ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু
ও নদী নদী রে
জ্যোতি পোদ্দার
১
আমি যখন নদীর কাছে যাই নদী নদীর মতো
একা একা বকবক করতে করতে
অনেক দূরে সরে যায়।
কোথায় যায়?
কোন উৎসে?
আমি নদীকে পাই না।
আমার আর নদীর মাঝে বড় বড় নদী
আমাকে আর নদীকে দূরবাসী করে।
আছে বটে তবু দূর আত্মীয়
আছি বটে দূরদর্শক
একএকা বকবক করতে করতে
হয়ত কোথাও যাচ্ছে আমি চিনি না জানি না।
এই যে আমি সমস্ত শহর চরকির মতো ঘুরি---
কোথায় যাই আমি?
কোন উৎস ?
নদী কি জানে কোথায় আমার ঘর?
আমি নদী কাছে যাই নদীকে পাই না।
আমার আর নদীর মাঝে বড় বড় নদী
আমাকে আর নদীকে দূরবাসী করে।
২
চৈত বৈশাখে নদীর জল অনেকটা নেমে গেছে।
গরম মোটা বালির চর পেরিয়ে
বাবা বসেছেন নদীর কান্দায়
মা বসেছেন নদীর কান্দায়
জলে ভেজা বালুচরে হাঁটুমোড়ে দুইহাত বুকের কাছে এনে
বাবা বলছে সাথে সাথে মা বলছে সাথে সাথে আমিওঃ
আমি নদীর
আমরা নদীর
আমাদের সাতপুরুষ নদীর
আমাদের অনাগত পুরুষ নদীর
রোদ ও বাতাসের ঝাপটায় নিভু নিভু মাটির
প্রদীপের সাথে ভাসিয়ে দিলাম কলার সবুজ আগ পাতায়
রাখা সিঁদূর বাতাসা আর ধান আর দূব্বা
আর হাঁটু পরিমান ভোগাইয়ের জলে নেমে অঞ্জলি ভরা জল
নিয়ে জলেই ঢেলে দিলাম পর তিনবার।
বাবা বললেন গঙ্গাজলে গঙ্গা তর্পন
একটু দূরে হে মা গঙ্গা বলে ডুব দিয়ে মা উঠে এলেন পাড়ে।
ভেজা শরীরে লাল গামছার জলে গরম বালুচর
ভেজাতে ভেজাতে
মার সাথে আমারও পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে
৩
আমার শহরের নদীর নাম ভোগাই।
এপাড়ে তারাগঞ্জ বাজার
ওপাড়ে আড়াই আনি
তখন ব্রীজ ছিল না----কালিবাড়ি গুদারা ঘাট ছিল।
মোটা ভেজা বালুর চর ছিল।
বালু খুঁড়ে খুঁড়ে ছিল ছেলেবেলার বালুঘর।
আর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে জলের কম্পনে ভিজিয়ে নিতাম
আমার ধুলো পা।
আর প্রার্থনার মতো করে দুই হাতের গহ্বরে জল তুলে
নদীর জলেই উঁচু করে ঢেলে দিতাম নদীর জল।
বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে গড়িয়ে পড়ত
জলের ধারা--- আমার শহরের ভোগাইয়ের ধারা।
এখন গুদারা ঘাট নেই।
ধনুকের ছিলার মতো ব্রীজ আছে।
একাকী নিসঙ্গ বালুচুর নদী থেকে বহুদূরে সরে গেছে।
সরে গেছে স্মৃতি ও সম্পর্কের ভাঁজ
তখনো পারাপার ছিল।
এখনো পারাপার।
দুইয়ের পার্থক্য সামন্য শুধু নয় প্রান্তিকও বটে।
তখন পারাপারে যৌথতা ছিল
এখন পারেপারে ভিড়ের মাঝেও নিসঙ্গ পারাপার।
দুইয়ের পার্থক্য সামন্য শুধু নয় প্রান্তিকও বটে।
৪
মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে যে জল সে জলে আমি স্নান করতে পারি না।
শাওয়ারে স্নাত হলেও মন ভিজে না।
পাটভাঙা শাড়ির ভাঁজের মতো খসখস করে মন;
দেহ ভিজলেও মন চৈত্রের খরা চাতাল।
মাটি খোঁড়া জলই তো ভোগাইয়ের জল মিলেমিশে
জলে জলে গভীরে গভীরে জলদের জলময় পাড়া।
মাটি খুঁড়ে যে জল সে জলে তেষ্টা মেটে না
শাওয়ারের জলে জলমগ্ন বাথটব
ডুব সাঁতারেও মন ভিজে না।
যে জল শরীরে ভেসে থাকা ভাসান জীবন---
কোথাও গুদারা ঘাট নেই
ঘাটের শেঁওলা সিঁড়ি নেই
নেই কারো অপেক্ষার ছায়া।
সে জীবন চেয়েছি আমি।
সে আখ্যান নদীর ধারাপাতের আখ্যান
কেবলই বহতা কেবলই বহত.....
৫
গাছের বাঁকানো ডালে ঝুলতে ঝুলতে ঝুপ করে
গাঙের জলে লাফিয়ে পড়ছে শিবু।
শিবু সরকার আমার বন্ধু
গাঙের পাহাড়ি ঢলে ভোগাইয়ের জলে
কত কিছুর সাথে শিবু ভাসছে ডুবছে।
নদীর সাথে যেন পলান্তি পলান্তি খেলা।
বর্ষার বানের ঘোলা জলে গভীরে তলিয়ে গিয়ে
টুপ করে ওঠে আবার সাঁতারে উঠে আসছে পাড়ে।
আরো অনেকের সাথে আমিও পাড়ে বসে
শিবুর ভাসা ডোবা খেলা দেখতে দেখতে
সেদিনের মতো আজও ভাবি
ভাসান জীবন সকলের জীবন নয়
কারো কারো থিতুর জীবন।
নদী আমার বন্ধুকে নিলেও আমাকে নেইনি।
0 Comments