জ্বলদর্চি

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষা - ১৩/ বিমল মণ্ডল

Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণঃ

বিমল মণ্ডল 

পর্ব-১৩ /তৃতীয় অধ্যায় 

রূপতত্ত্ব (Morphology) 


৭.কারক

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় সাধারণভাবে চলিত বাংলার মতো এখানকার যে উপভাষা পরিলক্ষিত হয়। তাতে বিভিন্ন কারককের ব্যবহার  সমস্ত বয়সের মানুষের  কথ্যভাষায় ধরা পড়ে। এই উপভাষায়তে কর্তৃকারক, কর্মকারক, করণ কারক, নিমিত্ত কারক, অধিকরণ কারক ও সমন্ধপদের ব্যবহার রয়েছে। সেই কারকগুলোর  কারক -চিহ্নগুলি (Case -mark)  হলো। যেমন—

কারক                         একবচন                      বহুবচন       
----------------------------------------------------------------

কর্তৃকারক                 -০, -, -র, -কে          -কের, -দের,-নে,গুয়া  
                                  - টা,   -মা                         -গুলা, গুলো, 
----------------------------------------------------------------

কর্মকারক                 -০,-কে, -টি,               -কের, -রো  
----------------------------------------------------------------
করণ কারক             -০, -রো, -তে, দিয়া,   -দিয়া,রো কো,ইতে, 
                                   হতে/হত্তে, নু,টা,-
----------------------------------------------------------------------
নিমিত্ত  কারক           কু, রো, তে          -তে,কো ,-জানে, লাগুকি
----------------------------------------------------------------
অপাদান কারক     ০,নু, থেকিতে,    চাইতে,কাচনু  লাগি,           
                              তে,ছাড়িকি, রো,   পালিকি, দিকি,চাইনু 
----------------------------------------------------------------
অধিকরণ কারক     -০, রো, নু,রা,          এ, কো, থাকত্যা, রো, 
----------------------------------------------------------------
সম্বন্ধপদ                       রো, র,             টির, রো, 
----------------------------------------------------------------

৭.১ কর্তৃকারক

এই জেলার কথ্যভাষায় একবচনে 'শূন্য', বিভক্তি এবং বহুবচনে 'কের' বিভক্তির প্রয়োগ রয়েছে। যেমন—

i.তুই গাঙে মাচ ধত্তে যাবু নু? (তুই নদীতে মাছ ধরতে যাবি না?) 
ii.মোর নৌকায় মেলা ভলা মাচ পড়থলো। (আমার নৌকায় অনেক ভোলা মাছ পড়ছিল।) 
iii.তোরমোনকের কতো টঙ্কা হউছি?(তোদের কত টাকা হয়েছে?) 
iv.আমানকের ঘরে কত অভাব জাঁউ?(আমাদের ঘরে কত অভাব  জানিস?)
v.অনুপ বোট লেকে দরিয়ামে  যাতে। (অনুপ নদীতে নৌকা নিয়ে যাচ্ছে।) 

এছাড়া এই কর্তৃকারকের একবচনে 'টা, ট্যা,' 'মা' এবং বহুবচনে এর, গুয়া,নে, কেরো/কের, দের,গুলা বিভক্তি অধিক পরিমাণে প্রচলিত আছে এই জেলার মৎস্যজীবী  সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায়। 
যেমন-

i. তোরমা লোকটা যাটে। (তোর দিকে লোকটা যাচ্ছে।) 
ii.    মাছের দাম যেনো হুহু করিয়্যা বাড়েঠে। (মাছের দাম যেন হুহু করে বাড়ছে।) 
iii.মাচগুয়া পচিয়ালো। (মাছ গুলো নষ্ট হয়ে গেল।)
iv.তোনে বোড়ো বোটে কবে যাবু? (তোরা বড়ো নৌকাতে কবে যাবি?)
v. তানকেরো ঘরো ঘরো অসুক হউছি। (তাদের ঘরে ঘরে অসুখ হয়েছে।) 

৭.২. কর্মকারক
এই জেলার কথ্যভাষায় কর্মকারকের একবচনে  'শুন্য', ',কে',রো, 'টা' বিভক্তি  এবং  বহুবচনে 'রো', 'কের' বিভক্তির আধিক্য দেখা যায়। যেমন—

i.শুকুড় তুই লিয়্যা যা। (এঁঠো তুলে নিয়ে যা।) 
ii.নৌকাটা মাজু গাঙে খেরাপ হইছে। (নৌকাটি মাঝ নদীতে খারাপ হয়ে গেছে।)
iii.  কানকের কানকের লিয়্যা আসবু কউটু? (কাকে কাকে নিয়ে আসবি বলছিস।) 
iv.নৌকারো আজু বরপ উঠিছু। (নৌকায় আজ বরফ উঠেছে।) 
v. সেল হ্যোতা হ্যা । (বিক্রয় হয়।)      
vi. লোকটারো অসুক হেইচু। (লোকটির অসুখ হয়েছে।) 

৭.৩. করণ কারক

চলিতবাংলার  মতো এই জেলার কথ্যভাষায়   একবচনে 'শুন্য'ঝুনকো, 'রো','তে', বিভক্তি  'দিয়া',' হত্তে', 'হতে' অনুসর্গ  এবং বহুবচনে  'দিয়্যা',' দিয়া' 'লিয়্যা' 'ইতে' অনুসর্গ  ব্যবহৃত হয়। যেমন—

i.উলোক ঢাপ্পাঝুনকো বহুদ্ দূর নাহি যা সাক্তে। (ঐ লোকটি সাঁতার দিয়ে বেশি দূর যেতে পারে নি।) 
ii. লোকটা নৌকা লিকি যাইথিলা, সাপে কামড়ি দেইছু।(লোকটি নৌকা নিয়ে গিয়েছিল, সাপে কামড়ে দিয়েছে।) 
iii. গেড়িয়াধার  দিয়্যা চোরটা পালিছে। (পুকুরধার  দিয়ে চোরটা পালিয়ে গেছে।) 
iv.দাউলিতে নারকোল ছাড়াইব্যা। (কাটারিয়ে নারকেল ছাড়াবো।) 
v.আইজকে রেশন দুয়া হবেনি। (আজকে রেশন দেওয়া হবে না।)   
 vi.টাকারো সবু মিলে। (টাকায় সব হয়।) 
vii.ভদ্রলোকো জালি অছি। (ভদ্রলোক পেশায় ধীবর।) 
viii.দুখোরো মোর দুচোখোরো পানি আসি গলা। (দুঃখে আমার চোখে জল এসে গেল।) 
ix.হাসি হাসি লুকোটা মরি গলা নি। (হেসে হেসে লোকটি মরে গেল।) 
x.তানকোর দ্বারা এ কামো হবো নি। (তাদের দিয়ে কাজটি হবে না।) 

৭.৪. নিমিত্ত কারক

এই জেলায় চলিত বাংলার মতো  এই কারক অর্থাৎ নিমিত্ত কারকের একবচনে 'কু', 'রো', 'তে' বিভক্তি ,এবং জানে জন্য, অনুসর্গ  এবং বহুবচনে 'তো', 'কে' বিভক্তি  'জানে' লাগুকি অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। যেমন-

i.নদীকু চলো মাছো ধরিয়া পাই।(নদীতে চলো মাছ ধরি।) 
ii.নৌকারো যিবো। (নৌকাতে যাবো।) 
iii.দুখি মানুষেরো পাখরো রুয়। (দুঃখী মানুষের পাশে থেকো।) 
iv.মাছেরো মোড়কো গাঁ রো সবু ছাই গলা না। (মাছের মোড়ক গ্রামে ছেয়ে গেছে।) 
v.গঙ্গাপূজা জালিমনকুর পুন্য কামো। (গঙ্গাপুজো জেলেদের পুণ্য কাজ।) 
vi.তোনকের জানে বাচিয়া আছি। (তোদের জন্য বেঁচে আছি।) 
vii.পূজার লাগুকি চাঁদা তুলিছো। (পুজোর নিমিত্তে চাঁদা তোলা হচ্ছে।) 

৭.৫.অপাদান কারক

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার  মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় এই কারককের আধিক্য দেখা যায়।  এই কারক চলিত বাংলার মতো একবচনে ও বহুবচনে  'কু','দিকি', 'র', 'তে'  এবং থাকতে, হোতে, চাইনু,  অনুসর্গ ব্যবহৃত হয়। যেমন—
i.পেদুর গাচনু কি পড়ি গেলা নাকি। (পিয়ারা গাছ থেকে পড়লো।) 
ii.চেয়ার ছাড়্ কি এঠি-ওঠি কাইকে যাউটু? (চেয়ার ছেড়ে এদিক ওদিক কোথায় যাও?) 
iii.নৌকাটা দীঘানু কি    হলদিয়া যিবো? (নৌকাটি কি দীঘা থেকে হলদিয়া যাবে?)     
iv.রাতেরো ললকু পাঁই সাবধানেরো রইবো। (রাতে সাপের  থেকে সাবধানে থেকো।) 
v.ঝড়ো লাগি ভয় পাইকি তড়াতড়ি ঘরকু চালি আইল্যা। (ঝড়ের ভয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলো।) 
vi.কলেরো মুক্ দিকি সবু সময় পানি পড়ু যাউছি। (কল দিয়ে ক্রমাগত জল পড়ে যাচ্ছে। 
vii.ইস্ কুল পালিকি কাই যাইথেলা?  (স্কুল পালিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?)

৭.৬.অধিকরণ কারক 

এই কারকের একবচন ও বহুবচনে  'রো ' নু,', 'রা', এ, তে, টে বিভক্তির ব্যবহার এই জেলার কথ্যভাষায় প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়। যেমন—
i.গইরা গাংরো ইলিশ মাছ মিলিব।(গভীর সমুদ্রে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়।) 
ii.টঙ্কারো পাঁচটা করিকি পাতিলেবু মিলতা এ্যাক সময়রো। (টাকায় পাঁচটা করে পাতিলেবু কিনেছি একসময়ে।) 
  
iii.    হটাত বিষ্টিরো রাস্তাঘাট পানিরো ভরি যাউছি। (হঠাৎ বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট জলে জলাকার।) 
iv.রাত বারোটারো অনুষ্ঠান  শেষ হইবি। (রাত বারটায় অনুষ্ঠান শেষ হবে।)
v.সকালনু মোর বাজারে যাইবাকু অভ্যাস। (সকালবেলায় বাজারে যাওয়া আমার অভ্যাস।) 
v.ঘরকো আসো। (ঘরে এসো।) 

৭.৭.সম্বন্ধ পদ

এই জেলার কথ্যভাষায় সম্বন্ধ পদে 'র','রো' ' এর' 'রু' এর প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন—

i.সাপরো পাঁচ পা দেখুচু? (সাপের পাঁচ পা   দেখেছো?)   
ii.গঙ্গার পাড়ো বসি রুয়। (গঙ্গার পাড়ে বসে থাকো।) 
iii.মাছেরো ডিম পন্ না গেড়িয়ারো ছাই গেলা। (মাছের ডিম পুকুরে প্রচুর হয়েছে।) 
iv.কামোরো টঙ্কা লি কি আসো। (পরিশ্রমের টাকা নিয়ে এসো।) 
v.মাথারো লাড়িয়্যা তেল দিও। (মাথায় নারকেল তেল মাখো।)       

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষা মান্যচলিত বাংলা ভাষা থেকে যে  কারকেরআলাদা  আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে তা যেমন উদাহরণ সহ দেখানো হল তেমনি পরবর্তী পর্বে একইভাবে  মান্যচলিত বাংলা ভাষা থেকে এই জেলার কথ্যভাষায়    উপসর্গ ও অনুসর্গের যে  পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে  তা  উদাহরণ সহ দেখানো হবে।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments