জ্বলদর্চি

যুগলবন্দীর নান্দনিক বিভা/ মৃণাল ঘোষ


যুগলবন্দীর নান্দনিক বিভা

মৃণাল ঘোষ


পৃথিবীর কবিতা কখনোই নিঃশেষ হয় না---সেই কবে লিখে গিয়েছিলেন কবি জন কিটস (১৭৯৫---১৮২১)৷ সেই পার্থিব কবিতা কিটসের আগেও ছিল, পরেও তা স্তব্ধ হয়ে যায়নি কখনো৷ আমরা কোনো কোনো বিরল মুহূর্তে মাত্র তা দেখতে পাই, অনুভব করতে পারি৷ তখন আমাদের সত্তা ঘিরে অলৌকিকের সুর অনুরণিত হতে থাকে৷ বুঝতে পারি আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে আমরা যেটুকু দেখি তার অভ্যন্তরে রয়ে গেছে অনেকটা না-দেখা৷ আমাদের আপাত-জানার ভিতরে রয়ে যায় এই না-দেখার বিরাট বিস্তার৷ আমরা যা দেখি এবং যেটুকু জানি--- তার পারস্পরিক সম্পর্কটা সব সময়ই অনেকটা অনিশ্চয়তায় মোড়া থাকে৷ অনেকটা এরকমই বলেছিলেন একবার প্রখ্যাত ইংরেজ কবি, ঔপন্যাসিক ও শিল্পতাত্ত্বিক জন বার্জার (১৯২৬---২০১৭)৷

বার্জার-এর এই উক্তিকেই মুখবন্ধ-স্বরূপ রেখে গড়ে উঠেছে ছবি ও সেই ছবির গহন থেকে তুলে আনা কবিতা-প্রতিম শব্দমালার সমন্বয়ে একটি বই৷ ‘উড়োপত্র’ প্রকাশিত সেই বইটির নাম ‘ছবি যখন...’৷ ছবি এখানে আলোকচিত্রেরই রূপান্তরিত এক রূপ৷ যার শিল্পী : প্রদীপ দত্ত৷ আর সেই ছবির প্রতিক্রিয়ায় শব্দমালা সৃজন করেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ৷ প্রদীপ দত্ত একজন প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামখ্যাত আলোকচিত্রী৷ তিনি প্রকৃতির ছবি তোলেন৷ কিন্তু আলোকচিত্রের মধ্যে রয়েছে যে দীর্ঘ-প্রবাহিত অনুপুঙ্খ-স্বাভাবিকতার উত্তরাধিকার, সেই স্বাভাবিকতাকে তিনি দ্রবীভূত করেন কল্পনার মায়া দিয়ে৷ দেখার ভিতর থেকে বের করে আনেন না-দেখা এক রহস্যময়তার সুরধবনি৷ দৃশ্যের নির্দিষ্টতাকে রূপান্তরিত করেন অনির্দেশ্য ও অসংজ্ঞায়িত রূপের বিভায়৷ শর্মিষ্ঠা একজন চিত্রশিল্পী ও সঙ্গীতসাধক৷ তাঁর ভিতর যে একটি কবিসত্তাও রয়েছে, এর পরিচয় ধরা রইল এই বইতে অন্তর্ভুক্ত তাঁর লেখামালায়৷

প্রদীপ দত্তর বারোটি আলোকচিত্রের প্রতিলিপি ও এর প্রত্যেকটিকে ভিত্তি করে শর্মিষ্ঠার একটি করে লেখা নিয়ে গড়ে উঠেছে ৩৫ পৃষ্ঠার এই বই৷ ভূমিকায় রয়েছে প্রদীপের এই বিশেষ ধরনের আলোকচিত্র নিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষের কিছু উপলব্ধি, যেখানে তিনি বলেছেন---‘‘আর প্রদীপ, সেই আকারটাকে দেখতে পেয়ে, তার মুহূর্তটাকে ধারণ করে নিয়ে... সৃষ্টি করে তোলে অসংখ্য তার উজ্জ্বল আলোকচিত্র, যেমন আছে ঠিক তেমনভাবেই,...’’৷ শঙ্খ ঘোষের এই লেখাটি আলোকচিত্রের মর্মে পৌঁছতে সাহায্য করে আমাদের৷

মানুষের খালি চোখের দেখা একটা নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ৷ সে যা দেখে সেটুকুই বাস্তবের পূর্ণ রূপ নয়৷ দেখাকে প্রসারিত করলে, তা যন্ত্রের সাহায্যেও হতে পারে, সেই বাস্তবের স্বরূপ পাল্টায়৷ এই প্রসারিত, বিস্ফারিত বা সংকুচিত দেখাকেই ক্যামেরার কারুকাজে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান প্রদীপ দত্ত৷ আর শিল্প তো সব সময় বাস্তব-লৌকিককে অলৌকিকে রূপান্তরিত করে৷ তাঁর এই আলোকচিত্র-ভিত্তিক চিত্রের বৈশিষ্ট্য এটাই৷ প্রকৃতির অনিঃশেষিত কবিতাকে ক্যামেরায় রূপবদ্ধ করেন তিনি৷ শর্মিষ্ঠার লেখা যে সেই দৃশ্যরূপের বর্ণনা বা বিশ্লেষণ করে, তা নয়৷ ওই ছবিটি দেখে যে অনুভূতি উদ্ভাসিত হয় তাঁর মনে, তাকেই তিনি শব্দের সাহায্যে রূপবদ্ধ করেন৷ কবিতার ধর্ম তো এটাই৷ এই বইকে তাই বলা যায় দৃশ্য-প্রতিমা ও কাব্য-প্রতিমার এক যুগলবন্দী৷ এরই দু-একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করব আমরা৷

ছবি তো বর্ণনায় বোঝানো যায় না৷ আমরা বরং শর্মিষ্ঠার শব্দমালা থেকে বুঝতে চাইব ছবিটির নান্দনিক স্বরূপ৷ প্রথম ছবিটি নিয়ে তিনি লিখছেন এরকম: ‘ভোর হতে না হতেই ধানের শিষের সোনালি রং সোনালি আলো নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে...একফালি সোনালি পাতার ফাঁক গলে এসে পড়েছে পুরোনো বাড়ির দেওয়ালে... বাড়ির গায়ে এ যেন এক নতুন ছন্দ, নতুন ভঙ্গি...ফাটল-ধরা বাড়ির দেওয়ালে পাতার অবয়বকে সামনে রেখে লুকিয়ে আছে সে... এক পূর্ণতা...’৷ এ থেকে হয়তো ছবির সত্তার অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছতে পারেন দর্শক৷

আর একটি ছবির বিষয় হয়তো ছন্দে প্রসারিত একটি লতা৷ সে-সম্পর্কে লেখার শেষ বাক্যটি এরকম: ‘শব্দ যে শব্দহীন হয়ে বসে আছে সরু ডালের উপর... পাতার সৌন্দর্য কি দাবি করে এক রূপরেখাকে!... এক কল্পনাকে!...’

আর দৃষ্টান্ত না বাড়িয়েও বুঝতে হয়তো অসুবিধা হবে না ছবির দৃশ্যসত্তা কেমন করে অনুরণিত হয়েছে শব্দের ব্যঞ্জনায়৷ এই যুগলবন্দীরও রয়েছে বিশেষ এক নান্দনিক বিভা, যা এই প্রকাশনাকে সার্থক করেছে৷


ছবি যখন...৷ ছবি: প্রদীপ দত্ত   শব্দ-ছবি: শর্মিষ্ঠা ঘোষ৷ ‘উড়োপত্র’ প্রকাশন৷ ২০০ টাকা

বইটি সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ: ৯৪৩২১৬৫১৬৯


জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন

http://www.jaladarchi.com/2020/12/bangladeshnama-deep-mukhopadhay.html



Post a Comment

0 Comments