জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩১/শ্যামল জানা


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩১

শ্যামল জানা

সেকশন ডি’ওর

এই “সেকশন ডি’ওর” দলটিকে “পুটাক্স গ্রুপ(Groupe de Puteaux)” নামেও ডাকা হত৷ এঁরা মূলত কিউবিস্ট হিসেবেই নিজেদেরকে চিহ্নিত করতেন৷ এই দলের মধ্যে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, সমালোচক এই রকম সব ধরনের মানুষরাই ছিলেন, যাঁরা স্পষ্টতই কিউবিজম বা অরফিজম্-এর সাথে যুক্ত ছিলেন৷ ১৯১১ সালে “স্যালোঁ দেস ইনডিপেন্ডেটস্”-এ একটি অত্যন্ত বিতর্কিত চিত্রপ্রদর্শনী থেকে শুরু হয়েছিল এঁদের পথচলা৷ প্রায় ১৯১৪ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল এই দলটি৷
   তবে, একটু বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশের মত হচ্ছে— প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-র আগে এঁরাই কিউবিজম্-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীটি করেন ১৯১২ সালের অক্টোবরে, প্যারিসের “গ্যালারি লা বোয়েতি (Galerie La Boétie)” গ্যালারি-তে, “স্যালোঁ দে লা সেকশন ডি’ওর (Salon de la Section d'Or )” নামে৷ এই প্রদর্শনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টটি ছিল— তাঁরা ১৯০৯ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত এই তিন-চার বছর ধরে কিউবিজমকে ধাপে ধাপে যেভাবে উন্নীত করেছেন, তার প্রতিটি ধাপের স্বাক্ষর হিসেবে প্রায় ২০০ বা তার বেশি ছবি এই প্রদর্শদীতে রেখেছিলেন দর্শকদের বোঝার সুবিধার জন্য৷ এজন্য তাঁরা “কিউবিস্ট রেট্রোস্পেক্টিভ” হিসেবে এই প্রদর্শনীকে চিহ্নিত করেছিলেন৷ ফলে, অত্যন্ত সাড়া পড়েছিল ও ব্যাপক দর্শক সমাগম হয়েছিল এই প্রদর্শনীতে৷
 এই “সেকশন ডি’ওর” দলটি, পাবলো পিকাসো ও জর্জেস ব্রাক-এর সমান্তরালে যে গোঁড়া ও সংকীর্ন আর একটি কিউবিস্ট দল ছিল, তাঁদের বিপরীতে অবস্থান করত৷ এই গোঁড়া ও সংকীর্ন দলটি কিউবিজমকে সম্পূর্ণ নতুন ও স্বতন্ত্র আর্ট ফর্ম হিসেবে চিহ্নিত করত৷ কিন্তু, এই “সেকশন ডি’ওর” দলটির দর্শন ছিল সম্পূর্ণ উল্টো৷ এঁরা বলতেন— কিউবিজম্ একটুও নতুন ব্যাপার নয়৷সময় অনুযায়ী বিবর্তিত হলেও দীর্ঘ দিনের সুমহান ঐতিহ্যই বহন করছে এই কিউবিজম্৷ যা অন্তত আড়াই হাজার বছরের পুরোনো! এবং এ জন্যই আমাদের দলের নামকরণ করেছি— “সেকশন ডি’ওর”৷
   সেকশন ডি’ওর (Section d’Or) কথাটির ইংরাজি প্রতিশব্দ হচ্ছে গোল্ডেন সেকশন (Golden Section)৷ এখানে গোল্ডেন কথাটির অর্থ স্বর্ণালী নয়৷ ঈশ্বর-সৃষ্ট কথাটিই এখানে সঠিক অর্থ৷ পুরো কথাটির অর্থ হচ্ছে— ঈশ্বর-সৃষ্ট ভাগ (Golden Section) বা ঈশ্বর সৃষ্ট অনুপাত (Golden Ratio), যার প্রতীক গ্রীক অক্ষর “ফাই” দিয়ে চিহ্নিতকরণ করা হয়৷ এই ঈশ্বর সৃষ্ট অনুপাতের সবচেয়ে কাছাকাছি নম্বর হল—১ : ১.৬১৮.... (ছবি-১)৷ 
কেন এরকম বলা হচ্ছে?
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার সময়কাল থেকেই যখন পিথাগোরাস বা ইউক্লিড অংক নিয়ে গবেষণা শুরু করছেন, তখন থেকেই তাঁদের যে পর্যবেক্ষণ, তা থেকে এই ধারণাটি চালু আছে যে, প্রাকৃতিক যে সব বস্তু বা দৃশ্যাবলি, অতি ছোট অণু-পরমাণু পরিমাপ থেকে অতি বড় ছায়াপথ বা বিশাল নক্ষত্র পর্যন্ত প্রায় সবই এই Golden Ratio(১ : ১.৬১৮)-র আওতাধীন৷ এবং তা এত সুচারু ও অসাধারণভাবে অংকর দ্বারা সাধিত, যে তা অতি উচ্চমানের শিল্প হিসেবে চিহ্নিত৷ এবং এই কারণেই, এই ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই মানুষের ছবি আঁকার সূত্রপাত হয়৷ তাই, সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও যথার্থ পণ্ডিতেরা মনে করেন— ঐতিহাসিকভাবে সর্ব অর্থেই অংক এবং শিল্প পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত৷ অংকের প্রয়োগ ছাড়া শিল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়৷ সে সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য বা বস্ত্রশিল্প যাইই বলি না কেন৷
   প্রশ্ন হল--- প্রকৃতির বস্তু বা দৃশ্যাবলীর ভিতরে কীভাবে গোল্ডেন সেকশন ও গোল্ডেন রেশিও থাকে? এটি জ্যামিতির সাহায্যে দৃশ্যত এবং তা শুধু অংকের মাধ্যমে প্রমাণিত— এই দুভাবেই প্রসঙ্গত বলা যায়৷
একটি চতুর্ভুজ, যার চারটি বাহুই সমান ( ‘a’ হিসেবে চিহ্নিত)৷ তার তলার বাহুটিকে খানিকটা বাড়িয়ে রাখা হল৷ এবার ওই তলার বাহুটির মধ্যাংশকে সেন্টার করে ডান দিকের খাড়া বাহুর মাথা থেকে একটি বৃত্তাংশ আঁকা হল, যেটি চতুর্ভুজের তলার বাহুটির বাড়িয়ে রাখা অংশটিকে কাট করল (‘b’হিসেবে চিহ্নিত)৷ যেখানে কাট করল, সেখান থেকে একটি খাড়া সরলরেখা ওপরে উঠল৷ যেটি চতুর্ভুজের ওপরের বাহুর ডান দিকের বেড়ে থাকা সরলরেখাটির সঙ্গে মিলিত হল (ছবি-১/১)৷ এবার যে আয়তক্ষেত্রটি তৈরি হল, সেটির মাঝখানে একটি দাগ (Section)৷ দাগটির বাঁ অংশটি (‘a’) একটি চতুর্ভুজ ও ডান অংশটি (‘b’) একটি আয়তক্ষেত্র, যেটি সামগ্রিকভাবে যে আয়তক্ষেত্র (‘a+b’), তার সঙ্গে একেবারে সমানুপাতিক৷ এই সমীকরণ থেকেই তৈরি হচ্ছে গোল্ডেন সেকশন (ছবি-১/৪)৷যাকে গ্রীক অক্ষর “ফাই” দিয়ে চিহ্নিতকরণ করা হয়৷  আর ম্যাজিকটা তৈরি হল এখানেই! কারণ, এই ছোট আয়তক্ষেত্রটিকে আবার যদি সেকশন করা হয়, যার ডানদিক চতুর্ভুজ আর বাঁদিকে আয়তক্ষেত্র হবে, তাহলে এই ছোট আয়তক্ষেত্রটিও আগের দুটি আয়তক্ষেত্রটির সঙ্গে সমানুপাতিক হবে৷এভাবে অবিরাম চলতেই থাকবে, শেষ হবে না! আর, প্রতি ক্ষেত্রে একটি করে চতুর্ভুজও তৈরি হতে থাকবে অবিরাম৷ আর, ওই চতুর্ভুজগুলোর প্রতিটির একটি কোণাকে সেন্টার করে, তাদের দুই কোণায় বৃত্তাংশ টানতে থাকি, তাহলে সামগ্রিকভাবে সেই বৃত্তাংশগুলি মিলিতভাবে একটি স্পাইরালে পরিণত হবে (ছবি-১/২)৷
   এই যে চতুর্ভুজগুলি ক্রমশ বড় থেকে ছোট হচ্ছে, বা ছোট থেকে বড় হচ্ছে, তার একটি নির্দিষ্ট অনুপাত বা পরিসংখ্যান আছে৷ একে বলা হয়— ফিবোনাচ্চি রাশিমালা৷ যার আবিষ্কারক ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিখ্যাত গণিতবিদ Leonardo Da Pisa (ডাকনাম ফিবোনোচ্চি [Fibonacci])৷ তিনি বলে গেছেন, "দৃশ্যত প্রকৃতির মূল রহস্য এই রাশিমালাতে আছে"। ফিবোনা হল একটা সিম্পল সিরিজ নম্বর। যে সিরিজটি শুরু হয় 0(শূন্য) থেকে এবং সিরিজের পরবর্তী সংখ্যাগুলো প্রতিটি তার পূর্ববর্তী দুইটি সংখ্যার যোগফল(ছবি-১/৩)।এবং এই পরিসংখ্যানই গোল্ডেন স্পাইরাল যে চতুর্ভুজগুলির সাহায্যে তৈরি হয়, তাদের ক্ষেত্রফলের পরিসংখ্যান(ছবি-১/২)৷
প্রকৃতির প্রায় সমস্ত বস্তু বা দৃশ্যাবলীর ভিতরে অদৃশ্যভাবে এই গোল্ডেন সেকশন ও গোল্ডেন রেশিওর বিজ্ঞান কাজ করে৷ সে মনুষ্য শরীরের অংশ হতে পারে (ছবি-১/৫), ছোট্ট গোলাপের পাপড়ির বিন্যাস হতে পারে বা মহাকাশের ছায়াপথও (Galaxy) হতে পারে (ছবি-২)৷
   এই দর্শন থেকেই এই কিউবিজম্ দলটির নাম হল— গোল্ডেন সেকশন (Golden Section) বা সেকশন ডি’ওর (Section d’Or)৷ কারণ, তাঁরা বিশ্বাস করতেন ক্যানভাসে কিউবিজমকে চূড়ান্ত পর্যায়ে ফুটিয়ে তুলতে হলে প্রকৃতির মধ্যে থাকা এই গোল্ডেন সেকশন ও গোল্ডেন রেশিওর প্রয়োগ অবশ্য প্রয়োজন৷      (ক্রমশ)
পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. রেডিমেড গ্রুপ সম্পর্কের লেখাটি প্রাঞ্জল। সাথে ছবির ব্যবহার এই
    লেখাটিকে আরও মনোগ্রাহী করে
    তুলেছে।
    পুটাক্স গ্রুপে এসে থমকে গেছি।
    বিজ্ঞান ও শিল্পের মেল বন্ধনের
    আখ্যান যেন। কি অসম্ভব পরিশ্রম
    সাধ্য কাজ যে, সে করে চলেছে।
    ভাবী প্রজন্মের শিল্প চর্চা ও
    শিল্পীর কথা ভেবেই যেন শ্যামলের
    সৃজনানন্দ। আমার হার্দিক শুভেচ্ছা
    তার জন্য।

    ReplyDelete