জ্বলদর্চি

পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম কোয়ারান্টিনে কে ছিলেন?দুর্গাপদ মাসান্ত

পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম কোয়ারান্টিনে কে ছিলেন?

দুর্গাপদ মাসান্ত


নাম মেরি ম্যালন, পেশায় পাচক, মার্কিন নাগরিক কিন্তু জন্মসূত্রে আইরিশ। এই ভদ্রমহিলা বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করতেন। কিন্তু হাত ধুতেন না, পরিচ্ছন্নও থাকতেন না। ফলে যে সব বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন সেই সব বাড়িতে সহজেই রোগ ছড়িয়ে পড়ত। তাদের থেকে আবার পাড়া-পড়শি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যেও। একের পর এক পরিবারে টাইফয়েড ছড়িয়ে তাঁর নামই হয়েছিল "টাইফয়েড মেরি"।

প্রায় পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা দশাসই চেহারা ছিল মেরির। তাঁর জন্ম ১৮৬৯-এ আয়ারল্যান্ডে। সেখান থেকে এক কাকা-কাকিমার সাথে ভাগ্যাণ্বেষণে আমেরিকায় আসেন তিনি। খুব চাপা স্বভাবের, কিন্তু বদমেজাজি ছিলেন। কারও সঙ্গে বেশি বন্ধুত্ব বা আলাপ ছিল না, খুব নিঃসঙ্গ ছিলেন মেরি।

মোট ৫৩ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁর মাধ্যমে। মারা গিয়েছিলেন ৪ জন। বাস্তবে সংখ্যাটা অনেক বেশি।  হাত ধোওয়ায় মেরির অনীহা এবং মল-মূত্র ত‍্যাগের পর নিজেকে ঠিক মতো পরিচ্ছন্ন না করে রান্না করা মেরিকে "টাইফয়েড মেরি" বানিয়েছিল। তাই তাঁর হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে তাঁকে দুটি পর্যায়ে প্রায় ২৮ বছর এক নির্জন দ্বীপে কোয়ারান্টিনে রাখা হয়েছিল।
মেরি প্রথমে যে বাড়িতে রান্না করতেন সেই বাড়ির প্রায় প্রত‍্যেক সদস‍্য একে একে টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ায় খোঁজ পড়ে নিয়মিত রান্না করেন এমন কেউ আছেন এর পিছনে। কিন্তু ততদিনে সেই রাঁধুনি চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছেন।  মেরি সারা জীবন শুধু পালিয়ে বেড়িয়েছেন, এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে। কারণ রাধুনি হিসেবে যেখানেই কাজ করেছেন সেখানেই কিছুদিন পরে টাইফয়েডর প্রকোপ শুরু হয়ে যায়। জানা যায় মেরি পর পর অন্তত সাতটি পরিবারে টাইফয়েড ছড়িয়েছেন। মূলত মেরির কাছে রান্না ছিল প্যাশন, দুর্দান্ত সব রান্না করতেন। অন্য কাজ তেমন তিনি জানতেন না। মাইনেও ভালো পেতেন, প্রায় ৪৫ ডলার। তাই কাজটি ছাড়তে চাননি।

পালিয়ে বেড়ালেও শেষ পর্যন্ত ১৯০৭ সালের মার্চ মাসে তাঁর খোঁজ মিলে। তখন তিনি নিউ ইয়র্কের এক পরিবারে রাধুনির কাজ করছেন। এবং ততদিনে ওই পরিবারের মালকিন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। পরিবারের একমাত্র ফুটফুটে সন্তানের টাইফয়েডে মৃত্যু হয়েছে। খবর পেয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মীরা তাঁকে বুঝিয়ে আনতে গেলে, সে তখন রান্নাঘরের জানলা গলে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় তাঁকে ধরা সম্ভব হয়। প্রথমে তাঁকে একটি হাসপাতালে, পরে ওই হাসপাতাল চত্বরের একটি বাংলোয় কোয়রাণ্টিনে রাখা হয়। তাঁর মল-মূত্র পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল শরীরে টাইফয়েডের ব্রাকটেরিয়া গিজগিজ করছে। বহু চিকিৎসাতেও দূর করা যায়নি।

 ইতিহাস বদলায় না। এলাকাভিত্তিক সংক্রমণ সে দিনও ঘটেছিল। সে দিনের টাইফয়েড, আজকের করোনা। রোগ মোকাবিলায়  হাত ধোওয়া, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং কোয়ারান্টিনের গুরুত্ব প্রায় ১১৪ বছর আগে প্রমাণিত হয়েছিল 'টাইফয়েড মেরি'-র ঘটনায়।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments