জ্বলদর্চি

৪৫-তম কলকাতা বইমেলা স্থগিত এবং তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস/গৌতম বাড়ই

৪৫-তম কলকাতা বইমেলা স্থগিত এবং তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

গৌতম বাড়ই

"কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে"

আর এই তিলোত্তমা মহানগরীর গর্বের একটি জায়গা বোধহয় আন্তর্জাতিক বইমেলা। বিশ্বের তাবড় বড়-বড় আন্তর্জাতিক বইমেলাগুলোর সাথে যার তুলনা করা হয়। সংস্কৃতিসম্পন্ন  মনস্কতার বাঙালির-ও এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে। সেই বইমেলার ৪৫-তম বছরটি অতিমারির দাপটে স্থগিত হয়ে গেল। এই প্রসঙ্গে একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক কলকাতা বইমেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।


গোড়ার কথা:

১৯৭৬ সালের ৫ মার্চ প্রথম কলিকাতা পুস্তকমেলা আয়োজিত হল। মেলা চলেছিল ১৪ মার্চ অবধি। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল-বিড়লা তারামণ্ডলের উলটো দিকের মাঠে (বর্তমানে মোহরকুঞ্জ উদ্যান) এই মেলা আয়োজিত হয়েছিল। কলকাতার ডিসি হেডকোয়ার্টার্স অর্চিষ্মান ঘটক মাঠের ভাড়া মকুব করে দেন।  প্রবেশদ্বারের নকশা অঙ্কণ করেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। মেলা উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের তদনীন্তন রাজ্যপাল এ. এল. ডায়াস। প্রথম মেলার সভাপতি ছিলেন জিজ্ঞাসা প্রকাশনের কর্ণধার শ্রীশকুমার কুণ্ডা। গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি সুশীল মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিয় সরকার, প্রবীর দাশগুপ্ত, বিমল ধর প্রমুখ বিশিষ্ট প্রকাশকেরা মেলার আয়োজনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। প্রথম বইমেলায় কলকাতার সব প্রকাশক সংস্থা যোগ দেননি। তাঁদের অনেকেই মেলার সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তাই মেলার মাঠ ছোটো হলেও তা ভরতি হওয়ার মতো স্টল পাওয়া যায়নি।  তখন এনবিটি একটি বিরাট অংশ জুড়ে বইয়ের প্রদর্শনী করে এবং রূপা অ্যান্ড কোম্পানি একটি বিরাট প্যাভিলিয়ন দেয়। কিন্তু এই বইমেলায় যথেষ্ট জনসমাগম হওয়ায় পরের বছর থেকে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে বইমেলার আয়তনও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে এই বইমেলা আয়োজনের সুবাদে সেই বছর নয়াদিল্লিতে বিশ্ব বইমেলায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় গিল্ড এবং জিতে নেয় মাঝারি স্টলের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি। সুপ্রিয় সরকার তার ‘প্রকাশকের ডায়েরি’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, “এই মেলায় সবকিছুই আলাদা, বিদেশি মেলার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই শুধু আইডিয়াটি ছাড়া।”
২০০১ সালে কলকাতা মহানগরীর ইংরেজি নাম "ক্যালকাটা" ("Calcutta") থেকে "কলকাতা" ("Kolkata") করা হলে, "কলিকাতা পুস্তকমেলা" বা "ক্যালকাটা বুক ফেয়ার"-ও নাম বদলে পরিণত হয় "কলকাতা পুস্তকমেলা" বা "কলকাতা বুক ফেয়ার"-এ। ২০০৭ সালে পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ময়দানের পরিবর্তে বিধাননগরের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণ-সংলগ্ন একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো মেলাপ্রাঙ্গণে বইমেলার আয়োজন করা হয়। ২০০৮ সালে একই ধরনের একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বোধনের আগের দিন মেলা বন্ধ হয়ে যায়। মেলার প্রাথমিক আয়োজন সেবার করা হয়েছিল পার্কসার্কাস ময়দানে। আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার উদ্বোধন করা হলেও, সেবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘কলকাতা পুস্তকমেলা’র আয়োজন করা হয়নি। বরং মার্চ মাসে ‘বইমেলা ২০০৮’ ব্যানারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ বিভাগের উদ্যোগে ও গিল্ডের সহযোগিতায় একটি মেলার আয়োজন করা হয়। কলকাতা পুস্তকমেলার ইতিহাসে এটি ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। ২০০৯ সালে কলকাতা পুস্তকমেলা স্থানান্তরিত হয় সায়েন্স সিটির বিপরীতে সেই বহুপ্রস্তাবিত মিলন মেলা নামক অত্যাধুনিক মেলাপ্রাঙ্গণে। ২০০৯ সালেই "কলকাতা পুস্তকমেলা" নাম বদলে হয় "আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা"।

আরও কিছু কথা এই বই- মেলার:

আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা। আগে একে কলিকাতা পুস্তকমেলা বলে জানতাম। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় আয়োজিত একটি বার্ষিক আন্তর্জাতিক বইমেলা। এই মেলাটি কলকাতা বইমেলা নামেই সমধিক পরিচিত। ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত এই বইমেলা ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। বর্তমানে জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার ও বারোদিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন হয়। মেলার প্রথম আয়োজনস্থল কলকাতা ময়দান থেকে শুরু হয়ে পূর্ব কলকাতার মিলন মেলা প্রাঙ্গণে এলেও, ৪২-তম থেকে ৪৪-তম সল্ট লেকের সেন্ট্রাল পার্কে হয়েছে। কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম অ-বাণিজ্যিক বইমেলা। ফ্রাঙ্কফুর্ট বা লন্ডন বইমেলার মতো কলকাতা বইমেলায় গ্রন্থপ্রকাশনা, পরিবেশনা ও অণুবাদ সংক্রান্ত চুক্তি বা ব্যবসাবাণিজ্য চলে না। বরং প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতারা সাধারণ মানুষের কাছে তাদের প্রকাশিত অথবা পরিবেশিত বইয়ের প্রচার ও বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে এই মেলায় যোগ দিয়ে থাকেন। কলকাতার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই মেলা একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। বর্তমানে বইমেলাকে ‘বাঙালির চতুর্দশ পার্বণ’ বলে অভিহিত করা হয়। কলকাতা বইমেলা আন্তর্জাতিক বইমেলা হলেও মেলার সিংহভাগ জুড়ে বাংলা বইয়ের বিক্রিই বেশি হয়। তবে প্রচুর ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশক ও বিক্রেতাও এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত ইত্যাদি অন্যান্য ভারতীয় ভাষার বইও এই মেলায় পাওয়া যায়। বিদেশি দূতাবাসগুলিও স্টল বা প্যাভিলিয়ন সাজিয়ে নিজ নিজ দেশে প্রকাশিত বইপত্রের প্রদর্শনী করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ভারত সরকারের বাংলা প্রকাশনা বিভাগগুলিও এই মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। এছাড়াও ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার আদলে প্রতি বছর মেলায় অংশগ্রহণকারী একটি বিদেশি রাষ্ট্র ‘ফোকাল থিম’ ও অপর একটি রাষ্ট্র ‘সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র’ নির্বাচিত হয়। ২০১০ সালের ৩৪তম আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলার ফোকাল থিম ও সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র হল মেক্সিকো। কলকাতা বইমেলায় বই ক্রয়বিক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়োজিত হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সেমিনার, পদযাত্রা,  প্রতিযোগিতা ও গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠান। উল্লেখ্য, বইমেলার সময়ই প্রকাশকেরা তাদের নতুন বই প্রকাশ করে থাকেন। গ্রন্থসম্ভারের পাশাপাশি চিত্রশিল্পী, শিশু, তথ্যপ্রযুক্তি ও লিটল ম্যাগাজিনের জন্য বিশেষ চত্বর নির্ধারিত থাকে। কলকাতা বইমেলা বর্তমানে কলকাতার অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মেলা। এই মেলার সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও ভারতের অন্যান্য স্থানে বাংলা বইয়ের মেলা চালু হয়েছে।
এই মেলার অনুপ্রেরণা:

১৯৭২ সালে নয়া দিল্লিতে আয়োজিত বিশ্ব বইমেলা ছিল কলকাতা বইমেলার আদি অণুপ্রেরণা। এরপর ১৯৭৪ সালে ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট (এনবিটি) কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে একটি জাতীয় বইমেলার আয়োজন করে। ১৯৬০-এর দশকে মুম্বইয়ের চার্চ গেট ময়দানে এনবিটি প্রথম জাতীয় বইমেলার আয়োজন করেছিল। এরপর দিল্লি, মুম্বই ও চেন্নাইতে জাতীয় বইমেলার আয়োজন করলেও কলকাতায় বইমেলার সাফল্য সম্পর্কে তারা সন্দিহান ছিলেন। এই কারণে এনবিটি নিজ উদ্যোগে কলকাতায় জাতীয় বইমেলা আয়োজনের উৎসাহ দেখাননি। ইউ. এন. ধর অ্যান্ড সনস প্রকাশন সংস্থার সত্ত্বাধিকারী বিমল ধর এনবিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে অ্যাকাডেমি চত্বরে একটি ছোটোখাটো বইমেলার আয়োজন করেন। এই বইমেলায় বাংলা বই বিক্রির সাফল্যে কলকাতার পাঠক সম্পর্কে এনবিটির ধারণা পরিবর্তিত হয়। এরপরই কলকাতায় বার্ষিক বইমেলা আয়োজনের চিন্তাভাবনা শুরু হয়।
১৯৭৫ সালে কলকাতার চোদ্দোটি প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতা সংস্থাকে নিয়ে বিমল ধরের উদ্যোগে গঠিত হয় পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল কলকাতায় বার্ষিক বইমেলার আয়োজন। বিমল ধরের সঙ্গে ছিলেন এম. সি. সরকার অ্যান্ড সনস সংস্থার সুপ্রিয় সরকার, দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানির প্রবীর দাশগুপ্ত, সাংবাদিক অতীন রায়, জিজ্ঞাসা প্রকাশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশকুমার কুণ্ডা ও সুশীল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। প্রথমে এই সংস্থার নাম ছিল ‘পাবলিশার্স গিল্ড’। কিন্তু গিল্ড সংবিধান তৈরি হওয়ার পর সংস্থার নাম বদলে রাখা হয় ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’। সুশীল মুখোপাধ্যায় গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালেই কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে গিল্ড ‘ওয়ার্ল্ড অফ পেপার ব্যাকস’ নামে একটি বইসংক্রান্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এরপরই শুরু হয় কলকাতা বইমেলার চিন্তাভাবনা। সর্বভারতীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে কলকাতা বইমেলার পোশাকি নামকরণ হয় ‘কলিকাতা পুস্তকমেলা’ বা ইংরেজিতে ‘ক্যালকাটা বুক ফেয়ার’। ১৯৭৬ সালে প্রথম কলকাতা বইমেলার আয়োজন করা হয়। 

 সেই বইমেলা স্থগিতের খবরে বাঙালি সত্যি আজকের দিনে  মনমরা। তিলোত্তমাও বুঝি ভারাক্রান্ত। বিশিষ্ট ও সম্মানীয় কবি সুবোধ সরকার ফেসবুকে পোস্ট করে তাঁর মন-খারাপের কথা জানিয়েছেন এই বলে-  "বড় বেদনার সঙ্গে মেনে নিতে হল এবারের বইমেলা হচ্ছে না। পরে আর কবে হবে! মে তে নির্বাচন,  জুলাই থেকে বর্ষা, তারপর পুজো"।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments