Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ
তৃতীয় অধ্যায়
রূপতত্ত্ব (Morphology)
পর্ব- ১৫
১০.সর্বনাম
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষায় ধরা পড়েছে মান্যচলিত বাংলার মতো বিভিন্ন পদের ব্যবহার। এই উপভাষায় হিন্দু, মুসলিম ধর্মের বিভিন্ন বয়সের কথা-বার্তায় সচারাচর ক্রিয়ার রূপ নিয়ন্ত্রণে পুরুষের ব্যবহার উঠে এসেছে।এখানে উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ এবং প্রথম পুরুষের যে ক্রিয়ার রূপ ধরা পড়ে তা এখানকার কথ্যভাষায় সেই রূপ একটু আলাদা। তা ছাড়া এই জেলার উপভাষায় পুরুষবাচক সর্বনাম পদের পূর্ণাঙ্গ ও বিচিত্র ব্যবহার দেখা যায়। যা চলিত বাংলার থেকে সামান্য পৃথক। সেই পুরুষবাচক সর্বনামগুলি হল -
----------------------------------------------------------------
পুরুষ একবচন বহুবচন
----------------------------------------------------------------
উত্তম মুই, মোর, হামকো, মোদের, মোনকের
আমি, হামার, আমানে, আমরা, আমাদের,হামরা
মোরমোনে,
আমাহারে,
----------------------------------------------------------------
মধ্যম তুই, তোকে, তুমি তোনে,তুমরা,তোদের
তোমার, তোর, তোরমোনকে,তোনকের
আপনি, তুদের, তুমাহারে
আপনারো আপনাদের,আপনারা
----------------------------------------------------------------
প্রথম ওর, অকে, সে, তার ওনে, অরা, তানে
ও, তিনি, তানকের, উরা,
তাকুকে তারমোনে, তারা,
---------------------------------------------------------------
১০.১. উত্তম পুরুষবাচক সর্বনাম
পুরুষ বাচক সর্বনামগুলির মধ্যে এখানে ব্যবহৃত একবচনের ক্ষেত্রে মুই, মোর,আমার, হামকো, আমি এবং বহুবচনের ক্ষেত্রে মোদের, মোনকের, হামরা, আমাহারে, আমাদের প্রভৃতি প্রাতিপদিক (Stem) হিসেবে ব্যবহার হয়। আবার উত্তম পুরুষবাচক সর্বনামের সাথে বিভক্তিবাচক বিকিরণ যোগ করে এই পদ নিষ্পন্ন হয়। যেমন-
----------------------------------------------------------------
বচন বদ্ধ/মুক্তরূপিম + বদ্ধরূপিম = পদ
(প্রাতিপদিক) (বিভক্তি)
----------------------------------------------------------------
একবচন
--------------
মু + ই = মুই (আমি)
হাম্ + কো = হামকো (আমাকে)
মোর + ০ =মোর (আমার)
আম্ + ই = আমি
----------------------------------------------------------------
বহুবচন
--------------
মোর্ +আ = মোরা (আমরা)
মো+দের = মোদের (আমাদের)
মোন্+ কের = মোনকের (আমাদের)
আমা +হারে = আমাহারে (আমাদের)
আমান্+ কের =আমানকের (আমাদেরকে)
মো+ নে = মোনে (আমরা)
হাম্ + রা =হামরা (আমরা)
---------------------------------------------------------------
উল্লিখিত একবচন ও বহুবচনে প্রাতিপদিক 'মু','হাম, 'মো' ও 'মোন' 'আমা', 'আমান' বিভক্তি 'ই', 'কো','র' ই'' এবং 'কের','হারে' 'নে'যোগ করে যে পদগুলি নিষ্পন্ন হয়েছে তা চলিতবাংলায় এই লক্ষণগুলো তেমন দেখা যায় না। তবে এই জেলার উপভাষায় সাধারণত এমন লক্ষণই হল অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১০.২. মধ্যম পুরুষবাচক সর্বনাম
মধ্যম পুরুষবাচক সর্বনামে একবচনের ক্ষেত্রে তুই, তোর, তুমকো, তুমি, তকে এবং বহুবচনের ক্ষেত্রে তোনে, তনে, তোদের, তোরা, তুদের, তোনকের, তনকের তুমাহারে প্রাতিপদিক হিসেবে ব্যবহার দেখা যায়। এই একবচন ও বহুবচনের ক্ষেত্রেই বিভক্তি বাচক বিকিরণ যোগ করে এমন পদ নিষ্পন্ন হয়। যেমন-
---------------------------------------------------------------
বদ্ধ/মক্তরূপিম + বদ্ধরূপিম =পদ (প্রাতিপদিক) (বিভক্তি বাচক)
----------------------------------------------------------------
একবচন
-------------
তু + ই = তুই
ত + র = তর(তোর)
তুমা + র = তুমার (তোমার)
ত +কে = তকে (তোকে)
তো+ কে = তোকে
তু+ কে = তুকে (তোকে)
তুমা +কে = তুমাকে (তোমাকে)
----------------------------------------------------------------
বহুবচন
----------------
তো/ত+রা = তোরা /তরা
তুন +কের = তুনকের (তোদের)
তোন/তন+ কের = তোনকের /তনকের (তোমাদের)
তর/তোর+হারে = তোরহারে (তোমাদের)
তোর +মোনকের = তোরমোনকের (তোদেরকে)
তুমা+হারে = তুমাহারে (তোমাদের)
--------------------------------------------------------------
উল্লিখিত মধ্যম পুরুষ বাচক এখানে মান্য চলিতের ন্যায় প্রাতিপদিক ব্যবহার করা হয়েছে তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই জেলার উপভাষায় একবচন ও বহুবচনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিভক্তি যেমন- 'কে','কের', 'হারে' যোগ করে এই পদ নিষ্পন্ন হয়েছে। যা এখানকার উপভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে এই বৈশিষ্ট্য কিন্তু চলিত বাংলায় দেখা যায়না।
১০.৩. প্রথম পুরুষবাচক সর্বনাম
উত্তম পুরুষবাচক সর্বনাম ও মধ্যম পুরুষবাচক সর্বনামের মতো এই জেলার উপভাষায় একবচনে তার, অর, ওকে, উনার, উহার, উকে, ও, তাকুকে, তিনি, তেনার এবং বহুবচনে ওরা, তারা, তাদের, তেনাদের, তারুনে, উহারা, উরা, অরা প্রাতিপদিক হিসেবে ব্যবহার হয় এবং বিভক্তি বাচক বিকরণ যোগ করে নতুন পদ তৈরি হয়।
যেমন—
---------------------------------------------
বদ্ধ/মুক্তরূপিম + বদ্ধরূপিম =পদ (প্রাতিপদিক) (বিভক্তি বাচক)
----------------------------------------------------------------
একবচন
----------------
ও+০ =ও (সে)
ও/অ+র =ওর/অর(তার)
তারু+র =তারুর (তাহার)
তাকু+কে=তাকুকে (তাকে)
তেনা+র =তেনার (তাঁর)
----------------------------------------------------------------
বহুবচন
-------------
ও/অ+রা = ওরা /অরা (তারা)
তারু+নে = তারুনে (তাহারা)
তারু+হারে = তারুহারে (তাহারে)
তেনা +রা =তেনারা (তাঁরা)
তারুন +কের =তারুনকের (তাদের)
----------------------------------------------------------------
এই জেলার উপভাষায় প্রথম পুরুষবাচক সর্বনাম পদের ক্ষেত্রে যে একবচন ও বহুবচনে প্রাতিপদিক হিসেবে যেমন -তারু, তাকু, তেনা এবং বিভক্তি রূপে 'র', 'কে', 'নে', 'হারে', 'কের' যোগ করে উল্লিখিত পদ নিষ্পন্ন হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি সাধারণত মান্যচলিত বা চলিত বাংলায় পুরোপুরি অনুপস্থিত। এই জেলার উপভাষার এটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১০.৪. চালুবাংলার মতো এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় ক্রিয়ার রূপ নিয়ন্ত্রণ করে এই পুরুষ বাচক সর্বনাম। এখানে মুক্ত রূপিমের সাথে পুরুষভেদে বদ্ধ রূপিম যুক্ত হয়ে মুক্ত রূপিমের গঠন-প্রকৃতির পরিবর্তন সাধন করে। পুরুষভেদে রূপের এই পরিবর্তন হলো—
১.ধরা-
--------------------------------------------------------------
পুরুষ মুক্ত + বদ্ধরূপিম = পদ (বিভক্তি)
উত্তম ধোর/ধর্ + /বা /বো=ধরবা/ধোরবো
(ধরবো)
মধ্যম ধোর/ধর্ + বে/বো/ =ধোরবে/ধরিবে
(তুমি)
মধ্যম ধোর/ধর্ + বু /বি= ধোরবু/ধরবু/ধরবি
(তুই)
প্রথম ধোর /ধর্ + বে = ধোরবে /ধরবে
----------------------------------------------------------------
২.যা-
----------------------------------------------------------------
পুরুষ মুক্ত + বদ্ধরূপিম বিভক্তি =পদ
----------------------------------------------------------------
উত্তম যা +যাব্বা/বা/ব্বো = যাবা/যাবো/যাব্বা
মধ্যম
(তুমি) যা + ব্বে/বে/যাবো/ =যাব্বে/যাবো
মধ্যম
(তুই) যা + ব্বু/বু =যাবু/যাব্বু
প্রথম যা +ব্বে /বে =যাব্বে /যাবে
----------------------------------------------------------------
উল্লিখিত ক্রিয়ার পুরুষভেদে রূপান্তরগুলো এই জেলার উপভাষাগুলো মান্য চলিত থেকে সামান্য আলাদা হওয়ায় এখানকার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় এমনই স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ে।
১০.৫.বিভিন্ন কারক ও বচন ভেদে সর্বনামের যে রূপভেদ চোখে পড়ে এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় তা হলো —
১.কর্তৃ কারক -
একবচন বহুবচন
উত্তম মোর মোদের
মুই মোরা
আমি আমানে
মধ্যম তুমি তুমরা তুই তোরা
প্রথম ও ওরা/অরা
তেনি তেনারা
২. কর্মকারক
একবচন বহুবচন
উত্তম মোকে মোনকের
আমাকে আমানকের
মধ্যম তুমাকে তুমাদেরকে
তোকে তোনকের
প্রথম ওকে উদেরকে
তাকু তারুনকের
ও অনকের
৩.করণ কারক
একবচন বহুবচন
উত্তম মোকে দিয়া মোনকে দিয়া
মোর দ্বারা মোদের দ্বারা
মধ্যম তুমাকে দিয়া তুমানকের দিয়া
তোকে দিয়া তোরহানকে দিয়া
প্রথম ওকে দিয়া ওরমনকে দিয়া
তাকুকে দিয়া তারুনকের দিয়া
৪.নিমিত্ত কারক
একবচন বহুবচন
উত্তম মোর জানে মোদের জানে
মুই তরে মোনকের তরে
মধ্যম তুমার জানে/তরে তুমানকের জানে
তোর জানে/তরে তোনকের জানে
প্রথম ওর জানে/তরে ওনকের জানে/তরে
৫. অপাদান কারক
একবচন বহুবচন
উত্তম মোর হোতে মোনকের হোতে
মোর থেকিয়া মোনকের থেকিয়া
মধ্যম তুমার থেকিয়া তুমানকের থেকিয়া
তোর চাইতে তোনকের চাইতে
প্রথম ওর চাইতে ওনকের চাইতে
ওর থেকিয়া ওরমোনকের থেকিয়া
৬.সম্বন্ধ পদ
একবচন বহুবচন
উত্তম মোর মোনকের
আমা-হারে আমানকে হারে
মধ্যম তুমার তুমানকের
তোর তোনকের
প্রথম ওর ওনকের
উল্লিখিত কারকে যে বচন ভেদে সর্বনামের যে পার্থক্য চোখে পড়ে এই জেলার উপভাষায় তা চলিত বাংলার অনুপস্থিত। এখানকার কথ্যভাষায় সাবলীলভাবে এই সর্বনামের ব্যবহারের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে।পরবর্তী পর্বে এই সর্বনামের বিভিন্ন শ্রেণি আলোচিত হবে।
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments