জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-৭/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৭

শুভদীপ বসু

বিষয়-কণ্ঠস্বর(দ্বিতীয় অধ্যায়)
স্বর-প্রক্ষেপণ:

সাধারণত প্রক্ষেপণ অনুযায়ী স্বরকে কে পাঁচভাগে ভাগ করা হয়।
১)অ্যাবডোমেন বা নাভি থেকে প্রক্ষেপণ।
২)লিপটাং বা মুখ গহ্বর থেকে প্রক্ষেপণ।
৩) হুইসপারিং বা ফিসফিস করে প্রক্ষেপণ।
৪)ন্যাজাল বা নাকের সংস্পর্শে প্রক্ষেপণ।
৫) হেড রেজিস্টার বা মস্তিষ্ক ছুঁয়ে নাক-মুখ জিহ্বা দিয়ে প্রক্ষেপণ।

কোন গভীর স্বরে কথা বা গম্ভীর হয়ে বলা কিংবা দীর্ঘনিঃশ্বাস এর সাথে ভেতর থেকে উচ্চারিত কথা আসে নাভি থেকে স্বরক্ষেপণ এর মাধ্যমে। স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার সময় মুখগহ্বর থেকেই স্বর প্রক্ষিপ্ত হয়।একজন অভিনেতা বা আবৃত্তিকার সাধারণত যে স্বরে কথা বলেন সেটি তার ক্ষেত্রে লিপটাং থেকে উদ্ভূত।যখন কোন কথা গোপনে বা আবেগে বুঝে আসা গলায় ব্যবহৃত হয় তখন ফিসফিস করে বলা হয়।দূরের কাউকে ডাকার সময় আমরা একটু নাকঘেঁষা স্বর প্রক্ষেপণ করে থাকি। যাকে ন্যাজাল বলি। আবদারের অভিব্যক্তি বোঝাতে এই স্বরক্ষেপণ প্রয়োজনীয়।যন্ত্রণা বা আর্তি, অসহ্য ক্রোধ বোঝাতে যে ধরনের স্বরক্ষেপণ করা হয় তা যেন আমাদের নাক,মুখ সব স্থান দিয়ে বেরোতে থাকে।আবার মস্তিষ্কের সঙ্গে তার যেন একটা সরাসরি যোগ থাকে। এইরকম মস্তিষ্ক  ছুঁয়ে নাক-মুখ জিহ্বা দিয়ে সর প্রক্ষেপণ কে বলে হেড রেজিস্টার।এই যে পাঁচটি প্রক্ষেপণ স্থান নির্দেশিত হলো তা সম্পূর্ণ ভাবেই বিজ্ঞান প্রদর্শিত স্বরস্থান।

অনুশীলন:

এটি অনুশীলনের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্তধারা নাটকের একটি গান নীচে প্রদর্শিত হল। এই গানটি বিভিন্ন স্বরে প্রক্ষেপণের মাধ্যমে বলার অভ্যাস করলে আরো সুন্দর হতে পারে-
"নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র।
তুমি চক্রমুখরমন্দ্রিত,
তুমি বজ্রবহ্নিবন্দিত,
তব বস্তুবিশ্ববক্ষোদংশ,
      ধ্বংস বিকট দন্ত।
তব দীপ্ত অগ্নি শতশতঘ্নী
      বিঘ্ন বিজয় পন্থ।
তব লৌহগলন শৈলদলন,
      অচলচলন মন্ত্র।
কভু কাষ্ঠলোষ্ঠ ইষ্টক দৃঢ়,
     ঘন পিনদ্ধকায়া।
কভু ভূতল জল-অন্তরীক্ষ-
     লঙ্ঘন লঘু মায়া।
তব খনিখনিত্রনখবিদীর্ণ
       ক্ষিতি বিকীর্ণ-অন্ত্র,
তব  পঞ্চভূতবন্ধনকর
       ইন্দ্রজাল তন্ত্র।"

জিভের সঠিক ব্যবহার:

