Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
তৃতীয় অধ্যায় ||রূপতত্ত্ব(Morphology)
পর্ব- ২০
১৬. পদাশ্রিত নির্দেশক
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষায় যে নির্দেশক লক্ষ্য করা যায় তা চলিতবাংলার নির্দেশকের থেকে সামান্য আলাদা। এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় যে নির্দেশকগুলো পাওয়া যায় তা হল -
কাড়ি, গাদা, মেল্লা, গুয়া, গা, টা,টায়, টুকু ইত্যাদি নির্দেশকের ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন-
ক. বিশেষ্যের অবস্থান নির্দেশক
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় যে সব বিশেষ্যের নির্দেশক পাওয়া যায় তা হল -
i.নৌকাটায় কটা মাঝি যাবু? (এই নৌকায় ক'জন মাঝি যাবি?)
ii.ঘরের বউড়িটা কতবা আসবে জাঁইনি। (ঘরের বউ কখন আসবে জানি না।)
iii.মাঝিগুয়া আজই নৌকালিকি যাবে। (মাঝিগুলো আজ নৌকা নিয়ে যাবে।)
iv.ছেইটা অখঁও নদীধারে বাঁধা আছে। ( ছাগলটি এখনও নদীধারে বাঁধা আছে।)
iv. মোর জমিটার বেশিরভাগ নদীতে চালিছে। (আমার জায়গার বেশিরভাগ অংশ নদীতে চলে গেছে।)
v.আমানকের ভাক আছে নৌকাটার। ( আমাদের ভাগ আছে নৌকার।)
খ. সংখ্যাবাচক বিশেষণ যোগে বিশেষ্যের অবস্থান নির্দেশক
এখানে এই সম্প্রদায়ের উপভাষায় সংখ্যাবাচক বিশেষণ যোগে বেশ কিছু কিছু বিশেষ্যের অবস্থান নির্দেশক পদ লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
i.পাশশো টাকা লি কি যা। (পাঁচশো টাকা নিয়ে যা।)
ii.মাজু গাঙে পণচাসটা জাল দেখা যা টে। (মাঝ নদীতে পঞ্চাশটা জাল দেখা যাচ্ছে।)
iii.দু'দশটা মাচ দুবু রে। (দু'দশটা মাছ দে না।)
iv.আমফান ঝড়ে আমাহারে পাশটা প্যাহারা গাছ ভাঙিছে। (আমফান ঝড়ে আমার ঘরে পাঁচটি পিয়ারা গাছ ভেঙে গেছে।)
v.টকাটার জানে দুটা কলেজের ফরম তুলছি। (ছেলেটার জন্ত দুটো কলেজের ফর্ম তুলেছি।)
গ.পরিমাণ বাচক বিশেষণ যোগে বিশেষ্যের অবস্থান নির্দেশক
এই জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষায় পরিমাণ বাচক বিশেষণ যোগে বিশেষ্যের অবস্থান নির্দেশক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। যেমন -
i.আইজ মেল্লাগুয়া মাচ পড়ছে। (আজ অনেক মাছ পড়েছে।)
ii.গাঙে অদগা নৌকা যাবে। ( নদীতে এতোগুলা নৌকা যাবে।)
iii. যত অসুবিধা করে মাঝিগুয়া। (যা কিছু অসুবিধা করে মাঝিগুলো।)
iv.কাজ তো করুনু, শুধু কাড়িকাড়ি খাবু। (কাজ তো করিস না শুধু এতোগুলা খাবি।)
v.কালনু নৌকা লিয়া মদ্দটা যাইছে আর আইজ এত্তো বেলা হয়ালো আইলো নি। ( কাল থেকে নৌকা নিয়ে ঘরের লোকটা গেছে আর আজ এতো সময় হয়ে গেল এলো না।)
vi. অত্তোটা জলে নামব্বু? (এতোটা জলে নামবি? )
ঘ. পরিমানে ও আদরে নির্দেশক
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় এই ধরনের নির্দেশক চোখে পড়ে। যেমন -
i. ওউ টুকু মাচ তরকারি লিয়্যা কি করব্যা? (এই টুকু মাচ তরকারি নিয়ে কি করবো? )
ii.এ্যকটুকু নু দে। ( একটুকু লবণ দে।)
iii. তুই অদগা খাবু? (তুই এতোগুলা খাবি?)
iv. এত্তো কম মাচ পড়ছে? (এত কম মাছ পড়ছে?)
v.তুই সব লিকি চালি যা। (তুই সব নিয়ে চলে যা।)
১৭. যৌগিক শব্দ
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের উপভাষায় যে সব যৌগিক শব্দ ব্যবহার দেখা যায় তা মান্যচলিত ভাষার মতো এই জেলায় সর্বত্র এক নয়। এখানে সব ধর্ম সমন্বয়ে, সব বয়সের নারী, পুরুষদের কথ্যভাষায় যে সব সমাসবদ্ধ পদ, শব্দদ্বৈত, ধ্বন্যাত্মক শব্দ ব্যবহার দেখা যায়। তা হল তাঁদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। তবে বেশিরভাগ এই সবশব্দে মিল পাওয়া যায় মান্যচলিত বাংলাভাষার প্রভাব। প্রতিটি বিভাগে আলাদা আলাদা করে নিচে উদাহরণসহ তুলে ধরলাম। যেমন—
১৭.১. সমাসবদ্ধ পদ
সমাসবদ্ধ পদ বিশ্লেষণ অর্থ মন্তব্য
অবড়া- খবড়া অবড়া ও খবড়া অসমতল দ্বন্দ্ব সমাস
আজা- আই আজা ও আই দাদু দিদা দ্বন্দ্ব সমাস
আউ-বগুন আউ ও বগুন আলু বেগুন দ্বন্দ্ব সমাস
টাকা- পইসা টাকা ও পইসা অর্থ দ্বন্দ্ব সমাস
হাস- মরোগ হাস ও মরোগ হাঁস- মোরগ দ্বন্দ্ব সমাস
ডাব - নারকোল ডাব ও নারকেল ডাব নারকেল "
দাদা - বইদি দাদা ও বইদি দাদা - বৌদি "
ঝি- জামি ঝি ও জামি মেয়ে - জামাই "
টকা - মেইঝি টকা ও মেইঝি ছেলে মেয়ে "
টকা- টেরকি টকা ও টেরকি ছেলে ছোকরা "
গোড় ধুয়া গোড়কে ধুয়া পা ধোওয়া তৎপুরুষ
নিমুয়া নেই মুয়া মুখহীন নঞ "
নিচ্ছিঞা নেই ছিঞা অসভ্য নঞ "
জন রাইত জন যে রাইত জ্যোৎস্নারাত তৎপুরুষ
চ্যাঁওয়া মাছ চ্যাঁওয়া যে মাছ মাছ তৎপুরুষ
টপাকুল টপা যে কুল টোপাকুল "
তারুয়া গুড় তারুয়া যে গুড় তরল গুড় "
ছপর খাট যা ছপর তা খাট খাট কর্মধারয়
তিলোচন বুড়া যিনি তিলোচন তিনি বুড়া নাম "
কুকড়ি শুয়া কুকুড়ি যে শয় চুপচাপ কর্মধারয়
দো চালিয়া দুই ধারে যে কথা বলে দুমুখো ববহুব্রীহি
চারপায়া চার পা যার গরু বহুব্রীহি
গাড়ুমুখা গাড়ুর মতো মুখ যার বড়ো মুখ "
দশজঁ দশ জঁয়ের সমাহার দশ জন দ্বিগু
তে মাথানি তে মাথার সমাহার তে মাথা দ্বিগু
বারো ভাতারি বারো ভাতার যার গালি গালাজ বহুব্রীহি
নিলজ্জ নেই লজ্জা যার লজ্জাহীন নঞ বহুব্রীহি
ভাতার খাউকি ভাতার কে খাওয়া গালি গালাজ তৎ পুরুষ
ছড়ি হাতে হাতে ছড়ি যার শাসন বহুব্রীহি
কলাকুলি কলে কলে যে মিলন কোলাকুলি বহুব্রীহি
হুনমান মুয়া হুনমানের মতো মুখ যা হুনমান মুখো বহুব্রীহি
অবুজ নেই বুজ যার অবুঝ নঞ বহুব্রীহি
অপুত্রক নেই পুত্র যার পুত্রহীন নঞ বহুব্রীহি
আউসিদ্ধ সিদ্ধ যে আউ আলুসিদ্ধ কর্মধারয়
বেগুনপুড়া পুড়া যে বেগুন বেগুন পোড়া কর্মধারয়
১৭.২ শব্দদ্বৈত বা দ্বিরুক্ত শব্দ
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় চলিত বাংলার মতো এই উপভাষাতেও শব্দদ্বৈত বা দ্বিরুক্ত শব্দ পাওয়া যায়। তবে এই শব্দগুলোর মধ্যে কিছু শব্দ এই জেলায় মৎস্যজীবীদের নিজস্ব শব্দদ্বৈত হিসাবে উচ্চারিত হয়। আর বেশিরভাগ শব্দ চলিতবাংলার মতো এখান ব্যবহার দেখা যায়।
যেমন —
ব্যবহৃত শব্দদ্বৈত অর্থ
গড়গড় রাগ
থরথর কাঁপন
বোস্তা বোস্তা বেশি বেশি
মুঠামুঠা অনেক
গাদাগাদা প্রচুর
ঝটপট তাড়াতাড়ি
ফুসফুস আস্তে আস্তে
সঁকর সঁকর নাকে কান্না
লুক্ লুকাঞি এক প্রকার খেলা
ভিটভিট মনে মনে কথা বলা
ফঁসফঁস রেগে যাওয়া
চড়চড়া প্রহার
ধাবড়া ধাবড়া বড়ো বড়ো
কুঁথিকুঁথি থেমেথেমে
খাটাখাটঞি কাজ
কুঁতরি কুঁতরি ধীরে ধীরে
ঝড়ঝড়িয়া নষ্ট
ডাগরডাগর সুন্দর
দুড়ুমদুড়ুম শব্দ
পটপট তাড়াতাড়ি
গটগট তাড়াতাড়ি
গজগজ বেশি কথা বলা
কাঁউকাঁউ কান্না
পঁকপঁক শব্দ
খটখট চঞ্চল
গমগম ভর্তি
ফুসুরফুসুর আস্তে কথা
এছাড়াও এই জেলায় মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় চলিত বাংলার প্রভাবে বেশ কিছু শব্দদ্বৈত এসেছে। তা এই জেলার উপভাষায় ব্যবহার হয়। যেমন —
ক.নৈকট্য সম্বন্ধ বাচক অর্থ
মাউশে মাউশে মানুষে মানুষে
উপ্রে উপ্রে উপরে - উপরে
পাএ পাএ পায়ে- পায়ে
মুকে মুকে মুখে- মুখে
চখে চখে চোখে - চোখে
মাজু মাজু মধ্যে - মধ্যে
আগু আগু আগে -আগে
ছামু ছামু সামনে সামনে
খ. দীর্ঘ কালীনতাবাচক অর্থ
বুসিয়া বুসিয়া বসে - বসে
খেতে খেতে খেয়ে খেয়ে
কেঁদিয়া কেঁদিয়া কেঁদে - কেঁদে
হেঁসিয়া হেঁসিয়া হেসে - হেসে
নাচিয়া নাচিয়া নেচে - নেচে
খাইতে খাইতে খেয়ে - খেয়ে
জাইতে জাইতে যেতে- যেতে
হাঁকিয়া হাঁকিয়া ডেকে -ডেকে
চোলিয়া চোলিয়া হেঁটে -হেঁটে
শুইতে শুইতে শোওয়া
গ. প্রকর্ষ বাচক অর্থ
সকাঁউ সকাঁউ সকাল - সকাল
গরোম গরোম গরম - গরম
কাটায় কাটায় কাঁটায় - কাঁটায়
টাটকা টাটকা সাজু
ঘ. অসম্পূর্ণ ভাব বাচক অর্থ
উঠবা উঠবা উঠি - উঠি
আসবো আসবো আসা
যাবা যাবা যাওয়া
কোরবো কোরবো করা
ধোরবো ধোরবো ধরা
ঙ.বহুবচন অর্থে অর্থ
কাড়িকাড়ি প্রচুর
গাদাগাদি পরপর
ভুরি ভুরি অনেক
কটি কটি কোটি কোটি
চ. পৌনঃপুনিক অর্থে অর্থে
রাসতায় রাসতায় পথ
ঘনট্যায় ঘনট্যায় সময়
বছোর বছোর বছর
কালে কালে সময়
ছ. সাদৃশ্য অর্থে অর্থে
ভিজা ভিজা ভেজা
কাদু কাদু কাদা
মাটিয়া মাটিয়া মেটে
শীত শীত ঋতু
জ. পদাধিকারমূলক অর্থ
ভাত টাত ভাতের সাথে তরিতরকারি
ভুজা টুজা মুড়ি
কাচ টাচ কাজ কর্ম
বই টই বই পত্র
নদী টদি নদী
লুচি ফুচি লুচি ও তরিতরকারি
জল টল জল
লুটে পুটে ডাকাতি
ঝ. সংযোগ বাচক অর্থ
কাঠে কাঠে কাঠ
কানে কানে শোনা
চখে চখে দেখা
কলে কলে কোলে বসা
হাতে হাতে দেওয়া
ঞ. আসন্নতাবাচক অর্থ
মরিযা মরিযা মৃত্যু কামনা
পড় পড় পড়াশুনা
কাঁদ কাঁদ কাঁদা
ডুব ডুব ডোবা
১৭.৩. ধ্বন্যাত্মক শব্দ বা অনুকার শব্দ
এই জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মান্যচলিতের মতো এখানকার উপভাষায় নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য উচ্চারিত হয়। যেমন-
ধ্বন্যাত্মক শব্দ অর্থ
হো হো সশব্দে
বিড়বিড় মনে মনে
ঝলমলিয়ে পরিস্কার
দাড়িয়া দাড়িয়া দাঁড়ানো
খচখচ অশান্ত
কুচকুচে ঘন
কিচিরমিচির চিৎকার
খুটখুটে অশান্ত
বকরবকর অনর্গল কথা বলা
এছাড়াও এই জেলায় মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় চলিত বাংলার প্রভাবে বেশ কিছু অনুকার শব্দ বা ধ্বন্যাত্মক শব্দ এসেছে। তা এই জেলার উপভাষায় ব্যবহার হয়। যেমন —
ক. ধ্বনি বাচক শব্দের একক প্রয়োগ
ধপাস, ঢং, সাঁ,বোঁ, খট, ঝাঁ, ফোঁস, হুস ইত্যাদি
খ.অবিকৃত দ্বিত্ব প্রয়োগ
পেনপেন, ঘেনঘেন, ঠকঠক, কনকন, সাঁইসাঁই, পিলপিল, গুনগুন, টনটন, কলকল, মচমচ, রোঁ রোঁ, বোঁ-বোঁ, হি হি, দুমদুম, ঢকঢক ইত্যাদি
গ. বিকৃত দ্বিত্ব প্রয়োগ
আইঠাই, চটপট, ধুপধাপ, ছটপট, কটকট, নড়বড়, টগবগ, ধড়পড়, হুড়মুড় ইত্যাদি ।
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায় রূপতত্ত্বের পাশাপাশি বাক্যতত্ত্বেরও সমীক্ষা করি। তাই পরবর্তী পর্বে এই জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ভিত্তিক কথ্যভাষায় উদাহরণ সহ বাক্যতত্ত্বের বিভিন্ন দিক আলোচিত হবে।
আরও পড়ুন
1 Comments
অসাধারণ পর্যবেক্ষণ
ReplyDelete