জ্বলদর্চি

ইউরােপ (লিথুয়ানিয়া)-র লোকগল্প / চিন্ময় দাশ

ইউরােপ (লিথুয়ানিয়া)-র লোকগল্প 

 চিন্ময় দাশ

বেড়ালের বুটজুতাে

এক দেশে ছিল এক জাঁতাওয়ালা। তিনটি ছেলে তার। লােকটি ভারি গরীব। সংসারে বলতে গেলে, তেমন কিছুই নাই। থাকবার মধ্যে ছিল একটা বুড়াে গাধা, একটা পােষা বিড়াল। আর ছিল আদ্যিকালের পুরাণাে জাঁতাটা।

একদিন মারা গেল লােকটি। বড় ছেলে বলল- আমি বড়। জাঁতাটা আমি নিলাম। এবার মেজো এগিয়ে এল- এখন তাে আমিই বড়! আমার পছন্দ আগে। আমি গাধাটা নিলাম।

রইল বাকি পােষা বেড়ালটা। অগত্যা সেটাই জুটল ছােটর কপালে। সে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল- মন্দকী ? একদিন পেট ভরে তাে খেয়ে নিই বেড়ালটাকে। বেড়ালের চামড়া দিয়ে একজোড়া দস্তানা বানিয়ে নেব। তারপর তাে মরতেই হবে অনাহারে।

কথাগুলাে বেড়ালের কানে গেছে। কিন্তু সে তা বুঝতে না দিয়ে বলল- অমন গােমড়া মুখ করে থাকবেন না, মনিব। বরং আমাকে একটা থলে দিন। তার সাথে এক জোড়া বুটজুতােও চাই মাপ মতন। তারপর আমি দেখিয়ে দেব, ভাগে খুব একটা ফেলনা জিনিষ জোটেনি আপনার।

বাড়িতে ইঁদুর ধরার বেলায় বেড়ালের অনেক কীর্তিই দেখেছে ছেলেটা। কখনও লাফিয়ে ওঠে, কখনও আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকে, কখনও বা পড়ে থাকে মড়ার মতনটি। বলা যায় না, লাগতেও পারে উপকারে-- এই ভেবে, একটা থলের বন্দোবস্ত করে ফেলল সে। তারপর যা দু-চারটে টাকাকড়ি ছিল, তাই দিয়ে বেড়ালের জন্য জুতসই একজোড়া বুটজুতাে বানিয়ে আনল মুচির বাড়ি থেকে।

বেড়ালের অনেক দিনের সখ একজোড়া বুট পরবে। এখন তা পেয়ে, ভারি খুশি। বুট পরে ঘাড়ে থলে নিয়ে, বেড়ালটা মাঠে এসে হাজির হল। দুটো সুতাে সেলাই করে নিয়েছে থলেটারমুখে। ভিতরে ভরেছে ভূষি আর ডালের দানা। একটা গর্তে অনেকগুলাে খরগােশ থাকে। গর্তের মুখে থলেটা পেতে দিয়ে, মড়ার মত ভান করে পড়ে রইল বেড়াল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না তাকে। যেমনটি চেয়েছিল, ঘটে গেল ঠিক তেমনটাই। একটা নধর খরগােশ এসে ঝঁপিয়ে পড়ল খাবারগুলাের উপর। আর যায় কোথায় ? ঝট করে থলের সুতাে দুটো টেনে দিল বেড়াল। অমনি খরগােশটা বাঁধা পড়ে গেল থলের ভিতরে।

মনিবের ঘরে গেল না বিড়াল। থলে ঘাড়ে নিয়ে, সে দেশের রাজার বাড়িতে এসে হাজির হল সে। সেপাই মােতায়েন আছে সদর দেউড়িতে। সে তাকে যেতে দেবে কেন ? বেড়াল গম্ভীর মুখে সেপাইকেই ধমকে বলল- রাজামশাইর জলখাবারেরমাংস এনেছি। দেখতে পাচ্ছিস না, বেকুব কোথাকার! মানে মানে তাকে দরজা খুলে দিল সেপাই।

সােজা দরবারে এসে হাজির হল বেড়াল। কুর্ণিশ করে রাজাকে বলল- আমাদের রাজগড়ের রাজামশাই একটা খরগােশ উপহার পাঠিয়েছেন আপনার জন্য। সদ্য খেত থেকে ধরে আনা। যেমন নধরটি, সুস্বাদুও হবে তেমনটি।

খুশি হয়ে রাজা বললেন- তােমাদের রাজামশাইকে আমার ধন্যবাদ জানিও।

ক'দিন বাদে, যবের খেত থেকে একজোড়া তিতির পাখি ধরে, দরবারে হাজির হল বেড়াল। রাজাও একইভাবে উপহার গ্রহণ করে ধন্যবাদ জানিয়ে দিতে বললেন বেড়ালের মনিবকে। সেদিন কিছু উপহার দিয়ে বেড়ালকে বিদায় দিলেন তিনি।

এভাবে একমাস যায়, দু'মাস যায়। তিন মাসও গেল। মাঝে মাঝেই রাজার দরবারে আসে বেড়াল উপহার নিয়ে। প্রতিবারই বলে- রাজগড়ের রাজামশাই পাঠিয়েছেন।

দরবারে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে বেড়ালটা। একদিন জানতে পারল, পরদিন সকালে বেড়াতে বেরুবেন রাজা। রাজকুমারিও থাকবেন সাথে।

ফিরে এসে নিজের মনিবকে সে বলল- আমার কথামত যদি চলেন, এবার কপাল ফিরে যাবে আপনার। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। কাল সকালে আমার সাথে বের হবেন। নদীতে নেমে স্নান করতে থাকবেন। তারপর যা করবার, সব আমার কাজ।

ছেলেটা বিড়ালের কথামত, পরদিন গিয়ে নদীতে নামল স্নান করতে। বেড়ালটা দাঁড়িয়ে আছে পাড়ে, রাস্তার উপর। একসময়, দেখা গেল রাজার রথ আসছে। অমনি বেড়াল চেঁচাতে লাগল- বাঁচাও, বাঁচাও। কে কোথায় আছাে। আমার রাজগড়ের রাজামশাই ডুবে যাচ্ছেন। বাঁচাও।

রাজার রথ তখন এসে গেছে। চেঁচামেচি শুনে রাজা উঁকি মারলেন জানালা দিয়ে। আরে, এ তাে সেই বেড়ালটা! -- রথ থামাও এখুনি। বলেই, সেপাইদের পাঠালেন সাহায্য করবার জন্য। তারা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটাকে তুলে আনতে।

সেই ফাঁকে বেড়ালটা তড়িঘড়ি চলে গেছে রাজার সামনে। গিয়ে বলল- আর এক বিপদ হয়েছে, রাজামশাই! আমার মনিব যখন জলে নেমেছেন, দুটো চোর এসে তার জামাকাপড় সব তুলে নিয়ে পালিয়েছে। চোরেরই বা দোষ কী? ঝলমলে দামি পোশাক দেখে, কার না লোভ হয়? আসলে আজ একা একা একটু বেরিয়েছিলাম আমরা। সেপাই-শান্ত্রী নেওয়া হয়নি। আমি কত চেঁচালাম চোর চোর বলে। কিন্তু কে আছে এখানে।

রাজার হুকুমে ধােপদূরস্ত পোষাক বের করে দেওয়া হল ছেলেটিকে। এমনিতে দেখতে বেশ সুন্দরই সে। তার উপর দামি পােষাকে তাকে সত্যিই রাজার মত দেখাচ্ছে।

রথের ভিতর থেকে রাজকুমারিও দেখল ছেলেটিকে। ভারি ভাল লাগল তার। ছেলেটিও দু'-এক পলক দেখেছে সেই মেয়েকে। চোখাচোখিও হল দু’জনের। তাতেই ছেলেটিকে ভারি ভাল লেগে গেল রাজার মেয়ের।

রাজা তাে ভারি খুশি এমন একজন রাজার সাথে দেখা হওয়ায়। এই লােকই তা এমন সব উপহার পাঠায়। খাতির করে তাকে রথে তুলে নিলেন- চলুন, একসাথে বেড়িয়ে আসি খানিকটা।

বেড়াল ভারি খুশি। তার ভাবনা ঠিক মতােই এগােচ্ছে। সে রথের অনেকখানি আগে আগে চলতে লাগল।

সামনে একটা বিশাল সবুজ ঘাসের মাঠ। অনেকগুলাে লােক ঘাস কাটছে সেখানে। বেড়াল দৌড়ে গিয়ে তাদের বলল- পেছনে রাজার রথ আসছে। তােরা বলবি, এই মাঠটা রাজগড়ের রাজার। নইলে সেপাইগুলাে কচুকাটা করবে তােদের। 
রাজার রথ এসে পৌঁছল। রাজা জানতে চাইলেন- মাঠটা কার হে? ভারি সুন্দর দেখতে।

লােকগুলাে বলল- কেন ? আমাদের রাজগড়ের রাজার।

রাজার পাশে বসে আছে ছেলেটি। সে বলল- সারা বছর ঘাসে ভরে থাকে মাঠখানা। গরু-মােষের জন্য বরাদ্দ এই মাঠ।

বেড়াল চলেছে রথের আগে আগে। এবার দেখা গেল বিরাট এক ফসলের খেত। কিছু লােক ফসল তুলছে। বেড়াল একই ভাবে তাদের হুমকি দিয়ে রাখল।

রাজার রথ এসে থমকে গেল আবার। এত বিরাট মাঠ! পাকা ফসলে ভরপুর! জানতে চাইলেন- কার মাঠ গাে এটা ?

লােকগুলাে একসাথে বলে উঠল- কেন ? আমাদের রাজগড়ের রাজার। শুনে রাজা ভারি খুশি। পাশে বসা ছেলেটির হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন- 
 চলুন, একবার প্রাসাদটা দেখে আসি আপনার।
ভারি ভড়কে গেল ছেলেটা। এবার কী হবে? সবই ধরা পড়ে যাবে এবার। গর্দানটাই না যায় রাজার হাতে! ভয়ে ভয়ে বেড়ালটার দিকে চাইল সে। এই হতভাগার জন্য এখন এই বিপদ!

বেড়াল ভারি খুশি। সে গদগদ হয়ে বলল- এ তাে আমাদের ভারি সৌভাগ্যের কথা। তবে, প্রাসাদে ঢােকার আগে, একটু সময় থামতে হবে আপনাকে। আমি গিয়ে আগে সাফসুতরাে করে আসব। আপনার উপযােগী করে একটু গােছগাছ করে নিতে হবে তাে সব, তাই।

কথাটা বলে না বলেই, সামনে দৌড় লাগাল বেড়াল। কিছু দূরে এক দৈত্যের একটা প্রাসাদ ছিল। সেখানে হাজির হয়ে বলল- এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনাকে কুর্ণিশ না করে, যাই কী করে? তাই ঢুকে পড়েছি।

দানবটা ভারি খুশি। সবাই তাকে ভয় পায়। সবাই দূরে দূরে থাকে। একজন অন্তত সম্মান জানাতে এসেছে। ভারি আদর করে বেড়ালকে বসাল সে।

বেড়াল বলল- শুনেছি, চাইলেই আপনি নাকি যে কোন জীবের রূপ ধরতে পারেন। এই যেমন বাঘ, সিংহ বা হাতির মত বড় বড় জীবেরও।

দৈত্যটা বলল- ঠিকই শুনেছ। এই দেখাে না, তােমার সামনেই আমি সিংহ হয়ে যাচ্ছি।

একেবারে গায়ের পাশেই একটা জলজ্যান্ত সিংহ! বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে দরজার পাল্লার মথায় চেপে বসল বেড়ালটা। যদিও পায়ের বুটজোড়াটার জন্য অনেক কসরত করতে হল উপরে উঠতে। একটু বাদে দৈত্য যখন নিজের চেহারায় ফিরে এল আবার, ঝুপ করে নেমে এল বেড়াল। বলল--  সত্যি বলতে কী, ভারি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে, সিংহের চেহারাতেও আজ বােধহয় রেহাই পাবেন না আপনি।

বেড়ালের কথা শুনে, দৈত্য বলল- কেন বলতাে ?

বাঁচবেন কী করে? দেশের রাজা আসছে আপনাকে বধ করতে। পুরাে সৈন্যদল সাথে নিয়ে। 
জানালা দিয়ে তাকাতেই, দূরে রাজার রথ দেখতে পেল দৈত্য। পিছনে লােক-লস্করও আছে কিছু। ভয় পেয়ে সে বলল- তাহলে, কী করা যায় এখন ? শমন যে একেবারে শিয়রে।

বেড়াল মওকা পেয়ে গেল। বলল- তাই তাে চুপিসারে সাবধান করে দিতে এলাম আপনাকে। একটাই উপায় আছে এখন। যদি ছােট্ট কিছুর রূপ ধরে ফেলতে পারেন, সহজেই লুকিয়ে পড়তে পারবেন। তাছাড়া রেহাই নাই আজ।
চোখের পলকটিও পড়ল না। ছােট্ট একটা ইঁদুর হয়ে গেল দৈত্যটা। ঘরের কোণায় গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল। আর রাজার চোখে পড়বে না নিশ্চয়।

বেড়াল তাে এটাই চাইছিল। সে এক লাফে গিয়ে পড়ল ইদুরটার ঘাড়ে। কপ করে ধরে, কচমচ করে চিবােতে লাগল দৈত্যটাকে।