উচ্চারিত শব্দ বা বাক্যকে কন্ঠ দিয়ে মানুষের কানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জিভের একটা বড় ভূমিকা আছে। মুখের মধ্যে জিভ এর ঠিকঠাক নড়াচড়া এবং কণ্ঠকে সহায়তা করার জন্য জিভের ও কিছু কিছু অনুশীলন করা যেতে পারে-
১) মুখ থেকে জিভ থেকে বের করে যতদূর সম্ভব প্রসারিত করার চেষ্টা করা।
২) জিভটিকে একেবারে ভাসিয়ে রাখা। তা যেন ওষ্ঠ বা অধরে স্পর্শ না করে।
৩) জিভকেদুটি গালের ভেতরের দিকের অংশে স্পর্শ করানো। ৪)দাঁতের ভেতর দিকের অংশকে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে জিভ দিয়ে স্পর্শ করা। এক্ষেত্রে ওপরের এবং নিচের দাঁতের মাড়িতে স্পর্শ করতে হবে।
৫) দাঁতের ঠিক নিচে ভেতর দিকে মাড়ির যে অংশ তা জিভ দিয়ে স্পর্শ করতে হবে।
৬) জিভকে সম্পূর্ণ উল্টে আলজিভের দিকে যতদূর নিয়ে যাওয়া যায় তার চেষ্টা করা।
৭)উপরের যে তালু রয়েছে যাকে আমরা টাকরা বলি তাকে জিভ দিয়ে চাটার মত করে বোলানোর চেষ্টা।
নাকের সঠিক ব্যবহার:

কন্ঠকে সঠিক রাখার জন্য নাক সব সময় খোলা থাকা প্রয়োজন। আমরা বলতে পারি,নাক যদি না খোলা থাকে তাহলে 'ন'উচ্চারণ সব সময় 'ল'শোনায়। তাই নাকি এর কোনো জটিলতা বা অসুস্থতা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

ঠোঁট, দাঁত, মূর্ধার সঠিক ব্যবহার:

কন্ঠের অনুরণন এর জন্য এগুলি রেসোনেটারের এর কাজ করে।তাই যদি কারো দাঁতের সমস্যা থাকে অথবা তার দাঁতগুলো যদি বানানো হয় সে ক্ষেত্রে কণ্ঠস্বরে তা ধরা পড়ে।আবার কারো যদি ঠোঁটে কোন সমস্যা থাকে জন্মগতভাবে সে যদি ঠোঁট কাটা হয় স্বরক্ষেপণ এ অবশ্যই তার প্রভাব পড়বে।

কণ্ঠস্বরের অসুখ:

১)ল্যারিনজাইটিস-একে লারিংস এর প্রদাহ বলে। হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, সাইনাসটিস,টনসিল সহ মুখ ও নাক-কান-গলার নানা অসুখে যারা ভোগেন তাদের অতিরিক্ত চিৎকার-চেঁচামেচি বা নেশা বা ঋতু পরিবর্তনের সময় এই রোগ হয়ে থাকে।লারিংস এর দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ দেখা যেতে পারে বিকৃত স্বরে কথা বললে বা অতিরিক্ত কথা বললে বা ওষুধ থেকে বা ধোঁয়া,ধুলোর পরিবেশে বসবাস করলে।জীবিকার জন্য যারা স্বরের ওপর নির্ভর করেন যেমন-উকিল,শিক্ষক,পেশাদার অভিনেতা,হকার বা গায়ক-গায়িকাদের সকলেরই কিন্তু স্বরের ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।
২)ডিসফাসিয়া: মস্তিষ্কে নানা অসুখে গলার স্বর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।মোটর ডিস্ফাসিয়া তে রোগী সব দেখতে পারে বুঝতে পারে লিখতে পারে কিন্তু সেই চিন্তাগুলোকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না।আবার সেনসরি ডিসফাসিয়া তে রোগী অপরের কথা বুঝতে পারে না ফলে সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে না।
৩)ডিসফোনিয়া-নানা কারণে গলা ভেঙে দিতে পারে বা বসে যেতে পারে। অনেক সময় বেশী জোর দিয়ে কথা বলতে গেলে হঠাৎ করে স্বরের তন্তুতে সংকোচন হয় ফলে কথা বন্ধ হয়ে যেতে পারে একে মোগিফোনিয়া বলে।
৪)ডিসারথ্রিয়া-কথা বলার জন্য যেসব মাংসপেশি যেমন তালু,দাঁত বা অন্যান্য অঙ্গ কাজ করে তাদের কোন বিকৃতি ঘটলে কথা বলার অসুবিধে হয়। ফলে বিকৃত স্বর উৎপন্ন হয়।
কন্ঠের যত্ন নিতে গেলে অবশ্যই করণীয় কিছু কর্তব্য:
১) অযথা চিৎকার করে কথা বলা উচিত নয় এতে ভোকাল কর্ডে চোট লাগতে পারে।
২) অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অর্থাৎ ধোঁয়া-ধুলো গলার ক্ষতি করতে পারে। তাই এ থেকে সর্তকতা জরুরি।
৩) ধূমপানসহ সব ধরনের নেশা বর্জন করা জরুরি।
৪) খুব গরম বা খুব ঠান্ডা জিনিস খেলে বা হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা বা গরম পরিবেশে গেলে গলা ধরে যেতে পারে। এগুলো থেকে নিজেকে এড়িয়ে চললেই ভালো।
৫)শ্বাস পথে,ল্যারিংসে বা গলা বা মুখের ভেতর কোনো অসুখ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে।
৬)যারা পেশার জন্য স্বরকে ব্যবহার করেন,যেমন- শিক্ষক, উকিল,হকার,কন্ডাক্টর বা অভিনেতা তাদের নিজেদের গলা কতটা উঠতে পারে অর্থাৎ ভোকাল সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। নিজের সীমার বাইরে গলা তোলা উচিত নয়।
৭) গায়ক বা অভিনেতা বা আবৃত্তিকাররা এসব ক্ষেত্রে সব সময় ট্রেনারের সাহায্য নেবেন।
৮) গলা ভেঙে গেলে সবথেকে বড় চিকিৎসা মনে হয় গলা কে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দেওয়া। এক্ষেত্রে একেবারেই কথা বলা যাবে না আর অবশ্যই গলায় ভাপ নিতে হবে নুন জলে প্রয়োজনমতো গারগেল করতে হবে।
৯) অনেক সময় আমরা দেখি কিছু জন বিশিষ্ট মানুষদের অনুকরণ করেন। কেউ লতাজির মত কণ্ঠস্বর কেউ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতমত কণ্ঠস্বর করতে চান।আমার মনে হয় বিশিষ্ট মানুষদের গলার নকল করার প্রয়োজন নেই এক্ষেত্রে আপনি আপনার নিজস্বতা হারিয়ে বিপদের মুখে পড়তে পারেন।
১০) কণ্ঠস্বরের সাথে পেটের অসুখের একটি যোগাযোগ রয়েছে সেজন্য গলার যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে পেটের ও যত্ন নিতে হবে অর্থাৎ অ্যাসিড যাতে না হয় এরকম খাবার বাঞ্ছনীয়।

পরিশেষে বলি আমাদের কন্ঠ আমাদের সম্পদ।আমাদের আইডেন্টিটি। তাই একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।শুধু সুন্দর মুখ নয় সুন্দর কন্ঠস্বরের জয় সর্বত্রই। আপনার ভালো কণ্ঠস্বর এর জন্যই আপনি সকলের থেকে একটু আলাদা হবেন,লোকে আপনাকে একটু অন্য চোখে দেখবে। মঞ্চে হোক বা আপনার পেশাগত কোন জায়গায় হোক বা দীর্ঘক্ষন ট্রেন বা বাস যাত্রার সময় অপরিচিত ব্যক্তিদের সাথে আলাপচারিতায় হোক আপনার ভালো কণ্ঠস্বর আপনাকে সকলের থেকে আলাদা করবে। আপনার ভালো কন্ঠের দরুন অন্যের স্মৃতিতে আপনি রয়ে যাবেন চিরকালীন। তাই বিখ্যাত একটি বাংলা ব্যান্ডের গান আমি যখন শুনি 'ত্বকের যত্ন নিন' তখন আমারও বলতে ইচ্ছে হয় স্বরের যত্ন নিন।
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments