্রকৃতির যে পরিবর্তন তাতে অর্থেরও পরিবর্তন হয়। তবে এখানে বদ্ধ রূপিম অর্থাৎ প্রত্যয়- বিভক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। এই জেলায় যে মুক্ত রূপিম ও বদ্ধ রূপিম সংযুক্ত হয়ে যে শব্দ  গঠিত হয় তা বাংলা ব্যাকরণগত মিলও দেখা যায়। ফলে মুক্ত রূপিম ও বদ্ধ রূপিমের সংযুক্তির মাধ্যমে ক্রিয়ার কাল, কারক, পুরুষ, বচন প্রভৃতি নিয়ে ব্যাকরণগত ভাবে এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষা আলোচিত হল।  

২. ক্রিয়ার কাল
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষাতে যে উপভাষা উঠে আসে তা চলিত বাংলা অনুযায়ী এখানে ক্রিয়াপদের তিনটি কাল এবং একটা ভাব অনুজ্ঞা পাওয়া যায়। তাছাড়া কাল ও পুরুষভেদে  একইভাবে বচনের ক্ষেত্রেও ক্রিয়াবিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন—

কাল ও পুরুষভেদে( উভয় বচনে) পূর্ব মেদিনীপুর জেলার  মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় যে উপভাষা উঠে আসে। সেই উপভাষার ক্রিয়া -বিভক্তি রূপিম গঠনে মুক্ত রূপিমের সংযুক্তি এই জেলার ক্রিয়াবাচক শব্দ উদাহরণ সহ দেখানো হল। যেমন—
ক.√শু

বর্তমান কাল
-----------------

      উত্তম পুরুষ      মধ্যম পুরুষ    প্রথম পুরুষ 

সাধারণ  শুই    শোও/শোন /শু       শোয়

ঘটমান   শুইটি/শুচ্ছি   শুয়োটো /শুটু   শুয়েটে
                             
পুরাঘটিত  শুইছি    শুইয়াছো /শুইয়াছু, শুয়াছে


অনুজ্ঞা-   শুই         শুয়ো /শু          শুক/শউ  


অতীত কাল
----------------

         উত্তম পুরুষ   মধ্যম পুরুষ   প্রথম পুরুষ                                
সাধারণ   শুইথলি  শুথলো /শুথলু   শুথলো 

ঘটমান  শুইথলি   শুইথলো/শুইথলু  শুইথলো
  
পুরাঘটিত শুইয়াথাইলি শুইয়াথাইলো/শুইয়াথাইলু       শুইয়াথাইলো

নিত্যবৃত্ত  শুথলি       শুথলো/শুথলু          শুথলো


ভবিষ্যৎ কাল
-----------------

        উত্তমপুরুষ      মধ্যমপুরুষ     প্রথম পুরুষ        
সাধারণ   শুব          শুবে/শুবু          শুবে      

ঘটমান  শুতে রইবো শুতে রইবো/শুতে রইবু    শুতে রইবে

পুরাঘটিত  শুইয়া রইবো শুইয়া রইবো/শুইয়া রইবু   শুইয়া রইবে

অনুজ্ঞা      শুবো/শুবা          শুবে/শুবু              শুবে


জ্বলদর্চি পেজ-এ লাইক দিন।👇


আরও পড়ুন 

বিষয় -ধ্বনিতত্ত্ব(Phonology) 

Post a Comment

0 Comments