ওদিকে রাজার রথও এসে গেল।

বিরাট প্রাসাদ দৈত্যের। বাড়িটাকে ঘিরে গভীর জলের এক পরিখা। তার সাঁকো পেরিয়ে ঢুকতে হয় ভিতরে। সাঁকো পার হয়ে, সােজা প্রাসাদে এসে দাঁড়াল রথখানা। বেড়াল এক দৌড়ে সেখানে গিয়ে রাজাকে বলল- আমার মনিব, রাজগড়ের রাজার প্রাসাদে আপনাদের স্বাগত জানাই। দয়া করে ভিতরে আসুন। 

তােমার মনিবের মানে? এটা কি এরই প্রাসাদ নাকি? রাজা যেমন ভারি চমকে গেলেন, তেমনি খুশিও হলেন।

বেড়াল সে কথার জবাব না দিয়ে, রাজাকে কুর্ণিশ করে বলল- দয়া করে ভেতরে আসুন।

রাজা নামলেন। ছেলেটি নামল। রাজকুমারি রথ থেকে নেমে, দু’জনে হাত ধরাধরি করে চলল রাজার পিছু পিছু।

তখন ভােজের আয়ােজন চলছিল প্রাসাদে। বিশাল হলঘরে থরে থরে খাবার আর পানীয় সাজানাে। ঝাড়বাতির রঙীন আলােয় ঝলমল করছে পুরাে প্রাসাদ। লােকজনের ছােটাছুটি।

ভারি ভূরিভােজ হল সকলের। রাজা ঘুরে ঘুরে দেখলেন প্রাসাদটা। তাঁর নিজের প্রাসাদটা কিছুই নয় এর কাছে। রাজার পিছনে রাজকুমারি। ছেলেটার হাত এখনও তার হাতে ধরা। তারও ভারি পছন্দ হয়েছে প্রাসাদটা।

রাজা বললেন ছেলেটিকে-- আমার একটি মাত্র সন্তান এই মেয়ে। আমার দু'চোখের মণি। তাকে আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। আমার অনুরােধ, আপনি অরাজী হবেন না!

ছেলেটার তাে বুক ফেটে যাওয়ার জোগাড় আনন্দে। কী বলবে, ভেবেই পেলনা। সে আড়চোখে চাইল বেড়ালের দিকে।

বেড়ালটা রাজার সামনে গিয়ে কয়েক বার কুর্ণিশ করল- রাজকুমারি এখানে রানি হয়ে থাকবেন? এটাকে আমরা সৌভাগ্য বলেই মনে করব, রাজামশাই। তবে একটা কথা আছে।
জবাব শুনে রাজা ভারি খুশি। বললেন- বলাে, কী কথা।

একটিই তাে সন্তান আপনার। বেড়াল জবাব দিল- মেয়ে তাে এখানে থাকবে। | ওখানে একা একা রাজবাড়িতে থেকে কাজ নাই আর আপনার। আপনি এখানেই চলে আসুন। সৈন্য-সামন্ত, লােক-লস্কর সব নিয়ে। তাতে মেয়ে চোখের আড়াল হবে না আপনার। মেয়েও খুশি হবে।
রাজা খুশি। রাজকুমারি খুশি। কেবল ছেলেটা খুশি নয়। তার মন খচখচ করতে লাগল। সে আড়ালে ডেকে বেড়ালকে বলল- সবই ভাল করেছ। কিন্তু বুড়াে রাজাটাকে আসতে বললে কেন?

তবে কি দৈত্য বাহিনীর হাতে মরতে চান ? রাজা চলে গেলেই, তারা এসে হাজির হবে। তখন কে বাঁচাবে আমাদের?

এবার ভারি খুশি ছেলেটিও। মাথা আছে বলতে হয়, হতভাগা বেড়ালটার!

ভারি ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল রাজার মেয়ের। নিজের রাজধানি ছেড়ে, সব তুলে নিয়ে চলে এলেন রাজামশাই। সবাই ভারি সুখে বাস করতে লাগলেন রাজগড়ের প্রাসাদে।

তবে সবচেয়ে সুখী বেড়ালটা। নিজের বুদ্ধির প্রমাণ দিয়েছে সে। সবাই তাকে খাতিরও করে খুব। কোন কাজই নাই তার। সারাদিন পায়ে ঝকঝকে বুটজোড়া পরে, মসমসিয়ে ঘুরে বেড়ায় প্রাসাদের এখানে ওখানে।

এ জন্যই বলে- ছােট বলে, কাউকে হেলা-ফেলা করতে নাই। কার কী ক্ষমতা, কে বলতে পারে ?

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments