জ্বলদর্চি

বিশেষ ছোটোবেলা সংখ্যা - ১৫

ছোটোবেলা || সংখ্যা - ১৫

এবারের সংখ্যায় স্বনামখ্যাত ফোটোগ্রাফার কল্যাণ সাহা উপহার দিয়েছেন তাঁর দুর্দান্ত এক ফোটোগ্রাফি। তাঁকে ও আমন্ত্রিত লেখকদের ধন্যবাদ। তরুণ লেখক শিল্পীদের শুভেচ্ছা। 
বড় যত্ন নিয়েই এবারের ছোটোবেলা সংখ্যা সাজিয়ে তুলছেন সম্পাদক তথা বিশিষ্ট গল্পকার মৌসুমী ঘোষ। তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। 
আমরা চাই আরও আরও লেখা ও ছবি। সরাসরি বিভাগীয় সম্পাদকের কাছে পাঠানোর আবেদন জানাই।


যদি এমন হতো

আনন্দী ব্যানার্জী

ষষ্ঠ শ্রেণি-ভারতীয় বিদ্যাভবন স্কুল

সল্ট লেক, কলকাতা


ভোরের আলো জানলা দিয়ে চোখে এসে পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেল  মোহরের। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়েই খেয়াল হলো আজ তো সুইমিং ক্লাস ছুটি! মনটা ভালো হয়ে গেল। সুইমিং এ যেতে একদমই ভালো লাগে না  ওর। মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করল এখন ও  বাংলা পড়বে। সেদিন ম্যাম  বাংলায় 'গুপি গাইন-বাঘা বাইন' পড়াচ্ছিলেন। আজ সেটা  নিয়েই বসল। পড়তে পড়তে ও ভাবছিল, সত্যি যদি ভুতের রাজা এসে বর দিত, তাহলে কি মজাটাই না হত!! তারপর  চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল, ভুতের  রাজার কাছে ও কী কী চাইত? তারপর কি মনে হতেই আলমারির কোনায় গিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে আনল। আগের বছর অ্যানুয়াল ফাংশানের একটা নাটকের জন্য বাবা একটা গুপি গাইন বাঘা বাইনের কস্টিউম কিনে দিয়েছিলো। সেটাই বেরিয়ে এল ব্যাগটা থেকে।  একটু ঝেরেঝুরে নিয়ে গুপী গাইন সাজলো নিজে, আর ওর দু ফুট সাইজের পুতুলকে সাজালো বাঘা বাইন। গলায় ঝুলিয়ে দিল একটা ছোটখাটো সাইজের মাটির খেলনা ঢোল। 

ভাবলো - ' এমনিতে তো গুপী- বাঘার মতো হতে পারবো না, কিন্তু তাদের মতো আ্যক্টিং করতে ক্ষতি কী?'তারপর বইতে যেমন লেখা ছিলো, তেমনভাবে তার পুতুলের সাথে তালি মারলো আর বললো- ' এমন যদি হতো - যে আমি একটা কচ্ছপ পুষতে পারতাম।' 

অনেকদিন ধরে ওর একটা কচ্ছপ পোষার ইচ্ছে ছিলো। মনে মনে ভাবছিল, সত্যিই যদি ইসস্ যদি গল্পের ভুতের রাজা  এসে তার ইচ্ছে পূরন করে দিয়ে যেত!

সেই দিন সন্ধেবেলা হঠাৎ করে ওর মামা এল। বেশ খানিক্ষন গল্পগুজবের পর মোহরকে কাছে আসার ইশারা করে ব্যাগ থেকে বের করল একটা জল ভরা প্যাকেট আর তার মধ্যে কালো রঙের কী একটা নড়ছে। একটু এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারল ওটা কী জিনিস আর আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। মামা একটা বেশ ছোট সাইজের বাচ্চা কচ্ছপ আর সেটা রাখার জন্য একটা ট্যাংক এনেছে!  সব সেট করে মামা মোহরের গাল টিপে চলে গেল।  

পরের  দিন সকালে উঠে মায়ের কাছে না গিয়ে প্রথমেই আলমারি খুলে গুপী বাঘার কস্টিউম বার করে নিজে পরল আর পুতুলকে পরালো। তারপর হাতে তালি মেরে বললো- ' এমন যদি যদি হতো - যে আমাকে বাবা আজ ডমিনোজে পিৎজা খাওয়াতে নিয়ে যেত। ' পিৎজা খেতে খুব ভালোবাসে মোহর, কিন্তু বাবার নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে ওঠে না। 

সন্ধেবেলা বাবা এসে বললো - ' মোহর, চল, তুই বলেছিলিস না, যে তোর কোন একটা বন্ধুর কালকে জন্মদিন আছে? চল, তার জন্য একটা গিফট কিনে আসি।'  গিফট কেনা হয়ে গেলে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল মোহর। বাবাকে বললো - ' বাবা, খুব খিদে পেয়েছে আর পাও ব্যাথা করছে। কোথাও একটা গিয়ে বসি না, প্লিজ।'

- ' আচ্ছা, বসবি বলছিস? খিদেও পেয়েছে? হ্যাঁ! চল, আজ ডমিনোজে ঢুকি।'

- ' হুররে! চলো!'

খাওয়া শেষে বাড়ি ফেরার সময় ও ভাবছিল, ২ নম্বর বরটাও হয়ে গেল। এবার? 


পরের দিন, অনেক ভেবে একটা ইচ্ছে বার করলো। রোজ রোজ এই ঘামে ভেজা ইউনিফর্ম পরে গরমের মধ্যে  বাসে করে স্কুলে গিয়ে ও খুব ক্লান্ত হয়ে যায়। এমন একটা ইচ্ছে চাইতে হবে যাতে করে বাড়িতে বসে বসেই পড়া যায়। 

পুতুলের সাথে হাতে তালি দিয়ে বললো - ' এমন যদি হতো - যে সব স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়ে বাড়িতে বসে মোবাইলে পড়া হবে।'

এক সপ্তাহ কেটে গেল। আজকাল কী একটা নতুন অসুখ এসেছে, নাম- ' করোনা ভাইরাস '

দিনে দিনে বাড়ছে। সকালে উঠে দেখছে মা টিভির সামনে বসে খবর শুনছে।

 নিউজ রিপোর্টার বলছে - ' করোনার জন্য দোকান থেকে স্টেশন, সিনেমা হল থেকে সুইমিংপুল, স্কুল- কলেজ থেকে অফিস- সব বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।  এমনকি কেউ কারোর বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না। পুরোপুরি লক ডাউন।'

মোহর অবাক হয়ে গেল শুনে। মনে মনে ভাবছিল, এ আবার কি! আমি তো শুধু স্কুল বন্ধ হওয়া চেয়েছিলাম। এ যে দেখছি সব বন্ধ হয়ে গেল! এখন তো বন্ধুদের সাথেও খেলা যাবে না। ইস্, এ কী চেয়ে বসলাম আমি!

                                                             

করোনাকান্ড 
সোমশ্রী দেব
দশম শ্রেণী, কৃষ্ণভাবিনী নারী শিক্ষা মন্দির, চন্দননগর


নির্বিঘ্নেই হয়েছিল ২০২০ এর
          বছরের প্রথমটা শুরু
দিব্যি ছিল ঠিকঠাক সব 
          চিন্তা ছিল না কারুর।

যেই জানালাম সুস্বাগতম
           তৃতীয় মাস মার্চকে
ধেয়ে এল ভাইরাস এক
           মুখ ঢাকল মাস্কে।

কী ভাইরাস, জানো কি?
           নাম যে তার 'করোনা'।
ছোঁয়াচে নাকি প্রবল সে 
           প্রকৃতি তবুও যায়নি জানা।

উঠে গেছে স্কুল কলেজ
           বন্ধ হয়েছে দোকান-পাট
পদ্মাপারে বসে না আজ
           বক্সীগঞ্জের গ্রামের হাট।

নেই কোলাহল, নেই লোকজন
           রাস্তা ঘাট শুনশান।
জেগে উঠেছে নীল আকাশ
           শোনা যাচ্ছে পাখির গান।

ভাইরাসের এই কবলে পড়ে
            আজ মানুষ জব্দ
বন্ধ হয়েছে জনজীবন
             সবই আজ স্তব্ধ।

ব্যঙ্গ করে প্রকৃতি বলছে
            "যেমন কর্ম তেমন ফল
আমাদের ওপরে অত্যাচার
            দেখো এবার খুড়োর কল।"

তবুও মানুষ আশাবাদী
            আমরা একদিন জিতবই
সমস্ত প্রকৃতি একসাথে
            আনন্দেতে মাতবই।

খুলে যাবে নতুন দিক
            ঘুচবেই রাতের কালো 
সূর্য উঠবেই ঠিক
            দেখা যায় ভোরের আলো।

অমলের সঙ্গে দেখা 
শ্রীপর্ণা ঘোষ
ষষ্ঠ শ্রেণি, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়
পশ্চিম মেদিনীপুর

ঘূর্ণিঝড় আর লকডাউনে ফাঁকা শুনশান রাস্তা। চারিদিক লন্ডভন্ড। একা বারান্দায় বসে আছি। সন্ধে নামার সময় আবছা অন্ধকারে দেখলাম একটা ছেলে এদিকে আসছে। আরে এ তো 'অমল'!

অমল হেসে বলল, 'লকডাউনে যে বাচ্চারা ঘরে একা আছে তাদের সঙ্গে গল্প করতে এলাম। '

আমি বললাম, 'তুমি কী করে এলে?'

অমল বলল, ' আমি তো এখন মুক্ত, খোলা আকাশে ভেসে যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারি।' আমি ভাবলাম, এখন আমরা বন্দী আর অমল স্বাধীন।

অমল বলল, 'সুধা আজ খুব কাঁদছিল। সব গাছগুলো পড়ে গেছে। তাদের খুব ব্যথা লেগেছে। তাই আমি তাদের গায়ে হাত বোলাতে যাচ্ছি।'

আমি বললাম, ' আমিও চাই ওদের গায়ে হাত বোলাতে।'

অমল বলল, 'চোখ বন্ধ করো। মনে করো আমি তোমারই কল্পনা। এবার তুমি আমাকে যেখানে খুশি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারো।'

আমি মনে মনে অমলকে আমার চেনা গাছেদের কাছে নিয়ে গেলাম। আশ্চর্য তাদের গায়ের ছোঁয়া অনুভব করলাম! তারপর অমল কোথায় চলে গেল! আমাকে ছেড়ে, আমার মনকে ছেড়ে, অন্য কারো মনে।
নাড়ুর নাক
তপশ্রী পাল

সামান্য একটা নাক- কতগুলি বাংলা বুলি সামলাচ্ছে ভাবা যায়? নাকের ডগায়, নাক উঁচু, নাক কাটা যাওয়া, নাক গলানো, নাক সিটকানো, নাক বরাবর – শেষ নেই, শেষ নেই । তা এই বিখ্যাত নাক নাড়ুকে কি বিপদে ফেলেছিল সেই নিয়েই গল্প – না না গল্প কোথা? এতো সত্যি ! 
নাড়ু ছেলেটা ভালো। সাতে পাঁচে নেই। খালি একটাই ঝামেলা । নাড়ু নাক খুঁটতে ভারী ভালোবাসে। চুপচাপ বসা মানেই নাড়ুর হাত নাকে চলে যাবে। আঙুল ঢুকিয়ে বেশ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে টেনে বার করবে – উঃ সেখানেও সেই বুলি “কি? নাকের ঘি !” নাড়ু যখন মন দিয়ে কিছু পড়ে, শোনে বা চিন্তা করে, তখন তার চোখ গোল গোল হয়ে যায় আর হাত চলে যায় নাকের গভীরে – আরো গভীরে ! স্কুলে বেশ কয়েকবার এর জন্য চাঁটি খেয়েছে টিচারদের কাছে – আর বাড়িতে তো মা অহরহ পিছনে লেগেই আছে । কিন্তু নাকের মধ্যে থেকে সব টেনে বার করার যে কি আরাম তা তো আর এরা বুঝবে না – 

তা এহেন নাড়ু গেলো এক অফিসে ইন্টারভিউ দিতে । সে ঠিক করে গেছে হাত সর্বদা পকেটে রাখবে । নাকে যাতে হাত না যায় । ইন্টারভিউ বেশ ভালো দিল নাড়ু । চটপট উত্তর দিয়ে দিল সব প্রশ্নের । সবশেষে টপ বস তাকে ডেকে কংগ্রাচুলেট করে বললেন “ওয়েলকাম টু আওয়ার কোম্পানি – আপনি বসুন একটু । আপনার অফারটা তৈরী হচ্ছে !” বলে বস বেরিয়ে গেলেন । নাড়ু তো সপ্তম স্বর্গে ! ভিতরে বেশ টেনশন হচ্ছে ! বসের ঘরে বসে বসে নাড়ু মন দিয়ে ভাবতে লাগলো চাকরীটা পেলেই কি কি করবে – আর তার হাত চলে গেলো নাকে ! গভীরে – আরো গভীরে – বার করে আনতে লাগলো নাকের নরম নকুলদানা ! সে যখন পরম পরিতৃপ্তিতে নিমীলিত চোখে এই কাজ করে চলেছে, ঘরে প্রবেশ করলেন বস ! তাড়াতাড়িতে কি করবে ভেবে না পেয়ে নাড়ু হাতের নকুলদানাগুলি বসের টেবিলের পায়ায় লাগিয়ে দিয়েই হাত টাত ঝেড়ে চটপট উঠে দাঁড়ালো ! তাকিয়ে দেখে বসের মুখ সিটকোনো, নাকে রুমাল ! তিনি শুধু অনেক কষ্টে বললেন “ও মাই গড ! গেট লস্ট !” চাকরীর সেখানেই ইতি ।

ছোট্টবেলা হাজির তো
অরিজিৎ পাঠক

ভোর হলো রে দরজা খোলো, সুয্যি মামা ডাকছে ওই
ঠাকুরদা আর অমল বসে ডাকঘরেতে খাচ্ছে দই
হাঁসজারু আজ বেজায় খুশি, হাত  বাড়ালেই খুড়োর কল
আতা গাছে চেঁচায় তোতা " এক্কা গাড়ি আস্তে চল"
ভাগ্নে মদন লাফিয়ে বলে " কুমোর পাড়া কী ই বা দূর"
সাঁঝের আগেই পৌঁছে যাবো, এই তো সবে ভর দুপুর
কাঠবিড়ালী মিটমিটিয়ে দেখছে খুকি কোথায় যায়
কাবলিওলার কাছে? নাকি পদ্মদীঘির ওখানটায়
জনসনে আর রনসনেতে ফিস্টি করে মাঝরাতে
অরণ্যদেব দেখতে থাকে মাংস ক'পিস কার পাতে
হাস্য মুখে চন্দ্রমামা টিপ দিয়ে যায় বছর ভর
সৎপাত্র গঙ্গারামের তবুও কেবল পিলের জ্বর
পেটের রোগে কাহিল প্যালাও খাচ্ছে বসে ডাল বড়া
শঙ্কু খাওয়ায় মিরাকুলিক্স, ওষুধ সকলরোগহরা
লালমোহন আর ফেলুচরণ  ডাকছে কাকে জোর গলায়
বললো গুপির গানটা ছাড়া আড্ডা কি আর জমতে চায়
ডি লা গ্র্যান্ডি ঘনঘটায় ঘনার বচন লাগছে বেশ
আজব দেশে ক্যাডবেরীটা একাই এলিস করছে শেষ
গোপাল ভাঁড় আর মংলী মিলে ফিসফিসিয়ে দেয় নালিশ
ম্যানড্রেকের ওই টুপির নিচে লুকিয়ে রাখা পাশ বালিশ
বাটুল এবং হাঁদা ভোঁদা বললো "ওটা হয় না কি?"
কাকাবাবু সায় মেলালো  "বালিশ ওটা, গয়না কি?
এসব নিয়ে কোর্ট আপিসে পা দিও না কক্ষনো
আমরা সবাই বিলোই খুশি, ঝগড়ার নেই সখ কোনো"

শিব ঠাকুরের আপন দেশে আজব বিচার কাজীর তো
সব মিলিয়ে বুকের ভেতর ছোট্ট বেলা হাজির তো !!


ছিরুচোরের হাতেখড়ি 
দেবদুলাল কুণ্ডু
সিঁধকাটতে অন্তত দশমিনিট সময় লাগল ছিরুর। সিঁধেলচোর হিসেবে আজ ওর হাতেখড়ি। গর্তের ভেতর দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতরে তাকালো সে। দেখল একটামাত্র হারিকেন জ্বলছে। মসীমাখা কাচের আবছা আলোতে ঘরতের ভেতরটাকে ঠিকমত ঠাহর করা যাচ্ছে না। মেঝে থেকে উঠতে গিয়ে ঠং করে মৃদু শব্দ হল; মেঝেতে রাখা স্টিলের বাসনের উপর বেখেয়ালে পা লেগেছে ছিরুর। 
“ওরে রামু, একটু তো দেখে শুনে চলাফেরা করতে পারিস? দেখিস, আমার ঘটির জল যেন ফেলে দিসনা বাছা।” পাশের শয্যা থেকে একটা বুড়ি খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল।
যাক বাবা জোর বাঁচা বেঁচে গেছি। বুড়িটা বুঝতে পারেনি-এই যা রক্ষে। ছিরু চারপাশে চোখ বোলাল, অপ্রশস্ত ঘর। দক্ষিণদিকে একটা ছোট্ট চৌকি। বেড়ার পাশে দড়িতে ঝুলছে কয়েকটা কাপড়। মেঝেতে পরিপাটি করে সাজানো কয়েকটা বাসন। আর চৌকির  ঠিক নিচে বুড়ির মাথার কাছে একটা পেতলের ঘটি। ঘটিটা দেখে লোভে চকচক করে উঠল ছিরুর চোখ। 
“কিরে রামু আর কোন সাড়া নেই যে তোর?” বুড়িটা আবার বলল। ঠিক তখনই একটা ‘মিউ’ ডাকে চমকে উঠল ছিরু। ভালো করে চেয়ে দেখল বুড়িটার ঠিক পায়ের কাছেই নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছিল বিড়ালটা।
“ওঃ তুই এখানে, রামু!” বুড়িটা বলল।
ও হরি! রামু তাহলে বুড়ির পোষা বিড়াল! এবারে ঘটিটা নিয়ে সটকে পড়ি। যখনই ছিরু হাত বাড়াল ঘটিটার দিকে, ঠিক তখনই বুড়ি নিচু হয়ে মেঝে থেকে ঘটিটা ধরতে গেল জল খাবে বলে। দুজনেই একসঙ্গে ঘটিটা ধরল।
“কে?” চমকে গিয়ে বুড়ি চেঁচিয়ে উঠল। দুজনেই ঘটিটা ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। ঘটিটা মেঝেতে পড়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। 
“আ—আমি ছিরু।” ধরা পড়ে গিয়ে গলা কাঁপতে লাগল।
“তুমি ঘরে ঢুকলে কী করে?” 
“সিঁধ কেটে। আমি চলে যাচ্ছি। দোহাই লোক ডাকবেন না।”
“চোখে দেখতে পাইনে;  আমার কাছে দিন-রাত সমান। এই রাতে কাকে  আবার ডাকব বাবা!”
“চোখে দেখতে পাননা?”
“না গো বাছা। তোমাকে বাছা বলেই ডাকলাম । গলা শুনে মনে হচ্ছে তুমি খুব ছোট্ট ছেলে হবে। ”
“কী হয়েছিল আপনার?”
“বছর চারেক আগে মায়ের দয়া হয়েছিল। তাতেই চোখদুটো নষ্ট হয় গেল আমার।”
ছিরু এবারে সাহসে ভোর করে সামনে এগিয়ে এসে বুড়ির মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখল; হ্যাঁ, বুড়ির সারা মুখে বসন্তের দাগ আছে বটে।
“বুড়িমা, তোমার আর কেউ নেই?”
“আছে বাছা, আছে। তোমার মত সোমত্ত ছেলে আছে আমার। গত বছর বিয়ে করে পাশের গাঁয়ে উঠে গেছে; ঘরজামাই থাকে। দেখতো আমার ঘটিটা কোথায় পড়ল? একটুও কি জল আছে ঘটিতে?”
“হ্যাঁ, কিছুটা আছে। এই নিন।” ছিরু ঘটিটা কুড়িয়ে বুড়ির হাতে দিল। বুড়ি ঘটিটা উঁচু করে জলটুকু খেল। বুড়ির করুণ অবস্থা দেখে ছিরুর চোখে জল এসে গেল।
“ সব বেঁচে বেঁচে খেয়েছি; এই ঘটিটা ছাড়া; শ্বশুরের জিনিস। তুমি এটা নিয়ে যাও—বেঁচে ভালো দাম পাবে।”
এবারে সত্যি সত্যিই ছিরুর চোখে জল চলে এল। সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,“না—না দরকার নেই মা। এটা আপনারই থাক। আপনি বরং এই পঞ্চাশ টাকার নোটটা রেখে দিন।” রাহাখরচ বাবদ মেধোকাকা যে টাকাটা তাকে দিয়েছিল, সেটা বুড়ির হাতে তুলে দিয়ে ছিরু হাতের চেটোয় চোখের জল মুছতে মুছতে পালিয়ে গেল। 
টাকাটা হাতে নিয়ে বুড়ি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর বলল, “রামু, কালকে তুই আর আমি মৌরলামাছ কিনে জমিয়ে খাব। যাই, দাওয়ার গর্তটা বুঁজিয়ে দি; নইলে আবার শিয়াল ঢুকবে।”
মেঝেতে নেমে অনায়াসে হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে মেঝের গর্ত বুঁজিয়ে থালা বাসন-গুছিয়ে সবশেষে ন্যাতা দিয়ে মেঝের জল মুছতে মুছতে বলল, “এ! আর একটু হলেই আমার কাশিদাসী মহাভারতখানা ভিজে যেত! বইটা সরিয়ে রাখি। কাল দুপুরে আবার পড়তে হবে তো!”
সাঁতরাইচেঙ্গার রহস্যময় সাতকাহন || পর্ব-৫
গৌতম বাড়ই

তারপর-----
তারপর দরজার কাছে এগোতে না এগোতেই কি এক চৌম্বকীয় আকর্ষণে এক আলোর রশ্মি আমাকে জানালা দিয়েই টেনে বাইরে নিয়ে গেল, আমাকে  একটা স্কুটারের মতন হ্যান্ডেল আর নৌকোর মতন ছোট্ট একটা যানে এক ঝটকায় বসিয়ে দিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম আমি ভিনগ্রহীদের পাল্লায় পড়েছি। একজন হ্যান্ডেল ধরে ড্রাইভারের সিটে, আমার উল্টোদিকে মুখোমুখি দু-জন বসে। আমার পাশের সিটটি খালি। বুঝলাম ড্রাইভারকে নিয়ে এই যানে পাঁচজন বসতে পারে। আমি বসতে না বসতেই যান্ত্রিক ভাবে আমাকে বেল্ট দিয়ে মুহূর্তে বেঁধে ফেলা হল। তারপর ঝড়ের গতিতে হাউই বাজির মতন আকাশে উড়ে গেল। আমার কাছে পুরোটাই স্বপ্নের মতন মনে হচ্ছিল তখন।

 সম্বিত ফিরে এল ওদের কথায়। উল্টো দিকে বসা দু-জনের মধ্যে একজন আমার দিকে তাকিয়ে গমগমে গলায় বলে উঠল-- "তোমায় নিয়ে আমরা আকাশে উড়ে চলেছি। তোমাকে আমাদের কাজে লাগবে। তোমার অগাধ কৌতূহল রয়েছে"। 

 নিচে টিম-টিমে আলোর মতন কিছু কখনো দেখা যাচ্ছে। তারপর একটা জায়গায় দেখলাম প্রচুর আলো আর সামনেও আকাশের গায়ে আলো। একটু শীত-শীত করছিলো। এবারে আকাশ থেকে সোজা ঐ ছোট্ট মহাকাশ যান একটু উঁচু-নিচু মাটিতে বা ভূমিতে নেমে এলো। আমি ঠান্ডায় কাঁপছি। একটা কম্বলের মতন কোন শীত-বস্ত্রে আমায় মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এবার ধাতস্থ হয়ে দেখি, জায়গাটা পাহাড়ি এলাকা। তারপর আবিষ্কার করি আরে এটা তো কার্শিয়াং-র দূরবিন দাড়া বা ঈগলস ক্রাকস। ছ-মাস আগেই তো আমরা কার্শিয়াং বেড়িয়ে গিয়েছি। তো আমাকে এখানে কেন?

 ---- তুমি আমাদের বন্ধু হে-হে-হে ঐ জন্য। বন্ধুরা তো একসাথেই বের হয় বেড়াতে।

 বিচ্ছিরি কথা আর তারচেয়েও বিচ্ছিরি হাসি।এবারে ঐ আলো-অন্ধকারে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম। আরে ইনি তো সেই বানজারা দলের বামুনদের কোন একজন হবেন।

 ---- ঠিক ধরেছো। আমি ওদের একজন। আমার পাশে আর একজন। সামনের সিটে আর একজন। আমাদের মনে পড়েছে তাহলে?

 ওরে বাবা, এরা আবার মনের কথাও পড়তে পারে দেখছি। আমায় ওরা সত্যি- সত্যি  বন্ধু বানিয়েছে তো? এখনও রাতের অন্ধকার রয়েছে। বুঝতেই পেরেছিলাম এক লহমায় এক দেড়শো কিলোমিটার চলে এসেছি। যানের স্বচ্ছ হুড মাথা থেকে সরে গেল। অনেকটা আদেশের সুরেই কথা বললেন দ্বিতীয় ব্যাক্তি।
  ----  নেমে এসো। এ জায়গাটিকে কার্শিয়াং বলে। আমাদের এই যন্ত্রে সব ধরা পড়ে। ল্যাঙ্গুয়েজ আমরা ট্রানস্লেট করে নি জাস্ট। এই গোল যন্ত্রে দেখবে এসো। তুমি তো কার্শিয়াং এসেছো?

  ---- হাঁ। কিছুদিন আগেই।

  ঐ যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেকটা চিনে হরফের মতন আঁকিবুঁকি নকশা কাটা আর নিচে ইংরেজিতে লেখা কার্শিয়াং। ওরা ইংরেজিও জানে দেখছি। আর কি কি ভাষা জানত কে জানে?

  আমরা সবে এন্ড্রোয়েড ফোনে জিপিএস দেখতে শিখেছি। আমার সামান্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছিল তাহলে সেদিন। তবে ওরা সেদিন রাতের অন্ধকারে এখানে এলেন কেন?

  দুরবিনদাড়া বা ঈগলস ক্রাকস এর মাথায় রয়েছে দূরদর্শনের টাওয়ার। হঠাৎ দেখি পলকে ওদের মধ্যে একজন বামন টাওয়ারের মাথায় চেপে বসেছে। আবার পর মুহূর্তেই মাটিতে। নিজেদের মধ্যে কী এক শব্দে কথা বলছিল। আমার কাছে ধাতব শব্দ মনে হচ্ছিল। কিছুতেই বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না। স্বপ্নে ঘোরাফেরা  করছি না সত্যি বাস্তবে? এরা কি সত্যি এলিয়েন? এরকম চেহারার হয়? ঐ ইউএফও নেমে আসবার পর ওদের দেখতে পাচ্ছি, এটা সত্যি। তবে এর মধ্যেই বানজারাদের দলে ওরা ঢুকলো কী করে? আমি কোথায়? কেন? এসব আমার মাথায় তখন খেলেনি। 
  একদম সামনের একটা এলিয়েন থুড়ি বামন এসে আমায় বলল-- ফ্রেন্ড এগুলো খুব সিম্পল ব্যাপার। চিন্তা করে মাথা খারাপ করোনা। আমরা টাওয়ারের মাথায় এমন এক যন্ত্র বসিয়ে দিলাম তাতে তোমাদের এই সমগ্র অঞ্চলের অনেক তথ্য ওতে জমা হয়ে থাকবে। কার্শিয়াং হল সেই জায়গা আর ঈগলস-ক্রাকস হল কার্শিয়াং-র সবচেয়ে সুন্দর পয়েন্ট যেখান থেকে এই অঞ্চলের সমতলের অনেকটা ধরা যাবে। উপরি পাওনা এই টাওয়ার। আমাদের এই মুহূর্তে কেউ দেখতে পারবে না, আমরা সবাইকে দেখতে পারব। তুমিও তাই। একজন কাউকে তো সাক্ষী হিসেবে লাগে, সে তুমি।

  ---- সাক্ষী! আমি? এসব কী?

  একটু মোটা মতন এলিয়েনটা এগিয়ে এসে বলল---  বন্ধু আমরা যে ভিন- গ্রহের প্রাণী, আমরা যে এসেছিলাম, আমরা যে তোমাদের থেকে উন্নত, তার প্রমাণ তুমি। ব্যাস! ঐ সাক্ষী। 

  এই বলে জোরে জোরে খ্যাক খ্যাক আওয়াজ করে উঠল। সঙ্গে বাদবাকি দুটো যোগ হয়ে সারা পাহাড় গমগম করে উঠল। আমার মনে হচ্ছিল পিশাচ বা মহাজাগতিক দুষ্টু- হাসি ওটাকে।

  একটা ঝটকা এসে লাগল আর তারপর বুঝতে পারলাম আমি আবার ওদের ছোট্ট মহাকাশ-যানে উপর দিয়ে ভেসে চলেছি। তারপর কিছু মনে নেই।


  পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে দেখি দিদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দিদিকে বললাম কী রে?

  দিদি বলল---- চল। বাইরে গিয়ে দেখবি চল। কী সাংঘাতিক কাণ্ড!

  আমি লাফিয়ে মেঝেতে নামলাম। বললাম-- চল। চল।
তারপর-----(সামনের রবিবার) 

জানো কি !

আজকের বিষয়: কিছু বিখ্যাত লেখক ও কবিদের ছদ্মনাম

১. বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম কি বলো?
২. 'বনফুল' কার ছদ্মনাম?
৩. প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ছদ্মনাম কি?
৪. এবার বলতে হবে 'ছন্দের জাদুকর' সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছদ্মনাম কি?
৫. 'টেকচাঁদ ঠাকুর' কার ছদ্মনাম?
৬. হুতুমপেঁচা ছদ্মনামে কাকে ডাকি?
৭. কালকূট নামে কাকে চিনি আমরা?
৮. কালপেঁচা নামে কে পরিচিত?
৯. রাজশেখর বসুর ছদ্মনাম কি বলো ? 
১০. মৌমাছি কার ছদ্মনাম ?

গত সপ্তাহের উত্তর : 
-----------------------

১.বাঘ  ২.ময়ূর  ৩.হাতি  ৪.ডলফিন  ৫.ট্রিল ও হর্নবিল ৬.বাবুই ৭.মনিপুর ৮.আলিপুরদুয়ার  ৯.গুজরাত  ১০. তিমি এছাড়া শীল মাছ।

প্রকাশিত 
সংক্ষিপ্ত মহাভারত / সুদর্শন নন্দী
পর্ব- ৪


জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments